চা বাগিচা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
চা বাগিচা (দ্বিতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে। আর কে না জানে উত্তরের লোকসভা নির্বাচন মানেই জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং এর চা বাগিচা বলয়। তাই এপ্রিল মাস জুড়ে সহজ উঠোনের বাগিচা বৃত্তান্তে মজুরি এবং পিএফ এবং গ্র্যাচুইটির সাতপালা গান গাইব বলে ঠিক করেছি। শোষণ যে কত রকমের হয়ে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ চা শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি। ন্যুনতম মজুরি নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন, ত্রিপাক্ষিক, দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, অনেক আলোচনা পর্যালোচনা হল। কিন্তু ন্যুনতম মজুরি বৃদ্ধি যে তিমিরে সেই তিমিরেই। আগের দিন বলেছিলাম ‘ন্যূনতম মজুরী’ ধারণা আসলে জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম, অধিকতর ভোগবিলাসের জন্য নয়। এই পরিমাণ মজুরী মজুরকে না দিলে সে পরিবারের সকলের প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য যথোপযুক্ত আহারের ব্যবস্থা করতে পারে না এবং নিজেও পরের দিন শ্রম দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত সক্ষমতা নিয়ে কাজে আসতে পারে না। এই মাগ্যিগন্ডার বাজারেও বছর কয়েক আগে শ্রমিকদের মজুরি ছিল দৈনিক ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। এটা অস্বীকার করা যায় না জুন মাসে মুখ্যমন্ত্রীর অন্তর্বর্তীকালীন ঘোষণা অনুযায়ী সেটা হয়েছে দৈনিক ২৫০ টাকা। অবশ্য সব বাগান মালিকেরা যে এই পয়সা দেবে বা দিচ্ছে তার কোন গ্যারান্টি কয়েকদিন আগেও ছিল না। তারা মামলা করেছিল। তবে এখন দিতে বাধ্য হচ্ছে। চা শিল্পে কোনো আইন শ্রমিকের প্রাপ্য পাওনাকে গ্রাহ্য করে না। চা শিল্পে প্রথম থেকেই শ্রমিকদের মজুরী কম। আজও ওদের যা মজুরী তাতে প্রাণ বাঁচানো দায়। স্বাধীনতার পরে শ্রমিকদের জন্য অনেক ভাল আইন হয়েছে। কিন্তু আইন আইন-ই থেকে গেছে। বাস্তবে সে আইন প্রয়োগ হয়নি। এমনকি ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হবার পরও শ্রমিকদের আয় বাড়ানো যায়নি। আমরা দেখেছি পরাধীন ভারতে দীর্ঘকাল ওদের মজুরী একই থেকে গেছে। অথচ বাজারে জিনিসের দাম সব সময়েই বেড়েছে। তাই যতদিন গেছে তত ওদের প্রকৃত আয় কমেছে। পরাধীন ভারতে ওরা সহজ সরল ও অশিক্ষিত ছিল। সুতরাং সে সুযোগ যেমন চা মালিকপক্ষ নিয়েছে, তেমনি নিয়েছে চা-বাবুরা।
চা বাগিচাতে পুরণো দিনে ‘সরদাররা’ একটু শিক্ষিত ছিল এবং তাদের ক্ষমতাও ছিল অসীম। এরাও কিন্তু নিজের জাতভাই বলে শ্রমিকদের ছেড়ে দেয়নি। শ্রমিক শোষণ এরাও করেছে। ফলে অচিরেই এরা ধনী হয়েছে। জমি-জমা কিনেছে। এমনকি প্রয়োজনে এরা চা কর্তৃপক্ষকে ধার দিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে সন্তানকে ভাল জায়গায় রেখে পড়াশুনা করিয়েছে। শ্রমিকের শ্রম চুরি করে এবং অন্যান্য অসৎ কাজ করে বাবুরাও ধনী হয়েছে। চা বাগিচায় যারা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী যেমন বৈদার, দফাদার, চৌকিদার, ডাকওয়ালা, রুটিওয়ালা, মুন্সি এরা অল্পবিস্তর পড়াশুনা জানত। সুতরাং এদের অবস্থা সাধারণ চা শ্রমিকদের চেয়ে ভাল ছিল। অবশ্য ধারাবাহিক আন্দোলন এবং ঘরে বাইরে বিভিন্ন চাপের ফলে সরকার ন্যূনতম মজুরির ঢোক গিলে এ বিষয়ে কিছু করার জন্য ২০১৫ সালে একটা কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সেই লোক দেখানো কমিটি এখনো কোন সদর্থক ভূমিকা রেখেছে বলে জানা যায়নি। কমিটিতে শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা তো একসময় অভিযোগ জানান যে দু বছরে তাদের মাত্র তিনবার কমিটির সভায় ডাকা হয়েছে। বলা যেতে পারে এই কমিটিকে জন্ম থেকেই পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে পরামর্শদাতা কমিটির ১৪ টি বৈঠকের পর এখনও বিষয়টি দিনের আলো দেখেনি। ফলে সবমিলিয়ে মজুরি ইসুতে হতাশা ক্রমশ বাড়ছে উত্তরের চা বাগানে। ২০১৫ সাল থেকে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে একের পর এক বৈঠক হলেও কোনো সমাধানসূত্র বের হয়নি। ন্যূনতম মজুরি সংক্রান্ত সরকারি প্রতিনিধির উপস্থিতিতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষ এর আগে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছে। তাতে সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে মাঝেমাঝে শ্রমমন্ত্রীও থাকতেন। চা-শিল্পের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নূন্যতম মজুরীর বিষয়টি মাথায় রেখে এবং পরিবর্তিত মহার্ঘ ভাতা বিবেচনায় রেখে ২০১৪ সালের শুরুতেই দাবীপত্র জমা দিয়েছিল। দাবীপত্রের ভিত্তিতে ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকাও শুরু হয় ২০১৪-র ফেব্রুয়ারী মাস থেকে। দফায় দফায় মিটিং হলেও কোনো সমাধান সূত্র বের হয় নি।
অপরদিকে ট্রেড ইউনিয়নগুলি সম্মিলিতভাবে আন্দোলনের চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে। ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষে চালসা, মালবাজার, শিলিগুড়িতে দফায় দফায় বৈঠকে মিলিত হয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব। জয়েন্ট ফোরাম নেতৃত্ব একযোগে শ্রমিকদের অধিকার মর্যাদা রক্ষায় নূন্যতম মজুরী দ্রুত রূপায়নে শ্রম আইন লঙ্ঘনের প্রতিরোধে বন্ধ বাগান খোলার দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের আগস্টে শিলিগুড়ি শহরে অনুষ্ঠিত হয় যৌথ ফোরামের ডাকে মহামিছিল। হাজার হাজার চা-শ্রমিক মিলিত হয় শিলিগুড়ি জংশনে। প্রায় ২৪ টি ট্রেড ইউনিয়নের আলাদা আলাদা ঝান্ডা, ব্যানার নিয়ে নানা জনজাতির মানুষ মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বদের সামনে রেখে দৃপ্ত পদক্ষেপে মিছিল চলতে শুরু করে বাঘাযতীন পার্কের দিকে। জাতপাতের নামে যে ঘৃণার রাজনীতি তৈরী হয়েছিল উত্তরবঙ্গে চা-শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ অর্থনৈতিক দাবী-দাওয়ার আন্দোলনে তা অনেকটা পেছনে চলে যায়। বাঘাযতীন পার্কে মিছিল পৌঁছানোর পর দীর্ঘক্ষণ সেখানে সভা চলে। চা শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের সেটাই কিন্তু শুরু। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আন্দোলন চলতে থাকে দিনের পর দিন। গড়ে ওঠে চা শ্রমিকদের যৌথ সংগঠন জয়েন্ট ফোরাম। শিলিগুড়ির দাগাপুরের শ্রম ভবনে ফোরামের একটি বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০২২ এর ১২ নভেম্বর মালবাজারে একটি পূর্ণাঙ্গ বৈঠকের পর আন্দোলনের রূপরেখা ঠিক হবে। সেই বৈঠকে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে রাজ্য সরকারের গঠিত পরামর্শদাতা কমিটির ১০ জন শ্রমিক প্রতিনিধিও থাকবেন। জয়েন্ট ফোরামের অন্যতম নেতা মণিকুমার দার্নাল বলেন, 'ন্যূনতম মজুরি নিয়ে মালিকপক্ষের ঢিলেমি রয়েছে। দ্রুত এর বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন শুরু হবে। নভেম্বর থেকেই আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা হয়। ৯ ও ১১ সেপ্টেম্বর শিলিগুড়ি এবং দার্জিলিংয়ে সমস্ত শ্রমিক সংগঠনগুলিকে নিয়ে সভা আয়োজিত হয়। সেরকম সভা মালবাজারেও অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিস্তারিত আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। ২৭ অক্টোবর কলকাতায় চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে সরকার, মালিক ও শ্রমিক - তিন পক্ষ থেকে দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত ৬ সদস্যের কমিটির একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের আলোচনার নির্যাস জয়েন্ট ফোরামের বৈঠকে উপস্থিত সমস্ত শ্রমিক নেতাদের সামনে পেশ করা হয়।
দেখা যায় শ্রম আইন মোতাবেক ন্যূনতম মজুরি কত হবে তা বেশ কিছু উপাদানের ওপর নির্ভর করছে। এতে রয়েছে শ্রমিক পিছু প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্রের মতো বিভিন্ন মৌলিক চাহিদা। টাকার অঙ্কে ওই সমস্ত উপাদানের মূল্য কত হতে পারে তা হিসেব কষে বের করার প্রয়োজন দেখা যায়। পাশাপাশি চা বাগানে মালিকরা বর্তমানে ফ্রিঞ্জ বেনিফিটের আকারে বাসস্থান, চিকিৎসা, জ্বালানি, ছাতা-জুতো-চপ্পল বা শ্ৰমিক পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য পরিবহণ বাবদ যে সমস্ত সুযোগসুবিধা দিয়ে থাকেন, ন্যূনতম মজুরিতে তা অন্তর্ভুক্ত হবে, নাকি সেটা বর্তমানের অবস্থাতেই থাকবে ওঠে সেই প্রশ্নও। শ্রমিক সংগঠনগুলির দাবি, মালিকপক্ষ ন্যূনতম মজুরি থেকে এসব বাদ দিয়ে দিতে চাইছে। একজন শ্রমিক পিছু ৩ সদস্যের একটি পরিবারকে উপভোক্তা ইউনিট হিসেবে তা ধরে ন্যূনতম মজুরির অঙ্ক নির্ধারণেও মালিকপক্ষের আপত্তি রয়েছে। রবিন রাই, কমল বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরজ সুব্বার মতো শ্রমিক নেতা সহ মণিকুমার দার্নালের যুক্তি ছিল আইনসিদ্ধ ন্যূনতম মজুরি কীভাবে হতে পারে তা নিয়ে শ্রমিক ইউনিয়নগুলির বক্তব্য আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিক স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে এমন সিদ্ধান্তই নিতে হবে। ৩ সদস্যের পরিবারকে উপভোক্তা ইউনিট হিসেবে ধরেই ন্যূনতম মজুরি ঠিক করার বিষয়টি এর আগে অ্যাটর্নি জেনারেলের তরফেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘদিন হয়ে গেল চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি চুক্তিই হচ্ছে না। এর নির্ধারিত সময় কবে পার হয়ে গিয়েছে। বর্ধিত মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন চা শ্রমিকরা। উত্তরবঙ্গে তাদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তিন লক্ষের বেশি। টাকার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। আনুপাতিক হারে মূল্যবদ্ধি ঘটেছে। অথচ উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির প্রাণভোমরা চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটেনি। কেউ বোঝারই চেষ্টা করেনি যে এটা না করলে উত্তরবঙ্গের সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে না। বাজার মূল্যের নিরিখে এ মজুরি দিতে মালিকপক্ষের অনীহার শেষ নেই।
চা শিল্পের আধুনিকীকরণে নতুন বিনিয়োগ না করায় বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন অনেক চা বাগানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হাজার হাজার চা শ্রমিক অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ৩০ সদস্যের পরামর্শদাতা কমিটির বৈঠকে কোনো সমাধান সূত্র বেরোয় নি। কমিটির শ্রমিক প্রতিনিধিরা মজুরির হার কত হওয়া উচিত সেই ব্যাপারে তাদের প্রস্তাব জমা দিয়ে এসেছিলেন। মালিকদের বলা হয়েছিল আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তাদের মতামত পেশ করার জন্য। কথা হয়েছিল এরপর ৩০ সদস্যের কমিটি থেকে সব পক্ষকে নিয়ে যে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল তারা ফের আলোচনায় বসবে। এই নিয়ে পরামর্শদাতা কমিটির গত ছয় বছরে ১৬ বার বৈঠক হয়ে গেছে। ছোট কমিটি বৈঠকে বসেছে তিনবার। এমন আবহে শুধু একের পর এক বৈঠক হবে, নাকি বিষয়টি দিনের আলো দেখবে এমন উষ্মা প্রকাশ শুরু হয়েছে চা বাগানগুলির শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে। চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে রাজ্যের ভূমিকা এককথায় হতাশাজনক বলে দাবী আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বারলাদের। অন্যদিকে চা বাগান তৃণমূল কংগ্রেস মজদুর ইউনিয়নের নেতা বাবলু মুখোপাধ্যায়দের মতে, ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে রাজ্যের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। তাদের যুক্তি চা শিল্পের সঙ্গে আরও কয়েকটি রাজ্যও জড়িত বলে সেই কারণে কেন্দ্রীয় সরকারকে আগে সর্বভারতীয় স্তরের ন্যূনতম মজুরির হার ঠিক করতে হবে। তবে জলপাইগুড়ি জেলা ক্ষুদ্র চা চাষি সমিতির সম্পাদক বিজয়গোপাল চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন শ্রমিকরাই চা শিল্পের সম্পদ। তাদের মজুরি বৃদ্ধি অবশ্যই প্রয়োজন। বেচারাম মান্না শ্রমমন্ত্রী হওয়ার পর চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে যে তৎপর হয়েছেন তা অস্বীকার করছেন না বিরোধী শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও। শ্রম দপ্তরের ভূমিকাকেও স্বাগত জানাচ্ছে তারা। তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে শ্রমিক সংগঠনগুলো মজুরি বৃদ্ধির নিষ্পত্তিতে রাজ্যের মধ্যস্থতার দিকেই তাকিয়ে থাকে।
বিধানসভার লবিতে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন শ্রমিকদের টাকা দেবে মালিক। মালিক-শ্রমিক বসে ঠিক করুক। সেটা সরকারকে জানাক। সরকার ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে দেবে। ওদের এসব ঠিক করার জন্য সরকার তিনবছর আগে কমিটি গড়ে দিয়েছে। তার একাধিক বৈঠকও হয়েছে। এবার শ্রমিকেরা দু’পক্ষ সর্বসম্মত হয়ে সরকারকে জানাক। রাজ্য সরকারের এই মনোভাবে নিতান্তই ক্ষুব্ধ এবং হতাশ হয়ে পড়ে চা শ্রমিক সংগঠনগুলির জয়েন্ট ফোরাম। ফোরামের পক্ষে জিয়াউল আলম বলেন পৃথিবীতে কোনো পরামর্শদাতা কমিটি মজুরী চূড়ান্ত করে না। একাধিক বৈঠক করে তারা শুধু কি হারে মজুরি ঠিক হতে পারে সেই পরামর্শ দেয় সরকারকে। তারপর সরকার সব যাচাই করে তা ঘোষণা করে। এখানে সরকারের গড়া কমিটিতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষ, সরকারি প্রতিনিধির উপস্থিতিতে একাধিক বৈঠক করে পুরো বিষয়টি সরকারকে জানানো হয়েছে। এবার রাজ্য সরকার সবদিক দেখে মজুরি ঘোষণা করবে। জিয়াউল বলেন, আসলে চা শ্রমিকদের নিয়ে ছেলেখেলা করছে রাজ্য সরকার। দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। চায়ের বাজারে মজুরির হার ও নিজেদের প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে এখন তাই হতাশাই বেড়েছে সাধারণ শ্রমিক মহলে। শ্রমিকেরা কাজ করে দিনের শেষে হাতে যা পায় তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই ডুয়ার্সের চা বাগিচাগুলিতে শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। পরিবারের খাই খরচও এখন উঠে আসছে না ওই রোজগারে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বা চিকিৎসার বিষয়গুলি আলোচনা না করাই ভালো। শ্রমিক নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান অটুট রেখে একে অপরকে দোষারোপেই ব্যস্ত। জয়েন্ট ফোরামের অন্যতম আহ্বায়ক মণিকুমার দার্নালরা যেখানে উত্তরবঙ্গের শ্রমিকদের মজুরির বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রের প্রস্তাবিত নয়া শ্রম আইনের ওয়েজ কোডের দিকে তাকিয়ে আছেন, তেমনি টাই-এর ডুয়ার্স শাখার এককালীন সম্পাদক রাম অবতার শর্মার ভিন্নধর্মী মত ছিল ওই মজুরি দিতে হলে সব বাগানের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে।
শ্রমদপ্তরের কর্তাদের মতে, একতরফাভাবে ন্যূনতম মজুরির বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিলে সেক্ষেত্রে মালিকপক্ষের কাছেও আইন আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পথ খোলা থাকবে। তেমন হলে বিষয়টা ঝুলে থাকবে। ফলে পারস্পরিক আলোচনা এবং সহমতের ভিত্তিতে চুক্তির মাধ্যমে মজুরি বৃদ্ধি হলে কারোর কোন অভিযোগ থাকবে না। যদি সমাধানসূত্র বেড়িয়ে না আসে তবে এমনটাও হতে পারে যে তারপরেও আলোচনা চলতে থাকবে। এই বিষয়ে নর্থবেঙ্গল টি প্ল্যান্টেশন এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সম্পাদক অভিজিৎ রায় বা ন্যূনতম মজুরির পরামর্শদাতা কমিটির শ্রমিক প্রতিনিধি মনিকুমার দার্নাল অথবা আরেক শ্রমিক প্রতিনিধি তেজকুমার টোপ্পো প্রমুখের মতে কত টাকা মজুরি বৃদ্ধি হবে তা বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে সরকার ঘোষণা করুক। তাদের দাবি, অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। রাজ্য এখন চেষ্টা করছে। উদ্যোগে খামতি নেই। মালিকরা যাই বলুক, আইনের আওতায় থেকেই ন্যূনতম মজুরির জট খুলতে হবে। শ্রমিকদের প্রস্তাব শ্রমিক নেতৃত্ব জমা দিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে চা মালিকদের শীর্ষ সংগঠন কনসালটেটিভ কমিটি অফ প্ল্যান্টেশন অ্যাসোসিয়েশন বা সিসিপিএর সেক্রেটারি জেনারেল অরিজিৎ রাহা বা চা মালিকদের সংগঠন টেরাই ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহেন্দ্র বনসাল জানান, গত আট নয় বছরে ২০০ শতাংশ হারে মজুরি বেড়েছে। অথচ তৈরি চায়ের দাম বাড়েনি। যেহারে মজুরি বাড়ানোর নানা কথা চলছে সেটা দিতে গেলে উত্তরবঙ্গের চা শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে। মজুরি বৃদ্ধির ইস্যুতে রাজ্যের ভূমিকার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন শ্রমিকেরা। জ্বালানি কাঠ, ছাতা, জুতো, চপ্পল, আবাসনের মত ফ্রিন্জ বেনিফিটের আকারে বাগানগুলির পক্ষ থেকে যেসব বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় সেসবের পরিবর্তে সমপরিমাণ টাকা প্রস্তাবিত বর্ধিত মজুরিতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠে এসেছে কোন কোন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে।
বর্তমানে প্রতি কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ ২৭০ টাকা। উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ১৬ শতাংশ। প্রতি কেজি চা তে বর্তমানে চা বাগান পরিচালন কর্তৃপক্ষের ১৫ টাকা করে লোকসান হচ্ছে। রোগ পোকার আক্রমণে চা-বাগানগুলির অবস্থা আরো খারাপ। চাবাগান শ্রমিকদের মজুরি চুক্তির বিষয়ে শ্রমদপ্তরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বেচারাম মান্নার সঙ্গে বৈঠকের আগে কনসালটেটিভ কমিটি অফ প্ল্যান্টেশন অ্যাসোসিয়েশনের পশ্চিমবঙ্গের চেয়ারপারসন নয়নতারা পাল চৌধুরী কলকাতাতে সংগঠনের একটি বৈঠকের প্রাক্কালে এই কথা জানিয়েছিলেন। তবে এ কথা ঠিক যে, চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে একমত চা বণিকসভা। বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করে চা বাগান শ্রমিকদের মজুরি সরকারকে বাড়াতে হবে এটা তাদেরও দাবী। অ্যাসোসিয়েশনের পশ্চিমবঙ্গের চেয়ারপার্সনের কথায় শিল্প এবং শ্রমিক উভয়েই যাতে ভালোভাবে চলতে পারে সেই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। মজুরির হার নির্ধারণ এমনভাবে করতে হবে যাতে শিল্পও বাঁচে।
ঋণ স্বীকারঃ ১) পেপার কাটিংঃ উত্তরবঙ্গ সংবাদ, আনন্দবাজার, বর্তমান ২) গদ্যে পদ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে - গৌতম চক্রবর্তী ৩) শুভজিত দত্ত, সংবাদদাতা তথা শিক্ষক, নাগরাকাটা, ৪) বিভিন্ন লেখালেখি এবং তথ্যসূত্রের জন্য কৃতজ্ঞতা সোমেন নাগ, রাম অবতার শর্মা, অমিতাংশু চক্রবর্তী, সুপম বিশ্বাস, প্রাবন্ধিক অশোক গঙ্গোপাধ্যায়, জয়েন্ট ফোরাম নেতৃত্ব তথা ট্রেড ইউনিয়নিস্ট জিয়াউল হক, মণিকুমার দার্নাল, পুলিন গোলদার, যোশেফ মুন্ডা ৫) মানস দাশগুপ্তঃ উত্তরবঙ্গে চা শিল্পে বর্তমান সমস্যা ৬) অভিজিত মজুমদারের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখালেখি (সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট), শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন,
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴