ইকো পর্যটনের সন্ধানে রামশাই টি এস্টেট/গৌতম চক্রবর্তী
ইকো পর্যটনের সন্ধানে রামশাই টি এস্টেট
গৌতম চক্রবর্তী
এই রোজকার কাজের চাপ এবং হাজারো টেনশনের মাঝে মনটা বড় হাঁপিয়ে ওঠে। মাঝেমাঝে ভাবি এইসব কিছুই যদি কয়েকদিনের জন্য ভুলে কোথাও হারিয়ে যাওয়া যেত। রবিবারের ছুটির আমেজে রামশাইয়ের অমোঘ আকর্ষণে বেরিয়ে পড়া। আজ যাব রামশাই টি এস্টেট ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। মাকড়সার জালের মতো ছড়ানো দোকান পসার ময়নাগুড়িতে। যতই হেরিটেজ গন্ধবহ মন্দির নগরী ময়নামতির দেশ বলা হোক না কেন, ময়নাগুড়ি বড় বেশি নোংরা। আবর্জনা এবং জঞ্জালে দূষিত, দুর্গন্ধে টেকা দায়। রাস্তার উপর বাস-ট্যাক্সি ঠেলাওয়ালাদের দাপাদাপি। কনডাকটরদের হাত ধরে টানাটানি। ময়নাগুড়ি থেকে হসপিটাল পাড়া, আমগুড়ি, পানবাড়ি, মহাকাল হয়ে রামসাই এর দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। শোনা যায় রাম শাহ নামে এক ব্যক্তি রামসাইতে বসবাস করতেন। নামের অপভ্রংশ হতে হতে রামসাইতে পরিণত হয়েছে। ময়নাগুড়ি ছাড়ালেই বট, পাকুড়, বড় বড় অশ্বত্থ গাছ। শুধুমাত্র বটপাকুড় নয়, ময়নাগুড়ি থেকে রামসাই যেতে রেলগেট পার হলেই দেখা যাবে বাদুড়বাগানে শতশত বাদুড় নিশ্চিন্তে বসবাস করছে। ডুয়ার্সের ময়নাগুড়ি থেকে আমগুড়ি, পানবাড়ি, বারোহাতি মহাকাল মোড় হয়ে রামসাই হাট। রামসাই হাটে মিষ্টির দোকান আছে এবং টুকিটাকি প্রয়োজনীয় বস্তু কিনতে পাওয়া যায়। স্থানীয় মানুষেরা সহজ, সরল এবং আন্তরিক। পর্যটনের ছোঁয়ায় রামসাই ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মহাকাল মোড় থেকে ডানদিকে কালামাটির অরণ্যপথ হয়ে লাটাগুড়ির জঙ্গল ঘেরা রামসাই। লাটাগুড়ি গেলেই কখনও কালামাটি হয়ে আবার কখনও ময়নাগুড়ি হয়ে রামশাই কালীপুর বেড়াতে যাই। ইকো ট্যুরিজমের দৌলতে রামশাইয়ের ভোল পালটেছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের পর্যটকদের সঙ্গে রামশাইয়ের পরিচয় ঘটেছে। মোষের গাড়িতে চেপে চা-বাগান, জঙ্গল-নদীর পাশ দিয়ে মেদলা নজরমিনারে যাওয়া রীতিমত রোমাঞ্চকর এক অনন্য অনুভূতি। আর নজরমিনারের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখা যায় বাইসন, গন্ডার, হাতির পাল। ওপারে জলঢাকা, ডায়না, মূর্তি টপকালে নাথুয়া টণ্ডু বামনডাঙা চা-বাগান, খেরকাটা, শুল্কাপাড়া। মাঝে টানাটানি নদী।
কোন একসময় লাটাগুড়ি জংশন থেকে রামসাই পর্যন্ত সুন্দর গভীর অরণ্যবেষ্টিত রেলপথ ছিল বেঙ্গল ডুয়ার্স রেল কোম্পানির অধীনে। নিবিড় অরণ্যের ভেতর দিয়ে প্যাসেঞ্জার এবং মালগাড়ি আসা-যাওয়া করত। লাটাগুড়ি জংশন থেকে ট্রেনে রামশাই স্টেশন পর্যন্ত অরণ্যবেষ্টিত রেলপথে যেতে চোখে পড়তো বহু বন্য জন্তু। নিবিড় শালবনের ভিতর দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে রেলগাড়ি চলে যেত। দিনের বেলাতেই চোখে পড়তো নিদ্রামগ্ন রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বুনো শুয়োর, গন্ডার, হরিণ, বাইসন অথবা হাতির পাল। জঙ্গল এত গহন গভীর ছিল যে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারত না। অদ্ভূত বনজ সোঁদা গন্ধ ভেসে আসত। বিশাল বিশাল শিরিষ, শিমূল, ময়না, লালী, খয়ের গাছ। গাছের গা বেয়ে সাপের মত লতা-গুল্ম পেঁচিয়ে উঠেছে। কত রং-বেরঙের অর্কিড। বনজ গন্ধে ভরে যেত রেল কামরা। কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে নিবিড় শালবনের ভেতর দিয়ে ট্রেন পৌঁছাত রামসাই স্টেশনে। তারপর নদী, চা বাগান, জঙ্গল হয়ে মালবাজার। লাটাগুড়ি থেকে রামসাই অনবদ্য অরণ্যবেষ্টিত রেলপথ কোথায় হারিয়ে গেল। কথা ছিল রামশাই হাট থেকে পূর্বদিকে জলঢাকা নদীর উপরে সেতু হবে। রেলপথটির যথেষ্ট বাণিজ্যিক সাফল্য ছিল। রামশাই লাটাগুড়ি জংশনের এই শাখা রেলপথটি অক্টেভিয়াস স্টিল কোম্পানির আনুকূল্যে লাভজনক ছিল বলতেই হবে। চা, কাঠ, বেত, যাত্রী পরিবহণ করে মোটামুটি লাভ হত। দেশভাগের পর কিছুদিন রামশাই-লাটাগুড়ি শাখা সচল থাকলেও ধীরে ধীরে অচল হয়ে একদিন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। জরাজীর্ণ লুপ্তপ্রায় স্টেশন ঘর ভবঘুরে, ছিন্নমূলদের আস্তানা হয়ে গেল। ভগ্নস্তূপ দেখলে কে বলবে এখানে ছিল রামসাই স্টেশন? রেলপথে এখন চা গাছ। এখান দিয়ে ইঞ্জিনের বাঁশি, ধোঁয়া, শব্দ, চাকার খসখসানি শোনা যেত। সবই এখন স্বপ্ন এবং মায়াময়। এখন মনে হয় রূপকথার গল্প। কবে রেলপথ বন্ধ হয়ে গেছে। চা বাগানের ধারে ঝোপঝাড়ে জঙ্গলের মধ্যে রেলের কোয়ার্টারগুলি এখনো উঁকিঝুঁকি দেয়। রামশাই হাটে চা খেতে খেতে পরিচয় হল স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে। চাকরি-বাকরি নেই। ওদের ইচ্ছে সরকারি সাহায্য পেলে সাধ্যমতো রামশাইয়ে জলঢাকা নদীতটে কয়েকটি কুটির তৈরি করা।
নয়ের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে একবার ময়নাগুড়ি থেকে আমবাড়ি পানবাড়ি হয়ে রামসাই বেড়াতে গেছিলাম। আমার বন্ধুর বাবা ছিল রামসাই এর যাদবপুর চা বাগানের ম্যানেজার। খুবই আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা। তখনো কালিপুর ইকো-ট্যুরিজমের জন্মই হয়নি। রামসাইয়ের এক চায়ের দোকানে পরিচয় হয়েছিল রতনদার সঙ্গে। জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের সভাধিপতি রতনদা আর দশজনের সঙ্গেই হাটে বসে চা খাচ্ছিলেন। খুবই সাদামাটা জীবনযাপন। রামসাইতে থাকতেন রতনদা। বর্ষীয়াণ এই মানুষটা দীর্ঘসময় জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের সভাধিপতি ছিলেন। পরবর্তীকালে “দৈনিক বসুমতীতে” সাংবাদিকতার সূত্রে এসেছিলাম। মেদলা নজরমিনার সৃষ্টির আগে যখন কাঠের নজরমিনার ছিল তখন সদ্য উদ্বোধন হওয়া কালিপুর ইকো ভিলেজ রিসর্ট দেখতে গিয়েছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম ফাটাফাটি জায়গা। লাটাগুড়িতে তখন রিসর্টগুলি গড়ে উঠছে। লাটাগুড়িতে ছিল পরাণ গোপের লরঝরে কাঠের দোতলা। এখন ইকো টুরিজম এর সৌজন্যে পাল্টাচ্ছে লাটাগুড়ি। রামসাই চা-বাগানে চা পর্যটনের কথা ভাবা প্রয়োজন। পরিত্যক্ত চা বাগানের পাশ দিয়ে যাদবপুর চা বাগানে পৌঁছে গেলাম যার পোশাকি নাম রামসাই টি এস্টেট। পাশেই বুধুরাম বিটে গরুমারা রাইনো ক্যাম্প। শোনা যায় রামসাই জনপদ থেকে গরুর গাড়ি এবং মোষের গাড়িতে জিনিসপত্র নিয়ে জঙ্গলের পথে চালসা এবং মালবাজারে যাতায়াত করত হাটুরেরা। জঙ্গলের ভেতরে তাঁবু ফেলে আগুন জ্বেলে রাত্রিযাপন করতো। যখন-তখন বাঘ এসে ঘাড় মটকে গরু নিয়ে চলে যেত মূর্তি নদীর ধারে। চিৎকার-চেঁচামেচি হলেও কিছু করার থাকতো না। সেই থেকে এলাকার নাম হয় গরুমারা। দিনেদুপুরে বাঘ শুয়ে থাকত রাস্তায়। ছুটির ফাঁক পেলেই হারিয়ে যাই গরুমারা ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশে। এই উত্তর বাংলারই ভারতবিখ্যাত অভয়ারণ্য – ‘গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক’। সুন্দর, ঘন, সবুজ অরণ্যে ঘেরা ডুয়ার্সের মাঝেই। গরুমারা ছোট্ট কোনও জঙ্গল নয়, আর গরুমারা ন্যাশনাল পার্কের পরিধিও বিশাল। গরুমারা বনবাংলো এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের সেরা বনবাংলো। এর গ্ল্যামার, অভিজাত্য, ঐতিহ্য সবকিছু অসাধারণ। স্থানীয় মানুষ, লোকালয়, ঘন জঙ্গল আর পৃথিবীখ্যাত ডুয়ার্সের চা-বাগান দেখতে দেখতে কখন যে ইকো ভিলেজ কালিপুর পৌঁছে গেলাম কে জানে।
জলপাইগুড়ি সদর মহকুমার যাদবপুর টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী যাদবপুর টি কোম্পানি লিমিটেড। ১৯৯৮ সালে বর্তমান কোম্পানি বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে। যুগল কিশোর গুপ্তা, লক্ষীনারায়ণ গুপ্তা, নভনিত কিশোর গুপ্তা বাগানের ডিরেক্টর। বাগানটি আইটিপিএ এর সদস্যভুক্ত। বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ১১ জন। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন তিনটি। এগুলি হল সিবিএমইউ, ডব্লিউবিসিএসইউ এবং টিডিপিডব্লিউইউ। ময়নাগুড়ি ব্লকে কেবলমাত্র এই একটাই প্রাতিষ্ঠানিক চা বাগান আছে। আগে থেকে অনুমতি নেওয়া ছিল। এলাম চা বাগিচার অফিসে। যাদবপুর চা বাগানের আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ২৭৭.৮৯ হেক্টর। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ১৮.৮৭ হেক্টর। সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ১৪১.৮৭ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদিক্ষেত্র ১৪১.৮৭ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে প্রতি হেক্টর জমি পিছু ২২১৪ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। যাদবপুর চা বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত চা ১৪ লাখ থেকে ১৫ লাখ কেজি এবং ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চা সাড়ে তিন লাখ কেজি। উৎপাদিত চা এর প্রকৃতি অনুযায়ী এই বাগানে সিটিসি কোয়ালিটির উৎকৃষ্ট মানের চা উৎপাদিত হয়। যাদবপুর বাগানটি চরিত্রগত দিক থেকে অত্যন্ত উন্নত মানের বাগান। যাদবপুর চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ২৯১ জন। মোট জনসংখ্যা ১১৬৫। স্থায়ী শ্রমিক ১৮৩ জন যারা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা তোলার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মজুরি পায়। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী বিঘা শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৫৪ জন। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক সংখ্যা ছিল ২৫ জন। কম্পিউটার অপারেটর একজন। বাগানে ক্ল্যারিক্যাল, টেকনিক্যাল এবং স্থায়ী শ্রমিক মিলে মোট কর্মরত শ্রমিক সংখ্যা ১৮৪ জন এবং শ্রমিক নয় এমন পরিবারের সদস্যদের সংখ্যা ৯৮১ জন।
চা-বাগিচা তথা চা-চাষ যে অন্য আর সব চাষের থেকে আলাদা এবং এর ক্ষেত্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রশ্নে বিশেষ দৃষ্টির প্রয়োজন, তার প্রমাণ ইন্ডিয়ান টি কন্ট্রোল অ্যাক্টে চা-বাগিচার উপর টি বোর্ডের বিধিনিষেধ প্রয়োগ থেকেই বোঝা যায়। এই বিধিতে বলা হয়েছে— টি বোর্ডের অনুমতি ছাড়া কোনও চা-বাগিচা স্থাপন করা যাবে না। বোর্ডের অনুমতি ছাড়া যে সমস্ত এলাকা চা এলাকা বলে ঘোষিত হয়েছে, কিন্তু চা-গাছ রোপণ করা হয়নি সেখানে চা গাছ রোপণ করা যাবে না। যে এলাকাকে বা আয়তনকে চা-চাষের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে বোর্ডের অনুমতি ছাড়া সেই আয়তন বৃদ্ধি করা চলবে না। চা-বাগিচার জন্য নির্দিষ্ট জমির বাইরে যদি কেউ চা চাষ করতে চায় তবে তাকে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে টি বোর্ডের কাছে লিখিত আবেদন করতে হবে। বোর্ড শর্তসাপেক্ষে এই আবেদন মঞ্জুর করতে পারে। সেই শর্তগুলি যথাযথভাবে রূপায়িত না হলে বোর্ড সেই অনুমতি প্রত্যাহার করে নিতে পারে। টি অ্যাক্টের এই বিধিতে দেখা যাচ্ছে, এই আইন কার্যকরী হবার পর বোর্ডের অনুমতি ছাড়া চা-বাগান স্থাপন করা যাবে না। তাই চা-বাগিচায় রূপান্তর করতে হলে জমির মালিককে “স্টেট ল্যান্ড রিফর্ম লেজিশলেশন” এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই টি বোর্ডের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। অর্থাৎ এই আইন কার্যকরী হবার পর চা-বাগান স্থাপনের জন্য বোর্ডের অনুমতি প্রয়োজন। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিঙের সমতলভূমি, উত্তর দিনাজপুর এবং কোচবিহারে যে অসংখ্য ক্ষুদ্র চা-বাগিচা কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অনুমতি নেই। ফলে এই সমস্ত ক্ষুদ্র চা-বাগান টি বোর্ডের নথিভুক্ত না হওয়াতে এরা দক্ষিণ ভারতের ক্ষুদ্র চা-বাগানগুলির মতো সরকারি অনুদান ও অন্যান্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বামফ্রন্টের উদার অর্থনীতির সিঁড়ি বেয়ে উত্তরবঙ্গের দু'টি জেলা কোচবিহার ও উত্তর দিনাজপুরসহ জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণ ভাগে চা সাম্রাজ্যের অভিযান শুরু হয়েছিল। এখানে কত চা-বাগান এভাবে গড়ে উঠেছে তার সঠিক হিসেব পাওয়া মুশকিল। কারণ এখানে সরকারের অনুমতি তথা কৃষিজমির রূপান্তরের নিয়মাবলিকে তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠছে নিত্যনতুন চা-বাগান।
যাদবপুর টি গার্ডেনটির আর্থিক সুবিধা প্রদানকারী ব্যাংক এর নাম স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে ব্যাংক, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স থেকে। বাগানটির লিজ হোল্ডার যাদবপুর টি কোম্পানী লিঃ। বাগিচায় ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকা বাড়ির সংখ্যা ২৪ টি এবং বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাসের সংখ্যাও ২৪ টি। আধা পাকাবাড়ির সংখ্যা ১৫০ টি। মোট শ্রমিক আবাস ১৯৮ টি। বাগানের মোট শ্রমিক সংখ্যা ১৮৪ এবং সেই হিসাবে বাগানে শতকরা ৯৫ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। ভৌগোলিক অবস্থান তথা ভূপ্রকৃতির চরিত্রের জন্য ডুয়ার্স ও তরাইতে যেমন শ্রমিক কলোনিগুলি পরস্পর পরস্পরের সংলগ্ন অবস্থায় থাকে সেটা এখানে দেখলাম না। কারণ হিসাবে জানতে পারলাম জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চল বলে বিশেষ সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। এখানকার প্রায় সব শ্রমিক আবাসের ঘরগুলির দেয়াল ইটের গাঁথনি ও সিমেন্টের। চাল টিন অথবা অ্যাসবেস্টসের তৈরি। মেরামতির কাজ উত্তর ভারতের চা-বাগিচা তুলনায় অনেক নিয়মিত হয় বলে শ্রমিকেরাই জানাল। জল সরবরাহের জন্য লেবার লাইনে পাইপের সাহায্যে জল সরবরাহ করা হয়। এর জন্য ট্যাপ কলের ব্যবস্থা আছে। সকালে এক থেকে দু'ঘণ্টা এবং বিকেলে এক থেকে দু'ঘণ্টা জল সরবরাহ করা হয়। রবিবার সারাদিনই জল সরবরাহ করা হয়। বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। শিশুদের জন্য অস্থায়ী ক্রেশ এর ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে জল, শৌচাগার এবং পানীয় জলের সংকট রয়েছে। দুধ, বিস্কুট, পোশাক কোন কিছুই শিশুদের দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ। ক্রেশে মোট অ্যাটেনডেন্ট এর সংখ্যা ৪ জন। পরিবহনের ব্যবস্থা হিসাবে যাদবপুর টি গার্ডেনে একটি জিপ আছে যেটি বাগানের শ্রমিকদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসার জন্য ব্যবহৃত হয়। বাগিচায় ক্লাব, খেলার মাঠ ইত্যাদি সবকিছুই রয়েছে। যাদবপুর চা বাগিচায় বাৎসরিক গড় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পিএফ বাবদ খরচ করা হয়।
ঘন অরণ্যের গা ঘেঁষে কালীপুর ইকো ভিলেজ। এত শান্ত পরিবেশ, যেন পাতা পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। সুন্দর দেখতে এই কটেজগুলো সব মিলিয়ে যেন কোনও শিল্পীর আঁকা ক্যানভাস। কংক্রিটের জটাজাল, ধোঁয়া, ধূলো, কোলাহলমুক্ত এক শান্তির সাম্রাজ্য। ইকো ভিলেজের খুব কাছেই রয়েছে মেদলা ওয়াচ টাওয়ার। এই টাওয়ারটিতে ভ্রমণপিপাসুদের নিয়ে যাওয়ার জন্য এক অভিনব আয়োজন দেখে ভারি মজা লাগল। কটেজ থেকে ওয়াচ টাওয়ার এই ছোট্ট পথটি নিয়ে যাওয়ার জন্য আছে অদ্ভূত সুন্দর দেখতে মোষের গাড়ি। মোষের গাড়ি চড়ে ওয়াচ টাওয়ার। ভারতের আর কোথাও আছে কি না জানা নেই অবশ্য। অল্প পথ হলেও সেটাও কী সুন্দর। একপাশে চা-বাগান, অন্যদিকে ঘন জঙ্গল। চা-বাগান পার হতেই মূর্তি নদী আর ওই নদীর একেবারে পাশেই ওয়াচ টাওয়ার। একটা নদী নয়। তিন-তিনটি নদীর সঙ্গম স্থানে এই ওয়াচ টাওয়ার। মুর্তি, জলঢাকা ও ডায়না। পাশেই গরুমারা রাইনো ক্যাম্প জারুল, অমলতাস, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিমুল, মান্দারের শোভায় মুগ্ধ। নানা রঙের বাহার দেখে বিস্ময়ে হতবাক। অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাঠের সাঁকো। টলটলে জলে শাপলা, শালুক, জলশিঙাড়া, শৈবাল দামের চারদিকে মাছেরা খেলছে। প্রত্যেকটি কটেজের ভিতর-বাহির দেখি। কটেজগুলির নাম জলদাপাড়া, কাজিরাঙা, গরুমারা, মানস। ভালো হত যদি গ্রামীণ শিল্পকলার ছোঁয়া পেত। রামশাই রাইনো ক্যাম্পে পরিচয় স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে। একদা কেএলও জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ভুটানের জেলে বন্দি, তারপর মুক্তি লাভ করে বেঁচে থাকার লড়াই। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাদের জন্য অবশ্যই কিছু করা হবে। প্রতিশ্রুতি, প্রতীক্ষা আর হতাশাই নিট ফল। আত্মসমর্পনের পর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলেও নানা প্রতিবন্ধকতা। গরুমারা রাইনো ক্যাম্প থেকে কালীপুর বনবস্তি, ইকো ভিলেজ রিসর্ট দেখে চুকচুকি হয়ে কালামাটি অরণ্যপথে যেতে যেতে ক্ষণিকের জন্য নিভৃত বনভূমিতে দাঁড়াই। যেদিকে চোখ যায়, ইট-কাঠ-লোহা-পাথরের জঙ্গল। হাতি চলাচলের পথ উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল রুদ্ধ। জঙ্গলে লুঠেরার রাজত্ব। সংঘবদ্ধ কাঠচোরেরা জঙ্গল শেষ করে ফেলছে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴