আমি এক যাযাবর-৮/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
৮ম পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
মধুপর্ণার অনেক দিনের ইচ্ছে পুরুলিয়া যাওয়ার। আর এই 'যাওয়া' বিষয়টিতে আমি তো সবসময়ই ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি। তবু আবহাওয়া, ছুটি, অন্যান্য সুযোগ সুবিধের হিসেব নিকেশ না করলেও চলে না! সব বিচারের শেষে ভোট পেল পুরুলিয়ার বড়ন্তি। নেটছবিতে বসন্তে সে পলাশলাল! শান্তিনিকেতন তো অনেকবারই হ'ল, তাই ল্যাডলিদার আখড়ার ডাকও সেবারের মত সরিয়ে রেখে বড়ন্তিই। সঙ্গিনী(লটবহর গোনার সময় যাকে আজও আমার গুনতে হয়)র বেশি দৌড়ঝাঁপ না-পসন্দ। সুতরাং ট্রেনবদলের ঝক্কি যাতে না পোহাতে হয়, তা-ও দেখতে হল। ভাগ্য ভালো দ্বিসাপ্তাহিক যশবন্তপুর এক্সপ্রেসে টিকেট পেয়ে গেলাম মার্চের কুড়িতে। একুশ সকালে নিখুঁত সময়ে আসানসোল। বুকিং আছে বড়ন্তির আঁখাইবাড়ি রিসর্টে। কথামতো স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়ে রেখেছেন সেখানকার সেনাপতি লক্ষ্মীকান্ত। আঁখাইবাড়ির সবার কাছে কান্ত'দা। গাড়িতে উঠে চালকের নাম জানলাম 'প্রান্ত'। ভেবে নিলাম ছন্দবাণী ক্লাবে এসে পড়েছি। ততক্ষণে ট্রেনযাত্রাক্লান্ত আমার মনে পড়ে গেছে সঙ্গে রসদ কিছু নেই! সুতরাং প্রান্তই ভরসা। চলতি পথে গাড়ি থামলো। রাস্তার ও পারে ধাবাগোছের আস্তানা। দোলের দিন, অন্য সম্ভাবনার ঝাঁপ বন্ধ। কিছু বেশি খেসারত অতএব বচ্ছরকার দিনে দিতেই হয়। বে আইনি, সুতরাং লুকোচুরির পেছনেও কিছু সময়। সে ফাঁক টুকু পূরণ করা গেল ঝটিতি দু গ্লাসে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। গাড়ি তে ফিরতেই বিপত্তি। বিশ্বসংসার যাকে জানে আলাভোলা, সানগ্লাসের আড়াল, গাড়ির কালো কাচ, মাঝের রাস্তাপেরোনো কৌণিক দূরত্ব, সব তুচ্ছ করে তিনি বলে উঠলেন, "আমি দেখতে পেয়েছি!" তবে এ বলায় পরিচিত কাঠিন্যের বদলে কিছুটা যেন প্রশ্রয়ই! সামনে পলাশবনের হাতছানি যে!
আসানসোল থেকে বড়ন্তি গাড়িতে মেরেকেটে এক ঘন্টা। রিসর্টে পৌঁছে প্রথম দেখা রাজার সাথে। আঁখাইবাড়ির মহারাজ। শিল্পী, রসিক, সুদর্শন যুবকটির প্রথম উচ্চারণেই আত্মীয়তার আহ্বান। ব্রেকফাস্ট সেরে রিসর্টের অন্যান্য বাসিন্দারা, যাঁরা আমাদেরই মত সকাল সকাল পৌঁছে গ্যাছেন, তাঁদের সাথে আবীর খেলা। স্নান, দুপুরের খাওয়ার পর পরিচয় হল পাশের ঘরের বাসিন্দাদের সাথে। প্যাকেজ অনুযায়ী বিকেল বেলা বেরোনো। সংগী তাঁরাই। গাড়ি গড়াতে পরিচয়। পার্থদা রিটায়ার্ড। সংস্তবের অভিনেতা, কদাচিৎ পরিচালকও। কণিকার চাকরিস্থায়িত্ব আমারই মত, আবার মধুপর্ণার মত একটু দেরি খোলস ছাড়তে!
প্রথম দ্রষ্টব্য জয়চন্ডী পাহাড়। নাম শুনেছি অনেক। কোনো একবার ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে ঠিক করেছিলাম একবার অন্তত আসবোই। এই সে আসা হল। তিনশো ধাপ সিঁড়ি ভেঙে পাহাড় মাথায় মন্দির। কেউই ওঠার চেষ্টা করি নি অতটা। যতটা পারি, হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই মন চলে গেল উদয়ন পন্ডিতের খোঁজে, তাঁর পাঠশালাটির খোঁজে। কিন্তু না, উদয়নেরা সবসময় দেখা দেন না। আবির্ভাব তাঁর অনিবার্য, হয়তো সময় হয় নি এখনো।
গাড়ি ছুটলো রঘুনাথপুর মহকুমার পাঁচুত গ্রামের দিকে। গড় পঞ্চকোট। যাওয়ার পথের ছোট্ট দুষ্টুমিটিকে আজ স্বীকার করি। শক্তি-সুনীল দের বুকে নিয়ে যার কৈশোর, মহুয়া তো তার সোনার ভ্রমর! চালককে হাত করে মূল রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়ি মাঝিপাড়ায়। পার্থদা, কণিকা, মধুপর্ণা গাড়িতে বসেই সাঁওতাল মহল্লাটিতে মুগ্ধ, চালক নন্তুকে সাথে নিয়ে আমি এগোই ভেতর পাড়ায়, বুধাই মুরমুর বাড়ি। এটুকু সংগীরা জানে, মহুয়ার বোতল নিয়ে ফিরে আসাটিও জানে। যা জানে না, সেটা এইখানে বলে নিই, বুধাইএর আতিথ্যে 'মহুলরস' দু'পাত্তর খেতে হয়েছিল ওর বাড়িতে। গাড়ি চলতে আরো দু'চার ঢোঁক, জল খাওয়ার অছিলায়!
গড় পঞ্চকোট চত্বরে ঢুকতে ঢুকতে নেভা বিকেল। দিগন্তের ক্যানভাসে দিনশেষের লজ্জারং। আর সেই প্রেক্ষিতে যেন আঁকা হয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন মন্দির, ভাঙা গড়! শরীর মনে তখন মহুয়ার মাদল, আমার মনে পড়ছে অনেকদিন আগে চেনা কবিতা চরণ,
"অনেক, অনেক দূরে আছে
মেঘমদির মহুয়ার দেশ
সমস্তক্ষণ সেখানে পথের দু'ধারে
ছায়া ফেলে দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য
আমার ক্লান্তির ওপর ঝরুক
মহুয়া ফুল
নামুক মহুয়ার গন্ধ...।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴