ভাস্কর্যের আঁতুরঘর/৮
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-৮)
মৈনাক ভট্টাচার্য
-------------------------------
দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর -ডাণ্ডি অভিযান
ভাস্করের বড় বাঁধা বয়স। কেননা মূর্তিকলা বা ভাস্কর্যের সৃষ্টিতে কায়িক শ্রম সব সময় একটা নির্ভরতা। ভাস্কর্যে মনুমেন্টাল গুণ এবং মূর্তির আলোছায়াও একটা বড় বিষয়। একটা সময়ে আমাদের ধ্যান ধারণায় ভাস্কর্য আর মূর্তির সংজ্ঞা ছিল আলাদা। যে সব শিল্পকর্মে মানুষ অথবা প্রাণীর বহিঃপ্রকাশ থাকত সেগুলোকে বলা হত মূর্তি, আর যে সব শিল্পকর্ম মূর্তিহীন বা ভাবনামূলক অনবয়ব সেগুলো হলো ভাস্কর্য। এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ধরলে সেই সময় সব মূর্তিকে ভাস্কর্যরূপে আখ্যায়িত করা গেলেও সব ভাস্কর্যকে মূর্তি বলা সম্ভব ছিল না। তার পর অনেক ভাঙচুরের চোরাস্রোত বেয়ে ভাস্কর্যের সংজ্ঞা গড়িয়ে গেছে। এসেছে ডাডাইজম্, কিউবিজমের মত একেকটা ঢেউ। উলট-পালট করে দিয়ে গেছে সব সংজ্ঞা। সে গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব। এই আন্দোলনের ইতিহাসে সামিল হয়ে আছেন পাবলো পিকাসো, মার্সাল ডুশোঁ, কর্ট শ্বিটার্স কিংবা ক্লিজ ওল্ডারম্যানদের মত আরও অনেক অনেক বিশ্ববন্দিত শিল্পীরা। ভাস্কর্যের পরিভ্রমণ অনেক বিস্তৃত। যদিও ইতিহাসে সবচেয়ে পুরনো যে ভাস্কর্য পাওয়া গেছে তা একটি টেরাকোটা এবং এর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক। মূর্তি শব্দটিই এসেছে মূর্ত থেকে। এই মূর্তি শব্দের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে রচিত প্রাথমিক উপনিষদে। তখন বলা হয়েছিল বস্তুগত উপাদান থেকে উৎপন্ন সুনির্দিষ্ট আকৃতি বা সীমাবদ্ধ কোনো কঠিন রূপই আসলে মূর্তি। ভাস্কর্যের মনুমেন্টাল গুণ এবং আলোছায়ার খেলা মানুষকে মোহিত করে রাখে একটা ভাস্কর্যে। এমন সব সচেতনাই পাওয়া যাবে ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর মূর্তিকলার নান্দনিক ছন্দে। তাঁর এক একটা কাজের ভাষা মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে রাখে মানুষকে কোন সন্দেহ নেই। অবাক হয়ে দেখতে ইচ্ছে করে পাটনা সচিবালয়ের শহিদ স্মারক, হোয়েন উইন্টার কামস, ভিকটিমস অব হাঙ্গার, চেন্নাইয়ের মেরিনা সৈকতের শ্রমের বিজয় মূর্তি বা ট্রায়াম্প অফ্ লেবার, চেন্নাই এবং কলকাতার গান্ধী, অ্যানি বেসান্ত কিংবা স্যার আশুতোষ – সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে তাঁর বলিষ্ঠ সব কীর্তি। নীরদ মজুমদার, প্রদোষ দাশগুপ্ত, পরিতোষ সেনের মতো প্রথিতযশা শিল্পীরা ছিলেন তাঁর ছাত্র। তবু তিনি কিন্তু বাঙালির হৃদয়ে আজও ততটা আলোড়িত নন। ডাণ্ডি অভিযানকে দলিল করবার বরাত তাঁকে দেওয়া হল। তিনি তখন একেবারে তাঁর জীবন সায়াহ্নে। দেবীপ্রসাদের মন নেচে উঠল, ভুলে গেলেন বয়স, শরীর, স্বাস্থ্য। ডাণ্ডি অভিযান যে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক মাইল ফলক, আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা। ১৯৩০শে এই সত্যাগ্রহের মাধ্যমে গান্ধীজি সবরমতি থেকে প্রথমেই লবণ আইন ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। সেসময় ভারতীয়দের লবণ তৈরি করা ছিল আইনত দণ্ডনীয়। তিনি জানতেন এই আন্দোলনে দেশের আপামর জনসাধারণ অংশ নিতে উৎসাহিত হবেন। এই দলিল ভাস্কর্যে প্রতিষ্ঠার মৌলিক দায়ভারে তাই দেবীপ্রসাদ অদম্য উৎসাহে নেমে পড়লেন। খসড়া তৈরি হয়ে গেল। যদিও বিশ্ব ভাস্কর্যের ইতিহাস বলে সপ্তম শতক থেকে ভাস্কর্য নির্মাণে পাথর, বিশেষত কষ্টিপাথরের ব্যবহারের সম সাময়িক ভাবেই ব্রোঞ্জ এর ব্যবহার শুরু হয়। ভারতীয় হিসেবে তো তিনিই এই দেশে ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের পথিকৃৎ। ব্রোঞ্জ মাধ্যমে দেবীপ্রসাদ সাবলীল কোন সন্দেহ নেই। পাশ্চাত্যের যে অর্গানাইজড্ প্রিন্সিপ্যাল বা ‘ব্যালেন্সড ফিলিং আপ অফ্ স্পেস’ নামক চিত্রশৈলীটি রপ্ত করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই চিত্রশৈলীকে ভারতীয় শৈলীর সঙ্গে মিশিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার দ্বারা অবনীন্দ্রনাথ প্রবর্তন করেছিলেন ‘নব্যবঙ্গীয় চিত্রশৈলী’বা ‘বেঙ্গল আর্ট’ ঘরানা। অবনীন্দ্রনাথের এই চিত্রশৈলীই অনুসরণ শুরু করেন দেবীপ্রসাদ। ভাস্কর্যের বিমূর্ততা নয়, বেঙ্গল স্কুল ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর ভাস্কর্যের প্রাণ পায় ভাস্কর্যের বলিষ্ঠ চলন। এই চলনে রদ্যাঁর রিয়ালিজমের প্রভাব পরিলক্ষিত হলেও দেবীপ্রসাদের নিজস্বতাও পরিলক্ষিত সন্দেহ নেই। শরিরের অ্যানাটমির ছন্দ ভাস্কর্যের ভিস্যুয়াল আর্টকে চলনের গতিতে আবদ্ধ করে তোলে। ব্রোঞ্জ একটা কাজকে অনেক অনেক বেশি স্থায়িত্ব দেয় তাই ব্রোঞ্জে তৈরি হয়ে গেল ‘ডাণ্ডি অভিযান’ মূর্তি। সমস্ত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে স্বাধীনতার দিকে ছুটে যাওয়ার এক আকাঙ্ক্ষায় এগারোটি মানুষ। ভাস্কর্যের প্রতিটি চলনের বলিষ্ঠ ভঙ্গি দেখলে শ্রদ্ধায় মন ভরে ওঠে। প্রথম মানুষটি নিঃসন্দেহে মহাত্মা গান্ধি, দুই নারী – মাতঙ্গিনী হাজরা এবং সরোজিনী নাইডু। একটি ফিগারে তিনি নিয়ে আসলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও চিন্তাবিদ ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে। সেই সাথে রাখলেন আব্বাস তায়েবজিকেও – ডান্ডি অভিযানে গান্ধিজির পরেই যাঁর স্থান। ভাস্কর্য দর্শনের প্রথম মন্ত্র- ভাস্কর্যের প্রতিটি টুকরা এক একটা চরিত্র। দেবীপ্রসাদ এই তত্ব খুব মানতেন। তাই তাঁর কাজে গান্ধীর লাঠিও যেমন চরিত্র হয়ে ওঠে, তেমন যে পেডেস্টাল বা তলের উপর ভাস্কর্যটি ধরে রাখার জন্য নির্মান করা হবে সেই তলও দেবীপ্রসাদের কাছে সমান মাত্রার চরিত্র হিসেবে ভাস্কর্যে উঠে আসে। ভাস্কর্যটি শেষ করার আগেই ১৯৭৫ সালের পনেরই অক্টোবর প্রয়াত হন ভাস্কর দেবীপ্রসাদ। শিল্পীর স্ত্রী এবং ছাত্রছাত্রীরা মিলে অসমাপ্ত কাজটিকে সমাপ্ত করেন।
ভারতীয় টাকায় একশ এবং দুইশ টাকা দীর্ঘদিন থাকলেও প্রথম ১৯৮৭ সালেই ভারতীয় অর্থরাশিতে ৫০০ টাকার আত্মপ্রকাশ। এই ইতিহাসের সাথে যেমন জড়িয়ে আছে গান্ধীজির ডাণ্ডি অভিযান তেমন এক বাঙালির কীর্তি যা আমরা কেউ খবরই রাখিনা। তিনি বাঙালি শিল্প সমৃদ্ধির অনাদরের এক ‘হীরামানিক’ ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। যাঁর ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য ‘ডাণ্ডি অভিযান’। কিন্তু এটাও বাস্তবতা যে ভাবে অনেক ইতিহাস আমাদের ইতিহাসের অতলে চাপা পড়ে যায়, সেই ভাবেই আবার টাকার নিয়তিতে দেবীপ্রসাদের ডাণ্ডি ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর। নোট বন্দীর পাঁচশ হাজারের নোট বাতিলের সাথে সাথে ওই নোট বাতিলের মতই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴