সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
16-December,2022 - Friday ✍️ By- নীলাঞ্জন মিস্ত্রী 516

তিস্তাবাথান-৮

তিস্তাবাথান
পর্ব : আট
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
"""""""""""""""""""""
 
তিস্তার জলে হাতি ডোবার অনেক ঘটনা রয়েছে। ‘গজলডোবা’ নামটির সাথে কমবেশি আমরা সকলেই পরিচিত। পর্যটনের হাত ধরে গজলডোবা আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জী’র স্বপ্নের প্রকল্প ‘ভোরের আলো’ ধীরে ধীরে তার ডালপালা মেলেছে। গজলডোবা নামটি হবার পেছনে কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে। গজ অর্থাৎ হাতি এই স্থানে জলে ডুবে মারা গিয়েছিল জন্যই নাকি এমন নামকরণ। আবার অনেকে বলেন যে- এই স্থানে গজার মাছের অনেক ডোবা ছিল। গজার মাছ হল সেই মাছ যাকে আমরা সাটি, ল্যাটা বা টাকিমাছ বলি। গজলডোবা অঞ্চলে যে টাকি মাছের প্রাচুর্য ছিল সে বিষয়ে কোন দ্বিমত থাকার কারন নেই। গজলডোবা লাগোয়া যে চরটি রয়েছে তার নাম এখন টাকীমারির চর। আগে তার নাম ছিল খটখটির চর। এই নামের পরিবর্তন ঘটেছে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের পর-ই।  যাইহোক, ‘গজার মাছের ডোবা’ বা ‘গজের জলে ডোবা- যেভাবেই হোক না এই নামকরণ, এর রহস্য উদঘাটন করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তবে আমার ব্যক্তিগত বিচারে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিকেই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছে।  

১৯৭৬ সালের আগে গজলডোবায় তিস্তা ব্যারেজ ছিল না। তারও আগে গজলডোবা অঞ্চল ছিল বড় বড় গাছ আর ঘন জঙ্গলে ঢাকা। টাকীমারির চরে আজ পাকা রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-স্বাস্থ্যকেন্দ্র সব হয়েছে। অথচ ১৯৫০ সালেও এই অঞ্চল ছিল ভীষণ দূর্গম। জঙ্গল আর বন্যজন্তুতে ভরা ছিল এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। বোদাগঞ্জ ফরেস্ট, বৈকুন্ঠপুর বনাঞ্চল, আপালচাঁদ ফরেস্ট, কাঠামবাড়ি ফরেষ্ট এখনও গজলডোবা অঞ্চলের তিস্তা অববাহিকাকে সবুজ দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এখান থেকে মাঝে মাঝেই হাতির দল পথ ভুলে প্রবেশ করে তিস্তাবক্ষে। কয়েকবছর আগেও হস্তি-শাবকদের তিস্তার জলে ভেসে যাবার ঘটনা খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছিল। তাই এই স্থানে হাতির জলে ডুবে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়। যদি নামকরণের ইতিহাস হয় গজের জলে ডোবা, তবে বলতেই হয় এ নামকরণ সার্থক।

মৈষাল বন্ধুদের কাছ থেকে টাকীমারি চরের বাথানের অনেক গল্প শুনেছি। তখনকার দিনে বড় বড় সব বাথানের ঠিকানাই ছিল টাকীমারির চর ও গোলাবাড়ির চর। সে গল্পে না হয় পরে আসা যাবে। এবার না হয় প্রিয় পাঠকবর্গের সাথে ঘুরে আসি  টাকীমারির চর থেকে আরো আগে গজলডোবা ছাড়িয়ে তিস্তাচরের ‘পাথরঘাটা’ নামক জায়গাটিতে। গজলডোবা থেকে শুধুমাত্র  ভাটির দিকে নয় তার উজানেও ছিল মহিষের চারণভূমি অথবা মৈষাল বন্ধুদের বিচরণ ক্ষেত্র। তিস্তার পশ্চিম পারের ‘পিয়াজী বাড়ির ঘাট-এর পর-ই ছিল ‘বুড়ির টুম’। তারপর ‘দুধিয়ার ঘাট’। আর এই দুধিয়ার ঘাটের পর-ই ‘পাথরঘাটা’। পাথরঘাটার আর একটি নাম ‘পখীহাগা’। বঙ্গের উত্তরে ‘পখীহাগা’ নামে আরও কিছু স্থান রয়েছে। কিন্তু এই ‘পখীহাগা’একান্তই তিস্তাবক্ষের 'পখীহাগা'। মৈষাল বন্ধুদের রসনা তৃপ্তির ‘পখীহাগা’। অন্যান্য ‘পখীহাগা’ নামক স্থানের সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না এই পখীহাগাকে। ‘রসনাতৃপ্তি’ আর ‘পখীহাগা’ শব্দ দুটি পাশাপাশি বড্ড বেমানান বলেই মনে হবে সকলের। তবে গল্পটা শুনলে এই অস্বস্তি দূর হবে বৈকি। 

নলখাগড়ার কথা এর আগেও আপনাদের  বলেছি। এই নলখাগড়ার বন দিয়ে আগে ভরা থাকতো তিস্তার দুই পাড়।  মধ্যতিস্তার বিভিন্ন চরকেও আচ্ছাদিত করে রাখত  নলখাগড়া। কিন্তু আজ এই নলখাগড়ার দেখা মেলা ভার। নজরে আসে কদাচিৎ। তিস্তাবক্ষের শুধুমাত্র দুই-তিনটি স্থানে গুটিকয়েক নলখাগড়ার ঝোপ দেখতে পেয়েছি মাত্র। নলগুলি আঙুলের মত সরু ও চার থেকে পাঁচ ফিট লম্বা। নলকে জড়িয়ে লম্বা লম্বা সরু সবুজ পাতা বের হয়। মৈষাল বন্ধুরা জানিয়েছেন এই নলখাগড়া আগে ছিল এক-একটা বাঁশের মতো মোটা এবং প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ ফিট লম্বা। স্থানীয় ভাষায় এদের বলা হয় 'বাগাচূড়া'। তবে বাস্তবে নলখাগড়া ও বাগাচূড়া এক জিনিস নয়। প্রজাতিভেদে পার্থক্য রয়েছে। তখন বাগাচূড়া বনের ঘনত্বও ছিল অনেক বেশী। বাগাচূড়ার কাটা ছিল এবং তাদের মাথাগুলি জড়িয়ে গিয়ে উপরে জালের মত বিস্তারলাভ করতো। সেই জালের উপর দিয়ে নাকি তখন হেঁটেও যাওয়া যেত। মৈষাল বন্ধুরা কোন কোন সময় এই জালের উপর উঠে লক্ষ্য রাখতেন মহিষের দলের গতিবিধি। কিন্তু বিপদ ছিল বহুবিধ। উপর থেকে একবার নীচে পরে গেলে তার থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসা কোনোভাবেই সম্ভবপর হতনা। নীচে পরে গেলে গায়ের জামাকাপর জড়িয়ে যেত নলখাগড়ার কাটায়। ঘন বনের ভিতর থেকে পথ খুঁজে পাওয়া যেতনা। হামাগুড়ি দিয়ে অথবা বুকে হেঁটে শরীর ক্ষতবিক্ষত করে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে হত। একারণেই মৈষাল বন্ধুরা অনেক সময় বিপদ সংকেত বন্ধুদের নিকট পৌঁছে দেবার জন্য  নিজেদের কাছে বাঁশি রাখতেন। মৈষাল বন্ধু আমিরদা রংধামালীর চরে পিয়াজীবাড়ির ঘাটের কাছে বাগাচূড়ার বনের ভেতরে একবার এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। সাথে তাঁর বাঁশি ছিল না। তাঁর চিৎকার পৌঁছায়নি কারোর কাছেই। বহু কষ্টে প্রায় আট ঘণ্টার প্রচেষ্টায় নলখাগড়ার ভেতরেই ঘুরপাক খেয়ে  রক্তাক্ত অবস্থায় কোনো মতে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে নিজেই জানিয়েছেন।

‘পখীহাগা’ স্থানটিও ভরা থাকত নলখাগড়ার বন দিয়ে। সেই বনের ভেতর থেকে একরকম পচা গন্ধ বের হত। রাইতচরা (রাতচরা) পাখিরা বড় বড় মাছ ধরে এসে বসত সেই নলখাগড়ার বনের উপর। কখনও সেই মাছ মুখ থেকে পরে যেত আবার কখনও পছন্দ না হলে নিজেরাই ফেলে দিত নীচে। রাতের বেলা শ’য়ে শ’য়ে রাতচরা পাখিরা এই কর্মযজ্ঞ চালাতো বিঘার পর বিঘা এলাকা জুড়ে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা মলত্যাগ করত নলের উপর বসেই।তাই পাখীর মলে ভরে যেত নলখাগড়ার বন। পাখীর এই মল আর পচা মাছ মিলেমিশেই তৈরী হত ওই দুর্গন্ধের। এই স্থান পাখী মলত্যাগ করে  ভরিয়ে রাখতো জন্যই মৈষাল বন্ধুরা এই স্থানের নাম দিয়েছিলেন ‘পখীহাগা’। এক্ষেত্রে মজার বিষয় হল পাখির নাম যদিও রাতচরা তবে রাতের বেলায় চোখে আলো পড়লে এরা পালাতে পারেনা। অনেকটা মুরগীর মতো দেখতে এই রাতচরা পাখির মাংস কিন্তু ভীষণ সুস্বাদু। মৈষাল বন্ধুরা এই সুযোগ হাত ছাড়া করতো না মোটেই। বাথানে রাতে মাংস খাবার ইচ্ছে হলেই তারা ‘পখীহাগা’  পৌঁছে যেত। নলের মাথা থেকে চার-পাঁচটি রাতচরা ধরে নিয়ে ফিরতেন বাথানে। এক একটি রাতচরা পাখী থেকে মাংস হত প্রায় এক থেকে দেড় কিলো। মাংসের কোন অভাব ছিলনা সে সময় বাথানে। শুধুমাত্র রাতচরা নয় বালিহাঁস, খরগোশ, বনমোরগ মিলে যেত হাতের কাছেই। হরিণের দল বাথানের আশেপাশেই ঘুরে বেড়াতো। কোন সময় ঘাস খেতে খেতে চলে আসতো বাথানের উঠোনেই। কিন্তু হরিণ শিকার করে তার মাংস খাবার মতো মনঃবৃত্তি মৈষাল বন্ধুদের একেবারেই ছিল না বলেই তাঁরা জানিয়েছেন।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri