তোতাপাড়া চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
তোতাপাড়া চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে। আর কে না জানে উত্তরের লোকসভা নির্বাচন মানেই জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং এর চা বাগিচা বলয়। তোতাপাড়া বাগিচার সার্ভে করতে রওনা দিয়েছি জলপাইগুড়ি থেকে। কিন্তু ময়নাগুড়িতে তীব্র যানজটে গাড়ি আটকে গেল। সৌজন্য জনগর্জন সভা। তাই তোতাপাড়াতে পৌছতে পৌছতে বিকেল গড়িয়ে গেল। দেখলাম গেট মিটিং চলছে। প্রচুর ভিড়। দাবি ন্যুনতম মজুরি। মনে হল লোকসভা ভোটের মূল ইসুই যেখানে ন্যুনতম মজুরি সেখানে এই বিষয়টা নিয়ে এবারে অনুসন্ধান করাই যাক। তাই এবারে নির্দিষ্ট চা বাগিচার সফরের পরিবর্তে মজুরির বিষয়টা নিয়ে সহজ উঠোনে কলম ধরলাম। বিগত ৭-৮ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চা-শিল্পে উৎপাদন ও মুনাফা বাড়ছে। বৃহৎ প্রতিষ্ঠিত চা-বাগিচাতে চাষের নিবিড়তা বাড়ছে। কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ছে। একই সঙ্গে মালিকদের জন্য সরকারি ভর্তুকি ও সাহায্য বহুমুখী ও ব্যাপক। সমান তালে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় বছর ধরে চা বাগিচা ক্ষেত্র প্রসারিত হচ্ছে এবং অসংখ্য বটলিফ ফ্যাক্টরিতে পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে। অথচ এর সাথে সাথে বাড়ছে শ্রমিকদের দুর্দশা। আসাম ও পশ্চিবঙ্গে গোটা ভারতের প্রায় ৭৫% চা উৎপাদন হয়। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি লজ্জাজনকভাবে দেশের যে কোনো সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রের মধ্যে সবচেয়ে কম। বহু চা শ্রমিক বাগান ছেড়ে নিরুদ্দেশ হচ্ছে। বন্ধ বাগান সম্পর্কে সরকার নজর এড়াচ্ছে। অনাহারে মৃত্যু, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অনুন্নয়নের হাহাকার আজ চা-বাগানের কর্ম পরিচয় হয়ে উঠছে। এমনকি ক্ষুদ্র চা-চাষী, বটলিফ ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা সবাই তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত।
প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার সাত দশক পরেও চা-শিল্পের সাথে যুক্ত ভারতবর্ষের এই প্রান্তিক অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, পরিবহণ ই চা শিল্পে দূর্দশা চলছে বলে দাবি করা হয় চা শিল্পপতিদের তরফে এবং এই যুক্তি খাড়া করেই তারা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বিপক্ষে। কিন্তু বাজার যখন ঠিক থাকে তখন কেন মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আপত্তি তোলা হবে এই প্রশ্ন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের। চা-শিল্পপতিদের বক্তব্য, গুণগতমান বজায় রাখতে গিয়ে বিভিন্ন মরশুমে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় অনেকটাই। তাই মন্দার বাজারে অতিরিক্ত ব্যয় কখনোই সম্ভব নয়। কিভাবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং বর্তমান সময়ে চা শিল্প কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তা নিয়ে টি বোর্ডের কাছে যে বাৎসরিক তথ্য দেয় চা বাগান মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন তাতে দেখা যায় উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও হয় নিলামের দর বাড়ে অথবা পাতা তোলা বেশি হয়। অর্থাৎ এককথাতে ক্ষতি কিন্তু পুষিয়ে যায়। অথচ হিসাবের কায়দাকানুন করে শ্রমিক বা বাবুদের মজুরী বা বোনাস কিন্তু বাড়ে না। শহরের মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে চা-বাগান বেড়ানোর জায়গা। কলকাতাবাসী তো বটেই, উত্তরের মানুষের কাছেও মৃত্যু এবং প্রতিবাদ দুই-ই যেন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। নামগোত্রহীন জনজাতির সদস্যদের জন্য আমাদের সহানুভূতি কতটাই বা জেগে ওঠে? কিন্তু দিনের পর দিন চোখের সামনে না খেতে পেয়ে বৌ-বাচ্চাকে মারা যেতে দেখে, নারীপাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে পরিবারের মেয়েদের নিখোঁজ হতে দেখে বা ন্যায্য মজুরি বা বোনাস না পেয়ে তারা খেপে উঠে যদি কোনও বাগান ম্যানেজারকে পিটিয়ে মেরে ফেলে, তখন আমাদের যাবতীয় বিবেক জেগে উঠে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রতিবাদ করতে। লাগাতার বঞ্চনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ছিন্নভিন্ন করা, অনাহারে মেরে ফেলা কিন্তু ক্রাইমের সমপর্যায়ভুক্ত। অথচ কোনও সরকারই চা বাগানে অনাহার বা অপুষ্টি বা মৃত্যুর ঘটনা স্বীকার করে না।
‘ন্যূনতম মজুরী’ ধারণা আসলে জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম, অধিকতর ভোগবিলাসের জন্য নয়। এই পরিমাণ মজুরী মজুরকে না দিলে সে পরিবারের সকলের প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য যথোপযুক্ত আহারের ব্যবস্থা করতে পারে না এবং নিজেও পরের দিন শ্রম দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত সক্ষমতা নিয়ে কাজে আসতে পারে না। সরকার ঘোষিত অদক্ষ কৃষি মজুরের ক্ষেত্রে যেখানে ন্যূনতম মজুরীর হার নির্ধারিত হয়েছে ২১৬ টাকা, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে তুলনামূলকভাবে চা বাগিচা শ্রমিকদের মজুরীর হার অত্যন্ত কম। একবিংশ শতকেও মজুরদের ন্যূনতম মজুরীর দাবী উপেক্ষিত হতে পারে এ কথা সভ্যতা-বিরোধী সন্দেহ নেই, তথাপি আমাদের দেশে সেইটাই করুণ বাস্তব। গত কয়েক বছর ধরেই উত্তরবঙ্গের রেডব্যাঙ্ক, বান্দাপানি, কাঁঠালগুড়ি, ঢেকলাপাড়া এবং রায়পুর চা-বাগান থেকে মৃত্যুর খবর আসছিল। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল যা ভাবা গিয়েছিল বাস্তব অবস্থা তার থেকে অনেক খারাপ। খাবার নেই, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কেউ কেউ নদীর বুকে পাথর ভেঙে খুবই সামান্য রোজগার করে। তা দিয়ে খাওয়া চলে না। অতএব অপুষ্টি, অনাহার। পরিবারের জীবনধারণের জন্য চা-বাগান শ্রমিক পরিবারের সবাইকেই শ্রম দিতে হয়। একজনের শ্রমের বিনিময়ে পরিবারের সকল সদস্যের ভরণপোষণ চলে না। ঔপনিবেশিক শাসকদের পক্ষ থেকে চালু করা এই নীতি এবং ব্যবস্থাকেই স্বাধীন রাষ্ট্র সরকারীভাবে মান্যতা দিয়েছে। চা নিয়ে যে কোনো আলোচনায় একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে কৃষিনির্ভর এই শিল্প অত্যন্ত শ্রমনিবিড়। অর্থাৎ শ্রমিক বাদ দিয়ে কোন কিছুই হবে না। সে যত আধুনিকতায় একে মুড়ে ফেলা যাক না কেন, মূল কাজ অর্থাৎ দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তোলার কাজে মেকানাইজেশন নৈব নৈব চ। শ্রমনিবিড় শিল্প হওয়ার ফলে এখানে লোক খাটিয়ে পয়সা। কিন্তু শ্রমিকদের পেছনে যে খরচা হয় তা এস্টেটের ৪০ শতাংশের বেশি নয়। বাকি পয়সা যায় অফিস, ম্যানেজার এবং তার অধস্তনদের রক্ষণাবেক্ষণে, অফিস চালানোর খরচা এবং লভ্যাংশ হিসেবে মালিকদের পকেটে।
কোন ধরনের সরকারি বিধিনিয়ম বা নিয়ন্ত্রণের অভাবে এই শিল্পে মজুরি অত্যন্ত কম হওয়ার জন্য সাধারণভাবে শ্রমিকদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। চা শিল্প যখন গড়ে উঠেছিল তখন ওদের কত মজুরি দেওয়া হতো তা জানা যায় না। দান খয়রাতিতে আপাতত ক্ষিদের যন্ত্রণা মিটলেও বাগানের মানুষগুলি চায় বাগান ফের চালু হবার মতো স্থায়ী সমাধান অথবা জীবন যাপনের জন্য ন্যূনতম মজুরি। কারণ এতদিনে তারা সবাই জেনে গেছে এই সমস্যা বাগান মালিকদের নিজেদের তৈরি চা শিল্পের নয়। এটুকু অনুমান করাই যায় দীর্ঘ বঞ্চনার কষ্ট এবং শ্রমিক নেতাদের ভন্ডামি গুন্ডামি সহ্য করার পর ডুয়ার্সের চা বাগানে আর উচ্ছ্বাস নেই। নেতাদের প্রতি আস্থা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অপুষ্টি অনাহার দুর্ভিক্ষের পরিমাণ বোঝার জন্য মান্য সূচক হল বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই। এই সংখ্যা যদি ১৮.৫-এর নীচে হয় বুঝতে হবে তার ওজন স্বাভাবিকের কম— সে অনাহার, অপুষ্টিতে আছে। কোনও জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের বিএমআই ১৮.৫-এর তলায় থাকলে ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজ়েশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। চা-শ্রমিক মারা গেলে সরকারি মহল থেকে বলা হয় কেউ অনাহারে বা অপুষ্টিতে মারা যায় নি। এটা ঠিক, দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা না হলেও ক্রমাগত অপুষ্টি ও অনাহার নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে রায়পুর সহ কিছু কিছু চা বাগিচাকে। পরিসংখ্যান বলছে চা শিল্পে শ্রমিক সংখ্যার দিক থেকে ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম। এর বেশিরভাগই মহিলা। চায়ের বাজারে ভিড় করে আছে মধ্যস্বত্বভোগীরা এবং তাদের মাথায় বসে আছে করপোরেটরা। এই পিরামিডের সবচেয়ে দূর্বল এবং ভঙ্গুর বিন্দুতে যে চা শ্রমিকেরাই থাকবেন তা বুঝতে আলাদা বুদ্ধি লাগে না। এখানে তাদের দর কষাকষির ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে। থাকলেও খুবই সামান্য। ফলে বিশ্ব বাজারে চায়ের দাম শিখর স্পর্শ করেছে। কিন্তু চা শ্রমিকরা সাম্প্রতিককাল থেকে বাজারের মূল্যনিরিখে বিচার করলে ৩০ বছর আগে যে মজুরি পেতেন এখনও প্রায় তাই পাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে সেটাও কমে গেছে।
কর্মসংস্থানের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের এক নম্বর সংগঠিত শিল্পে চাকরি পাওয়া একসময় ভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করা হতো। চা শ্রমিকদের আর্তনাদ এবং হাহাকার চিরকালই ছিল চা বাগানের নয়ানাভিরাম দৃশ্যপটের তলায় চাপা। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে সেই কঙ্কালসার চেহারাগুলো মাটির তলা থেকে উঠে এসে জানান দিচ্ছে তারা বেঁচে আছে। চিন্তা করলে গা ঘিনঘিন করে যে সংগঠিত শিল্প বলা হলেও এই শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা অসংগঠিত শিল্পের থেকেও খারাপ। এই শিল্পে কোন ন্যূনতম মজুরির বালাই নেই। ন্যূনতম মজুরি চাইতে গেলেই মালিকেরা আওয়াজ তোলেন যে চা শিল্প সংকটে এবং তাঁরা বাগান বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। কারন মালিকরা জানিয়ে দিয়েছেন যে কোন অবস্থাতেই তাঁরা ন্যূনতম মজুরি দিতে ইচ্ছুক নন। সরকার অথবা মালিকপক্ষ যে বিষয়টা জানে না তা কিন্তু একেবারেই নয়। অনেক পয়সা খরচ করে তারা লোক পোষে শ্রমিকদের পয়সা মারার মামলা ঘেঁটে ঘ করে দেওয়ার জন্য। তাঁরা জানেন যে তাঁরাই শেষ কথা। কারণ প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলি এবং তাদের নেতারা ফুটানি করে তাদেরই পয়সায়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে একটা বাগানের ভালো দাম পাওয়া নিশ্চিত করতে মালিক, ম্যানেজমেন্ট, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট সকলের দায়িত্ব আছে। সঙ্গে অবশ্যই এটাও নিশ্চিত করতে হবে শ্রমিকরা যেন তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। সমস্ত চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি আবশ্যিক তো বটেই, তার সঙ্গে তাদের সামাজিক সুরক্ষা এবং অন্যান্য চাকরিগত সুযোগ সুবিধাগুলিকেও নিশ্চিত করতে হবে। রাজ্যে প্রায় সাড়ে চারশো চা বাগান আছে ছোট-বড় মিলিয়ে এবং কার্যত উত্তরবঙ্গের এক বড় অংশের অর্থনীতি চা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের রাজ্যে বড় বড় কোম্পানি মালিকানাধীন বাগানের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও টাটা টি, গুডরিকস, ডানকানস, অ্যান্ড্রু উইলস, জয়শ্রী টি ইত্যাদি ভালো ভালো কোম্পানির ভালোই উপস্থিতি আছে। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় বাগিচা শিল্পের মতো আমাদের দেশের চা শিল্পেও এক ধরনের বৈপরীত্য বিরাজ করে।
স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৫৭ সালে যখন ইন্ডিয়ান লেবার কমিশন (আই-এল-সি) প্রয়োজনভিত্তিক ন্যূনতম মজুরীর ধারণা ঘোষণা করে, তখন পরিবারের তিনজনের ভরণপোষণ করা যাবে এমন মজুরীকে মানদন্ড হিসাবে নির্ধারণ করা হয়। আই-এল-সি সুপারিশকে ভিত্তি করে বাগিচা শ্রমিকদের মজুরী নির্ধারণের জন্য চা-শিল্পে সেন্ট্রাল ওয়েজ বোর্ড গঠিত হলে চা-মালিকদের পক্ষ থেকে তিনজনের ভরণপোষণের জন্য মজুরী নির্ধারণের মানদন্ডের প্রবল বিরোধিতা করা হয় এবং দাবী করা হয় যে দেড়জনের ভরণপোষণ সম্ভব এমন মজুরীকে মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ শ্রমিকের নিজের এবং এক সন্তানের আংশিক ভরণপোষণ সম্ভব এমন মজুরীকে ন্যূনতম মজুরী হিসাবে গণ্য করতে হবে। তাদের যুক্তি ছিল যে চা-শিল্পে শ্রমিক নিয়োজিত হয় পরিবার ভিত্তিক অর্থাৎ পরিবারের সকলে উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে। এই যুক্তিতে তাঁরা দাবী করে যে পরিবারের সম্মিলিত মজুরীকে জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট কিনা তাই বিবেচনা করতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উত্তরের চা বাগিচা শিল্পে এই শিল্পের মালিকেরা বেশ রশেবসেই আছেন। আসলে যারা সংকটে পিষ্ট তারা হল এই শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিক এবং তাদের পরিবার পরিজন। দুটো বিষয়ের দিকে নজর দিলে এই শিল্পের শ্রমিকদের সামগ্রিক পরিস্থিতি দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে যাবে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা সেটা হল ন্যুনতম মজুরি। চা-বাগিচার মজুরদের ন্যূনতম মজুরীর দাবী অনেকদিনের। সাম্প্রতিক মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলনে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিবেচনায় নানাবিধ মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ন্যূনতম মজুরীর দাবীর প্রশ্নে যে রকম সঙ্ঘবদ্ধতা দেখা গিয়েছিল তাতে আশা করা গিয়েছিল যে এই দাবী এবার পূরণ হবে। এই দাবীর সাথে মুদ্রাস্ফীতির সাথে সঙ্গতি রেখে মহার্ঘভাতা পাওয়ার অধিকারের দাবীটিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আসলে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স, তরাই এবং দার্জিলিংয়ের এই মনোরম চা বাগানের অন্তরালে যে নিষ্ঠুর শোষণ সর্বদা বিরাজমান তা খালি চোখে ঠাহর করা মুশকিল। এই শিল্পের সওয়ারী হয়ে মালিক থেকে শুরু করে স্থানীয় দালাল এবং বিভিন্ন প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা লাখপতি বা ক্রোড়পতি হয়েছে। কিন্তু যাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফলে এই শিল্পের বিপুল উৎপাদন এবং বাড়বাড়ন্ত হয়েছে সেই শ্রমিকেরা কিন্তু যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেও নেই। তারা মানব জীবনের একেবারে তলার সারিতে কোনরকমে টিকে আছে।
হাজারো সত্যি-মিথ্যে মেশানো গল্প বানিয়ে মালিকরা মজুরি চুক্তি থেকে কম পয়সাতে লোক খাটিয়ে নেয়। আসলে খাতায়-কলমে সংগঠিত শিল্প হলেও চা শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের থেকেও খারাপ। না হলে যেখানে রাজ্যের অসংগঠিত শিল্পে সরকার ঘোষিত সর্বনিম্ন মজুরি ২০৬ টাকা সেখানে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করে এমন একটি শিল্পের শ্রমিকরা কি করে অর্ধাহারে এবং অনাহারে থাকার মত কোন একটা মজুরি পেয়ে যুগের পর যুগ গাধার খাটনি খাটতে বাধ্য হয়? এই শিল্পের শ্রমিকদের তিন বছর অন্তর অন্তর মজুরি চুক্তি যেটা হয় সেটাও এক ধরনের প্রহসন। বাইরে থেকে দেখলে প্রক্রিয়াটা গণতান্ত্রিক বলে মনে হয়। মালিক এবং শ্রমিক দুই পক্ষই সুন্দর সরকারি উপস্থিতিতে যৌথ দর কষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকদের দাবি দাওয়া মিটিয়ে নিচ্ছেন। আসলে শ্রমিকেরা তিন বছর অন্তর অন্তর নিজেদের পাওনা গন্ডা বুঝে নেন না। মালিকদের দাবিগুলির আইনি মান্যতা দেন। এই মজুরি চুক্তিগুলো এখনো পর্যন্ত হয়ে এসেছে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য নয়। মজুরি চাপা দেওয়ার জন্য। রায়পুর চা বাগানে যান। বডিমাস ইনডেক্স আর করতে হবে না। ২০১২ সালে রায়পুর বাগানের ঝাপ বন্ধ হয়েছে। এখনও চলছে সাপলুডো খেলা। রায়পুর যখন গেলাম তখন চা শ্রমিক ফুলতি ওঁরাও, পালহো ওঁরাও, বুদো ওঁরাও, বেরনিকা চিকবরাইকরা জানালো কাঁচা পাতা বিক্রি করবেন তাঁরা নিজেরাই। তাতে যে টাকা রোজগার হবে তা ভাগ করে নেবেন নিজেদের মধ্যে। কারখানাতে চা পাতা পাঠানোর খরচও তাঁরাই বইবেন। বাগানের কাছাকাছিই এমন বেশ কয়েকটি কারখানা রয়েছে। বিভিন্ন চা বাগিচাতে মাঝেমাঝেই মালিকগোষ্ঠি চা বাগানে কাজ বন্ধের নোটিস ঝুলিয়ে বাগান ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু দেখা যায় কাজ বন্ধ রাখে না শ্রমিকরা। বন্ধ হওয়া বাগিচা শ্রমিকেরা কাঁচা পাতা বিক্রি করেন। এই প্রবণতা শীতকালে কাটিং এবং প্রুনিং এর সময় বেশি।
আখেরে যে মজুরি নির্ধারিত হয় সেটা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য এবং যেভাবে অতীতে চা-শ্রমিকদের মুলধারার সভ্যতা থেকে দূরে সরিয়ে এনে চা বাগানের গহীনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেভাবেই বিস্তর ফারাক রেখে দেওয়া হয় তাদের মজুরিতে। অন্য শিল্পের শ্রমিকদের তুলনায় চা শ্রমিকদের মজুরি থেকেছে ধারাবাহিকভাবেই কম। ১৯৮৭ সাল থেকে চুক্তিগুলোর দিকে তাকালে এটা পরিষ্কার যে মজুরি বৃদ্ধি হলেও সেই সময়কালের মূল্যবৃদ্ধির থেকেও সেটা কম থেকেছে। অর্থাৎ টাকার অংকে মজুরি বৃদ্ধি ঘটলেও শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা আগের থেকেও কমেছে। সমাজের যে অংশের মানুষ কোনোক্রমে নুন আনতে পানতা ফুরানোর মজুরি পান তাদের ক্ষেত্রে এই অবস্থা ভয়ংকর। মজুরি বৃদ্ধি সেই সময়ের মূল্যবৃদ্ধির ওপর কোনভাবে ভেসে থেকেছে। ২০১১-১৪ সালের মূল্যবৃদ্ধি আগের থেকে অনেক বেশি দেখাতে লাগলেও এর ফলে সামগ্রীক অবস্থা বা গতিপ্রকৃতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এই বৃদ্ধি হয়েছিল আদিবাসী চা শ্রমিকদের এক উত্তাল আন্দোলনের ফলে। এছাড়াও এই বৃদ্ধির হার খুবই নিম্ন আয়ের ওপর নির্ভর করে হয়েছে এবং পরবর্তীকালে এই বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে। এক সময় কমিউনিস্ট পার্টির দূর্গ ছিল জেলার চা বাগিচাগুলি। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল মালবাজার এবং মেটেলিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সেই ভিত আজ আর নেই বলাই বাহুল্য। জাতপাত, সম্প্রদায়গত সংঘাত নেই বললেই চলে। কিন্তু অবক্ষয়, চোখরাঙানি, বিরোধী দমননীতি শাসকশ্রেণীর প্রাধান্যকে যে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেই তথ্য দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। প্রকৃতপক্ষে বাংলার চা শ্রমিকদের মজুরি উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই অন্যান্য সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের মজুরির থেকেও কম। গত দেড়শ বছর ধরে ওদের মজুরি যা ছিল বা আজও যা আছে তা শুধুমাত্র বাংলা নয়, সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারতে কমবেশি একই অবস্থা। তবে সুযোগ সুবিধা প্রদানের প্রশ্নে বলা যায় বাংলায় শোষণের পরিমাণ বেশি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴