স্টাফ ও সাব-স্টাফদের বেতন জট আজও কাটল না/গৌতম চক্রবর্তী
স্টাফ ও সাব-স্টাফদের বেতন জট আজও কাটল না
গৌতম চক্রবর্তী
চা বাগিচার না ঘটকা না ঘরকারা হলেন বাবু সম্প্রদায়। বাগিচা বন্ধ হলে বা সমস্যা সৃষ্টি হলে হাইলাইট হন মালিকপক্ষ বা ভোটব্যাঙ্কের কারণে শ্রমিকেরা। কিন্তু বাবুদের কথা অকথিতই থেকে যায়। এবারের পর্বে বাবুদের অব্যক্ত কান্না তুলে আনার চেষ্টা করব। সবুজের মাঝে লাল রক্ত ঝরলে কার কি? চায়ের রঙটাও যে লাল। সেটা পাণীয় না বাবু এবং শ্রমিকদের রক্ত তার খোঁজ কে রাখে? আসলে সেই ঔপনিবেশিক জমানাতে যখন ঘন জঙ্গল কেটে জমি পাওয়া গেল চা-চাষের জন্য তখন আদিবাসী শ্রমিকদের চা-চাষে নিযুক্ত করা হয়েছিল। এক সবুজ অরণ্য কেটে তৈরি হয়েছিল আরেক সবুজ গালিচা। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকল চা-গাছ। চারপাশ দিয়ে বেড়ে ওঠা চা-গাছ থেকে যখন চা তৈরির জন্য কুঁড়ি ও পাতা বের হতে শুরু হল তখন চা-পাতা উৎপাদন, তৈরির প্রক্রিয়া এবং বাক্সবন্দী করে বিশ্ববাজারে নিয়ে যেতে প্রয়োজন হল হিসাব জানা কিছু মানুষের যারা সামান্য হলেও লেখাপড়া জানে। ব্রিটিশরা তখন ভারতবর্ষকে পরাধীনতার জালে বন্দী করে ফেলেছিল। ততদিনে চীন, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার সবই তাদের অধীনস্থ। তখন গোটা অঞ্চল ঘিরে এক অশান্ত পরিস্থিতির সূত্রপাত হয়। বাংলার পূর্ব অংশকে বলা হত পূর্ববঙ্গ যা সেই সময়ে ছিল শস্য উৎপাদনের মূল ক্ষেত্র। বাঙালি প্রধান অঞ্চল। যৌথ পরিবারের মুক্ত অঞ্চল। বিভিন্ন সমস্যা, ব্রিটিশের শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক নিরাপত্তা, খাদ্যাভাব ইত্যাদি কারণে মানুষ পরিবার থেকে এবং পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে লাগল। যৌথ পরিবারগুলি অসহায় হয়ে পড়তে থাকল। ভাগ্যের খোঁজে, রুটি-রুজির খোঁজে, বেঁচে থাকতে পূর্ববঙ্গ থেকে সামান্য শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত একদল মানুষ যারা অধিকাংশই বাঙালি তারা বেরিয়ে এসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। তাদের কেউ কেউ সাহস করে পাণ্ডববর্জিত, অনুন্নত, জঙ্গলাকীর্ণ এবং ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গু-কালাজ্বর অধ্যুষিত এই অঞ্চলে এসে পৌঁছেছিল। এ ছাড়াও লোক মারফত বা খোঁজ-খবর করে তুলে আনা হত বাঙালি যুবকদের বেশি সুবিধা দেবার ছলে। তারপর বাস স্ট্যান্ডে, রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকত সেই সময়ের সাহেবকুল। কারণ তাদের চাই এমন একটা সম্প্রদায় যারা শুধু ব্রিটিশদের জন্য এক মনে কাজ করতে পারে। তাদের কাজ ব্রিটিশ ও শ্রমিকদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশের পক্ষ নিয়ে চলা। ব্রিটিশ ও শ্রমিকের মাঝে নিযুক্ত করা এই যে সম্প্রদায় তাদের নামকরণ হল বাবু সম্প্রদায়' হিসেবে। একের পর এক বাংলা ভাষা বলা মানুষ অবস্থার শিকার বা ভাগ্য অন্বেষণে পৌঁছে গিয়েছিল এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাবু নামে চা-বাগানের মধ্যবর্তী মানুষ হিসেবে ব্রিটিশ চা-কর ও শ্রমিকের মাঝে সংযোগকারী হিসাবে তারা বাগিচাতে যোগদান করল। পরবর্তীতে তাদের মাধ্যমেও এসে পৌঁছেছিল তাদের পরিচিত অনেকে। এইভাবে ডুয়ার্স ও তরাই অঞ্চলে আসে বাবু সম্প্রদায়। প্রায় একইভাবে নেপাল ও ভারতের নেপালী অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে বাবুরা এসেছিল পাহাড় অঞ্চলের চা-বাগানে।
মূলত অর্ধ বা অল্প শিক্ষিত বহু পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যৌথ পরিবার ভেঙে যেতে থাকার কারণে এবং খাদ্যাভাব আর সামাজিক ও রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে উদ্ধার পেতে ঘর ছেড়েছিল। তারা না পারত শ্রমিকের কাজ করতে, না যোগ্য ছিল সরকারি দপ্তরের জন্য। এই ঘর ছাড়ার দল তখন পাড়ি দিত বার্মা বা মায়ানমার, আসাম, কলকাতা। কেউ কেউ পৌঁছেছিল উত্তরবঙ্গে। এই অঞ্চলে তখন চা-বাগান তৈরি হচ্ছে, অনেক কাজ। খুব সহজেই জুটে যেত একটা চাকরি যা ছিল তাদের একমাত্র কাম্য। এটাও কিন্তু ব্রিটিশের দ্বারা পরিচালিত এক অদ্ভুত পন্থা যখন সরাসরি সাহেবরা শ্রমিকদের পরিচালনার আগে চাইছিল এমন এক সম্প্রদায় যারা মালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যে লিয়াজো হিসাবে ব্রিটিশের জন্য কাজ করবে। ব্রিটিশ সাহেবদের তখন একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান চা-শিল্পকে দাঁড় করানো যা থেকে সংগ্রহ হবে প্রচুর অর্থ। চা-বাগান তৈরি হল। চা তৈরির কারখানা তৈরি হল। যেখানে করা সম্ভব হল সেখানে তৈরি হল শ্রমিকদের অস্থায়ী বাসস্থান। কারখানাকে মধ্যমণি করে তৈরি হল বাবুদের বাসস্থান, অফিস, হাসপাতাল। শ্রমিকদের বাসস্থান থেকে খানিকটা দূরে বাবুদের আর বাবু ও শ্রমিকদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে ব্রিটিশদের সাহেবদের বাংলো। ধীরে ধীরে দপ্তরভিত্তিক বাবুদের পদ তৈরি হল। অফিস, কারখানা, বাগান, চিকিৎসা প্রত্যেক জায়গায় অর্ধ বা অল্প শিক্ষিত লোক নিয়োগ হল। তবে কেউ কেউ যারা বিভিন্ন কারণে আসতে বাধ্য হয়েছিল তারা ছিল পূর্ণ শিক্ষিত। শুরু হল চা বাগিচায় এক নতুন মধ্যস্বত্বভোগী সম্প্রদায়ের চালচিত্র। এই চা-বাগান পত্তন, চা-শিল্প তৈরির ক্ষেত্রে সুদূর ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড থেকে যে সকল মানুষ এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে চাকরি নিয়ে এসেছিল ম্যানেজার পদে তাদের মধ্যেও খুব কম সংখ্যক শিক্ষিত মানুষ এসেছিল সেই সময়ে। ম্যানেজার ও সহকারী ম্যানেজার পদে থাকত ব্রিটিশ সাহেবরা। বড় বাবু থেকে ছোট বাবু হত বাঙালিরা। সর্দার থেকে শ্রমিক পদে বহাল হত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা। চা বাগিচার কর্মচারিদের মধ্যে যারা বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজে যুক্ত থাকত তাদেরকে বাগিচার পরিভাষায় বলে বাবু। বাগানের হেডক্লার্ক বড়বাবু, প্রভিডেন্ড ফান্ড বা হপ্তা পেমেন্টের দায়িত্বে যারা থাকেন তাঁরা ক্যাশ বাবু, ফিটার মিস্ত্রী যারা তারা কলবাবু। ইলেকট্রিক সম্পর্কিত কাজে যারা থাকে তারা বাতিবাবু, এককথাতে এরা বাগিচাগুলির কর্মচারি।
বাবুদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদটা হত বড়বাবুর। যিনি অর্থ, হিসাব অর্থাৎ অফিস সংক্রান্ত বিষয়ে শেষ কথা বলতেন। অনেক সময় ম্যানেজার সাহেবও বাধ্য হত তাকে গুরুত্ব দিতে। একইভাবে কারখানা, বাগান, স্টোর ইত্যাদিও থাকত বাবুদের হাতে দক্ষতার বিচারে। হাসপাতাল হোত ডাক্তারের অধীনে এবং যন্ত্রপাতি হোত ফিটার বাবু/কলবাবুর আওতায়। দক্ষ ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার যখন পৌঁছে যেত তাদের বলা হত ডাক্তার সাহেব এবং কল সাহেব। যে দর্শনকে ভিত্তি করে একজন শ্রমিক তার অবসরের পর তার এক উত্তরাধিকারীকে শ্রমিক পদে বহাল করতে সুযোগ পায়, প্রায় সেই দর্শনেই অবসরপ্রাপ্ত কোনো বাবুও অলিখিতভাবে একই সুযোগ পেয়ে থাকত এবং এখনো থাকে। যদি তার কোনো উত্তরাধিকার না থাকে তবে শূন্য পদটির পূরণে যোগ্য ব্যক্তির খোঁজ হয়। তখন কিন্তু বাবুকে বাঙালি হতেই হবে বলে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। তাই বর্তমানে চা-বাগানে বাগানের চাকরিতে বহাল হচ্ছে বহু শিক্ষিত আদিবাসী, নেপালী ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষজন। চা-বাগান গোড়াপত্তনে বাবু বলতে শুধু বাঙালির একাধিপত্য থাকলেও এখন বাবু বলতে বলা হয় চা বাগিচার শিক্ষিত বিভিন্ন পেশাদারি মানুষকে। বাগিচাগুলিতে বাবুদের সঙ্কট নিয়ে কলম ধরবার পূর্বে নিজের চোখে দেখা একটা ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। আসছিলাম আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দের অন্তর্গত বীরপাড়া চা বাগিচার পাশ দিয়ে। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে বন্ধ হওয়ার পর ডানকান পরিচালিত বীরপাড়া চা বাগানটি খোলে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে। বাগান বন্ধ থাকাকালীন অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে বেশ কিছু শ্রমিক, কর্মচারীর মৃত্যু হয় বলে সে সময় অভিযোগ ওঠে। যদিও রাজ্য সরকার ও তৃণমূল ওই অভিযোগ উড়িয়ে দেয়। বছর তিনেক ধুঁকে ধুঁকে বাগান চলার পর ফের ম্যানেজার বাগান ছেড়ে চলে যাওয়ায় অঘোষিত লক আউটের ছায়া পড়ে চা বাগানটিতে। আসলে বর্তমানে চা বাগানের মালিকপক্ষ শ্রমিক কর্মচারী সংকোচনের পক্ষপাতী। ধীরে ধীরে কর্মচারীদের সংখ্যা নানা কৌশলে কমানো হচ্ছে। কমানো হচ্ছে কৌশলগতভাবে স্টাফ এবং সাব স্টাফেদের সংখ্যা। শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ। ধীরে ধীরে চা-বাগানে লুপ্তপ্রায় বিরল প্রজাতিতে পরিণত হচ্ছে ওই দুটি শ্রেণী।
সালটা ২০১৯। বীরপাড়া চা বাগান সদ্য বন্ধ হয়েছে। বীরপাড়া চা বাগিচার পাশ দিয়ে আসতে আসতে চোখে পড়ল হাতে হাসুয়া, কলমছুরি নিয়ে চা গাছগুলি কাটাছেড়ার কাজ চলছে। ছবি নেওয়ার জন্য গাড়ি থামিয়ে বাগিচাতে প্রবেশ করলাম। দেখলাম এক অদ্ভূত দৃশ্য। বাগান ও নিজেদের সংসার বাঁচাতে গোটা চা বাগানের দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছেন ডানকান পরিচালিত আলিপুরদুয়ার জেলার বীরপাড়া চা বাগানের শ্রমিক ও কর্মচারীরা। কাঁচা চা পাতা তুলে বিক্রি করার পাশাপাশি চা গাছগুলির যত্ন নিতেও আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছেন তাঁরা। এমনকি যাঁরা চা বাগানের বাবু স্টাফ হিসেবে পরিচিত, বাগান বাঁচাতে তারাও হাতে তুলে নিয়েছেন হাঁসুয়া, কলমছুরি। চা বাগানের জঙ্গল কেটে সাফ করা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজকর্ম করতে শুরু করেছেন তাঁরাও। এই দৃশ্য আগে কখনও দেখিনি। সচরাচর কলোনিয়াল বা ঔপনিবেশিকতাবাদ যে ধারণাই হোক না কেন, চা বাগিচার শ্রেণী বৈষম্যের কারণে সবাই সবার সঙ্গে দূরত্ব নির্মাণ করে এটাই এতদিন শুনে এসেছিলাম। প্রত্যেকটি চা বাগানেই বাবু স্টাফ আর শ্রমিকদের কাজকর্মে ফারাক থাকে। ফারাক থাকে বেতনেরও। কিন্তু বীরপাড়া চা বাগিচাতে ধারণাটা পালটে গেল। নিজের চোখে দেখে এসেছিলাম পরিস্থিতি। বাগান বাঁচাতে তখন মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। বীরপাড়া চা বাগানে তৈরি হওয়া অচলাবস্থা সবাইকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কতটা দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে চা বাগানের শ্রমিক রিনা কেরকেট্টা, সুরজ লাকড়াদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাতা তোলা, গাছের যত্ন নিতে পরিশ্রম শুরু করেন কারখানার মেকানিক হরিশচন্দ্র দাস, ক্লার্ক রবিনসন কুজুর সহ অন্যরা। বাগানের পিএফ ক্লার্ক অজয় এক্কা দুঃখ করে জানিয়েছিলেন বীরপাড়া চা বাগানের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। তারা নিরুপায় হয়ে এ কাজ করতে পারেন তা চোখে না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবেন না। তাই যারা বাবু স্টাফ হিসেবে পরিচিত তাঁরাও বাগানের গাছের যত্ন নিতে বাধ্য হয়েছে। বাগানের বিদ্যুৎকর্মী শংকর বর্মন বলেছিলেন তাঁরা চরম বিপাকে পড়েছেন বলে শ্রমিকদের সঙ্গে তাদেরও চা পাতা তুলতে হয়েছে, জঙ্গল সাফাইও করতে হয়ছে। তবে কাঁচা চা পাতা তোলার মরশুম শেষ হলে এরপর তাদের রুজি রোজগারের কী হবে সেই আতঙ্কই তখন গ্রাস করেছিল দু’হাজারেরও ৰেশি শ্রমিক-কর্মচারীর পরিবারকে।
আসলে স্টাফ এবং সাব স্টাফদের কমিয়ে সেই কাজ করানো হচ্ছে দিন হাজিরা শ্রমিকদের দিয়ে যাদের অনেকেই স্থায়ী শ্রমিক নন। আর বাবুর কাজ করানো হচ্ছে অ্যাসিস্ট্যান্ট তকমাধারী কিছু চুক্তিভিত্তিক বহিরাগতকে দিয়ে। অথচ বাগানের চৌহদ্দিতেই বহু কর্মপ্রত্যাশী পড়ে রয়েছে। আসলে এসব হলো চা বাগানে চলে আসা চিরায়ত শাসন কাঠামো ভেঙে ফেলে এক স্বেচ্ছাচারি শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার অশনি সংকেত যে ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ শেষ কথা বলবে। দেশের রাজা হবেন নীরব দর্শক। আর থোর বড়ি খাড়া আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ একদিন ঘুম ভেঙে দেখবেন যাদের স্বার্থে তারা লড়াই করছেন তারা কেউ পেছনে নেই। সবাই সেদিন নতজানু হবেন স্বেচ্ছাচারী বাগান মালিকদের পদমূলে। চায়ের দেশে সেই কালো দিন বোধহয় সমাগত। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন বেতন বৃদ্ধির নির্দেশ কার্যকর করার পাশাপাশি অন্য যে সমস্ত দাবিগুলো নিয়ে উত্তরবঙ্গের ১৫০০০ বাগান কর্মচারী সরব হন সেগুলির মধ্যে অন্যতম হলো তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর করা, শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগ, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিকদের দিয়ে সাব স্টাফ এবং টেকনিক্যাল সি ক্যাটাগরির কর্মচারীদের নির্ধারিত কাজ করানো বন্ধ করা ইত্যাদি। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রমদপ্তর একটি নির্দেশিকা জারি করে চা শ্রমিকদের মজুরি ১৩২ টাকা ৫০ পয়সার উপরে অন্তর্বর্তীকালীন ভিত্তিতে ১৭ টাকা ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করে। সেই সময় বাবু এবং সাব স্টাফদের ২০১৭ সালের ৩১ শে মার্চ অনুযায়ী পাওয়া মোট বেতন অর্থাৎ গ্রস স্যালারি এর ওপর ১৮ শতাংশ হারে বেতন বাড়ানো হয়। পরবর্তীকালে ৩১ শে আগস্ট জারি করা আরেকটি নির্দেশিকায় শ্রমদপ্তর অন্তর্বর্তীকালীন ভিত্তিতে শ্রমিকদের মজুরি পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে আরও ১০ টাকা এবং পয়লা অক্টোবর থেকে ৭ টাকা বাড়ানোর পরামর্শ দেয়। সেই হিসেবে একজন শ্রমিক মজুরি পেতে শুরু করেন ১৭৬ টাকা। এর মধ্যে অবশ্য রেশন বাবদ প্রদেয় মজুরি খাতের অন্তর্বর্তীকালীন ৯ টাকাও ছিল। এরপর বাবু এবং সাব স্টাফদের জন্য ১২ ই অক্টোবর দ্বিতীয় দফার বেতন বৃদ্ধি সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশিকাটি জারি হয়। তাতে শ্রমদপ্তর এর পরামর্শ ছিল শ্রমিকদের সর্বশেষ যে হারে মজুরি বাড়ানো হয়েছে সেই একই আনুপাতিক হারে বাবু এবং সাব স্টাফদের বেতন বাড়াতে হবে। সেটা কার্যকরী না হওয়াতে বাবু এবং সাব স্টাফেরা আন্দোলনে নামেন।
ডুয়ার্সের জিতি, নয়া সাইলি, বানারহাট, কারবালা, লক্ষ্মীপাড়া, মরাঘাট, হলদিবাড়ি, তেলিপাড়ার মতো বিভিন্ন চা-বাগানে কর্মবিরতিকে ঘিরে কর্মচারী মহলে ভালো সাড়া পড়ে। তরাই এর বাগানগুলিতেও কর্মবিরতি পালন করেন বাগান কর্মীরা। তরাই এর ৪২ টা চা বাগানের মধ্যে বাইশটা চা-বাগানে কর্মবিরতি পালন করা হয়। এই আন্দোলনের জেরে নিশ্চিন্তপুর, মেরিভিউ, হাসখাওয়া, গঙ্গাধর, মতিধর, সয়দাবাদ সহ একাধিক বাগানে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। স্টাফ এবং সাব স্টাফেদের জয়েন্ট কমিটির তরফে সাধন দাশগুপ্তের নেতৃত্বে এই কর্মবিরতি আন্দোলন পালিত হয়। এর আগে গত ১৬ জুলাই বাবু এবং সাব স্টাফেরা মালিকদের বিন্নাগুড়ির ডিবিআইটিএ, জলপাইগুড়ির আইটিপিএ এবং মাটিগাড়ার অফিস ঘেরাও করে। তার আগে সাতাশে জুন কলকাতায় বেতন বৃদ্ধি নিয়ে শ্রম দপ্তরের নির্দেশিকা কার্যকর করার জন্য দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও সেদিন কোনো সমাধান সূত্র বেরোয় নি। মালিকপক্ষ তাদের মতামত জানানোর জন্য দু তিনদিন সময় চেয়ে নিলেও তা কার্যকর করতে গরিমসি করেছেন তারা। তাই বর্ধিত হারে বেতন দেওয়া সহ আরো আট দফা দাবিতে কর্মবিরতিতে নেমেছিলেন উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলিতে কর্মরত বাবু এবং স্টাফেরা। মন্ত্রীর উপস্থিতিতে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হলেও কোন সমাধানসূত্র মেলেনি বলেই এই সিদ্ধান্ত। এই কর্মবিরতির ফলে চা বাগানগুলিতে স্বাভাবিক কাজকর্মের ওপর ভাল প্রভাব পড়ে। মালিকপক্ষ নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকায় স্টাফ এবং সাব-স্টাফদের বেতন চুক্তিটা বিধানসভা নির্বাচনের মুখে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা তৃণমূলের কাছে। ফলে বিধানসভা ভোটের আগে তাদের মন জয় করার চেষ্টা শুরু হয় রাজ্য সরকারের তরফে। চা শ্রমিক ভোটারদের বুথমুখী যারা করে থাকেন সেই বাবু এবং সাব স্টাফদের উপেক্ষার জবাব দিতে তারা প্রস্তুতি নিতে শুরু করলে প্রমাদ গুনতে হবে রাজনৈতিক দলগুলিকে, বিশেষ করে রাজ্যের শাসকদলকে। অন্যথায় নির্বাচনে ফলাফল যে ভালো হবে না দলীয় স্তরে সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তৃণমূলের শ্রমিক নেতারা। কেননা সাড়ে চার লক্ষ চা শ্রমিকের রাশ কার্যত রয়েছে প্রায় দশ হাজার স্টাফ এবং সাব-স্টাফের হাতেই।
তবে বেতন চুক্তি দ্রুত কার্যকরের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন চা বাগান তৃণমূল কংগ্রেস মজদুর ইউনিয়নের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বাবলু মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে যখন কথা বলেছিলাম তখন তিনি জানিয়েছিলেন ভোটের সঙ্গে বেতন চুক্তির সরাসরি সম্পর্ক নেই। তবে বেতন চুক্তি যাতে দ্রুত কার্যকর হয় সেটা অত্যন্ত জরূরী। তখন মজুরি নিয়ে জোড়া বিপদ ছিল রাজ্য সরকারের সামনে। চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি চুক্তি নিয়ে উত্তরে আন্দোলন যখন সংগঠিত হচ্ছে, তখন বেঁকে বসেছিলেন বাগানের স্টাফ এবং সাব-স্টাফরাও। মূলত তাদের এই বেঁকে বসাটাই কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল রাজনৈতিক নেতাদের। শ্রমিক সংগঠনের মাথারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা হলেও চা শ্রমিকদের ভোটের লাইনে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা নিয়ে থাকেন বাগানের স্টাফ এবং সাব স্টাফরাই। ফলে চা বাগান অধ্যুষিত এলাকায় রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভরশীল স্টাফ এবং সাব-স্টাফদের ওপর। তাই বিগত বিধানসভা নির্বাচনের মুখে নতুন করে বেতন চুক্তির দাবিতে বাবুরা আন্দোলনে নামায় তাই কিছুটা হলেও চিন্তিত ছিল রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল। যে কারণেই চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, স্টাফ এবং সাব-স্টাফদের বেতন চুক্তি নিয়ে উদ্যোগী হয় রাজ্য সরকার। তবে জট খোলেনি। স্টাফ এবং সাব-স্টাফদের বেতন চুক্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রে ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর কলকাতায় ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়। কিন্তু সমাধান সূত্র বের হয়নি। ২৯ ডিসেম্বর শিলিগুড়ির শ্রমিক ভবনে শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গে বৈঠকে বসে নেতৃত্বের বক্তব্য শোনেন শ্রম কর্তারা। কিছুদিনের মধ্যে মালিকপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা জানান অতিরিক্ত শ্ৰম কমিশনার মহম্মদ রিজওয়ান। এরপরেই সমাধানের লক্ষ্যে নতুন করে ফের ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিকভাবে জট লাগে বেতন চুক্তি কার্যকরের দিন নিয়ে। স্টাফ, সাব-স্টাফ জয়েন্ট কমিটির দাবি ছিল বেতন চুক্তি কার্যকর করতে হবে ২০২০-র ১ এপ্রিল থেকে। মালিকপক্ষ ২০২১ এর ১ এপ্রিল থেকে তা কার্যকর করতে চায়। সরকারি তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয় ২০২১ এর ১ জানুয়ারি। কিন্তু কোনও পক্ষই তাতে সাড়া দেয়নি। নিজেদের অবস্থানে তারা অনড় থাকবেন বলে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন সিটু অনুমোদিত টি এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল তথা জয়েন্ট কমিটির নেতা সাধন দাশগুপ্ত। বেতন চুক্তি কার্যকর না হলে যে তার প্রভাব ভোটে পড়বে তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন তিনি। এটাও বলা হয় বেতন চুক্তির দিন নির্দিষ্ট হলেই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। (এরপর দ্বিতীয় পর্বে চোখ রাখুন)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴