অন্তহীন আকাশের নীচে/৮
অন্তহীন আকাশের নীচে
পর্ব ৮
দেবপ্রিয়া সরকার
-----------------------------
বোলপুর থেকে রাতের ট্রেন ধরে স্বয়ংদ্যুতি সকাল সকাল এন জে পি এসে পৌঁছালো। তার বাবা,মা আর দিদি প্লেনে আসছে। ফ্লাইট পৌঁছবে দুপুর নাগাদ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা গাড়ি নিয়ে স্বয়ংদ্যুতি সোজা চলে এল হোটেলে। শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোডের একটা হোটেলে দু’খানা ঘর অনলাইনে আগে থেকেই বুক করে রেখেছিল। ফ্রেশ হয়ে হালকা ব্রেকফাস্ট সেরে সে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হোটেলের গাড়িতে চেপে পাড়ি জমাল সোজা সেবকের উদ্দেশে। করোনেশন ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে তার চ্যানেলের জন্য ছোট্ট একটা টিজার শ্যুট করল প্রথমে। তারপর চলে গেল সেবকেশ্বরী কালি মন্দির দর্শনে। ফিরে এসে দেখল পরিবারের সকলে হোটেলে চেক ইন করে ফেলেছে। ঘন্টা দেড়েক আগে ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে তাদের। দিদি অরুন্ধতী অভিমানের সুরে বলল, তুই কী রে টুপুর? আমাদের না নিয়ে একাই সেবক চলে গেলি?
-একা একা হোটেলে বসে বোর হচ্ছিলাম তাই ভাবলাম একটু ঘুরে আসি।
সঞ্জীবনী বললেন, একটু অপেক্ষা করলে পারতি, সকলেই যেতাম একসঙ্গে।
-তোমরা তো সেবক আগে গিয়েছ অনেকবার।
-তা তো গিয়েছিই, কিন্তু বহুকাল আর এদিকে আসা হয়নি। এতোগুলা বছরে জায়গাটা কতটা বদলাল দেখতে চাইছিলাম, আর কী? যাক্ গে, ভিডিও করেছিস তো? সেটাই দেখব’খন।
এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার মুখ খুললেন রাধাকান্ত, ঢের হয়েছে এ’বয়সে হাঁটুর ব্যথা নিয়ে তোমাকে আর সেবক কালিবাড়ি যেতে হবে না।
সঞ্জীবনী তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, সে নাহয় গেলাম না কিন্তু কাল গাড়িতে কোচবিহার যাবার সময় একবার বাবা জল্পেশ্বরের দর্শন আমি করেই যাব। কে জানে, এজন্মে আর আসতে পারব কী না?
রাধাকান্ত মুচকি হেসে বললেন, চিন্তা করো না, তোমার ভবলীলা এত সহজে সাঙ্গ হবে বলে আমার মনে হয় না। নিজের মাকে দেখছ তো? কেমন সুন্দর নিরানব্বইয়ে নট আাউট থেকে এখন দিব্য সেঞ্চুরি হাঁকাতে চলেছেন। তোমার শরীরেও তো ওঁরই রক্ত সুতরাং একশো না হলেও নব্বই পর্যন্ত যে গড়াবে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
-তুমি থামবে? আমি কদ্দিন বাঁচব না বাঁচব তার ফিরিস্তি তোমাকে দিতে হবে না। কাল আমি জল্পেশ মন্দিরে যাবই, কোনও অজুহাত শুনব না।
সেই রাতটা শিলিগুড়িতে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন সকাল সকাল তারা গাড়ি করে কোচবিহারের দিকে রওনা হল। যাবার পথে স্বয়ংদ্যুতি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মা তুমি যে এই জল্পেশ মন্দিরে যেতে চাইছ, সেখানে কী এমন বিশেষ ব্যাপার আছে শুনি?
সঞ্জীবনী জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, উত্তরবঙ্গের প্রাচীন তীর্থক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটা হল জল্পেশ শিব মন্দির। শিবরাত্রিতে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিরাট উৎসব ও মেলা হয়। শ্রাবণ মাসেও প্রচুর লোক আসে শিবের মাথায় জল ঢালতে।
-সে তো বুঝলাম। কিন্তু পুরনো মন্দির যখন তাহলে এর কোনও হিস্টরিকাল ব্যাকগ্রাউন্ড নিশ্চয়ই আছে?
স্বয়ংদ্যুতির কথা শুনে সামনের সিটে বসা রাধাকান্ত বললেন, আছে বৈকি! শুনেছি কোচ রাজারা ছিলেন শিবের বংশধর। তাঁরাই ছিলেন এই মন্দিরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। মহারাজা প্রাণনারায়ণের রাজত্বকালে প্রথম ইটের তৈরি দেবালয়টি বানানো হয়। মন্দিরের পুজো এবং অন্যান্য খরচের জন্য তিনি বেশ কয়েকটি জোত দান করেছিলেন। সেগুলো দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার হতো।*
-শিবের বংশধর মানে? ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। একটু এক্সপ্লেইন করো।
স্বয়ংদ্যুতি ফোনের ভয়েস রেকর্ডার অন করে বাবার মুখের সামনে ধরল। রাধাকান্ত গলা খ্যাঁকারি দিয়ে বললেন, এই বিষয় নিয়ে আমার খুব বেশি পড়াশোনা নেই। যতটুকু জানি, কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ বিশ্বসিংহের মা হীরা নাকি ছিলেন অত্যন্ত রূপবতী এবং শিব ভক্ত নারী। তাঁর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে স্বয়ং শিব তাঁকে বর দেন। সেই বরের ফলে হীরার গর্ভে জন্ম হয়েছিল বিশু নামে এক অদ্ভুত প্রতিভা সম্পন্ন পুত্র সন্তানের। এই বিশুই পরে বিশ্বসিংহ নাম নিয়ে কোচ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিবের বর প্রাপ্ত বলে বিশুর বংশধরদের ‘শিব বংশ' বলা হয়।**
-বুঝলাম।
কথা বলতে বলতেই স্বয়ংদ্যুতিদের গাড়ি এসে থামল জল্পেশ মন্দির চত্বরে। প্রাচীনত্ব হারিয়ে মন্দিরের চেহারা এখন অনেক ঝকঝকে। ঠাকুর দর্শন, পুজো দেওয়া শেষ হলে বাবার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জল্পেশ মন্দিরের ওপর চটপট একটা ভ্লগ বানিয়ে ফেলল স্বয়ংদ্যুতি। তারপর আবার রওনা দিল কোচবিহারের পথে। টানা চার ঘন্টার সফর শেষে তারা যখন কোচবিহার পৌঁছাল তখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। রাঘবেন্দ্র আর জয়শীলা হৈ হৈ করে বেরিয়ে এলেন বাড়ির বাইরে। ডাব্বু আর তার স্ত্রী সোহাগও চলে এসেছে সকালের ট্রেনে। সকলের উপস্থিতিতে গমগম করে উঠল ঊষারানীর চার দেওয়াল।
লম্বা বিরতির পর মেয়ে, জামাই, নাতনিদের দেখে প্রথমটা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিলেন না ঊষারানী কিন্তু রক্তের টানকে কি এতো সহজে ভোলা যায়? কিছু সময় গড়াতেই সকলকে চিনতে পারলেন তিনি। বহুদিন পর আপনজনদের কাছে পেয়ে নিঃসঙ্গ, একলা ঊষারাণীর দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল। তাঁর গলা ধরে অরুন্ধতী বলল, এ কী! তুমি কাঁদছ দিদা?
চোখের জল মুছে ঊষারানী বললেন, এই কান্না দুঃখের কান্না নয় রে টাপুরদিদি। এতো আনন্দের অশ্রু। মরার আগে যে তোদের সকলকে আবার দেখতে পাব এ কথা কি স্বপ্নেও ভেবেছিলাম? মদনমোহনের অনেক কৃপা যে তিনি আবার সকলকে এনে হাজির করলেন আমার সামনে।
-মদনমোহনের কৃপা কতটুকু জানিনা তবে আমাদের সকলকে এক জায়গায় জড়ো করার পেছনে তোমার ছোট নাতনি টুপুরের কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি। ও হুজুগ না তুললে আমাদের আসাই হতো না।
ঊষারানী হাসি মুখে তাকালেন স্বয়ংদ্যুতির দিকে। বললেন, টুপুরদিদি আমার বরাবরের হুজুগে। সেই ছোটবেলায় যখন আসত সারা বাড়িময় হৈ হৈ করে বেড়াত। আর বিকেল হলেই বাইরে যাবার বায়না ধরত। আমি তোদের নিয়ে আজ রাজবাড়ি তো কাল মদনমোহন মন্দির, পরশু সাগরদিঘি এই করে বেড়াতাম। কী, মনে পড়ে টুপুরদিদি?
স্বয়ংদ্যুতি একগাল হাসি নিয়ে বলল, সেসব মনে পড়ে বলেই তো সকলকে নিয়ে দলবেঁধে চলে এলাম তোমার কাছে, ক’টাদিন আনন্দ করে কাটাতে। বেচারা জিজুটা আসতে পারল না শুধু, জরুরি কাজে আটকে রয়ে গেল দিল্লিতে।
ডাব্বু, সোহাগ, স্বয়ংদ্যুতি, অরুন্ধতী সকলে গোল হয়ে বসেছিল ঊষারানীকে ঘিরে। সোহাগ বলল, আমরা তো এলাম ঠিকই কিন্তু আরও একটা বড় সারপ্রাইজ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে ঠাম্মি।
ঊষারানী চোখ কুঁচকে সোহাগের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী অপেক্ষা করছে বললি, নাতবৌ?
ডাব্বু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, সেটা সময় এলেই দেখতে পাবে। তোমার জন্মদিনের সব থেকে বড় উপহার।
ঊষারানী মুখ বাঁকিয়ে বললেন, হুঁহ, আজ বাদে কাল চিতায় উঠব, তার আবার জন্মদিন!
ঊষারানীর বলার ধরনে হেসে উঠল সকলে। স্বয়ংদ্যুতি বলল, সে যখন চিতায় ওঠার তখন উঠবে এখন যতদিন বেঁচে আছো জীবনটাকে এনজয় করে নাও দিদা। একবার তাকাও দেখি আমার দিকে একটা সেলফি তুলি।
ঊষারানী কিছু বোঝার আগেই ফটাফট ক্যামেরার শাটারের শব্দ হল কয়েকবার। দিদার ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে সদ্য তোলা ছবিগুলো ভিক্টরকে হোয়াটস্ অ্যাপ করে স্বয়ংদ্যুতি লিখল, এই হল আমার দিদা। স্টিল অ্যাট্রাকটিভ অ্যান্ড গ্রেসফুল।
ভিক্টরের উত্তরের অপেক্ষা না করে হোয়াটস অ্যাপ থেকে বেরিয়ে এসে স্বয়ংদ্যুতি ডায়াল করল একটা নম্বর। কয়েকবার রিঙ্ হবার পর ওপাশ থেকে ভেসে এল, স্বয়ংদ্যুতি? পৌঁছে গিয়েছেন সেফলি?
-একদম। এই তো ঘন্টা খানেক আগেই নামলাম।
-গুড।
-আজ কি একবার দেখা হতে পারে আমাদের?
-উম্, আজ তো আমার সন্ধেবেলায় কোচিংয়ে পরপর তিনটে ক্লাস আছে। ইফ্ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আমরা কি কাল মিট করতে পারি?
-ও শিওর। কখন এবং কোথায় দেখা হবে আমাদের?
-আগামীকাল ঠিক বিকেল চারটেয় মদনমোহন মন্দিরের সামনে চলে আাসুন, আমি অপেক্ষা করব।
-ওকে, ডান।
ফোন বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল স্বয়ংদ্যুতি। অনেক পুরুষের সঙ্গেই বন্ধুত্ব আছে তার। আজ পর্যন্ত এমন কখনও হয়নি যে স্বয়ংদ্যুতির দেখা করার প্রস্তাবে তারা কেউ আপত্তি জানিয়েছে। যত অসুবিধাই থাকুক স্বয়ংদ্যুতির ডাকে পড়িমরি করে দৌড়ে আসে সকলে। আজ প্রথমবার কেউ একজন তার দেওয়া সময়কে নাকচ করল।
-আপনাকে তো কাল্টিভেট করতেই হচ্ছে মিস্টার!
ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বিড়বিড় করছিল স্বয়ংদ্যুতি এমন সময় পেছন থেকে ভেসে এল নারী কণ্ঠ, টুপুর তুমি এখানে? আমার মেয়ে তোমাকে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিল।
স্বয়ংদ্যুতি পেছন ফিরে দেখল একটা সতেরো-আঠারো বছরের রোগা চেহারার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বকুলের পাশে। পরনে সস্তার সালোয়ার কুর্তি। গায়ের রঙ তামাটে। মাথার চুলে তেল দিয়ে পাট করে আঁচড়ে বিনুনি বাঁধা। বড় বড় চোখ পাকিয়ে সে দেখছে স্বয়ংদ্যুতিকে। অসম্ভব উজ্জ্বল সেই চাহনি!
*তথ্যসূত্রঃ কোচবিহারের সম্পূর্ণ ইতিহাস (পৌরাণিক যুগ থেকে সাম্প্রতিক কাল)- মহেন্দ্র দেবনাথ
**তথ্যসূত্রঃ কোচবিহার রাজ্যঃ দীনেশচন্দ্র সেন [কোচবিহারের সম্পূর্ণ ইতিহাস -ভগবতীচরণ বন্দোপাধ্যায়]
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴