নানা রঙের গানগুলি-৭/শৌভিক কুন্ডা
নানা রঙের গানগুলি/৭
শৌভিক কুন্ডা
-----------------------------
আমার এক অনুজ বন্ধু, সাংবাদিকতা পেশা, একটা লেখায় বলেছিল, দূরপাল্লার ট্রেনে "সাইড লোয়ার বার্থটা হচ্ছে কবিতা", যদি একা থাকো। নিজের মনে ডুবতে পারো, আঁকতে পারো, হাসতে পারো, ডিস্টার্ব করবার কেউ নেই। আমার খুব মনে গেঁথে আছে লেখাটা। তো, তেমনি এক রেলগাড়ি। কোলকাতা থেকে ফিরছি। একা এবং সাইড লোয়ার। মনে মনেই হারিয়ে যেতে দিয়েছিলাম নিজেকে। হঠাৎ সেই নেই-দেশের ভেতর ঢুকে এলো, একটু চড়া গলা, রেল ছোটার ঝমঝম ছাপিয়ে,
" সেই না দেশের
কথা রে মন ভুলে গিয়েছ"
প্রায়যাত্রার অভিজ্ঞতা জানিয়ে দিলো লালমাটির দেশ ছাড়াচ্ছি। কোন দেশের কথা বলছেন এই বাউল ভিখিরি, বুঝতে বেশি সময় লাগলো না, কারণ তিনি তখন গাইছেন পরের লাইনে,
"হয়ে হেঁটমুন্ড ঊর্ধ্বপদ
যে দেশে বাস করেছ
সেই না দেশের কথা
রে মন ভুলে গিয়েছ...."
গায়ক বাউলকে ডেকে বসালাম। তারপর গানভাসি। নিজের স্টেশন এলে নমস্কার জানিয়ে নেমে গেলেন তিনি। আর, এতক্ষণ কি করছিলাম হারিয়ে গেলো আমার থেকে। মনে মনে ফিরে গেলাম রাঙাধুলোর দিনগুলোতে।
হ্যাঁ, একটা সময় ধরে বাউল সঙ্গ পেতে বারবার ছুটে যেতাম সেখানে। শুরু হয়েছিলো কোনো পৌষমেলা বা বসন্ত উৎসবের সময় শান্তিনিকেতনেই। মাঠে ঘুরতে ঘুরতে ডুবকি-খমক ডেকে নিয়েছিলো। সেখানে তখন আসরে মেতেছেন তরুণ দাস বাউল। তারপর গানভাসি। সেই যে শুরু, তার পর থেকে বহুবার, বার বার, উৎসবে, উৎসবহীনতায়। বেড়ে উঠতে লাগলো আমার বাউলবন্ধুদের সংখ্যা।
তেমনই একবার। ভোররাতে পৌঁছে গেছিলাম। সেলফোনের যুগে তো আর আলো ফোটার অপেক্ষায় স্টেশনে সময় কাটানোর প্রশ্ন নেই, ছোট্ট ওভারব্রীজ পেরোতেই সঞ্জয়ের হাসিমুখ, "সাড়ে চারটেতে ঢুক্যে বস্যে আচি ,দাদা!" আর একই নিশ্বাসে প্রায়, "ভাঁড়ের চা?"
সঞ্জয় টোটো চালায় সারাদিন। সন্ধ্যের পর আর না। তখন প্রেমজুরি হাতে হারিয়ে যায় আখড়াতে। শ্যামবাটি, বাসুদেব দাস বাউলের আখড়াতে। বাসুদার সাথে পরিচয় অনেক আগে থেকেই আমার। তাঁর আসরেই সঞ্জয়ের সাথে প্রথম যোগাযোগ। হাল্কা হিমেল বাতাস মাখতে মাখতে পৌঁছে গেলাম জামবনির রিসর্টে। ম্যানেজার হাবিবের সাথে কথা হয়ে আছে, চেক ইন বারোটায় যদিও, 'রেগুলার কাস্টমার'এর জন্য নাথিং অফিসিয়াল! ভোর ভোর পৌঁছেও তাই উষ্ণ অভ্যর্থনা, তৈরি শয্যা। সঞ্জয় বলে গেল ন'টায় আসবে। ততক্ষণ চোখ দুটোকে একটু বিশ্রাম।
আহ্, আবার সেই কোপাই! সঞ্জয় আমার লোক্যাল ম্যানেজার, রিসর্ট থেকে বের হতেই বলে রেখেছে, "কাল তো রঙ খেলায় মেইত্যে থাগবেন, সন্ধ্যেয় ফের সেঁদোবেন হাটে- দেখা-সাক্ষাৎ যা যা সারার এ বেলাতে সেরে লিত্যে হব্যে!" সুতরাং চলো চণ্ডীদাসের রাজত্বে। কোপাইয়ের ছোট্ট সাঁকোটি (সচরাচর ঠিক যেখানটিতে শান্তিনিকেতন ভ্রমণার্থীরা ক্যামেরায় নিজেদের চিরস্থায়ী রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন) না পেরিয়ে বাঁ হাতে নেমে যাও, নদীর ওপারে যেখানে অবাক করা জারুল গাছ ঝুঁকে আছে জল ছুঁয়ে, তার ঠিক সমান্তরালে এপারে একা গাছের নীচে বাবরি চুল, সুঠাম চণ্ডীদাস বাউল। উচ্ছ্বাস নেই, অবাক হওয়া নেই, সহজ স্মিত সম্ভাষণ আমাকে দেখে, "কখন এলেন? বসুন।" এগিয়ে দেন থার্মোকোলের টুকরোটি। যেন এ দেখার আগে দীর্ঘ বরষ মাস কেটে যায় নি, যেন আবহমান গান শুনতে শুনতে আমি খানিক সময়ের জন্য উঠে গেছিলাম মাত্র! বসতে না বসতেই বেজে ওঠে গুপিযন্ত্র, চোখ নাচিয়ে গলা ছাড়েন চণ্ডীদাস -
"আজো সেই বৃন্দাবনে
বাঁশি বাজে রে....."
গান শেষ হলেও কথা হয় না আর। আমার এগিয়ে দেওয়া সিগারেট ধরিয়ে চণ্ডীদাস বুঁদ হয়ে যান। আমি পরিচিত অপেক্ষায়। সিগারেট শেষ হলে চন্ডীবাউল ফের তুলে নেন একতারা। বেজে ওঠে তন্ত্রী, নেচে ওঠে ঝাঁকড়া চুলের বহর, ঝিকিয়ে ওঠে চোখের হাসি, চন্ডীদাস গান ধরেন -
"বৃন্দাবনে ফুল ফুটেছে
তিনরঙা
নীল-জরৎ-সাদা
বলো বলো
কোন ফুলে শ্রীকৃষ্ণ আছে
কোন ফুলে শ্রীমতী রাধা।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴