সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
04-August,2023 - Friday ✍️ By- শুক্লা রায় 560

বন রুটি/শুক্লা রায়

বন রুটি
শুক্লা রায়
--------------

দোকানে ঢুকতেই ছেলেকে দেখে বুড়োর মুখটা নিমেষে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হাসি হাসি মুখটা অকস্মাৎ নিভে গেল । একটু ইতস্তত করে বেরিয়ে যাবে কিনা যখন ভাবছে তখনই ছেলের গম্ভীর গলা, 'তুমি আবার সকালবেলা দোকানে কেন?' ক্ষিতীশ কিছু বলতে পারে না, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় একটু। তারপর কিছু না বলে দরজার দিকে ঘুরে ফেরার উদ্যোগ করতেই হরিপ্রিয়া এসে খপাৎ করে হাতটা ধরে। যত্ন করে ধরে নিয়ে কাঠের বেঞ্চে বসাতে বসাতে বলে, "দাদাকে আমি আসতে বলেছি। আমার দোকান আর দাদা আসবে না হয় নাকি?" উপস্থিত সবাই মাথা নাড়লেও মনে মনে সবাই জানে এই হরিপ্রিয়া ক্ষিতীশের পেছনে কত ঘুরঘুর করেছিল একসময়। ওই পুরনো প্রেমটাই বোধহয় এখনো আছে। ক্ষিতীশের ছেলে মোটা বেকারী বিস্কুট দিয়ে চা খায়। তারপর বিরক্ত মুখে শুধু নিজের চায়ের দামটুকুই দিয়ে উঠে যায়। ক্ষিতীশ কিছুটা অসহায়ভাবে ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। 
হরিপ্রিয়া পাড়ারই মেয়ে। এই গ্রামেই বেড়ে ওঠা। কোথায় একটা বিয়ে হয়েছিল নাকি ওর বাড়ির লোকই বেচে দিয়েছে নিশ্চিত কেউ কিছু জানে না। গ্রামের স্কুলে পড়ছিল তখন। বেশ কয়েকবার ফেল টেল করে অবশেষে নাইনে উঠেছে সেবার। তদ্দিনে চেহারা-পত্র, চলন-বলন সবই দেখনদার হয়েছে। যদিও গায়ের রঙটা কালো বলে কালো। যাকে বলে হা কুচ্ছিত কালো। কিন্তু বয়সের ধর্মে কালো মেয়েটিরও ডাগর-ডোগরটি হতে বাধা নেই কিছু। অনেক পাত্র পক্ষ এল, গেল। কিন্তু কথা কিছুই আগায় না। সবাই ওই কালো রঙটাতেই ধাক্কা খায়। যাও বা পছন্দ করে দাবী দাওয়া বেশি। হরিপ্রিয়ার ঠাকুর্দা বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষ। লোকের বাড়ি কামলা দিয়ে খেটে খেতে খেতে ভিটেটুকু করতে পেরেছে। তারপরেই বাকি পরিবারকে পার করে এখানে নিয়ে এসেছে। তার বংশধররা এখনও কেউই সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। গায়ে-গতরে খেটে দিন গুজরান। নয়ত বাড়ির কলাটা, মুলোটা সবই বেচার জন্য হাটে যায়। তা হরিপ্রিয়ার জন্য গুচ্ছের টাকা দিয়ে বর কেনা সম্ভব হয়নি। সেই হরিপ্রিয়াকে হঠাৎ করে তার বাড়ির লোকজন কোথায় নিয়ে গেল বিয়ে দিতে। কোন আত্মীয়ের বাড়ি। তার আর খোঁজ-খবর নেই। বাড়ির লোকেও দিব্বি আছে। জানা গেল বিহার দেশে মেয়ের সংখ্যা কম। বিহার থেকে পাত্রপক্ষ এসে বিয়ে করে নিয়ে গেছে। ওরা তো বাড়ির বাইরে বের হতে দেয় না, তাই মেয়েও আর আসতে পারবে না। কিন্তু সে এল। কোলে একটা ছেলে নিয়ে কি করে বা পালিয়ে চলে এল। এসেও তার নিজের সম্পর্কে কিছুই বলে না। একই কথা বলে। বিয়ে হয়েছে বিহারে। খুব অত্যাচার। বাড়ির বাইরে যেতে দেয় না। সেজন্য পালিয়ে এসেছে। এসে তো পড়ল। দাদাদের সংসারে কী আর জায়গা হয়! অবশেষে অনেক ঝগড়া করে ওখানেই মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু পেল কোনোরকম, পেট চালাবার দায় যার যার তার তার। শুরু হল আর এক যুদ্ধ। কোন যুদ্ধ শেষ করে বা মেয়েটা অ্যাদ্দিনে বাড়ি ফিরতে পেরেছে সে খবর আর কেউ রাখল না। বাচ্চাটাকে পিঠে বেঁধেই মাঠ-ঘাটের কাজে নেমে পড়ল। প্রথমে খুব বেশি কথা বলতে চাইত না। স্কুলে যে মেয়েটা ছটফটে চঞ্চল ছিল, ফিরে আসা মেয়েটার মধ্যে ছিঁটেফোটাও সে প্রাণচঞ্চলতা ধরা পড়ল না। কেমন যেন নির্জীব, ক্লান্ত। নারীসুলভ সাজগোজ কিছুই নেই। কোনোরকম শাড়িটা জড়ানো শরীরে।কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকে না। ধীরে ধীরে ভেতরের ক্ষত যা ছিল শুকিয়ে গেল। পোড়া দাগ মেলাতে না মেলাতেই হৃদয় আর একবার পুড়বার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠল। 
হরিপ্রিয়া দেখল যে পুরুষ মানুষ তাকে বিয়ে করতে মোটা পণ দাবী করেছিল, বিয়ের পর গোপনে প্রেম করতে তার কোনো অসুবিধা নেই। ব্যাপারটা যেন হরির লুটের বাতাসা, হাত বাড়ালেই মুঠোয় চলে আসবে। হরিপ্রিয়ার অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এরকমই একটা জীবন থেকে ও বেঁচে ফিরেছে। পুরুষ ওকে তছনছ করেছে নিজেদের মতো, কিন্তু ওতে প্রেম ছিল না। শুধু শরীর ছিল।
আসলে হরিপ্রিয়া নিজেও তো জানত না তার বিয়ে হয়েছে কিনা। গিয়ে একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকেছে, তাদের ভাষা ও বোঝে না। সময় মতো খাবার মিলত, এই পর্যন্তই। আর চিনেছে একটিমাত্র পুরুষকে। যদিও মুশকো কালো মাঝবয়সী লোকটাকে বর বলে মানতে তার কষ্ট হয়েছিল খুব। তবু প্রথম তিনমাসের মতো সেই লোকটিই ছিল তার স্বামী। তারপরে যেদিন প্রথম অন্য লোক এল, হরিপ্রিয়া অবাক হল, কাঁদল, প্রতিবাদ করল। তারপর ধীরে ধীরে সয়ে গেল। শুধু একবারটি জানতে ইচ্ছে করেছিল ওর বাবা-মা কি জেনেশুনেই তাকে এই অন্ধকারে ঠেলে দিল নাকি তারাও ঠকলেন? কী করে জানবে। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বাড়ি, পালানোর উপায় নেই। যখন ফিরল তখন বাবা আর বেঁচে নেই। বয়স বাড়তে পাহারা কমে এল। সেই সুযোগে হরিপ্রিয়া অনেক কষ্টে পালিয়ে এল। প্রথমেই অবশ্য গ্রামে ফিরতে পারেনি। অনেক ঘুরে তবে নিজের ঠিকানায়। এসব কাহিনী কেউ শুনতে চায়নি। সবাই ওর শীর্ণ চেহারার ভেতর গোপন রঙ খুঁজেছে। আর পুরুষ খুঁজেছে কাছে আসার ছুতো। প্রথম দিকে এসব পাত্তা দিত না। নবমশ্রেণীর মেয়েটা পড়ার বইয়ের বাইরে জীবন থেকেই আসলে শিখেছে বেশি। পুরুষ জাতটাকে দু'চক্ষে দেখতে পারে না। তবু সেই চোখেই রঙ লাগল একদিন।
একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে প্রচুর রসিকতা চলে। হরিপ্রিয়া পুরুষবিহীন। হরিপ্রিয়া একা একটা বিছানায় ঘুমায়। এসব ভাবনায় ওর থেকে প্রতিবেশীরা বেশি বিচলিত। ওর দিকে তাকালে অনেকেরই মুখের লাগাম ছুটে যায়। হরিপ্রিয়া সেসব তাকিয়েও দেখে না। কিন্তু তবু যেন কী একটা হয়ে গেল। হঠাৎই। পর পর দুদিন জ্বর। হরিপ্রিয়া কাজে গেল না। ছেলেটা শুকনো মুখে কী করছে কোথায় ঘুরছে ভগবান জানে, বিছানা থেকে ওঠার উপায় নেই। জ্বরটা একটু কমতেই বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। টাল সামলে উঠতে না উঠতেই দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে ক্ষিতীশ। মনটা বিস্বাদ হয়ে গেল। নিজের ত্রিসীমানায় ও কোনো পুরুষ মানুষের উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না। আর ক্ষিতীশ তো আবার বউ মরে যাওয়া ঝাড়া হাত পাওয়ালা লোক! মুখটা কালো করে বসে থাকল। ক্ষিতীশ যেন হাওয়ার দিকে তাকিয়ে  কথা বলল, "গ্লাসে দুধ আছে আর কাগজে বনরুটি। খেয়ে নিও।" বলে আর দাঁড়াল না। ছেলেটা হাতে একটা বনরুটি নিয়ে দরজার কাছে গোগ্রাসে গিলছে। দৃশ্যটা দেখে হরিপ্রিয়ার রাগটা ফণা তোলার আগেই অসহায়ভাবে কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু হরিপ্রিয়া যা ভেবেছিল তা হল না। ক্ষিতীশ বরাবরের মতোই চুপচাপ নিজের কাজ করে যেতে লাগল। একবারও ওর উপকারের কথা তুলল না। একদিন গেল, দুদিন গেল। হরিপ্রিয়া মানুষটাকে চেয়ে চেয়ে দেখে। বউ নাই। মরেছে সেই কোন কালে। ছেলের কথা ভেবে বিয়ে করেনি। নীরবতার মধ্যেও কী একটা ভাষা আছে। হরিপ্রিয়ার বুক উথাল-পাথাল। কিন্তু মানুষটা চেয়ে দেখে না। দল বেঁধে ধান কাটে। দুপুরের খাবার দোকান থেকে কিনে আনা দুটো বনরুটি আর চা। অথবা হাটখোলার দোকান থেকে কিনে আনা নুন-চিনি দিয়ে বানানো সস্তার সুজি আর আটার রুটি। সকালেই সেদ্ধ ভাত খেয়ে কাজে বের হয়। আবার সেই রাতে গিয়ে রাঁধা-বাড়া। খাওয়ার সাথে জমিয়ে গল্প, আড্ডা। এতদিন হরিপ্রিয়া চুপচাপ সবার কথা শুনত। বলত না কিছু। ধীরে ধীরে যেন তার চপলতা প্রকাশ পেতে লাগল। হাসি ফুটল ঠোঁটে। তার সাথে চুলে তেল, চিরুনির ছোঁয়া। কিন্তু মানুষটা যেন মূক ও বধির। তাকে ছোঁয়া যায় না কিছুতেই। "মা, চা দাও।" ছেলের ডাকে বাস্তবে ফেরে হরিপ্রিয়া। জমজমাট চায়ের দোকান এখন তার, মা-ছেলের। ঘন দুধে যত্ন করে বানানো চা-টা ক্ষতীশের কম্পিত হাতে তুলে দেয়। সেই চোখ, সেই চাহনি! নীরবতার মধ্যেও সে চোখের প্রেম চিনতে ভুল করেনি হরিপ্রিয়া। পরজন্মের অপেক্ষায় এ জন্মে তাদের প্রেমকে সংরক্ষণ করেছে দুজনেই।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri