বাগানিয়া জার্নাল
পর্ব।।আট।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^
আগের পর্বে চিন ও জাপানের সবুজ-চা তৈরি করার পদ্ধতি বলা হয়েছে।
ভারতে
সবুজ-চা মূলত জাপানের পদ্ধতিতেই তৈরি করা হয়। গাছ থেকে পাতা তুলে এনে
দ্রুত তাকে বাষ্পে কিছুক্ষণ সিদ্ধ করে নেওয়া; তারপর জল ঝরিয়ে হালকা চাপে
একটু ‘রোল’ করে একবার হাল্কা ভাজা। একে বলে ফার্স্ট রোলিং এবং ফার্স্ট
ফায়ারিং। তারপর তাকে আবার কিছুটা রোল করে (সেকেন্ড রোলিং) আবার ভাজা হয়
(সেকেন্ড ফায়ারিং)। তারপর ঝাড়াই-বাছাই-গ্রেডিং (সাইজ অনুযায়ী)। দুবার রোল
করার জন্য ভারতের সবুজ-চা সামান্য ‘ফার্মেন্টেড’ (Light Fermented) ।
এখানকার সবুজ-চায়ের বিভিন্ন গ্রেড হলঃ লাচ্চা , ফাইন প্রিমিয়াম , মাজদানা,
সুপার ফাইন , মগরা-১ ,মগরা-২ ইত্যাদি...
#
এরপরে
হল আধা ফার্মেন্টেড চা –যা ১০% থেকে ৮০% ফার্মেন্টেড করা হয়। এই চা হালকা
হলুদ থেকে খয়েরি রঙের হয় এবং এতে সামান্য সুবাস (aroma) পাওয়া যায়। ঠিক
অর্ধেক ফার্মেন্টেশান (৫০%) হলে তৈরি হয় ওলং (Oolong),তার চেয়ে কম
ফার্মেন্টেশানে হয় পুচং (Pouchong) এবং বেশী ফার্মেন্টেশানে হয় শ্যাম্পেন
ওলং(Champagne Oolong)।
#
আর ১০০% ফার্মেন্টেশান পাতা থেকে তৈরি হয় কালো-চা (Black Tea).
কখনও
কখনও পাতাকে কিছুটা ফার্মেন্টেড করার পর তাকে ভেজে ফার্মেন্টেশান বন্ধ করে
দেওয়া হয়। তারপর তাকে আবার ‘রোল’ করে ফার্মেন্টেড করে আবার ভাজা হয়। এই
চা-কে বলে পু-এর-চা (Pu-Erh Tea)। চিনে পু-এর চায়ের বেশ প্রচলন আছে।
#
কালো-চায়ের গ্রেড বলার আগে একটু কাঁচা চা-পাতার কথা বলে নিতে হবে এখানে।
‘দুটি
পাতা একটি কুঁড়ি’-র মধ্যে যেটা ‘কুঁড়ি’– তা আসলে ডালের একদম মাথার না-ফোটা
পাতা।একে আমরা বলি অগ্র-মুকুল বা শীর্ষ-মুকুল (Terminal Leaf Bud/Apical
Bud)। চায়ের ভাষায় ‘টিপ’ (Tip)। এই টিপ বা কুঁড়ির দিকে ভাল করে দেখলে এর
গায়ে, (সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় কচি পাতায়ও সামান্য), ছোট ছোট অনেক সূক্ষ্ম
সাদা রোঁয়া চোখে পড়ে। এদের বলে ‘পিকো’ (Pekoe)। [ছবি.১ - কুঁড়ির পিকো]
পিকো
শব্দের অর্থ সুঁচ বা রোঁয়া। শব্দটার সঠিক উৎস জানা যায় না। কেউ অনুমান
করেন চিনের এ্যাময় (Amoy) ভাষায় এক রকম চা-কে বলা হয় pe̍h-ho যার মানে
সাদা-চুল। আর একদল মনে করেন báihuā (মানে সাদা ফুল)–যা এ্যাময় (Amoy) ভাষায়
pe̍h-hoe - তার থেকে এর উৎপত্তি।ইউরোপিয়ানদের ভুল অনুবাদ-উচ্চারণ থেকে এই
pe̍h-ho বা pe̍h-hoe হয়েছে Pekoe।
সে যাই হোক, আমাদের কালো চায়ের গ্রেডিং-এর ক্ষেত্রে ‘পিকো’ ভীষণ জরুরী।[ছবি.২ –তৈরি-চায়ের গায়ে পিকো।]
#
দার্জিলিং চাপাতা জলে ফোটালে দেখা যায় গোটা পাতাটা খুলে ছড়িয়ে পড়েছে।
কারণটা
আগেই বলা হয়েছে - পাতাকে রোলিং টেবিলে মুচড়িয়ে (Twist) দলাই-মলাই করা হয়।
আর এই রোলিং-এর ফলে কিছু পাতা গোটা থাকে, কিছু অর্ধেক ভাঙে, কিছু আরও একটু
বেশী ভেঙ্গে ছোট ছোট টুকরো-টাকরা আর বাকীটা চাপে গুঁড়ো গুঁড়ো।
তাই
তৈরি কালো চা-কে মূলত চারটে ভাগে ভাগ করা হয়ঃ গোটা-পাতা (Whole-leaf),
ভাঙা-পাতা (Broken-Leaf), টুকরো-টাকরা (Fannings) আর গুঁড়ো (Dust)।
গোটা পাতার (Whole Leaf) প্রথম গ্রেড এর নাম Finest Tippy Golden Flowery Orange Pekoe বা FTGFOP।
Tippy
মানে প্রসেসড চায়ের মধ্যে কুঁড়ি (tip) বেশী।‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ দিয়ে
তৈরি চায়ে যত বেশী কুঁড়ি থাকবে তত ভালো (এবং দামী)। কারণটা তো আগেই বলা
হয়েছে যে চায়ের গুণগুলো সবচেয়ে বেশী থাকে ওই কুঁড়িতে।
কখনও
কখনও শুধু মাত্র কুঁড়ি দিয়েই চা তৈরি করা হয়। কুঁড়ি ভাজার পর তার রঙ হয়
ছাই ছাই বা পুরনো ময়লা-পড়া রূপার মত।তাই এই চা-কে সিলভার-টিপস্ বলে। বোঝাই
যাচ্ছে এই চা-ই সর্বোত্তম। ফলে সবচেয়ে দামী।
‘Golden’,
‘Flowery’ এবং ’Orange’ – এই শব্দ তিনটে কেন ব্যবহার করা হয় – সে সম্পর্কে
কোন সুপ্রযুক্ত ও মনোমত উত্তর আমি পাইনি। কেউ কেউ বলেন এই চায়ের ‘লিকার’
সোনালি রঙের হয় বলে ‘গোল্ডন’। হতে পারে – কিন্তু এর কোন প্রামাণ্য সমর্থন
(authentic backup) পাই নি।তেমনই পাওয়া গেল না ‘ফ্লাওয়ারি’-র ক্ষেত্রেও।
কেউ কেউ বলেন ‘আধ-ফোটা কুঁড়ি’ অর্থাৎ কুঁড়িটা যখন ফুলের মত ফুটে উঠছে
(Flowery) – তখনও পুরোপুরি পাতা হয়ে ওঠেনি – সেই পাতার চা বোঝাতে
‘ফ্লাওয়ারি’ শব্দের ব্যবহার।
‘অরেঞ্জ’ নিয়ে দুটো মত প্রচলিত আছে।
প্রথম
মত বলে যে পনের-ষোল শতকে ডাচ ‘House of Orange-Nassau’ ছিল হল্যান্ডের
সবচেয়ে অভিজাত পরিবার এবং তারাই প্রকৃতপক্ষে (de facto) দেশের প্রধান ছিল।
ইউরোপে চা নিয়ে যাবার কেন্দ্রীয় ভূমিকায় ছিল ডাচ ‘ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানী’।তারাই ‘হাউস অফ অরেঞ্জ’-এর সঙ্গে চা-য়ের ঘনিষ্ঠতা তথা গুরুত্ব ও
গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য বাজারে চা-কে ‘অরেঞ্জ টি’ হিসেবে প্রচার
করেছিল -যেমন আজকের দিনেও সিনেমার নায়ক-নায়িকা বা নামী মানুষদের দিয়ে
বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হয়- (শাহরুখ 'ময়ূর' খান)।চিনদেশে বা জাপানে কিন্তু
চায়ের এজাতীয় কোন নাম নেই। এটা ইউরোপীয়দের দেওয়া।
দ্বিতীয়
মত বলে ভালো মানের পিকো-চাপাতাকে ঠিক মতো ‘ফার্মেন্টেশান’ করার পর যে
তামার রঙ হয় - ভাজার পর তা হয় উজ্জ্বল কমলা রঙের। তা থেকেই এই নাম।
সে যাই হোক এরসঙ্গে না কমলা ফল না তার গন্ধ – কোন কিছুরই কিন্তু কোন রকম সম্বন্ধ নেই।
#
গোটা
পাতার (Whole Leaf) এর পরের ‘গ্রেড’গুলো খুব মজার। গ্রেড যত নীচের দিকে
নামতে থাকে FTGFOP-র বাঁ দিক থেকে তত একটা একটা করে শব্দ খসতে থাকে –
TGFOP,GFOP,FOP এবং OP (Orange Pekoe)।
#
গ্রেডের
এই সব নামকরনের আদি কারণগুলো হারিয়ে গেলেও আমাদের এখানে এবং আশেপাশের
দেশগুলোতে নামকরণের প্রচলনটা এখন এভাবেঃ কুঁড়িকে বলা হয় ‘ফ্লাওয়ারি অরেঞ্জ
পিকো’, প্রথম পাতা ‘অরেঞ্জ পিকো, দ্বিতীয় পাতা ‘পিকো’, তৃতীয় পাতা ‘পিকো
সুচঙ্ (Pekoe Suchong)’, চতুর্থ পাতা সুচঙ ( Suchong) ... ইত্যাদি। [ছবি-
৩. নামকরণ]
সেই অনুযায়ী গোটা পাতার গ্রেডগুলো ধরা হয় এরকমঃ
Orange
Pekoe (OP) – গোটাপাতার শেষতম গ্রেড।পাকানো তারের মত লম্বা লম্বা
চেহারা।শুধু পাতা - এতে কোন ‘কুঁড়ি’ থাকে না। কুঁড়ির নিচের প্রথম ও দ্বিতীয়
পাতা থেকে তৈরি হয়।
Flowery Orange Pekoe (FOP) – এতে কিছু কুঁড়ি থাকে।
Golden Flowery Orange Pekoe (GFOP) – এতে FOP-র চেয়ে বেশী কুঁড়ি থাকে।
Tippy Golden Flowery Orange Pekoe (TGFOP) – এতে কুঁড়ি থাকবে অনেক বেশী।
Finest
Tippy Golden Flowery Orange Pekoe (FTGFOP) – সবচেয়ে বেশী কুঁড়ি।
কুঁড়িগুলো পূর্ণ বিকশিত অর্থাৎ ফোটার ঠিক আগের পর্যায়। ছাই বা রূপো রঙের
কুঁড়ি লম্বা এবং চওড়ায় সবচেয়ে বড়।
এরপরেও
কেউ শুধু কুঁড়ি দিয়ে বা বেশীর ভাগটাই কুঁড়ি দিয়ে চা তৈরি করে। তারা
FTGFOP-র আগে Special-র ‘S’ বসিয়ে SFTGFOP বাজারে ছাড়েন।যেমন সিলভার
টিপ্স বা ড্রাগন চা...বলাই বাহুল্য যে তার দাম নির্ধারিত হয় মার্কেটিং
স্ট্র্যাটেজি ও ব্রান্ড-এর ওপর...কেউ কেউ গল্প জোড়েন এই চা নাকি রাতের ভরা
চাঁদের আলোয় শুধু কুমারী মেয়েদের হাত দিয়ে গাছ থেকে তোলা (pluck) হয়,
তারপর দিনের রোদ আর রাতের শিশির খাইয়ে খাইয়ে ...
সে সব কথা পরে হবে...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া