বাংড়ি তিতি ও হাউড়ি শেষে
পর্ব : ৭
মিশা ঘোষাল
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
তিতির অরণ্যে
লঙ্কাপাড়া
রেঞ্জের অন্তর্গত তিতির বনভূমি আমাদের টোটোপাড়ায় যাবার পথের এক চির সবুজ
অলংকার। তিতি নদীর পাড়ের এই অরণ্যপথে নিত্য নতুন অ্যাডভেঞ্চার প্রায়ই
আমাদের যাত্রাপথে অপেক্ষা করে থাকে। এই তো সেদিনের কথা (৮ জুন ২০২১),
টোটোপাড়া থেকে বিদ্যালয়ের কাজ শেষ করে আমরা ফিরছিলাম আমাদের রিজার্ভ
গাড়িটি নিয়ে। ফিরছিলাম এই তিতি নদীর পাড়ের অভয়ারণ্যের পথ ধরে। হঠাৎ দেখি
আমাদের জিপ ড্রাইভার কৃষ্ণ গাড়ির ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল! আমি সাধারণত
জিপের সামনের সিটের বাঁ দিকেই বসি।
বললাম,"কি হল কৃষ্ণ? গাড়ি থামালে কেন?"
কৃষ্ণ বলল, "ম্যাডাম, হাতি আছে সামনেই !"
আচমকা
সবুজের মাঝখানে চেয়ে দেখি একদল হাতি আমাদের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে !
সেগুন গাছের বড় বড় পাতাগুলির আড়ালে গাছের কান্ডের যে রঙ, হাতির গায়ের রঙও
ঠিক তেমনি। যেন পাতার মতো হাতির কানগুলিও দুলছে পাতার আড়ালে ! বড় বড় সেগুন
পাতার মতো কানগুলি দোলানো শুধু দেখা যাচ্ছিল দূর থেকে। আর দেখা যাচ্ছিল
ওদের কাচ্চা বাচ্চাগুলোকে ওদের মায়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে। মা হাতিরাও
যে তাদের বাচ্চাদের আদর করতে জানে! দেখি মস্ত বড় শুঁড় দিয়ে ওদের বাচ্চাদের
গায়ে আদরের পরশ এঁকে দিচ্ছে! ওদের আঘাত করলে বা কোনো হাতি দলছুট হলে তবেই
ওরা তেড়ে আসে। না হলে ওরা শান্তই থাকে, চুপচাপ।
কখনও
কখনও এরকম হাতির পালের কোনো একটি হাতি পথ হারিয়ে পিছনে পড়ে গেলে সেই দলছুট
হাতিটি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অভয়ারণ্যের রাস্তায় কোনো গাছের পিছনে
এরকম দলছুট হাতি লুকিয়ে থাকে। আর সামনে পেলে কাউকে আর রক্ষা থাকে না ! একলা
পথচারীকে দেখলে হঠাৎই তেড়ে এসে আক্রমণ করে। পথচারীরা এরকম দলছুট হাতিকে
দেখে ভয় পায়। এইরকম দলছুট হাতির কবলে পড়েই প্রতি বছর মারা যায় অনেক মানুষ
এই অভয়ারন্যের জঙ্গলে। সামনে পেলে পা দিয়ে পিষে মারে। মাদারীহাটেও এরকম
হাতির কবলে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা অনেক। ডুয়ার্সের বিভিন্ন জঙ্গলে এই দলছুট
হাতির দ্বারাই অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু এরকম শান্ত সদলবলে হাতি
যখন সপরিবারে অরণ্যপথ পরিভ্রমণ করে তখন সাধারণত কোনো বিপদের আশংকা থাকে না।
যখন এইরকম বিশ ত্রিশটির মতো হাতি একসাথে থাকে তখন সাধারণত কোনো বিপদের
আশংকা থাকে না।
একসাথে এতগুলো হাতি একসঙ্গে দেখতে পেলে বুঝতে হবে ওরাও অরণ্য, নদী আর ঝোরার রাস্তা পরিভ্রমণে বেরিয়েছে।
হাতিরা
নিরামিশাষী হয়। সাধারণত অরণ্যের লতাপাতা সবুজ গাছগাছালি খায়। কলাগাছ খুব
প্রিয় ওদের। ওদের খাবারের স্পেশাল মেনুতে থাকে ওদলা, চালতা আর জংলি
কাঁঠাল। বনদপ্তর এই গাছগুলি এই লঙ্কাপাড়া ও জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে এসব গাছের
চারা লাগিয়ে দেয় প্রতিবছর। জঙ্গলে চালতা, ওদলা বুনোকাঁঠাল, কলাগাছ সবই হয়।
কিন্তু ঐ যে! সেখানেও এলাকার মানুষ জন বনের এই ফলগুলি তুলে আনতে গভীর
জঙ্গলে প্রবেশ করে। পশুপাখির এই খাবার তুলে আনার সময় অনেকেই বিপদে পড়ে,
হাতির নখযুক্ত মোটা থামের মতো পায়ের চাপায় পিষ্ট হয় এইসব লোকজন।
গাছের
শুকনো কাঠ ও ডালপালা কুড়িয়ে আনতে গিয়েও এই অরণ্যে মারা যায় অনেক আদিবাসী
মেয়ে, বৌ ও ছেলে। এখানকার আদিবাসী মহল্লার অধিকাংশেরই এখনও জঙ্গলের কাঠ
কুড়িয়ে না আনতে পারলে হেসেলের উনুনে আগুন জ্বলে না। টোটোদের মেয়ে বৌদেরও
টোটোপাড়া সংলগ্ন এই হাউড়ি ও তোর্ষার বনাঞ্চল থেকে কাঠ সংগহ করে আনতে হয়।
বাঁশের ঝুড়ি বা "ডোকো" নিয়ে ওরাও পাহাড়ের উপর থেকে কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে
আসে। ইদানিং অবশ্য অনেকের বাড়িতে গ্যাসে রান্না করার উপযোগী সরঞ্জাম
রয়েছে। তথাপি টোটোরা তাঁদের পুরোনো টোটোঘরে কাঠের উনুনে বা মাটির তৈরি
উনুনে রান্না করে তাঁদের অভিজাত রন্ধনকৌশল অক্ষুন্ন রেখেছে আজও ।
টোটোপাড়ায়
হাতির ভয়ে এখনো অনেকে গাছবাড়ি বা টুঙ-এ বসবাস করে। হাতি এলেই তাঁরা ঐ
গাছের উপরে যে ঘর থাকে, তাতে উঠে যায়। হাউড়ির পাড়ে টোটোপাড়ায় ঢোকার মুখে,
হাতি তাড়ানোর এরকম একটি নজরমিনার রয়েছে, যা গাছের উপর তৈরি একটি গাছবাড়ি
বা টুঙ। দৃষ্টিনন্দন এই টুঙ এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে হাউড়ির কিনারে।