সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
06-December,2022 - Tuesday ✍️ By- নীলাঞ্জন মিস্ত্রী 475

সানিয়া-৮/নীলাঞ্জন মিস্ত্রী

সানিয়া
পর্ব-আট
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^^

সানিয়া-রামু এগিয়ে চলে দুই অবলাকে নিয়ে। বাকি মহিষেরা থোপের ভেতর থেকে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। বুকফাটা এক নিঃশব্দ বিদায় বার্তায় গুরুগম্ভীর তখন তিস্তাচর। সানিয়া খুব ভালো করেই জানে  পরিবার ছেড়ে যাবার যন্ত্রণা -  তাই তো মহিষ পেটানোর লাঠিটি ভাঙ্গাবেড়া হাতে ধরিয়ে দিলেও একটি বারের জন্য ব্যবহার করবে না সে। আজ ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! হাতিরামকে তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা করবার জন্যই নিজে যেতে পারছে পরিবারের কাছে। নিজেকে স্বার্থপর মনে হয় সানিয়ার। বিবেক নামক বস্তুটা কাটা গুল্মের মত খোঁচা দিতে থাকে খালি পায়ের তলায়। খোঁচা খেতে খেতেই এগিয়ে চলে তারা। একটু আগে রাজা-রাণীও ছিল তাদের পিছু পিছু। ওদের তাড়িয়ে দিতে চাইলেও সঙ্গ ছাড়েনি শেষ পর্যন্ত। তিস্তার যে সোঁতাটি বালি কেটে বেরিয়ে এসেছে তার পাড়েই বাথান ঘাট। এ সোঁতায় এখন হাঁটু সমান জল। খুব সহজেই মহিষ নিয়ে সোঁতা পেরিয়ে যায় রামুরা। রাজা-রাণী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সেই সোঁতা ঘেঁষেই।  

সামনে এখন সুবিস্তৃত বালুকারাশি। মাটিতে রস নেই বিন্দুমাত্র। চারিদিকেই রুক্ষতা ও শুষ্কতার কঠিন চাদর বেছানো। নলবন হোগলাবন ঝাউবন আরও কতশত লতা-গুল্ম তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে রেখেছে  কৃপণ বুকে। তবে সবুজে ঢাকতে পারেনি সম্পূর্ণ বেলাভূমিকে। সূর্যালোকের সখ্যতায় পলি-মাটি-কাদার সংসার আজ বিলুপ্ত। ঝোপঝাড় জঙ্গল রয়েছে একটু দূরেই। তারপরেই যে মূল তিস্তা। মহিষ নিয়ে নদী ঠিকমতো পেরোতে পারলেই সামনে রাজারহাট এলাকা।

চৈত্রের চরভূমি ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। বালির উপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটছে সানিয়া-রামু। মহিষেরাও বিন্দুমাত্র বিরক্ত করছে না তাদের। গায়ে হাত বুলিয়ে হালকা ধাক্কা দিলেই তারা বুঝে নিচ্ছে বালুপথ। সামনেই নল আগাছার জঙ্গল। এই জঙ্গলের ভেতর দিয়েই হেঁটে এগিয়ে যেতে হবে তাদের। নলের এই জঙ্গলে ভয় রয়েছে অনেক। ভয় বন্য জীবজন্তুর। কোথায় কে লুকিয়ে রয়েছে কে জানে? বাঘের উৎপাত রয়েছে খুব। তবে বাঘকে এখন আর ভয় করেনা সানিয়া। বাথানের আশেপাশে দিনে রাতে বাঘের কান্না শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে। সানিয়া ভালো করেই জানে মুখে আর পায়ে আওয়াজ করে এগিয়ে গেলে বাঘ কখনই সামনে আসবে না। এই ক’বছরের মৈষালি জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে এমন অনেক কিছুই। 

এক ফুট দুই ফুট নয়। দুই-তিন মানুষ সমান নলের জঙ্গলে ঢেকে রয়েছে তারা। কাটা ঝোপঝাড়ও রয়েছে অনেক। মধুয়া, কাশিয়া, হোগলা রয়েছে মাঝে মাঝেই। মহিষ নিয়ে সেই জঙ্গলে ঢুকে পরে সানিয়ারা। জঙ্গল মাড়ানো হাঁটা পথের চিহ্ন দেখে দেখে এগিয়ে চলতে থাকে। সুরক্ষার জন্য সানিয়া সবার সামনে হাঁটছে। তারপর দুটি মহিষ এবং শেষে রামু। মহিষেরা পিছিয়ে গেলে বাঘ তাদের পিছু নেবেই এবং সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পরবে মহিষের উপর। বাথানিয়া জীবনে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। মাঝে মাঝেই বাঘ চুপটি করে দলছুট বা পিছিয়ে পরা মহিষ টেনে নিয়ে যেত নলের জঙ্গলের মাঝে। মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে জঙ্গলের ভেতরে বিচিত্র সব জীবেরা আওয়াজ শুরু করেছে। মাথার উপর হাটিটিরা রেকি করে চলেছে। লাল সাদা খরগোশেরা ঝোপ থেকে বেরিয়ে দৌঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে গর্তের ভেতর। নাম না জানা পাখপাখালিরা এ ডাল ও ডালে ছুটোছুটি করছে। আশেপাশেই মধুয়ার নল রয়েছে প্রচুর। কয়েকটি মধুয়ার নল তুলে চেবাতে চেবাতে এগিয়ে চলে দুই ক্ষুদে মৈষাল। মধুয়ার নরম নল জলের পিপাসা মেটায়। শরীরে তাৎক্ষণিক শক্তিরও জোগান দেয়। রামুর মধুয়া চিবিয়ে বেশ আনন্দ হয়। মধুয়া কি জিনিস এর আগে তার জানা ছিল না। আরও গোটা কয়েক নল তুলে সাথে নেয় রামু। জঙ্গল সরিয়ে সরিয়ে দুই বন্ধু চলতে থাকে বড় নদীর দিকে।

হালকা হয়েছে জঙ্গল। জঙ্গল ভেদ করে দূরে নজরে আসে মহিষের পাল। সানিয়া ভীষণ অবাক হয় এই এলাকায় মহিষের এমন পাল দেখে। মনে মনে ভাবে ওই চরে নিশ্চই নতুন কেউ বাথান বেঁধেছে। মহিষের পাল আর একটু কাছে আসতেই সানিয়ার চক্ষু চড়কগাছ। এতো মহিষ নয়। এযে জংলী শুকরের দল। কাছে এলে রক্ষে নেই। তাদের দু'জনকে ছিড়ে ক্ষতবিক্ষত করবে ওরা।  রামু ভীষণ ভয় পায়। সাহস জোগায় সানিয়া। বিগত চার বছরের অভিজ্ঞতায় সে এখন অনেক সাহসী। নদীর দিকে জংলী শূকরের দল তেমন ঘেঁষে না। তাই মহিষ নিয়ে দ্রুত ছোটে তারা নদীর দিকে। মহিষেরাও অশনিসংকেত বুঝে গিয়ে প্রাণপণে ছুটতে থাকে জঙ্গল ভেঙে। অবশেষে জঙ্গল শেষ হয়। নদীর দেখা মেলে। ভয় কাটে তাদের। হাপিয়ে গেছে সানিয়া, বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছে রামু, হাপিয়েছে মহিষেরাও। নদীর জলে ঝুকে মুখ লাগিয়ে তৃষ্ণা মেটায় তারা। মহিষেরা পাড় ঘেঁষে জলে দাঁড়িয়ে বিশ্রামরত। সানিয়া আর রামু চিত হয়ে শুয়ে পরে বালির উপর। প্রখর রোদের মাঝেই আকাশের দিকে মুখ করে
-রামু ইয়ার আগোত এতোগিলা শুয়োর দেখিসিত একসাথে ?
-নারে ভাই। খিব ভয় পাইসি রে সানিয়া। খিব ভয় পাইসি। আর কনেক হইলে মারি ফেলাইল হয় হামাক।
-মুইয়ো ভয় পাইসু রে। এতোগিলা এক নগত মুইয়ো দেখো নাই আগত্। ভাগ্যখান হামার ভাল রে রামু। শূয়োর গিলা ওদিকিনা চলি গেইল। না হইলে বিপদ আছিল।
-ভোক নাগাইসেরে সানিয়া। পেটটা মোচোরাছে খিব।
-বাইর কর কেনে চিড়া গুঁড়। কনেক না হয় খ্যায়া নেই এঠে বসিয়া। ভইসগিলাও খাউক। এইপাখে ঘাস আছে। নদীর ওই পাড়ত তো আর মিলিবার নহয়।

চিড়া গুঁড় চেবাতে চেবাতে সামনের তিস্তাকে পরখ করে নেয় অভিজ্ঞ সানিয়া। জলের রঙ ও স্রোত দেখে গভীরতা বোঝবার চেষ্টা করে। নদী বেশী লম্বা নয় সামনে। এক মানুষ সমান জল বইছে হয়তো। নৌকা পাওয়া যাবেনা আশেপাশে। এই নির্জনে সেটা আশা করাটাও যে বৃথা। সবাইকেই সাঁতরে পেরোতে হবে নদী। মাথার গামছা খুলে কোমরে জড়িয়ে নেয় তারা। পরনের জামা কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিস পোটলা করে ধরে নেয় এক হাতে। মহিষ দুটির গলার দড়ি খুলে দিয়ে নামিয়ে দেয় জলে। নিজেদের কোমরে সেই দড়ি লাগিয়ে সাথে আনা ছাতা দুটি উল্টো করে বেঁধে দেয় দড়ির অপর প্রান্তে। মহিষ দু'টির পেছনে ধাক্কা দিতেই ওরা বুঝে যায় মৈষালি সংকেত। মহিষেরা সাঁতার কাটে ভালো। ওদের দমও বেশী। তাই স্রোত কেটে মাথা উঁচু করে ওরা সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে থাকে স্বচ্ছন্দে। সামনে রামু পেছনে সানিয়া মাঝে তাদের মহিষ। এক হাত উঁচু করে সাঁতরে যাচ্ছে দুই দুঃসাহসী বালক। আর যাই হোক না কেন হাতের এই পোটলা ভেজালে চলবে না। গন্তব্য যে এখনও ঢের দূর।

পাড়ের নিকট আসতেই ছন্দ পতন। স্রোতের ঘূর্ণিতে পরে দিকচ্যুত হয় হাতিরাম। ভেসে যেতে থাকে নদীর স্রোতের সাথে। রামু ততক্ষণে একটি মহিষ নিয়ে পাড়ে উঠেছে। হাতিরামের এই অবস্থা দেখে চিৎকার করতে করতে পাড় বরাবর ছুটতে থাকে রামু। সানিয়াও স্রোতের অনুকূলে হাতিরামের পিছু নেয়। কিলোমিটার খানেক এভাবে ছুটে অবশেষে তারা পাড়ে ঠেকাতে সমর্থ হয় হাতিরামকে।
 
অনেকক্ষণ পর হাতিরামকে দেখতে পেয়ে প্রাণে জল আসে তার সাথীর। সাহস মেলে সানিয়া রামুকে দেখেও। সানিয়া রামুর  ভিজে চুপচুপ গামছা পরা শরীরদুটি ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে সূর্যের প্রখরতায়। বালির উপর পরে রয়েছে তাদের পোটলা দুটি। পোটলা খুলে জামা কাপড় পরে নেয় তারা। পুনরায় শুরু হয় তাদের কর্তব্য পালনের যুদ্ধ। উত্তপ্ত বালির উপর পায়ের ছাপ ফেলতে ফেলতে এগিয়ে চলে তারা রাজার হাটের দিকে।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri