ইষ্টিকুটুম
অমিত কুমার দে
=============
ডাকটা
পাবার পরেই নিজেকে ‘কুটুম কুটুম’ মনে হচ্ছিল। এত আন্তরিকভাবেও অচেনা কেউ
ডাকতে পারেন? সুব্রত কুন্ডু বললেন, “আমার ফার্ম হাউসে এসে নিশ্চিন্তে
নির্জনে আপনি লিখুন!” আর ওখানে গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের স্পর্শ লেগে আছে।
ভেতরে ভেতরে একটা টান অনুভব করছিলাম।
২০১৩ সালের
জন্মাষ্টমীতে ভ্রমণলেখক গৌরীদা গোলাপজামের চারা পুঁতে ‘ইষ্টিকুটুম ফার্ম
হাউসের’ উদবোধন করেছিলেন। ইষ্টিকুটুম ডাকলে কুটুম আসে ঘরে! তাই
শিক্ষকদম্পতি সুব্রত-চম্পা-র কন্যা শ্রুতর্ষী ‘ইষ্টিকুটুম’ নামটা দিয়েছিল।
সুব্রত-র ঠাকুর্দা জ্যোতিষ চন্দ্র কুন্ডু পাটকাপাড়া চা-বাগানে কাজ করতেন।
তাঁর পুত্র, সুব্রত-র বাবা, শৈলেশ চন্দ্র কুন্ডু মনে প্রাণে শেকড় গেড়েছিলেন
এই গ্রামের মাটিতেই। তিনিই এখানে জমি কিনে চাষআবাদ শুরু করেন। প্রায় তিরিশ
বিঘে জমি। জমির গা ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে কালজানি নদী। বাতাসে চিলাপাতা
মেন্দামারি অরণ্যের ঘ্রাণ।
চার চাকায় স্টার্ট দিয়েই
ফেললাম। যাবার আগে গৌরীদা বললেন – “খুব ভালো লাগবে দেখো! তবে রাতে গাছ থেকে
পাকা তাল পড়ার শব্দে ঘুম নাও হতে পারে!” হাসিমারাকে বাঁদিকে রেখে মসৃণ
রাস্তায় অগাধ সবুজ নিতে নিতে নিমতি মোড়। ডানদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে আর তিন
কিলোমিটার। পাটকাপাড়া।
সুব্রত যেন তালের ক্ষীর
খাওয়াবে বলে মুখিয়ে ছিলেন! দু’হাত বাড়িয়ে দেওয়া আত্মীয়তায় মনে হল যেন নিজের
বাড়িতেই এলাম! “পরে ঘরে যাবেন, আগে সকালের খাবারটা খেয়ে নিন।” গ্রামীণ
বাঁশে তৈরি ডাইনিং হল। ঢুকতে হয় ফুটে থাকা জুঁইফুল কপালে ঠেকিয়ে! “এখন
আমার গাছের তালের ক্ষীর খেয়ে নিন, পরে তালের বড়া ভেজে দেবে। এই দেখুন
কালজানি থেকে আপনাদের জন্য নদীয়ালী মাছ এনে রেখেছি – বোরোলি পিঠকাটা ঘাটসি
চেলি দাড়াঙ্গি কুসুমা, রাতে দেশী মোরগ! ঢেঁকি শাক ভাজা চাল কুমড়োপাতার বড়া
থাকছে। এই যে সবজিগুলো দেখছেন – সব আমার ক্ষেতের, রাসায়নিক বিষ নেই।”
গোয়ালঘর থেকে হাম্বা ডাকে গরু ডেকে উঠল!
ঘরে কি ঢুকব!
বড় বড় পাকা পেয়ারা দু’তিন রকমের, রসালো মুসুম্বি, চেরীর থোকা ঝুলছে
নাগালের মধ্যে। আরো কত কত গাছ – নাসপাতি জামরুল আপেলকূল বেল কামরাঙা ডাউয়া
আম কাঁঠাল পানিয়াল খেজুর নারকেল ইত্যাদি ইত্যাদি। গাছে গাছে রকমারি পাখিদের
কিচমিচ। ঘরগুলোর নামও পাখিদের নামে! আমি থাকব ‘বুলবুলি’তে! রয়েছে বাবুই
মুনিয়া মৌটুসি হরিতাল ধনেশ!
বুলবুলির বারান্দায়
বসতেই চোখ জুড়ে চায়ের বাগান। তার ওপারে কুলকুল কালজানি। সুব্রত বললেন –
“এদিক দিয়েই হাতি আসে। ওই দেখুন, ওই গেট ভেঙে ঢুকেছিল। কিন্তু তেমন কোনো
ক্ষতি করেনি কখনো।”
সুব্রত-র নিজেরই চা-বাগান, মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে কালজানির দিকে। হাঁটতে হাঁটতে মন শান্তি পায়।
সুব্রত
ঘুরিয়ে আনলেন চিলাপাতার অলিগলি। নদীটা কী সুন্দর। বানিয়া নদী। গাড়ি
থামাতেই পপি নবনীতা টংঘরে উঠে পড়ল। হু-হু হাওয়া। মাছ ধরে ঘরে ফিরছেন রাভা
বৃদ্ধ। সুব্রত বললেন – “এখানে লালন ফকিরকে নিয়ে তৈরি ‘মনের মানুষ’
সিনেমাটার শ্যুটিং হয়েছিল।” বিকেলে গাড়ি চালিয়ে ঘুরে এলাম কালচিনি
রাজাভাতখাওয়া। দমনপুরের ওদিকটায় হাইওয়ের পাশেই হাতি বেরিয়েছিল!
এ
যাত্রায় যাওয়া হল না। তবে সুব্রত শোনালেন পাটকাপাড়া চা বাগানের প্রাচীন
অশ্বত্থ গাছের কথা, যেখানে প্রচুর তক্ষকের বাস, সেই গাছের তলায় পুরোনো
শিবমন্দির। সুব্রত বললেন – “ওখানে কত শেয়াল দেখেছি, হাতি দেখেছি!” উনি এক
এক ঋতুর নিমন্ত্রণ করে যেতে লাগলেন – “দুর্গাপুজোয় চলে আসুন, এই গ্রামের
পুজো আন্তরিকতার সুতোয় বাঁধা। বিভিন্ন জনজাতি মিলে যায় ভালোবাসায়!”
“নিমতিঝোরা চাবাগানের অসুর-লাইনে নিয়ে যাব। ওরা এখনো দুর্গাপুজোয় যায় না।
দেবী অসুরকে বধ করেছিলেন যে!” “কালীপুজোয় আদিবাসীদের পাড়ায় মোরগ লড়াই হয়,
দেখাতে নিয়ে যাব।” “এখান থেকে মাত্র সাত কিমি দূরেই একটা শতবর্ষ প্রাচীন
মসজিদ আছে। নিয়ে যাব কিন্তু, আপনার ভালো লাগবে।” “রাভা মেচ বোড়োদের গ্রাম
ঘুরে আসবেন। মাটির গন্ধমাখা মানুষগুলো বড্ড ভালো।” “আর এবার ডিসেম্বরের
শীতে আসতে ভুলবেন না। আমার গাছের খেজুরের রস পেড়ে খাওয়াব!”
মানুষগুলো
যে কত ভালো, তা তো বুঝেছি বন্ধন বড়াইকের সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে। চল্লিশ
বছর থেকে সুব্রতদের পরিবারের সঙ্গে রয়েছেন তিনি। শুধু কাজের যোগ নয়,
ভালোবাসার যোগসূত্র। তাঁর মুখে চার দশকের কত ছবি মন ভরে নিচ্ছিলাম সান্ধ্য
আলোআঁধারিতে বসে। তাঁর পুত্র দীপাঞ্জনও এই খামারবাড়ির সঙ্গেই যুক্ত, নীরবে
মুখে মিষ্টি হাসি রেখে কাজ করে চলেছে ছেলেটা। আর ভাইয়ারাম ওঁরাও-এর হাতে তো
জাদু আছে। প্রতিটি রান্নাই যেন অমৃত! ওরা কী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল –
আমাদের এখানে একজনেরও করোনা হয়নি। আমাদের দূষণ নেই যে! আমরা পরিশ্রম করি,
ঘাম ঝরাই, বিষছাড়া খাবার খাই, তাই এসব অসুখ আসে না! পাকা তাল কুড়িয়ে যত্ন
করে রেখে দিয়েছেন বন্ধন বড়াইক – “নিয়ে যাবেন কিন্তু!”
রাতে অঝোর বৃষ্টি। আর তাল পড়বার শব্দ। একটা প্রশান্তি নামছে চরাচরে। কতদিন পর।
--------------------------------------------------------------------
ইস্টিকুটুম ফার্ম হাউসে যেতে হলে যোগাযোগ : সুব্রত কুন্ডু – ৮৩৭২০০৬৫৫২