পইলা সাঞ্ঝির কথা/৭
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৭
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সাতাও
>>>>>>>
তিন দিনের বাসি পেপার পুঙ্খানুপুঙ্খ মায় পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন সহ শেষ করেও সময় কাটছে না। আজকের পেপার তো হাতে পাওয়ারই কোনো চান্স নেই। সবই আগের। এখানে পেপার আসে না, কান্তেশ্বর একটা দোকানে পান খায়, ওখানেই পেপার রাখে, ফেরার সময় নিয়ে আসে, মাস গেলে টাকা দেয়। নানা কাজে দরকার হলে একমাত্র এই বাড়িতেই পেপার পাওয়া যায়। নতুন ক্লাসে ওঠার আগে থেকেই সেজন্য বাচ্চাগুলোর মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় বইয়ের মলাট লাগানোর জন্য পেপার নিয়ে যাওয়ার।
কান্তেশ্বর আজকে কাজে যেতে পারেনি। পারবে কি করে! ছাতা, ধুতি, কাদা এই ত্র্যহ্যস্পর্শে রাস্তায় কি হতে পারে অনুমান করে আর বেরোনোর সাহস হয়নি। সেজন্য মুখটা আলু সেদ্ধর মতো করে বসে আছে। ঘুমানোর উপায় নেই, বিছানা দুই হনুমানের দখলে। তবু আশায় আশায় একটু বিছানাটার দিকে তাকালো, দেখল মেয়ের পুতুলের সংসারের পাশে জমে উঠেছে ছেলের দোকান দোকান খেলা। সারা বিছানা লন্ডভন্ড! অবশ্য কোনো খেলাই বেশিক্ষণ একনাগাড়ে চলছে না, ক্ষণে ক্ষণে পালটে যাচ্ছে।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল, চমকে উঠল বিকট চিৎকারে। দুজনে একটা করে নাক চেপে ধরে ব্যাঙের ডাক ডাকতে শুরু করেছে –
“তোর বাপ্পে মোর বাপ্পে
পাটাবাড়িতে ধান নাপ্পে”
“আহ!”
মৃদু ধমক দিল কান্তেশ্বর। তারপর বিরক্ত মুখে বাঁশের বেড়ার গায়ে ঝোলানো দোতোরাটা হাতে নিয়ে ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়ল। বসমতী হা হা করে উঠল,
“এই মতোন জল খানোত তোমরা আরো কোটে খ্যাও মারির যাছেন”।
“কোটে যে আরো যাছোং তে কায় জানে! এটেখেনায় না, হামারে ডারিয়া ঘরটাত যায়া বোইসোং, একটা দুইটা মানসি জুটি যাবে এলায়”।
“জুটিবে, সোগায় তো তোমারে মতোন বাউদিয়া”!
বসমতী সুযোগ পেয়ে ফোড়ন কাটে। কান্তেশ্বর এসব কথাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। দোতারাটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে উঠোনের জল পেরিয়ে বাইরের দিকে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই বসমতী প্রমাদ গোণে। প্রাণপণ চেঁচিয়ে বলে,
“মুই কিন্তুক এমন জল খানোত ঘোন্টায় ঘোন্টায় চা পানি নিগির পাইম না কয়া দিলুং, তোমরা কিন্তুক চিকরির পাবেন না কয়া দেছোং”!
কান্তেশ্বর বসমতীর কথাকে আমল না দিয়ে গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ডারিয়া ঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে একটি নিঃসঙ্গ দোতারার আওয়াজ ভেসে আসে,
"ডোলডং, ডোলডং"
কান্তেশ্বর যেতে না যেতেই বাচ্চাদুটোও এক ছুটে উঠোন পেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বাইরে পগার পা। বসমতী হতভম্ব! তারপর মরীয়া হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে –
“ওই ছাওয়ার ঘর না যান না যান, দ্যাখো ক্যামন দ্যাওয়াটা ফুটেছে। দ্যাওয়া ফুটিলে কিন্তুক ঘেংটিয়া সাপের বাচ্চা হয়, মাতাত পড়িলে এলায় বুজিবেন”!
বসমতীর সমস্ত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দুটোই ছুট্টে বেরিয়ে গেল। রসবালা সান্ত্বনা দিয়ে বলে
“যাউক দি, ঘরটাত আর কতো নয়! ছাওয়া হইলেও উমরাও না মানসি, হামাকে নোবার মোনায় না”!
“ভয় নাগে যে মাই, চাইরো পাকে ডিগিডাগা ভত্তি হইসে, যায়া কি চুপ করি নবে, কার পাটার জাগোত চড়িবে, কোটে এলায় কলার ভুরা ভাসাবে! চিন্তাতে মুই মরি যাং”।
“হোটা তো হয়, কয়দিন আগোত বোলে একটা ছাওয়া পাটার জাগের তলোত পইচ্চে, ছাওয়াটাক চান্দে পায় নাই দি! এখেরে বোলে মানসি ডিগির পাড়টাত, মানসিময় মানসি। পরে জাল দিয়া তুলি আইনচে। মাওটার বোলে কান্দন, সোয়ায় না যায়। এখেনায় সার বেটা বোলে, চাইরটায় বেটি! তে বেটাটায় মরিল”!
বসমতী শিউরে ওঠে, মনখারাপ হয়ে যায়, রাগও হয় খুব। বলে,
“কয়দিন আগত এমন অউদ খানোত নালকাল হয়া ফাকোতে ঢেকিয়ার ফুল চান্দে বেরাইল। কারটে শুনিসে কায়জানে, ঢেকিয়ার ফুল পালে মানসি বড়লোক হয়! দোনো ভাই বইনি এখেরে হায়মারা হয়া চান্দের ধইচ্চে নদীর পাড় খানোত। শুনিয়া গেলুং, বাড়ি আনিয়া দিলুং কয়টা বসেয়া। উমার কোনো ভাইস্যা আচে, এমন জলখানোত যাবে এলায় নদী, নাহয় তে ডিগি, পাটার জাগোত চড়ির না”!
রসবালা বুঝতে পারে। তারপর কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে
“জলখান কমেও না, শনিবারিয়া সাতাও নাগিলে বোলে আর শনিবার আসিলেই ছাড়িবে, হয় দি”?
বসমতী উত্তর দেবার আগেই বাইরে থেকে ডাক এল
“মাই বাড়িত আচিস”?
“আছোং, কায়”?
দরজা দিয়ে একটু ঝুঁকে তাকাতেই দেখে ভাঙা একটা ছাতা মাথায় দিয়ে নৃপেনের মা এসে বারান্দায় ওঠে। বসমতী ব্যস্ত হয়ে বলে
“আস্তে আইসেক দি, বারান্দাখান জল পড়ি পিচিলা হইসে”।
“ কি করিছিত”
বলে ভেতরের দিকে মুখ বাড়িয়ে রসবালাকে দেখে কেমন যেন একটু সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। তারপর বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, যেন যা বলতে এসেছে ভুলে গেছে। বসমতী ঘরের ভেতরে ডাকে। নৃপেনের মা দাঁড়িয়েই থাকে, তারপর ইতস্তত করে বলে,
“মাই, চাইট্টা চাউল ধার দিবার পাবু, বাউ কাজত গেইলে আনি দিম। নাই কাজ, আজিও না যায়া ঘুরি আসিল। একঝনকার পাটা ধুবার কাথা ছিল তে, ভাল করি পাকে নাই বোলে, এলাইতে নেকালে দড়কচা পড়িবে। মোরে হইসে এইলা জ্বালা, ছাওয়ালা না খায়া আচে, ক্যাং করি পরানটা সয় কত মাই”!
গলাটা কি একটু ধরে এল? বসমতী সহজভাবে বলে
‘কিসোত নিবু তে”?
“আঞ্চোল খানোতে দে, নাই আনোং কোনো, বাড়িত এখেরে বাটুয়া খুচি একটাও নাই, সব ভাঙিসে”।
বলে মাটিতেই আঁচলটা পেতে দেয়, বসমতী আন্দাজমতো দু বেলার খাওয়ার হিসেব করে কয়েক কৌটা চাল ঢেলে দেয়। এবার রসবালা কথা বলে,
“তোমার বুড়াটা ভাল আচে এলা”?
রসবালা কথা বলাতে দৃশ্যতই খুশি দেখায় নৃপেনের মা কে। গলায় একটু জোর পায়। কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না, এই চাল নিয়ে গেলে তবেই রান্না হবে, বাড়িতে সবাই অভূক্ত। নৃপেনের মা চলে গেলে রসবালা উঁকি দিয়ে একটু বাইরেটা দেখার চেষ্টা করে।
“ঝালি বোদায় অনেকটাই গড়ি গেইসে হেনা দি”?
বসমতী অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয়,
“ক্যাং করি কবু, বেলাটারে দেকা নাই”! গ্রামের মানুষ মাথার উপর সূর্য আর ঘরের চালের ছায়া দেখে সময় ঠাহর করে, আজ সে উপায় নেই। তবু আন্দাজ করে অনেক সময় সঠিকটা বেরিয়ে আসে।
রসবালার কাঁথা সেলাই করতে বসেছে দুজনে। অনেকদিন থেকেই ঘ্যান ঘ্যান করে বসমতীর কাছে,
“কেতাখান কোনেক বন খোয়া দে তো দিদি, পরে সেলা মুই আস্তে আস্তে সিয়াইম”।
তো আজকে বৃষ্টি, অন্য কোনো কাজ হওয়ার উপায় নেই দেখে বসমতী বলে এসেছিল তাড়াতাড়ি খাওয়ার পাট চুকিয়ে কাপড় নিয়ে আসতে, এখানেই সেলাই করবে। চারদিকের ধারগুলো সেলাই করে নিয়ে এখন মাটিতে পেতে সেলাই করছে, নিচে দুজনে দুটো থালা নিয়েছে। থালাটা থাকলে সেলাই করতে সুবিধা হয়। একটু করে সেলাই করে আর থালাটা ঠেলে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যায়। বৃষ্টি দেখতে দেখতে বসমতী অন্যমনস্কভাবে বলে,
“এমন আতি দিন সামানে জল পইল্লে গরু ছাগলগিলারও কষ্ট, মানষিরও কষ্ট। কাজ নাই, মানষি খাবে কি! নৃপেনের মাওটা এমন বুড়ালি বসত জলখানোতে বেরাইসে চাইট্টা চাউল খুঁজির”।
রসবালা বলে,
“ সেদিন মোরঠেও আনিসে। কয়দিন থাকি কেমন জলখান! ধান চাইট্টা উসি দিসুং শুকায় আর না, হিদি খাবার চাউলও ফুরাইল। কি আর করং, কান্তাইতে ধানগিলা ভাজিলুং। ভাজিয়া একেলায় ভুকালুং। ওঠে থাকি চাইট্টা সেদিন নিগাইল। কয়দিন পরেই দিবার চান্দাইসে, দিবে কোটে থাকি। মনত তো শরম নাগে! মোক দেখিয়া কেমন ছোমা খাইল দেখিলু না”?
বসমতীও লক্ষ্য করেছে ব্যপারটা। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“বুড়িটা কি করিবে? বেটার কামাই না হইলে এমতোন করিয়ায় চলির নাগিবে। আর কয়দিন পরে পাটা ধোয়া শুরু হইলে সেলা কোনেক অভাবটা কমিবে। কিন্তুক আরো না অভাব আসিবে। সারাবছর কাজ না পালে অভাব কি ফুরায়”!
বসমতী ভাবে দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এই মানুষগুলোর জীবনটাই কখন ফুরিয়ে যায় টেরও পায় না। অথচ সারাজীবন সুখের জন্য চিন্তা করতে করতে যেন অবধারিত মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে চলা।
বসমতীকে অন্যমনস্ক দেখে রসবালা জিজ্ঞেস করে
“কি শাক আন্দিলু দি”।
নাই মাই শাগে নাই। যে জল! হাটে যাবার পায় নাই। বাড়িরে কয়টা ঢ্যাঁড়স ফলিসে তাকে ভাজিলুং আর সাতপুতি দিয়া আলু দিয়া আন্দিলুং। ছাওয়া দুইটাক ডিমা ভাজি দিলুং, সুদায় খাবারে না চান্দায়”!
গল্পে গল্পে কান্তেশ্বরের কথা দুজনেই ভুলে গেছিল। ডারিয়া ঘর থেকে জোরে দরিয়ার টান ভেসে এলে দুজনেই সচকিত হয়ে ওঠে। রসবালা সেলাইয়ের ফোঁড় তুলতে তুলতে গুন গুন করে, আপন মনে গলা মেলায়। বসমতী বাচ্চাগুলোর জন্য আর চায়ের চিন্তায় উসখুশ করে। এবার বাইরে একটু চা চিড়া বা মুড়ি দিয়ে আসতে হয়। কতজন যে আছে ভগবান জানে! পান সুপারি দিতে গেলেই আন্দাজ পাওয়া যাবে। সেলাই থামিয়ে ছেলের নাম ধরে ডাকে। সাড়া নেই। তবু উৎকর্ণ হয়ে থাকে। জলের উপর ছপ ছপ থপ থপ আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখে বুধেশ্বর। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলে
"বাউ মাই দোনোঝোনে এটেকেনায় আছে বারে। মেলাক্ষণ থাকি কাকার গা'ত ন্যাচের প্যাছের করির ধইচ্চে।"
বুধেশ্বরকে দেখেই বসমতী বুঝতে পারে চায়ের এত্তেলা এল। রসবালার দিকে তাকিয়ে বলে,
"নে, থো এলা। যে ভোটোরা ভোটোরা সিলাই দিছিত, কেতাখানোকে অপাতে ফেলাছিত। যা আকাটা নাগা। ঠ্যাঙ্গাটা বসে চা খান বানা। মুই আর কোনেক সিলাই করি উঠোং। মুড়ি চাইট্টা নিকলির নাইগবে টিন থাকি।
................................................................
খ্যাও মারা - মাছ ধরার জন্য প্রতিবার জাল ফেলাকে খ্যাও বলে।
ডারিয়া ঘর - একদম সেপারেট বসার ঘর বা বাইরের ঘর।
কলার ভুরা - কলার ভেলা।
নালকাল - ঘেমেনেয়ে লালচে হয়ে যাওয়া।
হায়মারা - হয়রাণ।
ঝালি - চালের ছায়াকে ঝালি বলে। তা দেখে সময় আন্দাজ করা হয়।
সাতপুতি - ঝুমকো ঝিঙ্গে।
ন্যাচের প্যাছের - গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকা।
-----------------------------------------------------------
ছবি : ময়ূখ রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴