স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/অষ্টম পর্ব
রণজিৎ কুমার মিত্র
++++++++++++++++++
উত্তরবঙ্গের ছাত্রসমাজের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিকে লক্ষ্য রেখে বিশ্ববিদ্যালয় একটু একটু করে মাথা তুলছিল। দুঃখের বিষয় সেই উত্থান পর্বে রাজা রামমোহনপুর ক্যাম্পাসের কোণে কোণে জমে উঠেছিল ক্লেদ। ভুঁই ফোড়ের মতো বহু অর্থ ব্যয়, ঢাকঢোল পিটিয়ে গড়ে ওঠে তদন্ত কমিশন, যার ফলাফল সাধারণের গোচরে আসে না। 1967র নির্বাচনে যে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছিল তা মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে, 1969এর নির্বাচনে সরকারে এসেছিল দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট। ছাত্র পরিষদ-এর সহযোগিতায় স্নাতকোত্তর পরীক্ষা গ্রহণ, রেজাল্ট বের করার সাফল্যের সাথে এই রাজনৈতিক বাতাবরণে উপাচার্য অতুল চন্দ্র রায় উদ্বিগ্ন ছিলেন। ছাত্র পরিষদ নেতা দেবপ্রসাদ রায়কে তাঁর 158 টাকার স্কুল টিচারের চাকরি ছেড়ে উপাচার্য ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে বললেন, "শোনো টিউশন ফি লাগছে না, ফ্লাড এফেক্টেড এরিয়া বলে মুকুব করা হয়েছে, তুমি স্টাফ কোয়ার্টারে থাকবে। আমি ঘর দিয়ে দেব, আর লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়বে, তুমি পড়ো।" দেবপ্রসাদ ক্লাস শুরু করলেন কিন্তু ভালো লাগল না, অল্পদিনের মধ্যেই আবার পুরোনো জীবনে ফিরে গেলেন। স্মৃতি জুড়ে রইল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শ্রেণিকক্ষ, অধ্যাপক শংকর গুপ্ত ও অধ্যাপক শ্যামল রায়ের কথা।
"সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে"এই কথাটির মধ্যে বোধহয় যে মুক্তির কথা বলা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে তা কোনোদিনই অর্থবহ হয়ে ওঠেনি। স্বাধীন ভারতের চিন্তক, শিক্ষাবিদরা স্বপ্ন দেখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় স্বশাসিত হবে, কিন্তু রাজনৈতিক খবরদারি যে এইসব প্রতিষ্ঠানের শ্রীবৃদ্ধিতে পদে পদে বাধা দেয়, বিচিত্র ঘটনার জালে জড়িয়ে বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে তা আর কে জানত! উপাচার্য অতুল চন্দ্র রায়ের কর্মযোগ বিচিত্র ঘটনা জালে জড়ানো ছিল। চার বছরের কার্যকালের মেয়াদ ফুরানোর আগেই তিনি চলে গেলেন। তৃতীয় উপাচার্য রূপে যোগ দিলেন অধ্যাপক পূর্ণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিক্সের অধ্যাপক ছিলেন, পরে ডিপিআই। "সাবধানী মানুষ রাইটার্স-এর ফাইল চালাচালিতে অভ্যস্ত শ্রী মুখোপাধ্যায়-এর কাছে কোনো সমস্যার কথা পারতে গেলে শোনার আগেই বলতেন, "লিখে দিন।"
সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মাফিক শিক্ষকদের ভেতর থেকে মাত্র একজন নির্বাচিত হয়ে যেতে পারতেন কোর্টে। তিনি আবার সদস্যরূপে বসতেন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে। কলেজ শিক্ষকদের থেকেও একজন আসতেন, কলেজের গভর্নিং বডি গুলোর সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে একজন, বাকি সব সদস্য ছিলেন মনোনীত।পদাধিকার বলে উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আমলারা বিশেষ আদেশ নির্দেশ না থাকলে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-সংস্কৃতির একমাত্র স্থল, রাজধানী কলকাতা থেকে অনেক দূরে, সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টির আড়ালে থাকা এই প্রত্যন্ত এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব একটা আসতেন না। কলকাতাতেও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্প অফিস ছিল।
সেই সময়ে পরিচালন সমিতির সদস্যরা প্রভাবশালীও ক্ষমতাশালী ছিলেন। উপাচার্য তাঁদের সমঝে চলতেন। এখন অবশ্য উল্টো, সে নিয়ম নীতি পালনের দায় শাসক দলের শিক্ষা অনুরাগী দাদাদের। সেই সময়ে উপাচার্যের সিদ্ধান্ত, অভিরুচি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র শিক্ষা প্রসারের কর্মসূচিতে যাতে কোনো স্বেচ্ছাচার না হয় তার দায়িত্ব নিয়ে পরিচালন সমিতির স্থানীয় কোনো সদস্যকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যেত, যেমন শিলিগুড়ির বিশিষ্ট আইনজীবী আনন্দময় ভট্টাচার্য ও জলপাইগুড়ির অধ্যাপক দেবেশ রায়। দুজনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ও বিখ্যাত। এই দুজনের ভূমিকা সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু আলোচিত। দেবেশ রায় সম্পর্কে অধ্যাপক পুলিন দাসের "স্মৃতি জাগানিয়াতে একটি মন্তব্য দেখেছি, "জনশ্রুতি, উপাচার্য পূর্ণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রায়শই বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি চেপে জলপাইগুড়িতে দেবেশবাবুর আবাসে হাজির হয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শলাপরামর্শ সেরে আসতেন।"
রাজনৈতিক পালাবদলএর সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিস্তারে - গণতন্ত্রে, যে দলের সরকার তাঁদের নির্বাচিত প্রার্থী প্রাধান্য পেত পরিচালন সমিতিতে। দু'চারজন থাকতেন একটু ব্যতিক্রমী সংবেদনশীল শিক্ষানুরাগী। পূর্ণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়-এর আমল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থীদের 'সুপবন' বইতে শুরু করে। অনেক নতুন অধ্যাপক আসেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ঘাটাল কলেজ থেকে এসেছিলেন অধ্যাপক শংকর গুপ্ত, যিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বামপন্থী ছাত্র নেতা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় আসবার পর স্থানীয় অধ্যাপক সমাজে ও ছাত্রসমাজে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন, পরে তিনি বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় বিদ্যুৎমন্ত্রী হয়েছিলেন, যাদবপুর বিধানসভা থেকে নির্বাচিত হয়ে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নকশালবাদী ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে নিয়ে মন্তব্য করতেন, তাঁদের ওপর নজরদারি করবার জন্যই নাকি কলকাতা থেকে পার্টি অধ্যাপক শংকর গুপ্তকে পাঠিয়েছেন। মাত্র 42 বছর বয়সে, বড় অসময়ে অধ্যাপক গুপ্ত প্রয়াত হন। অধ্যাপক সমিতির আন্দোলনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ মুখ। শিলিগুড়ির বাম রাজনীতির সাথে কলকাতার সংযোগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা তার ছিল।
সেই সময়ে শিলিগুড়ি কলেজ থেকে বাংলা বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক অশ্রুকুমার সিকদার। স্যারের কাছ থেকে সেই পর্বের কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।পরে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকার কারণে আর অবাক হতাম না। ভাবা যায় অশ্রুবাবুর মতো অভিজ্ঞ সুপন্ডিত অধ্যাপককেও বলতে হয়েছিল - "সতেরো বছর শিলিগুড়ি কলেজে পড়ানোর পর আমি ঊনিশ শো বাহাত্তর সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে চল্লিশ বছর বয়সে একজন লেকচারার হিসেবে পড়াতে শুরু করি ।লেকচারার পদে যোগদানের জন্য আমি চারবার প্রার্থী হিসেবে আবেদন করি যেন রবার্ট ব্রুসের অধ্যবসায়। চতুর্থবারের জন্য যখন মনোনীত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগদান করি তখন উপাচার্য ছিলেন পূর্ণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে প্রত্যাখ্যানের কারণ অনার্স পড়ানোর অভিজ্ঞতা না থাকা ও পিএইচডি ডিগ্রী না থাকা এসব কথা জানবার পর মনে হয়েছিল, এমনও হয়!" আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী তখন দেখেছি বাংলা বিভাগে শুধু নয় অন্যত্র এমন অনেক অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছেন যাদের নিজের বিষয়টি কলেজে পড়ানো কেন, হায়ার সেকেন্ডারী স্কুলের পড়ানোর অভিজ্ঞতাও নেই। সেই সময়ে "বিধিবাম" প্রবাদ বাক্যটি একেবারে বিপরীতার্থে কারো কারো ক্ষেত্রে হয়েছিল অসীম সৌভাগ্যসূচক।
জলপাইগুড়ির সাথে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মিক সম্পর্ক একেবারে সূচনা পর্ব থেকে। প্রথম ও দ্বিতীয় উপাচার্য দুজনেই ছিলেন জলপাইগুড়ির মানুষ ।কলেজের শিক্ষকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে জলপাইগুড়ি থেকে অধ্যাপক দেবেশ রায়ের পরে অনেকেই এসেছেন। সব নাম মনে নেই, তবে বিশেষ করে আনন্দ চন্দ্র কলেজের অধ্যাপক শক্তি দাস মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক দেবব্রত ঘোষ, প্রসন্নদেব মহিলা মহাবিদ্যালয়-এর অধ্যাপক রূপন সরকারের কথা মনে আছে। আর মনে আছে দুই প্রসিদ্ধ আইনজীবী পরেশ মিত্র ও বিভূতি ঘোষের কথা। আজো দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সেরে জলপাইগুড়িতে ফিরছিলেন, ভয়ঙ্কর পথদুর্ঘটনায় দু'জনকেই আমরা হারিয়েছি।তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনাপর্ব থেকেই যে মানুষটির সহযোগিতার উপর আস্থা রাখতেন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়, তিনি হলেন ডাক্তার চারুচন্দ্র সান্যাল। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। রাজনীতি, চিকিৎসা বিদ্যা, নৃতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি, সমাজ মনস্কতা, শিক্ষানুরাগ সবেতেই তিনি ছিলেন অতুলনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিস্তারে তিনি একান্তই ছিলেন মুক্ত চিন্তার মানুষ। উত্তরবঙ্গের আর্থ-সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে যে মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিলগুলি তিনি তৈরি করেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। চারুচন্দ্র সান্যাল অবিভক্ত বাংলার বিধান পরিষদের সদস্য (এমএলসি) ছিলেন দেশবিভাগের পূর্ব দিন পর্যন্ত 1952 থেকে 1968 পর্যন্ত বিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন, গ্রাজুয়েট কনস্টিটিউন্সি থেকে নির্বাচিত হয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনীত প্রতিনিধি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কাজ তিনি আলো দিয়েছেন। নেপালি একাডেমির সভাপতি ছিলেন চারুচনদ্র সান্যাল, সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক দেবেশ রায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগেই এসব হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে নেপালি বিভাগের প্রতিষ্ঠা। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় চারুচন্দ্র সান্যালকে ডিলিট সম্মান দিয়েছিলেন। সেন্টার ফর হিমালয়ান স্টাডিজ বিভাগে চারু চান্দ্র সান্যাল-এর স্মৃতিতে একটি চেয়ার স্থাপিত হয়।উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতির গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের কাছে আজও তিনি প্রেরণা।