মায়াপথের মীড়-৭/সৌগত ভট্টাচার্য
মায়াপথের মীড়/৭
সৌগত ভট্টাচার্য
সুন্দরী দিদির সাথে আমার পরিচয়েরও এক যুগের বেশি সময় হয়ে গেল। ওর ছেলে স্বদেশ তখন স্কুলে যায়। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে তখন। দিদি একটা ভাতের হোটেল চালায়। হোটেল না বলে বাড়ির বাইরের ঘর বলাই ভালো। ময়নাগুড়ি-চালসা হাইওয়ের ধারে বাগজানে একটা বটগাছের তলায় দিদির বাড়ি। বাইরের ঘরে একটা আম কাঠের চৌকি, চৌকির ওপর একটা হারমোনিয়াম রাখা, একটা বেঞ্চ, একটা প্লাস্টিকের টেবিল, পাশে রান্না করার জায়গা -- এটাই দিদির হোটেল। উপেনদার তখন সাইকেল সারাইয়ের দোকান। বাড়ির সামনে কদম গাছ তালায় সাইকেল সরানোর জিনিসপত্র নিয়ে ছালায় বসত। মাঝেমধ্যে ডাক পড়লে আশপাশের গ্রামে কীর্তন গাইতে যেত। আমরা, মানে আমার কলিগরা, হইহই করে দুপুরবেলায় দিদির দোকানে খেতে যাই। সেই খেতে যাওয়া ছিল এক আনন্দ উৎসব!
আসমুদ্রহিমাচল ছোট বড় মাঝারি কত রকম হোটেলে তো খেলাম কিন্তু এত কম তেল মশলা ব্যবহার করে, এত স্বাদু খাবার আমি খুব খাইনি। মোটা চালের ভাত, ডাল, আলু বাঁধাকপি ফুলকপি একসাথে একটা সবজি আর শীতের নতুন ছোট আলু ভাজা থেকে আলু কুমড়া দিয়ে শুঁটকি মাছের তরকারি কিংবা -- কী যে অতুলনীয় স্বাদ! এরকম কত রেসিপির কথা বলব! দিদি যেমন মাংস রান্না করত, খেয়ে আমার বারবার মনে হত, নিশ্চয়ই সকালে স্বর্গলোকে রান্নার কাজ সেরে দুপুরে আমাদের জন্য রান্না করে দিদি। দিদির রান্নার মেনু আর রেসিপি নিয়ে বলতে গেলে আলাদা লেখা লিখতে হবে।
সুন্দরী দিদির ছোট মেয়ের যেদিন বিয়ে হল সেদিন আমাদের সকলের নিমন্ত্রণ ছিল ওর বাড়িতে। নিমন্ত্রণ বলতে হোটেলে দুপুরবেলায় মাংস ভাত খাওয়া ফ্রি। এরপর থেকে মেয়ে জামাইকে প্রায়ই আসতে দেখতাম।
স্বদেশ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আমাদের ছাত্র হল। কিছুদিন পর স্বদেশের বিয়ে দিল। বৌমা এসে হোটেলের হাল ধরল। শাশুড়ি বৌমা মিলে হোটেল চালায়। উপেনদা দোকানের সামনে বটগাছ তলায় একটা লটারির দোকান দিল, লোকসান হল, কিছুদিন পর একটা টোটো কিনে চালাতে শুরু করল। উপেনদা মাঝেমাঝে আম কাঠের চৌকিতে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইত। আমরা শুনতাম। কিছুদিন পর স্বদেশ অসুস্থ হল। অনেক ডাক্তার বদ্যি চিকিৎসা, কিছুতেই আর স্বদেশকে বাঁচানো গেল না। সবটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল।
সময় ময়নাগুড়ি চালসা হাইওয়ে দিয়ে যাওয়া গাড়ির থেকেও দ্রুত চলে যায়। এখন রাস্তার দুই পাশে প্রচুর খাওয়ার দোকান। দিদির দোকানে কেউ আর তেমন যায় না। প্রতিদিন নতুন নতুন খাবার দোকান খুলছে। দিদি যেন কিছুতেই আর পেরে ওঠে না। এখন প্রতিদিন নিজেদের দুইজনের বাদ দিয়েও আরো তিন চারজন খাওয়ার মতো রান্না করে। কেউ খেলে খেল, নয়ত একজন ভবঘুরে আছে ওকে ডেকে খাবারগুলো দিয়ে দেয়।
দুপুরে মাঝেমধ্যে আমি দিদির দোকানে যাই। দিদি ভাত বেড়ে থালা সাজিয়ে দেয়। কাস্টমার শূন্য দোকানে আমি যখন খাই আমার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে সুন্দরী দিদি গল্প করে -- কিছুদিন আগে গয়া কাশী গেছিল সেই গল্প করছিল। দিদির চোখ দিয়ে আমি গতকাল গয়া কাশী দেখছিলাম। আবার কখনও শুনি বন্ধন ব্যাংকের কথা, কখনও বলে ওর দশ বছরের নাতি পুকুরে জাল ফেলে আমেরিকান রুই ধরেছে, আবার কখনও বিয়ের প্রথম জীবনে জলঢাকার চরে কাটানো দিনগুলোর কথা। থালার ভাত শেষ হয়ে গেলে দিদি বলে, আরেকটু ভাত দিই সৌগত!
আমি প্রতিদিনই না বলি। দিদি প্রতিদিন একই কথা বলে, দ্যাখত এইটুকু খাইলে হয়! বাড়ি যাইতে খিদা পায়ে যাবে না!
দিদি বলে, একটু শুঁটকি রান্না করছি, খাবা? বেগুন দিয়ে ইলিশের শুঁটকি! আরেকটু ভাত দিই এটা দিয়ে খাও...
অবিন্যস্ত ভাবে একটার পর একটা গল্প বলে চলে সুন্দরী দিদি... যে গল্প রোজকার, যে গল্পের কোন শুরু নেই শেষ নেই... যে গল্প সামান্য জীবনের...
যে গল্প ভাত খাওয়ার শেষে এঁটো হাত শুকিয়ে যাওয়ার পরেও শেষ হয় না...
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴