সানিয়া-৭/নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
সানিয়া
পর্ব- সাত
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^^
রামু
ঘুমিয়ে পরেছে অনেকক্ষণ আগেই। ঘুম আসছেনা সানিয়ার। রাতটা যেন হঠাৎ করেই আজ
খুব বড় হয়ে গেছে। গভীর কালো রাত। রাতকে ছোট করার উপায় খোঁজে সানিয়া। বালিশে
মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে উপুর হয়ে। আজ সে ঘুমিয়ে যেতে চায় তাড়াতাড়ি। কিন্তু
কোথায় ঘুম? শত চেষ্টা করেও ঘুমবুড়িকে ডেকে বসাতে পারেনা দু'চোখে। ঘুমবুড়িও
যেন আজ অন্ধকারে পথ হারিয়েছে। বাইরে তিস্তার হাওয়া বইছে শন শন করে। সে
হাওয়া এসে ধাক্কা মারছে ঘরের বেড়ায়। হোগলার বেড়া ভেদ করে সুরসুর করে হাওয়া
ঢুকছে ঘরের ভেতর। বাইরের বেড়ায় ঝুলে থাকা কাপড়-চোপড় হাওয়ায় দোল খেতে খেতে
ধেরে গলায় কত গান ধরেছে। একে ঘুম আসছে না। তারপর আবার বিরক্তিকর সেই
পতপত-ফড়ফড়-সড়সড় আওয়াজ। বড্ড অসহ্য লাগে সানিয়ার। রাগে দুই কান চেপে ধরে
বালিশ মাথায় চাপায় সানিয়া। চোখ কুচকিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করে চলে। চোখ খুলেই
ভোরের আলো দেখতে চায় তার মন। কিন্তু ব্যর্থ হয় সানিয়া। সারাদিন সূর্যের
আলোয় উত্তপ্ত হয়েছে তিস্তাবক্ষ। নরম বাতাস ছুটোছুটি করছে তার উপর দিয়ে। সেই
নরম মিষ্টি হাওয়ার আমেজে ঘুমিয়ে গেছে বাকি সবাই। শুধু ঘুমাতে পারে না
সানিয়া।
প্রকৃতির ডাকে
সাড়া দিতে মাঝরাতেই বিছানা থেকে উঠে পরে সানিয়া। দরজা সরিয়ে বাইরে আসে।
কুচকুচে কালো রঙে ডুবে রয়েছে চারপাশ। এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন তিস্তাকে এর আগে
সে কোনদিন দেখেনি। আশেপাশের সবকিছুই অদৃশ্য হয়ে রয়েছে। একটু দূরেই ঈষৎ
দৃশ্যমান তিস্তার জলরাশি। সাদা ধোঁয়াশা জাতীয় কিছু তুলির টান হয়ে লেপ্টে
রয়েছে কালো দেওয়ালের গায়ে। তিস্তার কুলু কুলু আর ছলাৎ ছলাৎ-এর জলতরঙ্গ মিশে
যাচ্ছে দক্ষিণা হাওয়ায়। মায়াবী প্রকৃতির নি:শব্দতা কেটে যাচ্ছে ক্ষণে
ক্ষণেই। হঠাৎ বালি কেটে পাড় ভাঙার শব্দে বুকটা কেঁপে উঠে সানিয়ার। ভয়ার্ত
এই প্রকৃতিকে অবাক চোখে কিছুক্ষণ দেখেই ঘরে ঢুকে পরে সানিয়া।
রাত
কেটেছে নিয়ম মেনেই। ভাওয়াইয়ার মনভোলানো সমবেত সুরের আদরে ঘুম ভাঙে
সানিয়ার। পাশের ঘরেই শুরু হয়েছে মৈষালি বৈঠক। দোতরা বাঁশী খমকের সুরেলা তাল
ও অন্যান্যদের গলা ছাপিয়ে শোনা যায় ভগলু কাকার উদার্ত কন্ঠ। ফান্দত্ পরিয়া
বগা কান্দের মর্মার্থ ষোল বছরের সতেজ হৃদয়টিতে কোন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে
না। ঝটাপট বিছানা ছাড়ে সানিয়া। চোখ কচলাতে কচলাতে বাইরেটা একবার দেখে নেয়।
মৈষাল কাকাদের ঘরটা উনোনের আগুনে লাল হয়ে রয়েছে। ধোঁয়ার কুন্ডুলী চালের উপর
ঘুরপাক খেতে খেতে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। ঘরের পাশের লজ্জাবতীরা হাত-পা
মেলতে শুরু করেছে। আনন্দে ভরে ওঠে সানিয়ার মন। ভোরের প্রথম আলো মাখতে মাখতে
ছুটে যায় পারা মহিষ দুটির দিকে। গতকাল রাতেই ওদের আলাদা করে পায়ে ডোর
বেঁধে দিয়েছে বড় মৈষালেরা।
রামুকে
বিছানা থেকে টেনে তোলে সানিয়া। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে দু'জনে
আসে নদীর পাড়ে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে আসে বাথান ঘাটের শালের
খুঁটিটির উপর। উদীয়মান সূর্যের সোনালী আলো ঝরে পরছে তিস্তার জলে। আলোর ছটায়
খিলখিলিয়ে হেসেই চলেছে তিস্তামা। মায়ের সোনালী জল আজলা আজলা তুলে মুখে
ছেটায় তারা। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে গলাগাথি বেঁধে ফিরে আসে নিজেদের
ঘরে। প্রস্তুতি শুরু হয় সুদীর্ঘ পথ পারি দেবার।
সানিয়া
সানিয়া করে হাঁক দেয় ভগলু কাকা। এ ডাক চা পান করবার। দুই মগ চা হাতে নিয়ে
সানিয়া ও রামু চলে আসে পরুদের ঘরে। এই ঘরের এক কোণেই তাদের থাকবার জায়গা।
দড়ি দিয়ে বেড়ায় ঝোলানো নোংরা সব জামা কাপড়। সেখান থেকেই হাঁটুছেড়া
ফুলপ্যান্টটা নিয়ে পা গলিয়ে নেয় সানিয়া। তৈরী হয়ে নেয় রামুও। ভগলু কাকা
চিড়া আর গুঁড় দিয়ে যায় ঘরে। গুড় চিড়া পোটলায় বেঁধে মাথায় গামছা পেঁচিয়ে
তারা প্রস্তুত হয়। রামু বেতন না পেলেও সানিয়ার বেতন শুরু হয়েছিল মাস ছয়েক
আগেই। বিশ টাকা মূল্যের মুদ্রা বাঁশের পইয়ের ভেতর জমিয়ে ছিল সে। সেই মুদ্রা
সযত্নে প্যান্টের পকেটে পুরে নেয় সানিয়া। কখন এই টাকা দিয়ে বাচ্চু ফুলমণির
হাতে মিঠাই তুলে দেবে সেটা ভেবেই উত্তেজনা আর পরিতৃপ্তিতে ভরে ওঠে সানিয়ার
মন। একজনের পিঠে ছাতা আর একজনের হাতে লাঠি। একজনের কোমরে পুটুলি আর একজনের
পকেটে দস্তার পয়সা। এভাবেই দুই কিশোর মৈষাল মহিষের গলার দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে
তিস্তার বেলাভূমিতে। ভাঙ্গাবেড়া মহিষের পায়ের ডোর খুলছে। আন্ধারু মৈষাল
মহিষের গলার ঘন্টি খুলছে। ল্যাপা অলিন মহিষের শিং এ তেল মাখিয়ে ধুনো দিচ্ছে
অবলা জীবগুলির মুখে। ভগলু কাকা এসে পরম আদরে হাত বোলায় মহিষের মাথায়।
সানিয়া আর রামুকে এগিয়ে যাবার সবুজ সংকেত দিয়ে বলে
-যা হাতিরাম যা। এলা জমিত যায়া নাঙ্গল মারিবো। আর তো দেখা হবার নহয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴