ঢোলসানাই-৭/সুবীর সরকার
ঢোলসানাই/সুবীর সরকার
সপ্তম পর্ব
""""""""""""""''''""""""""""""""""""""""
১৯.
ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এই প্রাকসন্ধ্যের বিষণ্ণ আলো শরীরে মাখতে মাখতে কত কথাই যে মনে আসে অনিমেষের! কথার জালে জড়িয়ে যেতে যেতে,স্মৃতির পাকে পাকে জড়িয়ে যেতে যেতে এই প্রায় পঞ্চাশে অনিমেষ কি তবে চূড়ান্তরকম তাড়িত হয়!
সে কি শাহ আব্দুল করিমের গান শুনতে শুনতে জীবনের আরো গভীরেই ঢুকে পড়তে থাকে! এত এত বছরের কবিতা লিখবার জীবনে এত ক্লান্তি জমে কেন! এই জনপদের সবচেয়ে অপমানিত কবি অনিমেষ। কবিতার জন্য কত কিছু ছাড়তে হয়েছে তাকে।
ভালোবাসতে ভালোবাসতে কি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে সে। আগুনের ভেতর দিয়েই তো একজন স্রষ্টাকে হেঁটে যেতে হয়। সেই ৩০ বছর আগে এক কিংবদন্তি কবি তরুণ অনিমেষকে এই কথা বলেছিলেন।তারপর থেকেই অনিমেষ বেছে নিয়েছে কবিতা লিখবার এক জীবন। প্রবল অভিশপ্ত এক জীবন।তাড়িত দুঃখের মতন সে কেবল জীবনের পরতে পরতে বাদ্য ও বাজনার সমস্বর মিশিয়ে দিতে চেয়েছে।এই বিকেল সন্ধ্যের মাঝামাঝি অনিমেষ তার চোয়ালের পেশিতে এঁকে রাখতে থাকে এক চিলতে হাসি। আর পাখিরা ফিরে আসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে।
২০.
মানুষের ঘরবাড়ি থেকে যাপনের গল্পগুলি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চাঁদের আলোয় রহস্য গড়িয়ে নামে। ভাঙ্গা হাটের টুকরো টুকরো অংশগুলি তখনও জেগেই থাকে।আর উকিল মুন্সীর গান গাইতে গাইতে হারাধন তার চায়ের দোকানে একটা ময়মনসিংহ একটা নেত্রকোনা আর হাউড়ের জলের শব্দ শুন্তে থাকে বুঝি!হারাধনের দু’চোখ তখন বন্ধ।চোখে জলের ধারা। দেশ ছেড়ে এসেছে কবে, কিন্তু আজও সে তার শরীরে;তার সমগ্রতার ভেতর বহন করেই চলেছে তার দেশ।অনিমেষ সামান্য দূর থেকে এটা দেখে। সে এগোতে থাকে হারাধনের গানের দিকে।না কি গানই এগিয়ে আসে তার দিকে_
‘আখ খেতে ছাগল বন্দী
জলে বন্দী মাছ
নারীর কাছে পুরুষ বন্দী
ঘুরায় বারো মাস’
এটাই তো জীবন।জীবনের বাঁকে বাঁকে বাঁকে কে বুঝি গুঁজে দিতেই থাকে প্রসন্ন বিজধান।
২১.
একা একা হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ কেমন দূরাগত হয়।স্মৃতির গোপন কুঠুরি থেকে গত জন্মের রহস্যময় বাতাস তাকে জাপটে ধরে।কিছুই তখন আর করার থাকে না।সে দেখতে পারে গোলক গঞ্জের কলেজ মাঠে জুলুস। রংবেরঙের মানুষের ভিড়। মাইকে বাজতে থাকা গোয়ালপাড়া অঞ্চলের গান। কি এক আগ্রহে সে ক্রমে ঢুকে পড়তে থাকে সেই জমায়েতের ভিতরে।
সে ছিল ভোটের সভা।ইয়াকুব গিদাল এবারো ভোটের ক্যান্ডিডেট।দুই দুইবারের বিজয়ী এম.এল.এ. তিনি। লোকগানের লোক। গান লেখেন। দোতারা বাজিয়ে গান গান।আর মরুচমতি শিল্পী সমাজের মহিন মাস্টারের সাথে ঘুরে বেড়ান জনপদের পর জনপদ।ইয়াকুব গীদাল কেন জানি না কখনো ইয়াকুব এমেলে হতে পারলেন না।
কোনো ভোটেই তাকে ভোট চাইতে হয় না।তার কোন ভোট প্রচার নেই।তিনি কেবল জুলুসের পর জুলুস গানে গানে ভরিয়ে দেন।মানুষ গান শুনতে শুনতে মাতোয়ারা হয়।আবার নেচেও ওঠে দু চার পাক।
কোন জুলুসের জনমানুষেরা তাদের ভেতর ফাউ হিসেবে পেয়ে যায় আব্দুল জব্বার কিংবা কেরামত আলীকে। বাতাসে গান ভাসতে ভাসতে চলে যায় গঙ্গাধরের দিকে, মুন্সী বাড়ির বাহির খোলা নের দিকে_
"চাষার মুখত আর নাইরে সেই গান
বড় সাধের বাপ কা লা নি আমার ভাওয়াইয়া ভাসান"।
অনিমেষের মুখ জুড়ে নেমে আসতে থাকে এক লুপ্ত পৃথিবীর নাশপাতি গন্ধ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴