ভাস্কর্যের আঁতুরঘর/৭
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-৭)
মৈনাক ভট্টাচার্য
-----------------------------------
মেরিনা সৈকতের ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য : ট্রাম্প অফ লেবার
চারজন মানুষ মিলে একটা পাথর ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। পেশীবহুল শ্রমছন্দের মননে নিজেকে আন্দোলিত করছে ভাস্কর্যের এক চেতনা। চেন্নাইয়ের মেরিনা সৈকতে যদি এক পলক উদাস হাওয়ার মত ‘ট্রাম্প অফ লেবার’ ভাস্কর্যটির সামনে মনকে ভাসাতে পারেন আপনিও আন্দোলিত হয়ে উঠবেন এক ভাস্কর্য চেতনায়। আজকের ২০২৩-এ এসে মেরিনা সৈকতের একশ বছরের ইতিহাসের গল্প গাঁথা হয়ে গেছে এই ভাস্কর্যে। এই ভাস্কর্যের আঁতুড় কথার পরতে পরতেও কিন্তু লেগে আছে এক বাঙালী ঐতিহ্যের আবেগ। সালটা ১৯২৩, মে দিবসের মাস। চেন্নাইয়ের মেরিনা সৈকতে। পরাধীন ভারতে শ্রমজীবী মানুষদের কথা বলবার অধিকার প্রতিষ্ঠা স্বীকৃতির দাবীতে সমাবেশ ডাকা হয়েছে. ডেকেছেন তৎকালীন দাপুটে শ্রমিক নেতা মালয়পুরম সিঙ্গারাভেলু। সভায় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তও হয়ে গেল। ভারতে শ্রম অধিকার সুরক্ষার শপথে গঠিত হল একটি রাজনৈতিক দল। পরবর্তীতে কামরাজ নেতৃত্বাধীন তামিলনাড়ু সরকার ঠিক করলেন সমুদ্র সৈকত সৌন্দর্যায়ন পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে এক সৈকত-ভাস্কর্যে এই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করা হবে। ভাবনায় উঠে এলো তৎকালীন মাদ্রাজ স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস (বর্তমানে গভর্নমেন্ট কলেজ অব ফাইন আর্টস)-এর প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী নাম। শিল্পীকে দায়িত্ব দেওয়া হল তাঁর মৌলিক ভাবনায় রূপায়িত হোক এই ভাস্কর্য দলিল। দেবীপ্রসাদ রূপ দিলেন এক নান্দনিক শ্রমমূর্তির। ফুটিয়ে তুললেন -কঠিন কাজে নিমগ্ন চার শ্রমিকের একটি ভারী পাথর সরানোর অনুপ্রেরণামূলক ভঙ্গি। নাম দিলেন-‘ট্রাম্প অফ লেবার’ বা ‘শ্রমের বিজয়’। ভাস্কর্যটি তৈরির সময় পুরুষ শ্রমিকের মডেল হিসেবে ব্যবহার করলেন তাঁরই ‘স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস’এর নৈশপ্রহরী এ পি শ্রীনিবাসন এবং রামু নামে এক ছাত্রকেও।
# # #
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ভাস্কর্য নির্মাণের সনাতন পদ্ধতির দুটি ধারা। প্রথমটি বিযুক্তিকরণ পদ্ধতি আর দ্বিতীয়টি সংযুক্তিকরণ পদ্ধতি। বিযুক্তিকরণ পদ্ধতি বলতে বোঝায় গোটাপাথর, শিলা ইত্যাদি থেকে খোদাই মাধ্যমে ভাস্কর্যের কাজকে। সংযুক্তিকরণ হল মাটির মত নরম কিছু যেমন প্লাস্টার বা এমন ধরনের মাধ্যমে আর্মেচার বা কাঠামো বেঁধে নিয়ে মূর্তি গড়া। পাথর কাটা তো ভাস্কর্যের এক আদি অকৃত্যিম নেশা। আলতামিরার বাইসন গুহাচিত্র থেকে শুরু করে মিকেল্যাঞ্জেলোই হোক, এই মাধ্যম যেন শিল্পীদের বার বার পিছু ডাকে অনেক বেশী। তবে খসড়া চিত্র বা হোম নেট-ওয়ার্কের ভাস্কর্য-স্কেচ যাকে বলে, সেই কাজের প্রথম খসড়া বা ম্যাকেট তৈরিতে কিন্তু ভাস্কর্যের দ্বিতীয় ধারাকেই গুরুত্ব দিতে হয়। ভাস্কর্যের ইতিহাস ঘাটলে বোঝা যায় এই প্রথম ধারা থেকেই দ্বিতীয় ধারার উত্তরণ। সে না হয় গেল ভাস্কর্যধারার ব্যাকরণ। দেবীপ্রসাদও বেশী করে ভালবাসতেন বিযুক্ত পদ্ধতিতে কাজ করতে। একটা দীর্ঘ সময়ে দেশীয় ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে ভারতীয় শিল্পীদের চেয়ে ইউরোপীয় শিল্পীদের প্রাধান্যই বেশী লক্ষ্যনীয় ছিল। অবশ্যই আমাদের পরাধীনতা এবং দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবই এর প্রধান কারণ। পরাধীন ভারতের ইউরোপীয় ভাস্করদের এই একচেটিয়া আধিপত্য কিন্তু প্রথম ক্ষুন্ন হয়েছিল ভারতীয় ভাস্কর দেবীপ্রসাদের কর্ম নৈপুণ্যে। ভারতীয় ভাস্কর্য-চেতনাকে বহুদূর বিস্তৃত করে আধুনিকতার উৎসমুখে যাঁরা পৌঁছে দিয়েছেন দেবীপ্রসাদ তাঁদেরই একজন। তিনিই প্রথম ভারতীয় ভাস্কর হিসেবে ব্রোঞ্জ মাধ্যম ব্যবহার করেছিলেন। দেবীপ্রসাদের শিল্পের হাতেখড়ি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে চিত্রকর হিসেবে হলেও ভাস্কর্যের পাঠ নেন শিল্পী হিরন্ময় রায়চৌধুরীর কাছে। এর পর দেবীপ্রসাদ আরও উন্নত মানের ভাস্কর্য পাঠের তাগিদে ইতালিতে যান। ইতালি থেকে শিল্পী ফিরলেন তাঁর পুরানো ছন্দকে ফেলে রেখে নুতন ছন্দ নিয়ে। শিল্পগুরুর প্রবর্তিত বেঙ্গল স্কুলের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে পাশ্চাত্যের বাস্তবধর্মী শিল্পকর্মকেই তাঁর ভাস্কর্যে গ্ৰহণ করলেন এই নুতন ছন্দে। তাঁর কাজগুলি লক্ষ্য করলে বোঝা যায় তিনি প্রভাবিত ছিলেন ইউরোপীয় স্বাভাবিকতার ‘রিয়ালিজম’-এর শিল্পরূপের প্ৰাধান্যে। কাজের ভেতরে তৈরি করলেন এক নিজস্ব ভারতীয় ঘরানা। চিত্রকর হিসেবে যত না পরিচিত, ভাস্কর হিসেবেই বরং তার পরিচয়ের ব্যপ্তি হয়ে উঠল অনেক বেশী। পাশ্চাত্য ধারাকে অনুসরণ করে শিল্প ভাস্কর্যের প্রসারে ভারতবর্ষে প্রথম ন্যুড স্টাডির প্রবর্তনও করেন তিনিই। এই ন্যুড স্টাডি কিন্তু ভারতবর্ষের মত রক্ষণশীল দেশের সে-সময় সমাজ ও মূল্যবোধের নিরিখে খুব সহজ ব্যাপার ছিলনা। অথচ দেবীপ্রসাদ অনুভব করেছিলেন ভাস্কর্য আন্দোলনের প্রসারে এই মডেল পাঠের প্রয়োজনীয়তা। এইখানেই হয়ত তিনি নন্দলাল বসুর থেকে এক ধাপ এগিয়ে। শিল্পগুণে শ্রমিক শ্রেণীর কঠোর পরিশ্রম ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা শারীরিক ছন্দের শিল্প ভারসাম্যে উপস্থাপিত তাঁর এই শ্রমমূর্তি ‘ট্রাম্প অফ লেবার’। মোহিত হয়ে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে অনেকটা সময় জুড়ে। মেরিনা সৈকতের উত্তর প্রান্তে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে আন্না স্কোয়ারে নির্মিত দেবীপ্রসাদের এই ভাস্কর্য চেন্নাইয়ের আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক। মেরিনা সৈকতই শুধু নয়, ভারতীয় সমুদ্র সৈকতের ইতিহাসেও প্রথম ভাস্কর্য এইটি । ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে মূর্তিটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। আজও এই ভাস্কর্য শহরের মে দিবস উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রয়ে গেছে। রয়ে গেছে ভারতীয় ভাস্কর্যে বাঙালীর ঐতিহ্যের এক শিল্প হরকরা হয়ে......।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴