রায়পুর চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
রায়পুর চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^
সবেমাত্র নতুন বছর শুরু হয়েছে। তীব্র হিমেল আবহাওয়া। ডুয়ার্সের চা বাগানগুলিতে এমনিতেই এই সময়কালে নীরবতা বিরাজ করে। কারণ কাটিং এবং প্রুনিং এর সময়কাল এই শীতকাল। কিন্তু এই শীতকালীন সময়কালে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে যে এইরকম একটি বাগানে আসতে হবে সেটা ভাবতেও পারিনি। এমনিতে অনেক সময় শীতকালীন মরসুমে সামান্য ছুতো পেলে বাগান বন্ধ করে দেবার প্রবণতা অনেক বাগান মালিকের মধ্যে কাজ করে। শ্রমিকদের যতটা সম্ভব কম মজুরি দিয়ে লাভের পারদটাকে আরেকটু
উপরে তোলা। কিন্তু লাভ এবং লোভ গগনচুম্বী হলে সেটা তো বিপদ। দীর্ঘদিন ধরে যে পরিমাণ শ্রমিক শোষণ রায়পুরে করে চলেছেন গৌরীশংকরবাবু সেটার বুঝি কোন তুলনাই অন্যান্য বাগানগুলোর সঙ্গে চলে না। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে বন্ধ রায়পুর চা বাগানের মালিক গৌরীশংকরকে শোকজ নোটিশ ধরাতে বাধ্য হয়েছেন জলপাইগুড়ির জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রায়পুর চা বাগানের ম্যানেজার চুপিসারে বাগান ছেড়ে চলে যান। কারণ বাগান মালিক ওই বছর বেশ কয়েকমাস ধরে শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া রেখেছিলেন। প্রায় এক বছর বাগান চালু রাখলেও ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে পরিত্যক্ত হয়ে পড়া রায়পুর চা বাগানকে ২০১৯ সালের পয়লা জানুয়ারি সরকারিভাবে বন্ধ ঘোষণা করে শ্রমদপ্তর। কর্মহীন হয়ে পড়ে প্রায় ৫৫৮ জন স্থায়ী শ্রমিক। বাগান বন্ধের পর দেরিতে হলেও চা পাতা বিক্রি করে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দিলেও তা সংসার চালানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। বাগানের ওএমসির সম্পাদক ফিতনা বরাইকের কাছ থেকে জানলাম এখন চা গাছ পরিচর্যার জন্য কাঁচা পাতা যারা কেনেন, তাঁদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রুণিং এর জন্য শ্রমিকদের মজুরি দিতে হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান মালিক বাগানে না আসায় শ্রমিকেরাই কাঁচা পাতা বিক্রি করে মজুরি দিচ্ছে। লাভের কড়ি পকেটে পুরে মজুরি, বেতন এবং বোনাস বকেয়া রেখে বাগান ছেড়ে মালিকপক্ষ চলে যায়।
বাঁচার অধিকার শুধুমাত্র জন্মগত অধিকার নয়। এটি একটি আইনসঙ্গত অধিকার। একইরকমভাবে আত্মরক্ষার অধিকারও। উত্তরবাংলার পরিকাঠামোহীন চা বাগিচাগুলির কর্মহীন শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটাতে বন্দুক থেকে তপ্ত সীসা ছুড়তে হয় না। বাগিচা মালিকের পেটোয়া মাফিয়া গুন্ডাদের শ্রেণী সংগ্রামরত শ্রমিকবাহিনীকে দমন করতে সংগ্রামের মঞ্চে উপস্থিত হতে হয় না। শ্রমিকেরা তাদের চা বাগিচার পর্ণকুটিরের ভাঙা দাওয়াতেই দিনের পর দিন একদানা ভাতের জন্য অপেক্ষা করে, তারপর শূন্য পাকস্থলীর দাবি মানতে না পেরে ফুসফুসের শেষ রায়টুকুকে বার করে দিয়ে বাঁচার অধিকারের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির মুখে লাথি মারে। রায়পুর চা বাগিচার পরিস্থিতি এখন তাই। এই পর্বের ক্ষেত্রসমীক্ষায় লক্ষ্য করলাম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সরকার নিছক দর্শকই। ট্রেড ইউনিয়নের ট্রেডের সাইনবোর্ড আছে, আন্দোলনের নেতা আছে, কিন্তু নেতৃত্ব নেই। পথ আছে, দিশা দেখাবার জন্য পথপ্রদর্শক নেই। আইন আছে, কিন্তু শ্রমিকের বাঁচার জন্য আইনের দন্ড নেই। কারখানার গেটে তালা ঝোলানোর জন্য মালিকের হাতে তালা আছে, বন্ধ তালা খুলবার জন্য সরকার এবং শ্রমিকের হাতে চাবি নেই। এদের সুখ আর ওদের অসুখ। এই মন্তব্যের সারকথা হল চায়ের বাজারের সুফলের জন্য চা মালিকরা সুখে থাকেন, অন্যদিকে আর্থিক অনটনের শিকার চা শ্রমিকরা অস্বস্তিতে অর্থাৎ গভীর অসুখে আক্রান্ত। প্রায়ই দেখা যায় মালিকপক্ষের অভিযোগ থাকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। তাদের বক্তব্য শ্রমিকদের একাংশের নিজেদের মধ্যে বিরোধের কারণে পরিচালনার কাজে সমস্যা সৃষ্টি হয়। একাংশ শ্রমিক পুরো দিনের কাজ করে না। তখন বাগানে স্থায়ী শ্রমিকের বদলে কাজে লাগানো হয় অস্থায়ী সস্তার শ্রমিকদের। অন্যদিকে চা শ্রমিকদের বক্তব্য শীতের শুখা মরশুমে চা-পাতা ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। শীতকালে পাতা তোলা বন্ধ হয়ে গেলে মালিকের অনুপস্থিতিতে চলবে কেমন করে সেটা ভেবেই অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নেয়।
রায়পুর চা বাগিচাতে প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ফ্যাক্টরি, পরিত্যক্ত শ্রমিক আবাসগুলিও ভুতুড়ে বাড়ির আকার ধারণ করেছে। স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে বাগানে ৭০০-রও বেশি আবাসন রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি আবাসন ভেঙেচুরে একাকার হয়েছে। টিনের চাল ফুটো হওয়ায় ভিতরে বৃষ্টির জল পড়ে। জানলা-দরজা ভেঙে গিয়েছে চা বাগানের শ্রমিক বস্তির প্রায় প্রতিটা পরিবারের। রাজ্য সরকার চা সুন্দরী প্রকল্পে জলপাইগুড়ির বেশ কয়েকটি বন্ধ ও রুগ্ন চা বাগানে শ্রমিকদের জন্য ঘর তৈরি করে দিচ্ছে। কিন্তু অবাক কান্ড জলপাইগুড়ির রায়পুর চা বাগান বছরের পর বছর ধরে বন্ধ থাকলেও এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত হয়নি। এই তালিকায় রায়পুর চা বাগান না থাকায় তাই শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়েছিল। চা সুন্দরী প্রকল্পে রায়পুর চা বাগানকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে বন্ধ বাগানের চা শ্রমিকদের নিয়ে খোদ তৃণমূল প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠন তরাই-ডুয়ার্স প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন (টিডিপিডব্লিউইউ) কে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিতে হয়েছিল। এমনকি রায়পুর চা বাগানের শ্রমিক তথা পাতকাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান প্রধান হেমব্রমের নেতৃত্বে আন্দোলনও শুরু হয়। চা সুন্দরী প্রকল্পে এই বাগানকে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রচুর দাবি জানিয়েও কোনও কাজের কাজ হয় নি সেই সময়। জলপাইগুড়ির ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিক তথা অতিরিক্ত জেলাশাসক রঞ্জন চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন চা সুন্দরী প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের এনলিস্টেড বাগানগুলির মধ্যে রায়পুর বাগান ছিল না। দ্বিতীয় দফায় আরও কিছু চা বাগান নিয়ে পরিকল্পনা করা হবে। রায়পুর চা বাগান এই তালিকায় এলে সেখানেও কাজ করা হবে।
স্প্রেইং মেশিনে যদি একটা লিভারকে সামান্য প্রকৌশলগত পরিবর্তন করা যায় তাহলে প্রকৌশলের ক্ষেত্রে এই সামান্য পরিবর্তন করে পাম্পিং পদ্ধতিকে আরও সহজতর করা যেতে পারে। একজন শ্রমিককে রিফিলার আনার জন্য বারবার যাতায়াত করতে হয়, যাতে সময় ও এনার্জি ক্ষয় হয়, শ্রমিক ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সোলার প্রোজেক্ট ব্যবহার করে পাম্পিং স্টেশন থেকে সরাসরি পাইপের মাধ্যমে স্প্রে করার কথা ভাবা যেতেই পারে। এইভাবেই চিন্তাভাবনা করেছিলেন জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক, ৪০-৫০ জন ছাত্রছাত্রীর একটা দল এবং জলপাইগুড়ি জেলার সদর হাসপাতালের চিকিৎসকদের একটা টিমের সঙ্গে জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে অনতিদুরে রায়পুর চা বাগানের ৩০০ টি পরিবারের উপর সার্বিক স্বাস্থ্যসমীক্ষা এবং মেডিকেল ক্যাম্প করতে গিয়েছিলাম। ছাত্ররা শ্রমিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, বিদ্যুত, জ্বালানি, পুষ্টি, আবাসন, নিবিড় স্বাস্থ্যবিধান, নিকাশি- সব বিষয়ে খুটিনাটি তথ্যসমীক্ষার মাধ্যমে জোগাড় করে এই সমীক্ষা রিপোর্ট সরকারি স্তরে পাঠিয়ে সরকারকে পরিকল্পনা রূপায়ণে কাজ করার আবেদন জানায়। কলেজের অধ্যাপক সৌপায়ন মিত্রর কাছ থেকে জেনেছিলাম পরিবেশবান্ধৰ বিভিন্ন পরিষেবা যাতে চা বাগানের শ্রমিকরা পান সেই লক্ষ্যে চা বাগান শ্রমিকদের জন্য তাঁরা প্রকল্প প্রণয়ন করেছেন। রায়পুর চা বাগানের জমি, কৃষিব্যবস্থা, নিকাশি, প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা, চা বাগানের মেশিনের ব্যবহার জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের চিন্তাভাবনাকে যেমন আলোড়িত করেছে, তেমনি কলেজের পুঁথিগত পড়াশোনার বাইরে হাতে কলমে এই ধরনের সমীক্ষার কাজ যদি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ অন্তর্গত চা বাগিচাগুলিতে করা যায় তাহলে সত্যিই যে উপকার হবে এটা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু চিন্তাভাবনা নেই রায়পুর চা বাগানের ম্যানেজমেন্টের, মালিকপক্ষের। পরিস্থিতি ভয়ংকর, কিন্তু কবে ঘুম ভাঙবে মালিক পক্ষের?
ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে করতে বাগানে ঢুকতেই কারণগুলি চোখের সামনে উন্মোচিত হতে লাগল। রায়পুর টি গার্ডেনটির বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ তিনজন। স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন অনেকগুলি ছিল। কিন্তু প্রকৃত শ্রমিক স্বার্থে কারা কাজ করে বলা মুস্কিল। বাগানটির অবস্থান জলপাইগুড়ি সদর ব্লকে। আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ৩৪৪.২১ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদিক্ষেত্র ২৩৯.৮৩ হেক্টর। প্রতি হেক্টর জমি পিছু ২৪৬১ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। সেই উৎপাদিত চা এর গুণগত মান উন্নত নয়। বাজারে দামের ক্ষেত্রেও হেরফের হয়। যা খরচ সেই তুলনায় ব্যয় অনুযায়ী আয় হয় না বললেই চলে। এটি একটি অত্যন্ত দূর্দশাগ্রস্ত বাগান যেখানে শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতিনিয়তই নিজেদের সঙ্গেই লড়াই চালাতে হয়। বাগানের শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৩৭৫। মোট কর্মরত শ্রমিক ৬১৭ জন ছিল। বহু শ্রমিক দিনমজুরীর কাজ করে। বহু বাড়িতে এখনো ইলেকট্রিক আসেনি। শ্রমিক আবাসগুলিতে শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। বাগানের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। নেই এর স্বর্গরাজ্যে রায়পুর চা বাগান। রায়পুর বাগানে কোনও হাসপাতাল নেই। কাজ চানোর মতো ডাক্তার ও ডিসপেনসরি থাকলেও পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড নেই। আইসোলেশন ওয়ার্ড, মেটারনিটি ব্যবস্থা নেই। অ্যাম্বুলেন্স নেই। ওষুধ সরবরাহ হয় না বললেই চলে। ক্রেশ দায়সারাভাবেই চলে। জলের ব্যবস্থা নেই, শৌচাগার নেই, ক্ৰেশে দুধ বিস্কুট, শিশুদের পোশাক দেওয়া হয় না। পানীয় জল আছে তবে পানের যোগ্য কিনা সন্দেহ আছে। ছাত্রদের স্কুলে নিয়ে যাবার কোনরকম পরিবহনের ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকেরা সময়ে সময়ে মাইনেই পান না, বোনাস পাবেন কেমন করে? এইভাবেই চলছে রায়পুর বাগান এবং আশ্চর্য ব্যাপার হল শ্রমিকেরা এই ভাবেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কয়েকবছর ধরে চা বাগিচাটি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত পরিস্থিতি অর্জন করার চেষ্টা করলেও মালিকের ভ্রান্ত নীতির ফলে দূর্দশার চরম সীমায় চলে এসেছে ।
কোনরকমে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর বুলবুলি ওঁরাও আর এগোতে পারেনি। রায়পুর চা বাগানের মেন্দা ওঁরাও এর বড় মেয়ে বুলবুলি ওঁরাও। বয়সজনিত কারণে বাবা আর কাজ করতে পারে না বলে সেই দায়িত্বটা এখন পালন করতে হয় বুলবুলিকে। চার ভাই বোন তারা। মা পূর্ণিমাদেবী বুলবুলিকে চা পাতা তোলার কাজে সাহায্য করে। তাদের দুজনের উপার্জিত অর্থে সাংসারিক খরচ চালিয়ে নিতে হয়। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে জলপাইগুড়ি শহর লাগোয় রায়পুর চা বাগানের অচলাবস্থা চলছে। কাজ না থাকায় অসহায় অবস্থা প্রায় দেড় হাজার শ্রমিকের। বাধ্য হয়ে করোনা আবহে অনেক শ্রমিক ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। অনেকদিন আগে রংধামালীর রাস্তা দিয়ে বেলাকোবা থেকে আসার সময় চোখে পড়েছিল রংধামালি জলপাইগুড়ি সিটি অটোর ভিতরে ঠাসাঠাসি ভিড়ে, এমনকি গাড়ির মাথায় ব্যাগের স্তূপের উপরেও অনেকে বসে, দরজা-জানলা এমনকি পিছনে ঝুলেও অনেকে চলে যাচ্ছেন বাগিচা ছেড়ে। কৌতূহলী হয়ে জেনেছিলাম ওরা কাজের সন্ধানে যাচ্ছে রাজ্যের বাইরে। বাগানের রাস্তায় ধূলো উড়িয়ে অটো চলে যেতেই অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাদের কেউ আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন, আবার কেউ বা ওদের দিকে চেয়ে হাত নেড়েই চললেন। ডুয়ার্সে এ রকমভাবেই রায়পুরের মতো বন্ধ চা বাগিচাগুলির বাসিন্দারা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়ে বিকল্প পথে রোজগারের চেষ্টা করে। আবার মাটি কামড়ে পড়ে থাকার সংখ্যাটাও খুব একটা কম নয়। রায়পুর চা বাগানের গুদাম লাইনের শিবু সাওয়াসী জানালেন, বাগান খোলা থাকলেও বাড়তি রোজগারের জন্য বাইরে মজুরের কাজ করতে যেতে হয়। আর্থিক দুরবস্থার জন্য ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে না। মজুরি পেতে দেরি হচ্ছে। অতিরিক্ত মদ্যপান, অপুষ্টি জনিত সমস্যার কারণে বিভিন্ন রোগে ভুগছে শ্রমিকরা। গত কয়েকবছর ধরে চা বাগিচাটি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি অর্জন করার চেষ্টা করেও পারেনি।
বারবার প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও রায়পুর বাগানের কাজ স্বাভাবিক ছন্দে ফেরেনি। বারবার জলপাইগুড়ি শ্রম দফতরের দ্বারস্থ হয়েছেন বাগানের শ্রমিকরা শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের নিয়ে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। একসময় প্রতিদিন ভোরে বাগানের শ্রমিক মহল্লার ঘুম ভাঙত সাইরেনের আওয়াজে। এখন আর সেই সাইরেনের শব্দ শোনা যায় না। নিজেদের রুটিরুজির টানে সকাল হলেই বাগান ছেড়ে শহরে ভিন্নধর্মী কাজের সন্ধানে বেড়িয়ে যান অনেকেই। বাগানে ছ'শোরও বেশি স্থায়ী শ্রমিক আছে। অন্যদিকে অস্থায়ী শ্রমিক প্রায় এগারোশো। একাংশ শ্রমিক ঝুঁকি নিয়ে নিজেরাই গোষ্ঠী গড়ে চা পাতা তুলে বিক্রি করে কোনরকমে দিন কাটাচ্ছেন। বাগানের কারখানা বন্ধ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রম দফতরের কাছে শ্রমিকদের দাবি দ্রুত বাগানের কাজ চালু করতে হবে। যতদিন না বাগানের কাজ স্বাভাবিক হচ্ছে ততদিন শ্রমিকদের ফাউলাই অর্থাৎ রাজ্য সরকারের দেওয়া আর্থিক সাহায্য প্রত্যেক শ্রমিককে দিতে হবে। অভিযোগ, দু'শো শ্রমিক এখনও ফাউলাই পাচ্ছেন না। বারবার আবেদন করা হলেও প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ করছে না। এদিকে, এই চা বাগানের শ্রমিক আবাসনগুলিরও বেহাল দশা। ‘চা সুন্দরী’ প্রকল্পের মাধ্যমে বাগানকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার দাবিও তুলেছেন শ্রমিকেরা। শ্রমিকেরা খুবই অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। ওঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। নিয়মিত খাবার পাচ্ছেন না। তাই দ্রুত এই চা বাগানটি খোলার দাবি উঠেছে
প্রায় এক দশক ধরে বন্ধ রায়পুর চা বাগান। সেই বাগানের সঙ্গে যুক্ত ছিল যেসব পরিবার, তাদের পক্ষে এখন সংসার চালানোই সমস্যাজনক। সেসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা তাই সংসার চালানোর কাজের ভার নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে। লাটে উঠেছে তাদের স্কুলে যাওয়া। শিকেয় উঠেছে পড়াশোনা। শতাধিক স্কুল পড়ুয়া পড়াশোনায় ইতি টেনে পরিবারের স্বার্থে হাতে কোদাল-বেলচা নিয়ে দিনমজুরির কাজ করছে। একাদশ শ্রেণির মনোজিৎ মুন্ডা, দশম শ্রেণির রাজ ওরাওঁ, নবম শ্রেণির করণ ওরাওঁ, অষ্টম শ্রেণির অর্জুন মুন্ডাদের এখন আর বইয়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। সকাল হলেই দিনমজুরির সন্ধানে ওরা বেরিয়ে পড়ে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন সেটুকুও প্রতিদিন জুটছে না। ভোটের আগে বাগানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভিড় লক্ষ করা গেলেও সেসব মিটে যাওয়ার পর এখন আর কোনও নেতা পা দিচ্ছেন না বাগানে। বাগানের বাসিন্দা নন্দ মুন্ডা বলেন, রায়পুর চা বাগান থেকে রাজগঞ্জ কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী খগেশ্বর রায় ছয় শতাধিক ভোটে জয়ী হয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের এই বিপুল সাফল্যের পরও কোনও নেতাকেই বাগানে আসতে দেখা যায় নি। এলাকায় কেবল দেখা যায় শুধু রায়পুর চা বাগানের শ্রমিক তথা পাতকাটা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান প্রধান হেমব্রমকে। বিধায়ক খগেশ্বর রায় অবশ্য বাগানের স্কুলছুট শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ চা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। বাগানের চা গাছের পাশেই ছায়াগাছ। এই ছায়াগাছের তলায় বসে থাকতে দেখা গেল মনোজিৎ, করণ, রাজ, অর্জুনদের। বিভিন্ন দফায় দশ বছর ধরে রায়পুর চা বাগান বন্ধ। শুধুমাত্র ত্রাণের উপর নির্ভর করে সংসার চলে না। একাদশ শ্রেণির মনোজিত তাই বাধ্য হয়েই দিনমজুরির কাজ করছে। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ে কাজের সন্ধানে। দিনমজুরি করে সামান্য যে উপার্জন করে তা বাবা মায়ের হাতে তুলে দেয় সে। ইচ্ছে ছিল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার। কিন্তু আর কোনও উপায় নেই। বাগিচার ছেলেমেয়েরা অর্থাভাবের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিশ্রুতির ফিরিস্তি দেওয়া হলেও বন্ধ রায়পুর চা বাগানের তালা খুলছে না। কবে খুলবে, সে প্রশ্নের উত্তরও পাচ্ছেন না বাগিচার শ্রমিকেরা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴