নানা রঙের গানগুলি-৮/শৌভিক কুন্ডা
নানা রঙের গানগুলি-৮
শৌভিক কুন্ডা
-----------------------------
বিকেলের সব পথই চলে যায় খোয়াই ছুঁয়ে শনিবারের হাটে। পায়ে পায়ে এগোই। হাটের মুখেই গাছের নীচে ভীড়ে ভীড়। এ আস্তানা কার, জানি আমি। একবার দেখা না করলে অন্যায় হবে। অতএব ভীড় ঠেলি। লক্ষ্মণ দাস বাউল চোখ বুঁজে গেয়ে চলেছে "মিলন হবে কত দিনে"! ভীড়ের বাবুবিবিরা অনেকেই "মনের মানুষ " দেখে বাউল চিনেছেন। গান শেষে লক্ষণের চোখ হাসে আমায় দেখে। সুঠাম হাত বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে কেঁদে ওঠে সুরে, "বনমালী তুমি / পরজনমে হয়ো রাধা"! আমার উৎসব সার্থক হয়। বাপিকে হাত নেড়ে এগোই। হ্যাঁ, লক্ষ্মণ দাস বাউল আমার কাছে বাপি-ই। ওরই বাবা সেই তরুণ দাস বাউল, যাঁর কথা আগের পর্বটিতে লিখেছি। যিনি আমায় নিয়ে এলেন এই জগতটিতে!
উল্টো পথে হেঁটে যাই। সুধীর ক্ষ্যাপার গাছতলায়। ছেলে গৌতম দাস বেশ নাম করেছে ইদানীং, কিন্তু আমার মন বাঁধা ক্ষ্যাপা বুড়োর কাছেই। সামনা হতেই বুড়ো হৈ হৈ করে জড়িয়ে ধরে, "জয়গুরু! আজ তো দেখি চাঁদের হাট! ওদিকে দ্যাখো, কে এসেছেন!" ওর নজরের অনুগামী হই, বাপরে বাপ, বাউলরাজা, ইঞ্জিনিয়ারকবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী, লালধুলোর দেশে মেঠো মানুষগুলোর 'অরুণদা'! চোখ ইশারায় বসতে বলেন, তারপর গলা মেলান সুধীর ক্ষ্যাপার সাথে, "আমার মনচাষা চিনলা না তুমি/এ আমার স্বর্ণভূমি"।
গতবছর একটি গানের ৫০ বছর পেরোনোর উৎসব হ'ল! সহজিয়া ফাউন্ডেশন আয়োজন করেছিলো, নন্দনে, ৮ই জুলাই, ২০২২।
‘‘সময়টা এপ্রিল মাস। শ্রীরামপুর স্টেশনের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, নাকে এল পরিচিত গন্ধ। এই সেই গন্ধ যার আবেশ আমাকে মাতাল করে দেয়। এখানে মহুয়া? পাতাহীন গাছের অজস্র ঝুমকো মহুয়া ফুল যেন আমাকে ডাকছে। রুমালে কিছু ফুল নিয়ে রাখলাম। মনের ভিতর একটা কষ্ট হচ্ছিল। ওকে এখানে দেখে মনে হয়েছিল, বড্ড বেমানান। এই ধান, আলুর দেশে ও কেন? মহুয়া তো জঙ্গলমহলের রানি! ওকে তো সেখানেই মানায়। ওর গায়ে জড়িয়ে আছে আদিবাসী গন্ধ। ও তো লাল মাটির গাছ। তার পর আমার মনের রঙে কখন যে লিখে ফেললাম গানটা!’’ আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানিয়েছিলেন কবি অরুণ চক্রবর্তী। হ্যাঁ, লোক্যাল ট্রেনে যেতে যেতে স্টেশনের ধারে মহুয়া গাছটিকে দেখে যে কথাগুলো লিখেছিলেন, ১৯৭৯ সালে ভি.বালসারার আয়োজনে ঝুমুর গায়ক সুভাষ চক্রবর্তী প্রথম তাতে সুর ছুঁইয়ে গান হিসেবে ক্যাসেটের মাধ্যমে বাঙালির কাছে নিয়ে আসেন। আরও পরে জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড 'ভূমি' গানটি রেকর্ড করে। সুর প্রচলিত, কিন্তু গীতিকারের নামের স্বীকৃতি না থাকায় বেশ বিতর্ক শুরু হয়। লালপাহাড়ির ৫০ বছর উপলক্ষে ভূমির সৌমিত্র সাক্ষাৎকারে জানান,
‘‘এক অনুষ্ঠানে বাসুদেব বাউল গাইছিলেন ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’। আমরা ‘ভূমি’-র সবাই ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। গানটা এত ভাল লেগেছিল, রেকর্ড করে নিই। এর পর কোচবিহার যাচ্ছিলাম অনুষ্ঠান করতে, ট্রেনে একজন বাউল উঠলেন। উনিও সে দিন 'লাল পাহাড়ি' গাইছিলেন, সঙ্গে ছিল ‘ও নাগর’। সে দিনই আমরা ঠিক করি, গানটা রেকর্ড করব।’’
বিতর্ক প্রসঙ্গে সৌমিত্রর জবাব, ‘‘গীতিকারের নাম জানতাম না। তাই উল্লেখ করিনি। ভুল করেছিলাম। পরে অরুণদার কাছে ক্ষমাও চেয়েছি।" দোষ সৌমিত্রের নয়। অনেকেরই জানা ছিলো না, আজও হয়তো নেই, "প্রচলিত লোকগান" তকমা বয়ে চলা এই গানটির রচয়িতা কবির নাম। এমনকি যে বাসুদেব বাউলের কথা সৌমিত্র তাঁর সাক্ষাৎকারটিতে বলেছেন, সেই বাসুদাও জানতেন না। জলপাইগুড়িতে একটি অনুষ্ঠানে বাসুদাকে নিয়ে এসেছিলাম, সেখানে এই শ্রদ্ধেয় বাউলশিল্পী শ্রোতাদের সে কথা জানিয়েওছিলেন এই ভাষায়,
"বাউল সবাই হয় না। আবার গান না গেয়েও তেমনটা হতে পারা যায়। যেমন শৌভিক দা। উনি মনে-প্রাণে বাউল। আমরা এখন বাউলগীতি ছাড়াও নানারকম লোকগান গেয়ে থাকি। তারই একটি এখন গাইবো। এ গান আমি গাইছি বহু বছর হ'ল, কিন্তু এর ইতিহাস আমার জানা ছিলো না। শৌভিক দার কাছ থেকেই জেনেছিলাম।" তারযন্ত্রে আঙুল খেলিয়ে গান ধরেন বাসুদেব দাস,
"হাই দ্যাখ গো/ তুই ইখানে কেনে,
ও তুই লাল পাহাড়ির দেশে যা/ রাঙামাটির দেশে যা
হেথাকে তুকে মানাইছে নাই রে/ ইক্কেবারেই মানাইছে নাই রে…’
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴