পইলা সাঞ্ঝির কথা/৮
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৮
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
ঘড়ি পিন্দা চেংরা
>>>>>>>>>>>>>
রোজকার মতো গরু বাছুর বাইরে বের করে কান্তেশ্বর ঘরে ঢুকে আগে রেডিওটা চালিয়ে দিল। রেডিওতে তখন প্যাঁ করে সানাই বাজছে। বসমতী বলে,
“এলাইতে এডিওটা চালাইলেন, মানষিগিলায় এলাং উঠে নাই, দেখ তো কেমতোন করি বাজাছে।"
কান্তেশ্বর এসব কথায় কান দেয় না। টিউবওয়েলের পাশে বাঁশের বেড়া থেকে আগের দিনের ভেঙে রাখা নিম ডালটা নিয়ে দাঁতে চিপে ধরে বাঁ হাতে মর্নিং ফ্রেশ পাউডার ঢেলে নেয়। তারপর ওটা দাঁতেই চিবিয়ে নরম করে মাজন শুরু করে। আসলে ঘোষক অতনু চৌধুরীর ‘সুপ্রভাত’ উচ্চারণটাই যেন অন্যরকম। যেন সদ্য ঘুম ভাঙা কন্ঠস্বর। সেই কন্ঠস্বরের মাধুর্য সারা উঠোন ছড়িয়ে পড়ে। কান্তেশ্বর ভেবে পায় না, গান নয় বাজনা নয় কথা বলার গলাটাই এত সুন্দর কি করে হয়! ওই একটা কন্ঠস্বরের জাদুতেই কান্তেশ্বরের সকালটা অন্যরকম হয়ে যায়। সকালের গায়ে যেন অদৃশ্য ডানা গজায়, ফু্রফুর করে হাওয়ায় ওড়ে।
ছেলে-মেয়ে দুটোকে ডেকে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়। চায়ের কাপ আর মুড়ির বাটিটা হাতে নিয়ে উঠোনে আসতে না আসতেই বসমতীর গলা শুনতে পেল। কান্তেশ্বরের নরম-সরম ডাককে পাত্তা না দিলেও বসমতীর এক ডাকেই দুজনে নিমেষে কলপাড়ে । ‘রঘুপতি রাঘব রাজারাম, পতিত পাবন সীতারাম’ ততক্ষণে শেষ।
পূরবী দত্ত-র নজরুলগীতি শুরু হতেই কান্তেশ্বর রেডিওটা নিয়ে একটু ঘরের পাশ থেকে দূরে সরে আসে। বাচ্চাগুলো এত চেঁচায় যে ঠিকমতো কিচ্ছু শোনা যায় না। সাড়ে সাতটার খবরটা ও খুব মন দিয়ে শোনে।
“গান শুনছেন বারে”?
পুণ্য বুড়া লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে উঠোনে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে দুটো গলা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল
“আজু, তুই আরো আজি নাটি নিসিত কেনে”?
তাই তো! কোমড়ে আবার ব্যথা ট্যাথা হল নাকি? বুড়া একটা ধমক দিয়ে বলে,
“তোমার ওইলা পড়া না সরা! যেদি সেদি মন দেন? কায় নাটি ঢোকা দি বেড়াছে, কায় আস্তা দি যাছে –এইলা না দেকি বই পড়।"
তারপর কান্তেশ্বরের দিকে তাকিয়ে একটু দুঃখী দুঃখী গলায় বলল,
“কি করিবেন বারে, ওয়াখান ঘাসে সার হইসে। কামলা নিবার পাইসা কোটে? এই বুড়া বয়সে কমর হ্যাঁকড়ে ওয়াখান নেকাছোং, তে কোনেক বিষ হইসে”।
বলে, সাবধানে লাঠিটা একপাশে বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে রেখে আয়েস করে বেঞ্চে বসে। বসমতী বুড়োকে দেখেই আর একবার চায়ের জল চড়িয়ে দেয়। বুড়াও আগে বসমতীকে বৌমা করে ডাক দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। উত্তর পেলে নিশ্চিন্ত হয়ে আগের প্রসঙ্গে ফিরে যায়।
“গানলা তো শুনিবার ভাল, তে বেটারি যে নাগে বারে। হামার এডিওটা বাজায় হয় না। বেটারি কিনিবারে পাইসা নাহয়। অকোদিন না শুনিলুং। গান শুনিলুং, মহিলা মজলিশ না কি কয়, হোটাও শুনিলুং। অই যে মহিলাটা, কি সুন্দর কাতা কয়। বেশ সুন্দর নাগে।"
কান্তেশ্বর বলে, “মুক্তি চন্দ নাম কাকা”
পুণ্য বুড়া খুশি হয় শুনে,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, মুক্তি চন্দ। একদিন আরো কম ত্যালত পোটোল ভাজা সিকাইল। তোর কাকিও শুনিল।"
"তে এলা কি কাকি অল্প ত্যালত পোটোল ভাজে বারে?”
কান্তেশ্বরের কথায় পূণ্য বুড়া একটু লজ্জা পায়।
“হামা কি ভাজা শাক বেশি আন্দির পাই বারে! দৈব্যে কুনোদিন ভাজা আন্দে। তাও শুনি, গালাখান শুনিবার ভাল নাগে। এত যে মিঠা গালা বারে!"
কান্তেশ্বর মাথা নাড়ে। দুপুরের অনুষ্ঠানগুলো শুনতে পারে না ছুটির দিন ছাড়া। তবু রেডিওটা আছে বলে গ্রামের মানুষ একটু বাইরের খবর টবর পায়। গ্রামের অনেক বাড়িতেই রেডিও আছে। সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঘরে বেজে ওঠে নানা অনুষ্ঠান। তবে সবাই ব্যাটারির খরচ পোষাতে পারে না, এও সত্যি কথা। কারো কারো রেডিওটার জীর্ণ দশা। মাঝখানে কাপড়ের ফিতে বাঁধা, কারো রেডিও চালিয়ে দু-চারটা থাপ্পর না মারলে আওয়াজ বের হয় না। কারো রেডিও খাদ্যের অভাবে ধুঁকছে। প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া ব্যাটারি কয়েকবার রোদে শুকিয়ে নিয়ে চালানোর চেষ্টায় অদ্ভুত ঘররর ঘররর আওয়াজের প্রতিবাদ উঠিয়ে বাজছে। একেকটা অনুষ্ঠানেরও একেক রকম গুরুত্ব। আবহাওয়ার খবর, চাষবাসের টুকিটাকি, খেলার খবর আরো কত কি। সন্ধ্যাবেলার আড্ডাখানায় রেডিওর নানান অনুষ্ঠান নিয়েই একচোট আলোচনা জায়গা করে নেয়। হুঁকা, ছিলিম, তামাক, দোতারা, সারিঞ্জা, ভাওয়াইয়ার সাথে রেডিওটাও সমান গুরুত্বে অধিষ্ঠিত থাকে।
রেডিও শুধু বাড়ির ভেতর আবদ্ধ থাকে না, মাঠে রোয়া বোনার সময় বড় কালো ছাতাটির নিচে রেডিও বাজছে, রোয়ার আগাছা উপড়ে ফেলার সময় মাঝ মাঠে দূরে দূরে রেডিও বাজছে। লোকগীতির অনুষ্ঠানে যেদিন ভাওয়াইয়া বাজে সেদিন তো সে গান রেডিওর সাথে আশপাশের সবার কন্ঠেও উঠে আসে।
রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কারো বাড়িতে রেডিও বাজলে মানুষ দু দন্ড দাঁড়ায়, একটু শোনে তারপর গুনগুন করতে করতে নিজের পথ ধরে। কখনও বা হাতে একটু সময় বেশি থাকলে বাড়ির ভেতরেই ঢুকে পড়ে, কথায় কথায় পেরিয়ে যায় অনেকটা সময়। পান সুপুরি দাঁতে ভাঙতে ভাঙতে হঠাত চমকে উঠে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায়।
আসলে ‘চোর-চুন্নি’, ‘কুষানযাত্রা’, ‘দধিকাদো’ ‘হা-ডু-ডু’, নানান যাত্রার আসর আর পালাগানের সঙ্গে রেডিও ও আমাদের সমাজ জীবনে একটি অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসার জায়গা করে নিয়েছে। আর জায়গা করে নিয়েছে অতনু চৌধুরী, মুক্তি চন্দ। মানুষের হৃদয়ে, শুধুমাত্র অপূর্ব কন্ঠশ্বরের গুণে, ভাষা আলাদা, কথা বলার ভঙ্গি আলাদা। তাতে কি! কন্ঠের জাদুতেই তাঁরা পৌঁছে গেছেন আমাদের হালুয়ার পরিশ্রমী জীবন থেকে বাড়ির অন্দরমহলে।
মুড়ির বাটি আর চা-টা এগিয়ে দিতে দিতে বসমতী জিজ্ঞেস করে,
“বাড়িত চা খাইসেন বা”?
পুণ্য বুড়া খুব সাবধানে গরম চায়ের কাপটা বেঞ্চের একপাশে নামিয়ে রেখে মুখ তুলে তাকিয়ে একগাল হাসে, তারপর গলায় জোর এনে টেনে টেনে বলে,
“খাসুং বারে, নুন-চা। ভুবুরা ভাজিসে তোমার মাও, অইলায় চাইট্টা চবেয়া আসিলুং। দুধ চা কেনায় খাবার জইন্যে এঠে আইসোং”।
বসমতী কলপাড়ে সকালের বাসনগুলো মাজতে বসেছে। মাজতে মাজতেই বলে
“আজি কেনেতে দেরি করিলেন বা?"
বুড়া মুড়ি চিবোতে চিবোতে জবাব দেয়,
“অই যে ঘাটাত মন্তেশ্বরের সাতে দেকা হইল, জাঙ্গোই আইচ্চে, হাটখোলা থাকি ডিমা কিনি দিয়া কাজোত যাবে। দুপুরে আন্দিবে বাড়িত, না হলে এলায় কোটে পাবে।"
তারপর একটু থেমে গলায় তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলে,
“উয়ার যে জাঙ্গোই বারে, যে বোলে আলসিয়া, কাজ কামাই কোনোই না করে। উয়ার দাদাটা আর বাপটায় কাজ করে। হাল কিসসি, তামাল্লায়! উয়ায় এই তো, সাগাই বাড়ি সাগাই বাড়ি করিই বেড়ায়। আসিলে তো সেজারির খ্যাড় গুন্ডা করি যায় এখেরে!"
এরপর একটু থামে। থেমে গলাটাকে বিশ্রাম দেয় যেন। তারপর বলে,
"জাঙ্গোইটার খানেরও ফুটানি আছে বলে। মসলা ছাড়া সুদায় খাবারে না চায়। ইমিরা দিন মিলি দিন খায়, এত কোটে থাকি পাবে!"
বসমতীও জানে এ কথা। তবু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“বুজুক খেনে মাইটা হামার এলা, উয়াক বোলে ঘড়ি পিন্দা চেংরা নাগে, না হলে না করে বিয়াও! ঘড়ি পিন্দা চেংরা কি আর হামার হাল কিসসির কাম করির চায়! উয়ায় তো বাউদিয়া হয়ায় ঘুরি ব্যাড়ের চাবে!"
কথাগুলোর সাথে সাথে একটা গোপন বিষন্নতা উঠোনে ছড়িয়ে যায়, তার সাথে পাড়ার মেয়েটির অনাগত ভবিষ্যতের দুর্গতির কথাও মনে ভেসে বেড়ায়।
সাড়ে সাতটার খবর শেষ হয়েছে কখন যেন, উঠোনে এখন দেবব্রত বিশ্বাসের নিবিড় কন্ঠশ্বর বেজে চলেছে সাবলীল গতিতে।
................................................................
ভুবুরা - চালভাজা
সেজারির খ্যাড় - বিছানায় পাতার জন্য চটের ভেতর খড় ঢুকিয়ে গদির মতো মোটা করা হয়। ওগুলোকেই সেজারির খ্যাড় বলে।
..................................................................
ছবি : ময়ূখ রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴