স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/সপ্তম পর্ব
রণজিৎ কুমার মিত্র
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে চলার সন্ধিক্ষণে কত মানুষের কত রকমের অভিজ্ঞতা যে জমা হয়েছে। এক প্রজন্মের অভিজ্ঞতা আর এক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায় সময়ের প্রবাহে। বিমল কুমার বাজপেয়ীর অবসরের পর রেজিষ্টারের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন অধ্যাপক ডক্টর তাপস কুমার চট্টোপাধ্যায়। সম্প্রতি তাঁর অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের আলোকে প্রকাশিত হয়েছে "A Short History of The University of North Bengal -1962-October,2020", উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস জানবার মূল্যবান বই এইটি। ডক্টর চট্টোপাধ্যায় তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা, মতামত ও বিশ্বাসকে ব্যক্ত করেছেন ।
অবস্থানজনিত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে অভিজ্ঞতা ও বিবরণ সবার এক হতে পারে না। নব্য গণমাধ্যমে ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিকদের বহু আলোচিত ইতিহাস তুলে আনবার একাধিপত্য আর নেই। সর্বজনগ্রাহ্য তথ্যই আজকাল এলিট ও সাধারণ সকলের কাছে গ্রহণীয়। পাঠকদের পণ্ডিত, ইতিহাসবিদদের সাথে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের ওপরেও ভরসা রাখতে হয়। "স্মৃতি দিয়ে ঘেরা"তে আমি শুধু ইতিহাস আর তথ্য সম্বল করে হাঁটিনি বরং বহুজনের স্মৃতির উপরে নির্ভর করেছি, সেইসঙ্গে মিশেল দিয়েছি নিজস্ব আবেগ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষদের স্মৃতিকে আমি শুধু উস্কে দিতে চেয়েছি। প্রশ্রয় ও প্রেরণা দুইই পেয়েছি, ভালোলাগার কথা তারা জানিয়েছেন। স্মৃতি বিভ্রমে ভুল করে ফেলা তথ্যের সংশোধন করে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা অনিতা বাগচি, বর্তমান গ্রন্থাগারিক মৃগাঙ্ক মন্ডল, প্রায় মাঝ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার আমার শ্রদ্ধেয় ও ভালোবাসার মানুষ শোভন সান্যাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজের সামনে উপাচার্য বিনয়েনদ্র দাশগুপ্তর সাধের লিলিপুলের সংস্কার ও অনেক অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী মমতা চন্দ, এ লেখার পাঠ প্রতিক্রিয়ায় শুনিয়েছেন নকশাল আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষে নিহত পুলিশ অফিসার সোনম ওয়াং দি-র নিহত হওয়ার পর, তাঁর পরিবারের সাথে অশ্রুসজল অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যের কথা। "স্মৃতি দিয়ে ঘেরা" কোনো ব্যক্তির একার স্মৃতিচিত্র নয়, একটি বৃহৎ বিদ্যায়তনকে ঘিরে সমষ্টির স্মৃতিকথা।
বিতর্ক বিসম্বাদ উপাচার্য অতুল চন্দ্র রায়ের পিছু ছাড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এগ্রিকালচারাল সাইন্স খুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর উদ্যোগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটি হয়েছিল জলপাইগুড়িতে। মেডিকেল কলেজ প্রথমে রাজা রামমোহনপুরের ক্যাম্পাসেই শুরু হয়, পরে বর্তমানের সুশ্রুত নগরে চলে যায়। এই দুটি কলেজের পরীক্ষা গ্রহণ, পরিচালন দীর্ঘকাল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতেই ছিল। উত্তরবঙ্গে প্রথম মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার বিস্তারে উপাচার্য অতুল চন্দ্র রায়ের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার কয়েক মাস পরেই উপাচার্য সমাবর্তনের উদ্যোগ নিলেন। প্রথম সমাবর্তনে তেমন জাঁকজমক জৌলুস ছিল না। দ্বিতীয় সমাবর্তনে জৌলুস ও আড়ম্বর ছিল। তখন বিভিন্ন কলেজের স্নাতক ছাত্র ছাত্রীরা সমাবর্তনে যোগ দিতেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমস্ত স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেই সমাবর্তন ছিল প্রাণের উৎসব। প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি সমাবর্তনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন অধ্যাপক পুলিন দাস, তিনি "স্মৃতিজাগানিয়া"তে লিখেছেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল শালকুঞ্জের খোলা আকাশ তলে, ইঞ্জিনিয়ার ভাইস-চ্যান্সেলরের প্রযত্নে এবার দ্বিতীয় সমাবর্তনের জন্য তৈরি হল ছাদ আটা চারিদিক খোলা সমাবর্তন মন্ডপ, হেলথ সেন্টার-এর পেছনের দিকটায়। সুসজ্জিত হল বাড়িঘর পথঘাট। পাহাড়ের কোলে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়, সাজসজ্জায় তাই পাহাড়ি সংস্কৃতি ছাপ ফুটিয়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেই অনুযায়ী উপকরণ সংগ্রহ করে তাদের বিন্যস্ত করা হলো। চ্যান্সেলর পদ্মজা নাইডু এলেন, আর এলেন ইন্দিরা গান্ধী প্রধান অতিথি রূপে। দীক্ষান্তিক ভাষণ দিলেন ইন্দিরা গান্ধী। লিখিত ভাষণ পড়লেন, সাদামাটা সাধারণ মানের। শেষ বক্তা পদ্মজা নাইডু অলিখিত তাঁর ভাষণ। এককথায় অসাধারণ। শব্দ চয়ন, বাচনভঙ্গি, কণ্ঠস্বর - সব মিলিয়ে স্মরণীয় তাঁর সেই বক্তৃতা। 'নাইটিঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া' সরোজিনী নাইডুর যোগ্য কন্যা যে তিনি সেটা অনুভব করা গেল তাঁর সেদিনের সেই ভাষণের শ্রুতিনন্দন গীতি মূর্ছনায়।" সেই সমাবর্তন মন্ডপ পরবর্তীকালে সংস্কার করে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে বর্তমানে যার নাম বিদ্যাসাগর মঞ্চ।
উপাচার্য অতুল চন্দ্র রায়ের সময়কার উল্লেখযোগ্য ঘটনা-গল্প আমি আমার অধ্যাপক শিবচন্দ্র লাহিড়ীর কাছে শুনেছিলাম, পুলিন বাবুর স্মৃতিকথাতেও সেই বর্ণনা আছে। ধান চাষের জন্য খেলার মাঠটি আর কোনো খেলার উপযুক্ত ছিল না। উপাচার্যের ধান চাষের শখ মিটলে তিনি আরেকটি নতুন খেলার মাঠ তৈরি করলেন গেস্ট হাউজের সামনে। ওই মাঠে উপাচার্যের উদ্যোগে বসেছিল আন্তঃরাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের বাস্কেটবল প্রতিযোগিতা ।কয়েকদিন ধরে ওই খেলা চলছিল। শেষ পর্যায়ের সেমিফাইনালের খেলায় চূড়ান্ত হবে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী দল ফাইনালে যাবে। খেলা দেখতে উপাচার্য, অধ্যাপক, ছাত্র-ছাত্রীরা সকলেই উপস্থিত থাকতেন। আশেপাশের কয়েকটি মিলিটারি ক্যাম্প থেকে আসতেন জওয়ানেরা। এদের মধ্যেই একজন খেলা খেলা দেখতে দেখতে নিজের রাজ্যের ছাত্রীদের দল হেরে যাওয়াতে ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার হইহল্লা বাঁধিয়ে খেলা বন্ধ করতে মাঠের দিকে এগিয়ে গেলে, ছাত্রদের সঙ্গে মারামারি বেঁধে যায়। একজন জোয়ান দ্রুত সাইকেল নিয়ে তাদের ক্যাম্পে গিয়ে আর একদল জওয়ানদের ডেকে নিয়ে আসে। তারাও ছাত্রদের সঙ্গে মারামারি করতে এগিয়ে যায়। জওয়ানরা ছাত্রদের উপর চড়াও হচ্ছে দেখে তাদের ঠেকাতে ম্যাথামেটিক্স ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক সত্য পাল স্যার জড়িয়ে জাপটে ধরলেন একজনকে। ধুতি-পাঞ্জাবি পড়া ভাত-মছলিখানেওয়ালা বাঙালির গা-য় যে এত জোর থাকতে পারে জোয়ানটি ভাবতে পারিনি, তাকে ছাড়িয়ে নিতে আরেকটি জোয়ান এগিয়ে এলেই আর এক ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত অধ্যাপক শিবচন্দ্র লাহিড়ী ধুতির কোঁচা পকেটে পুরে তাঁর হাতে রাখা ছাতার বাট দিয়ে মারলেন, জোয়ানের মাথাটি অক্ষত রইল কিন্তু লাহিড়ী স্যারের ছাতার বাট ভেঙে ছত্রখান। সবাই হেসে কুটিপাটি।জওয়ানরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাল। সেই সময়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্ক এমনই ছিল।ছাত্রদের যে কোনো বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে একটুও দ্বিধা বোধ করতেন না মাষ্টার মশাইরা। অনেক পরে লাহিড়ী স্যারের ছাত্র হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। স্যারের কাছে পুরনো দিনের অনেক গল্প শুনেছিলাম ।দার্জিলিংয়ের সেন্ট যোসেফ কলেজে থাকবার সময় তিনি রাজ্যপাল ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ্মজা নাইডুকে বাংলা শেখাতেন। গভর্নর হাউস ও সে সময়কার দার্জিলিংয়ের অনেক গল্প তার ভান্ডারে ছিল ।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রভাব ও রাজনীতি বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাম রাজনীতি থেকে মুক্ত করার জন্য উপাচার্য বিশেষ উদগ্রীব ছিলেন। ক্যাম্পাসে তাঁর অফিস ছাত্রদের ঘেরাও কর্মসূচির কারণে সিকিউরিটি বাহিনীর সাথে ছাত্রদলের সংঘর্ষে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রেখে ছিলেন। প্রায় সাত মাস পরে বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছিল।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের তীব্রতা তখনো কমেনি। চারু মজুমদারের তত্ত্বর প্রভাব অনেক ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে ছিল। তখনো নকশালবাড়ি আন্দোলনকারীরা CPIML হয়ে যাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশনের সমর্থক ছাত্র-ছাত্রীরাও নকশালদের সমর্থন করতেন। এরই মধ্যে উপাচার্য পরীক্ষার দিন ঘোষণা করলেন।ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষা বয়কটের ডাক দিলেন। উপাচার্য পরীক্ষা নেবেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পরীক্ষা ভন্ডুল হল, আবারো সেই পরীক্ষা নতুন করে নেবার বন্দোবস্ত করলেন, সে পরীক্ষাও ভন্ডুল হলে, উপাচার্য পরীক্ষা কেন্দ্র বিকেন্দ্রীকরণ করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সিকিউরিটির বাহিনীদের ইনভিজিলেটর করবেন। পরীক্ষা হলে অধ্যাপকরা ইনভিজিলেশনে যাবেন কিনা এ নিয়ে সংশয় ও আতঙ্ক প্রকাশ করেছিলেন। ইতিমধ্যেই দেয়াল লিখন শুরু হয়েছিল শিক্ষকেরা পরীক্ষা হলে গার্ড দিতে এলে যেন বাড়িতে স্ত্রীর জন্য থান কাপড় কিনে রাখেন।খাতা ছিঁড়ে ফেলা, টেবিলে ছুরি চাকু গেঁথে রাখার আতঙ্ক তারা মেনে নিতে পারেননি। এরইমধ্যে উপাচার্য স্থির করলেন ক্যাম্পাস থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রগুলি সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাবেন। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি দুই জায়গাতেই তিনি পরীক্ষা কেন্দ্র করবেন। এই পরীক্ষা কেন্দ্রের জন্য তিনি ছাত্র পরিষদের সহায়তা নেবেন স্থির করলেন।জলপাইগুড়িতে তখন ছাত্র পরিষদের দায়িত্বে ছিলেন দেবপ্রসাদ রায়। যিনি পরবর্তীকালে সাংসদ ও বিধায়ক। আমাদের প্রজন্মের প্রায় সকলেই দেবপ্রসাদ রায়কে মিঠুদা বলতেন। 2017তে মিঠুদার আত্মজীবনী "ডুয়ার্স থেকে দিল্লি" প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটিতে মিঠুদা উপাচার্য অতুল চন্দ্র রায়ের সাথে তাঁর যোগাযোগ ও জলপাইগুড়িতে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা নেওয়ার কথা একেবারে ছবির মতো বর্ণনা করেছেন। জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজ থেকে মিঠুদা স্নাতক হন। উপাচার্য অতুল চন্দ্র রায় ঘোর কংগ্রেসী ও জলপাইগুড়ির মানুষ হবার সুবাদে ছাত্র পরিষদ নেতা দেবপ্রসাদ রায় সম্পর্কে জানতেন। উপাচার্যের কাছে পরীক্ষা নেওয়াটা তখন চ্যালেঞ্জের মতো ছিল। মিঠুদা তখন জলপাইগুড়ির আরেক বিখ্যাত কংগ্রেস ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ শিকদারের প্রতিষ্ঠিত রানীনগর জুনিয়র হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। উপাচার্য অতুল চন্দ্র রায় স্থির করেছিলেন নিরাপত্তা কর্মীদের দিয়ে পরীক্ষা নেবেন। এর জন্য ক্যাম্পাসের বাইরে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে পরীক্ষা সেন্টার করলেন।জলপাইগুড়িতে পরীক্ষা সেন্টার হয়েছিল আনন্দ চন্দ্র বিএড কলেজে। এই পরীক্ষা পর্ব সামলানোর জন্য 14 জন নিরাপত্তাকর্মী উপাচার্য নিয়োগ করবেন স্থির করলেন।সকলেই নিযুক্ত হবেন ছাত্র পরিষদ থেকে। এই 14 জন নিরাপত্তাকর্মী বাছাইয়ের দায়িত্বটা ছাত্র পরিষদের উপর পড়েছিল। "দায়িত্ব নিলেন অন্তিদা, তিনি ছিলেন ব্যায়াম করা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, বলশালী লোক, প্রগতি ব্যায়ামাগার-এর প্রতিষ্ঠাতা। ঝুট ঝামেলা সামলানোর ব্যাপারে তাকে বেশ ভরসা করা যেত। তাই নিরাপত্তাকর্মী বাছাইয়ের ব্যাপারটা তার উপরেই ছেড়ে দেওয়া হল। তিনি দল বানালেন, শচী লালা ,প্রকাশ চক্রবর্তী ছাড়া আরো 12 জন কংগ্রেস কর্মী সেই দলে ছিল। জলপাইগুড়ি আনন্দ চন্দ্র বিএড কলেজে পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে গন্ডগোল বাঁধতে দেরি হয়নি। পরীক্ষা না দিতে চাওয়ার সংখ্যা ছিল অনেক বেশি, ফলে কলেজের গেট থেকেই শুরু হয়ে গেল গোলমাল। এরই মধ্যেই হঠাৎ খবর ছড়িয়ে গেল শচী লালা নাকি কলেজের হলঘরে একজন ছাত্রকে ছুরি মেরে আহত করেছে।শহরে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো। অচিরেই দেখা গেল বিরাট বিরাট মিছিল শহরের রাস্তায় বেরিয়েছে প্রতিটি মিছিলের গতিপথ শচী লালার বাড়ির দিকে। শচী লালার বাড়ির দিকে আমরা থাকতাম, ঠিক তার পাশের বাড়িতে। চোখের সামনে দেখলাম শচী লালা দের বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে ছাই করে দেওয়া হল। নীরবে সেই দৃশ্য দেখা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। প্রতিবাদের কোনো প্রশ্নই নেই। আমি আজও ঠিক জানি না সেদিন শচী লালা ছুরি চালিয়েছিল কিনা, তবে আঘাত করে থাকলে যে সে খুব অন্যায় করেছিল তা বলাই বাহুল্য।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি দুর্নীতি উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের কত ঘটনা আড়ালে রয়ে গেছে।কেউ কেউ হয়তো বা বিস্মৃত। এই পরীক্ষা পর্ব শেষ হল, এবারে খাতা দেখার পালা ।অধ্যাপকদের একাংশ পরীক্ষার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। অনেকেই খাতা না দেখে সেই অবস্থায় বিভাগীয় প্রধানের কাছে ফেরত দিয়ে দিলেন কিন্তু পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল উপাচার্যের ঘোষিত দিনে। কারা কিভাবে ওই অল্প সময়ে খাতা দেখে দিলেন, নাম্বার দিলেন সে তথ্য সকলের অগোচরে থেকে গেল। সেই পরীক্ষায় সফল ও প্রচুর নম্বর পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন কলেজে স্কুলে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই হয়েছেন।তাঁদের কেউ কেউ কলেজে আমাদের অধ্যাপক ছিলেন বটে। সবচেয়ে কষ্ট হয় সেই সব অগ্রজদের জন্য, যাদের আত্মত্যাগ, বিপ্লবের জন্য শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন, সব অসম্পূর্ণ থেকে গেল ।কেউ চলে গেলেন কারাগারের অন্তরালে, কেউবা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে নিহত হলেন। এরা হতে পারতেন মেধাবী দায়িত্বশীল অধ্যাপক, প্রশাসক, বুদ্ধিজীবীদের শিরোমণি। আজকের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে ওই শহীদদের মূল্যায়ন কি হবে? কারা করবেন? কারাই বা এই মূল্যায়ন করার উপযুক্ত? তা কিন্তু বড় প্রশ্ন হয়েই রইল? তিন দশকেরও বেশি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা কাজে, অভিজ্ঞতায় এইটুকু বুঝেছি পাণ্ডিত্য জাহির করার মতো এবং অবস্থানগত সুবিধার সুযোগে পরাক্রম দেখাবার মতো কুশ্রী আর কিছু হয় না। আমার মতো অতি সাধারণের স্মৃতি কথা যে আপনারা সহ্য করছেন, লিখতে উৎসাহ দিচ্ছেন, তার জন্যআন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।