বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং-৭/রূপন সরকার
বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং
পর্ব-৭
ড. রূপন সরকার
----------------------------------------
দার্জিলিং শহরের পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা। দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা না গেলে কোম্পানির কোন উদ্দেশ্যই সফল হবে না, একথা সাহেবরা বিলক্ষণ বুঝতেন। সমকালিন সময়ে (১৮৩৪ সাল) কোলকাতা থেকে দার্জিলিং-এর পাদদেশে পৌঁছতে সময় লাগত কমবেশি ৯৮ ঘন্টা। কোলকাতা থেকে মালদা পর্যন্ত ৫৪ ঘন্টা, মালদা থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত ১৬ ঘন্টা, দিনাজপুর থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত ২০ ঘন্টা এবং সবশেষে তেতুলিয়া থেকে শহরের পাদদেশ পর্যন্ত ৮ ঘন্টা। এই ৯৮ ঘন্টা পারি দিতে সময় লাগতো ৫ থেকে ৬ দিন। এর সাথে রয়েছে যাত্রাপথের ক্লান্তিকর এবং বিপদজ্জনক পরিস্থিতি। এই অবস্থা থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে বহির্বিশ্বের সাথে দার্জিলিং শহরকে যুক্ত করা রীতিমত ছিল চ্যালেঞ্জের বিষয়।
এই অসাধ্যসাধন প্রথম দায়িত্ব দেওয়া হল এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট গিলমোরের ওপর। কিন্তু কোনরাকম কাজ শুরু করার পূর্বেই গিলমোর সাহেব অসুস্থ হয়ে পরেন। এবার দায়িত্ব এসে বর্তায় লেফটেনেন্ট নেপিয়ারের ওপর (Lt. Robent Napier)। ইনিই সেই ব্যক্তি, যিনি দার্জিলিং শহরকে প্রথম 'জীবন রেখা' দান করেন। ১৮৪০ সাল থেকে পাঙ্খাবাড়ি দিয়ে একটি রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয়। সমস্ত রকম প্রতিকূল পরিস্থিতি থাকা সত্বেও নেপিয়ার অবশেষে ১৮৪২ সালের মধ্যে দার্জিলিং শহরকে সড়কপথে শিলিগুড়ি শহরের সাথে যুক্ত করেন। রাস্তাটি শিলিগুড়ি থেকে শুরু হয়ে প্রথমে পাঙ্খাবাড়ি পর্যন্ত যায়, যেখানে একটি পুরাতন ডাক বাংলো এখনো রয়েছে। এরপর আরেকটু উঁচুতে উঠে কার্শিয়াং পৌঁছায়, সেখানে তখন কোন শহর ছিল না। সেখান থেকে ডাউহিল, জলাপাহাড় হয়ে দার্জিলিং।
এই রাস্তাটি বর্তমানে পুরাতন মিলিটারি রোড নামে পরিচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুদশকের মধ্যেই কোম্পানি উপলব্ধি করে যে রাস্তাটি দার্জিলিংয়ের ভবিষ্যত সম্ভাবনার জন্য উপযুক্ত নয়। যে দ্রুততার সাথে নেপিয়ার ঐ দুর্গম এলাকায় রাস্তাটি তৈরি করেছিলেন, তাতে বোঝা যায় তিনি কতটা তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলেন। আসলে নেপিয়ার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে ছেড়ে কোম্পানির নির্দেশে এই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। সুতরাং তিনি তাঁর কাজ শেষ করে দ্রুত তাঁর নব্য বিবাহিতা স্ত্রীর কাছে যেতে চেয়েছিলেন। এখান থেকেই সমস্যার সৃষ্টি। এই ধরনের রাস্তা তৈরি করতে যে সময় ও পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল তা তিনি করেন নি। ফলে রাস্তাটি প্রচণ্ড খাড়া এবং বিপদ সঙ্কুল প্রমাণিত হয়। যদিও নেপিয়ারের ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতা ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে তবে অপরিকল্পিত কাজের জন্য বহু শ্রমিকের প্রাণহানিও ঘটে। যদিও একজন সাহেবেরও এতে প্রাণহানি হয়নি, সুতরাং স্থানীয়দের মৃত্যু যথারীতি ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। যাই হোক, দার্জিলিংয়ের ভবিষ্যতের জন্য বিকল্প রাস্তা তৈরি করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পথ থাকে না এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে অন্য একটি বিকল্প রাস্তা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴