মায়াপথের মীড়-৮/সৌগত ভট্টাচার্য
মায়াপথের মীড়/৮
সৌগত ভট্টাচার্য
প্রতি বছর চৈত্রের শেষের দিকে মোস্তাফার কথা মনে পড়ে, খাদির দোকানের কথা মনে পড়ে আর একটা নতুন-নতুন গন্ধের কথা মনে পড়ে।
চারপাশে কয়েকশ বছরের বিরাট বিরাট পুরানো দালান, মাঝে একটা শান বাঁধানো চাতাল, খুব একটা রোদের আলো এসে পড়ে না এখানে, শুধু ফাঁকফোকর দিয়ে চাঁদ দেখা যায়। এরই মাঝে একটা জরাজীর্ণ ইট বেরিয়ে যাওয়া দেওয়াল থেকে বট চারা উঁকি দেওয়া তিনতলা বাড়ির নিচ তলায় বিশুদ্ধ খাদির দোকান দাঁড়িয়ে থাকে, সেই বিয়াল্লিশ সাল থেকে। খাদির দোকানের এক কোণে গর্ভগৃহে সেলাই মেশিন নিয়ে বসে থাকে মোস্তফা, দুটি দোকানের মাঝে একটা সরু দেওয়াল। আজকাল চোখে কম দেখে কানে কম শোনে সে। চশমাটা নাকের কাছ থেকে চোখের সামনে নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকায়, তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফিতা বের করে ছাতি আস্তিন হাতা কাঁধ গলার মাপ লিখে নেয় ওর গত নববর্ষে কেনা সরু লম্বা খাতায়।
তার মতো পাঞ্জাবি শুধু এই শহর কেন, আশেপাশের কোনো শহরে কেউ বানায় কী না সন্দেহ! একসময় ভাবতাম আকবরের পাঞ্জাবি নিশ্চয়ই ওর কোনো পূর্বপুরুষ সেলাই করত; এখন শীতল পটির ওপর বসে আমার মতো হরিপদর পয়লা বৈশাখের পাঞ্জাবির কাপড় কাটে। স্কুল পাঠ্য ইতিহাস বইয়ে লেখা থাকে, একসময় নাকি আকবর ফসলি সাল অনুযায়ী পয়লা বৈশাখের রীতি চালু করেছিলেন যাতে হরিপদরা বছর শেষে চৈত্রের মধ্যে তাদের হাল অনুযায়ী পাওনা গান্ডা মিটিয়ে দেয়।
এই বছর চৈত্রের গায়ে লেগে থাকে একটা রমজান মাস। মোস্তফা রোজা রাখে, আর কয়দিন পর ঈদ। এই সময় বছরে সবচেয়ে বেশি কাজ হয়, ঈদে দারভাঙ্গা যাওয়া হয় না তার। বৈশাখে বিশুদ্ধ খাদির দোকানে রাম নবমী হয় ধুমধাম করে। খাদির দোকানের মালিন কাঠের তাকে সাজানো নানা রঙের পাঞ্জাবির কাপড়গুলো শুধু দেওয়াল টপকে এই পারে আসার অপেক্ষায়, মোস্তফার দোকানে নতুন পাঞ্জাবি রাখার দড়ি ঝুলে পড়ে। সেলাই মেশিন নিয়ে বসে থাকে দুটো চোখ। খাদির দোকান থেকে কাপড় কিনে পাঞ্জাবি বানাতে দিই, স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার সরু দোকানটা রঙিন হয়ে ওঠে বৈশাখে এলে।
মুস্তাফা পাঞ্জাবির মাপ নেয় — ছত্রিশ চোদ্দ ষোলো… খাতায় উর্দুতে মাপগুলো আর কাস্টমারের নাম লেখে। হিজরী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সাতাশ রোজার দিন পাঞ্জাবি ডেলিভারি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি লেখে।
একটা চরকের দল ঢাক বাজিয়ে এসে দাঁড়ায় ওর দোকানের সামনে, সে ওদের খুচরো দিয়ে আবার মাপ নেয়, দলটি পাশের খাদির দোকানে যায় সেখান থেকেও ভিক্ষা নেয়। ঢাকের শব্দের মধ্যে পাঞ্জাবি কাটতে কাটতে মাথায় তিনটা ক্যালেন্ডার পাক খায় – কাস্টমারের ইংরেজি ক্যালেন্ডার, পয়লা আর পঁচিশে বৈশাখের বাংলা ক্যালেন্ডার আর রশিদে লেখা হিজরি ক্যালেন্ডারের তারিখ।
সেলাই মেশিনে সুতো ঢোকাতে ঢোকাতে সন্ধ্যার পর পাঞ্জাবির বুক পকেটের সমান একটা আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ দেখে, প্রতিদিন চাঁদের একটু একটু করে ঘুণ ধরে ছোট হয়ে আসা দেখে। কখন যে সেই চাঁদ পাঞ্জাবির বুকের কাছে চিকনের কলকা হয়ে যায়…
হিজরী ক্যালেন্ডার চান্দ্র মাস অনুযায়ী হয়, সে কথা সে না জানলেও এটা জানে হিজরির প্রতিটা মাস এগারো দিন করে এগিয়ে যায়। বৈশাখ মাসের বেলায় সেরকম হয় না। চিকনের কলকা-পাঞ্জাবি পরা আকবর নাকি চান্দ্র ও সৌর মাসের মধ্যে এই সাযুজ্য, বছরের একটা সময় খাজনা আদায় স্থির রাখার জন্যই সৌর সন হিসেবে বৈশাখে নববর্ষ চালু করেছিলেন। যদিও সে খবর সেলাইয়ের ব্যাপারীর না রাখলেও চলে, সে শুধু আকাশ রঙের পাঞ্জাবির কাপড় কেটে আবার সুতো দিয়ে সেলাই করতে জানে। বিয়ের অর্ডারি সাদা পাঞ্জাবিতে চাঁদ-সূর্য চিকনের কাজ করে। ঘুণ ধরা চাঁদের দিকে তাকিয়ে ঈদের কথা মনে করে, দ্বারভাঙ্গার কথা মনে করে, পয়লা বৈশাখের আগে পাঞ্জাবি ডেলিভারি দেওয়ার কথা মনে করে।
ঈদের পরের দিন পাঞ্জাবি আনতে যাই। বিশুদ্ধ খাদির দোকান আর মুস্তাফার দোকানের মাঝামাঝি দাঁড়াই। রমজান মাস শেষ, দুইদিন পর বৈশাখে পড়বে। সে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বৈশাখে রঙিন হয়ে ওঠা সরু একফালি দোকানের ভিতরে ঢুকে যায়, দড়িতে ঝোলানো অনেক রঙ থেকে আমার পাঞ্জাবিটা বের করে আনে।
বৈশাখ মাস জুড়ে তাপ বাড়ে, হাওয়া বাড়ে, ধুলো ওড়ে। মোস্তাফার বানানো পাঞ্জাবি পরলেই আমি ওর দোকানের গন্ধ, যা একান্ত এক বৈশাখের গন্ধ। আমার সারা গায়ে সে গন্ধ লেগে থাকে, আমার ঘরময় সে গন্ধ ঘুরে বেড়ায়।
পাঞ্জাবির লকিংয়ের সেলাইয়ের সুতো দুটি যেন একটা রমজান একটা চৈত্র — দুটি মাস বুনে দিয়েছে একটা বৈশাখকে, একটা নতুন ফসলি গন্ধকে। নতুন পাঞ্জাবির বুক পকেটে একটা রামনবমী কয়েকটা রোজা একটা ঈদের চাঁদ চরকের ঢাক কয়েকটা ইফতার… আর কত যে চৈত্র-রমজানের ধুধু হাওয়ার গন্ধ ঢুকে আছে, সে খবর আকবর না জানলেও, হরিপদ জানে,
আমি নিশ্চিত।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴