গঞ্জহাটের আখ্যান-৮/সুবীর সরকার
গঞ্জহাটের আখ্যান/৮
সুবীর সরকার
--------------------------
২৮.
যাতায়াতের রাস্তায় কত রকমের মানুষের সঙ্গেই যে দেখা হয়! অন্তহীন কথা হয়। গল্প হয়। সেই গল্প জুড়ে পুরোন কোন ধনীবাড়ির খোলানে ঘুরে বেড়ানো হাঁস মুরগী কইতরের দল যেমন থাকে তেমন থাকে পাকঘর,পুরোন খড়ম আর ঢেঁকি পাড়ের শব্দ।
গঙ্গাধরের পারের চর গুলি থেকে ধান নিয়ে যান জামালউদ্দিন ভাই।তার জোড়া মহিষের "ভইসা গাড়ি"।সন্ধ্যের শেয়াল দৌড়ে বেড়ায়। একটা মেটাফিজিকাল ডার্কনেস জড়ানো পৃথিবীতে গান বাজে,গান ঘুরে বেড়ায় -
"আরে নবরঙ্গের ময়না
ময়না না যান গৌরীপুরে রে"
আর জামালউদ্দিন ভাইয়ের "ভইসা গাড়ি"-র নিচে দুলতে থাকে ভুসো কালি মাখা লন্ঠন।
আমি কূপি আর লন্ঠন হারানো হাটগুলোর কথা ভাবতে থাকি।
তখন ঘোড়া জোতদারের টাড়িতে চুপচাপ মস্ত এক ছায়াশরীরের মত এগিয়ে আসতে থাকেন মহি গিদাল।রাত ঘন হতে থাকে। নিশি পংখী উড়াল দেয় গঙ্গাধর পেরিয়ে বুঝি নদী গদাধরের দিকে।
মহি গীদাল তার দোতরার কান মোচড়ান আর গানের ভিতর ডুবে যেতে থাকেন -
"ফুলবাড়ীত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিতে যামো হামরা গরুর গাড়িত চড়ি"
আমি গল্পের শরীরে হাত রাখি।
এভাবে গঙ্গাধরের পারে পারে জীবনের পর জীবন বেশ গুছিয়ে রাখা থাকে, হেমন্ত মাঠে শুয়ে থাকা পাকা ধানের আটির মতো!
২৯.
তখন মরা দুপুরের প্রাক শীতের নরম রোদে ভিজতে ভিজতে এমএলএর হাট থেকে হাতি হারানো জোতদারের জোতের দিকে হেঁটে যেতে থাকে ইজাজ মাস্টার। পাটের শনের মতন তার দীর্ঘ পাকনা চুল দোল খেতে থাকে হাওয়ায় হাওয়ায়। চার কুড়ির এক জীবনে বাঁচতে বাঁচতে ইজাজ মাস্টার দূরাগত বাতাসের ভেতর ঢুকে পড়তে থাকে। তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মস্ত এক স্মৃতির খামার।
ইজাজ মাস্টার আসলে বাইচ খেলার দক্ষ বাইচার।
বাইচ খেলায় ইজাজের নাও কখনো হারে না। এই পঞ্চাশ সত্তর গ্রাম গঞ্জে সবাই তাকে ইজাজ মাস্টার বলেই ডাকে। জানে। চেনে।
ইজাজ তখন হাতি হারানো নরকান্ত জোতদারের
আখ্যানগুলির মধ্যে ডুবে যেতে থাকে। ইজাজ তখন ১৫/১৬। রূপসীর জমিদারের চড়ক মেলায় ইজাজ তার নানার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।নানাই তাকে প্রথম জোতদারকে চেনায়। দীর্ঘ মেদহীন পেশীবহুল সেই জোতদারের রাজকীয় ছবি সুরত আজও ইজাজের
স্মৃতিতে জীবন্ত হয়েই রয়ে গেছে।
তারপর সেই বড় বন্যার বছর "লক্ষীমালা" নামের সেই জোতদারের হাতিটি হারিয়ে গেলে সেই জোতদার "হাতি হারানো জোতদারের" কিংবদন্তিতে
ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে যান।
এখন ইজাজ মাস্টার তার বেটার ঘরের বেটি, বেটির ঘরের বেটাকে সেই জোতদারের গল্প শোনান।
আর জোতদারটাড়ি জুড়ে উড়ে বেড়াতে থাকে বাইচের গানের কলি_
"ওরে হাউসের মেলা জোড়া খেলা
গঙ্গাধরের কাছাড়ে
ওরে মাস্টার বেটার নাও ফাইনালে"
৩০.
নদী গঙ্গাধরের ভাটিতে চন্দ্রকান্ত দেউনিয়ার জোত জুড়ে এই হেমন্তে হেউতি ধান কাটার মরসুম।ধান নিয়ে গো_মহিষের গাড়ি চলেছে কৃষকের ঘরে। এ দৃশ্যে উৎসব জড়িয়ে থাকে।জীবনের মায়া জড়িয়ে থাকে।বগা বগির দল উড়ে যাচ্ছে রতিয়াদহর দিকে,বালাজানের দিকে, বিষখোয়ার দিকে,আগমনীর দিকে,গোলকগঞ্জের দিকে,আগমনী পেরিয়ে রূপসীর দিকে। মাঠ মাঠ ধানের মাঝখান থেকে মেয়ে বউদের সমবেত গান ভেসে আসে -
"আজি কার বা বাড়ির ভোন্দা বিলাই
দুয়রত করিলেক হায় ম্যাও"
ধান কাটতে কাটতে কণ্ঠে গান আসে,শরীরে পুলক জাগে। আর শরীরের পেশিতে জেগে উঠতে থাকে নাচের মুদ্রা। বাদ্য থাকে না।বাজনা থাকে না। কিন্তু নাচ থাকে।নাচের সাথে জড়িয়ে থাকে গান।চিরকালের সব গান, যা জীবন নিংড়ে উঠে আসা -
"ধর তো দ্যাওরা ছাওয়াটাক
মুই বিলাইওক সাজা দেও"
জীবন বয়ে চলে এভাবেই। দুর দুরান্তরে ছড়িয়ে পড়া বগা-বগি একসময় ফিরে আসতে থাকে। হেমন্তের ধানের মাঠে তাদের ডানার শান্ত ছায়া বিছিয়ে পড়তে থাকে।
৩১.
জীবনের গল্প কখনো শেষ হয় না। হাটপর্ব ফুরোয় না কখনো! আসলে হাট হারানো একটা জীবনের কথা ভাবতেই পারে না মানুষ। গঙ্গাধর নদীর উজান ভাটি জুড়ে কত কত মানুষের জমায়েত। আসা যাওয়া।জমায়েতের ভেতর সারি সারি সাজানো সব গল্পেরা।
এক গল্প শেষ না হতেই নতুন গল্পের শুরু হয়ে যায়।
গল্পে গল্পে মানুষ বাঁচে। মানুষকে আসলে বেঁচে থাকতে হয়।জন্ম জন্ম জুড়েই।
আমরা আবার দেখি হেমন্তের ম্যাজিক জমে থাকা মাঠে আবার বাওকুমটা বাতাস। বগা-বগির হাহাকার মিশে থাকা কান্নার সুর।
আর মাঠের সিথানে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকা আবহমান কালের জোড়া মহিষ। ময়কান্ত ব্যাপারী।
আর গুয়া পানের মৌতাতে গান গাইতে থাকেন ফুলেশ্বরী আবো_
"ধান কাটে ধানুয়া ভাইয়া রে
ছাড়িয়া কাটে ওরে নাড়া
সেই মতন মানুষের দেহা
পবন গেইলে ওরে মরা জীবন রে"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴