করলাভ্যালি চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
করলাভ্যালি চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
জলপাইগুড়ি শহর ডুয়ার্সের গেটওয়ে। তিস্তা পেরিয়ে ডুয়ার্সভূমিতে ঢুকে পড়বার জন্য পর্যটকদের সাদর আপ্যায়ন জানাতেই যেন যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই জল শহর। জলপাইগুড়ি থেকে সামান্য এগিয়ে বাঁদিকে বা ডানদিকে গেলেই অফুরন্ত সবুজ। চা বাগান, জঙ্গল, পাহাড়, পাহাড়ি নদী। তিস্তা নদীর তীরে দেড়শ বছরের পুরনো শহর জলপাইগুড়ি। নদীর পাড় ঘেঁষে দীর্ঘ বাঁধ দিয়ে শহরকে সুরক্ষিত করা হয়েছে ১৯৬৮ সালের ভয়ংকর বন্যার পর। শহরের খোলা জায়গা থেকে
রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি, সবুজ চা বাগানে ঘেরা মোহময় প্রান্তর, নারকেল সুপারি গাছে ঘেরা মফস্বল শহরটি বসবাসের জন্য আজও এতটাই শান্তিপূর্ণ যে, অস্থায়ীভাবে শহরে এসে বসবাসকালে অনেকেই মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়ে স্থায়ীভাবেই শহরে থেকে যান। ৬৮ সালের বন্যা শহরের অর্থনীতিতে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। আর্দ্রতা বেশি, শীতও যথেষ্ট বেশি এবং বৃষ্টি অধ্যুষিত অঞ্চল জলপাইগুড়ি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা চরমভাবাপন্ন বলে সমগ্র জেলা চা চাষের পক্ষে উর্বর মাটির জন্ম দিয়েছে। তাই ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ মিলে সবুজ চা বাগিচার সুঘ্রাণ জেলার অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। তিস্তা নদীর দ্বারা পরিবেষ্টিত জলপাইগুড়ি শহর জলপাইগুড়ি জেলার সদর দপ্তর এবং উত্তরবঙ্গের বিভাগীয় সদর দপ্তর। তিস্তা নদীর পাড়ে জুবিলী পার্ক, তিস্তা সেতু উদ্যান, সরোজেন্দ্র দেব রায়কত কলাকেন্দ্র অর্থাৎ যাকে আর্ট গ্যালারি বলা হয়, টাউন ক্লাব স্টেডিয়াম, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, আর্য নাট্য সমাজ, কিং সাহেবের ঘাট, করলা ভ্যালি, ডেঙ্গুয়াঝাড়, রায়পুর চা বাগান, জয়পুর চা বাগান, রাজবাড়ি হেরিটেজ গেট, নবাববাড়ি, সার্কিট বেঞ্চ, দেবী চৌধুরানীর মন্দির, ভ্রামরী দেবীর মন্দির, যোগমায়া কালীবাড়ি, লোকনাথ মন্দির, হুজুর সাহেবের মাজার এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চ, কালু সাহেবের মাজার, সাতকুড়ার মহাপীঠ, শিকারপুরের ভবানী পাঠকের মন্দির, গজলডোবা, ইউরোপিয়ান ক্লাব সবার সঙ্গেই শহর তথা জেলার পুরনো ইতিহাস জড়িত, যা আজও নস্টালজিক করে তোলে পুরনো দিনের মানুষগুলিকে।
জলপাইগুড়ি শহরের উত্তরের শহরতলিতে পাহাড়পুর মোড়ের কাছাকাছি স্থানে রুকরুকা নদী এসে করলার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই সংগম স্থলের পাশেই অবস্থিত শ্মশানকালী মন্দির, যা লোকমুখে দেবী চৌধুরণীর কালী মন্দির নামে বহুল পরিচিত। প্রায় চারশ বছরের প্রাচীন বটগাছের তলায় কে বা কারা এই কালীর স্থান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে অনাদিকাল ধরেই সংলগ্ন পাতকাটা অঞ্চলের অধিবাসীরা এখানে পুজো দিয়ে আসছেন। কালী থানের পাশাপাশি যে বিষহরির থানও ছিল তা প্রবীণ বাসিন্দাদের মুখে শোনা যায়। জনশ্রুতি যে, দেবী চৌধুরণী এখানে কালীমূর্তি স্থাপন করেছিলেন, সেই সূত্রেই কালীবাড়ির পরিচিতি দেবী চৌধুরণীর মন্দির নামে। তবে রুকরুকা নদীর পাড়ে এখানে যে সর্বসাধারণের শ্মশান ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখানে হিন্দু শ্মশান ছিল এবং তা মাসকলাইবাড়ি শ্মশানের চাইতেও প্রাচীন ছিল। পাতকাটা এলাকায় এমন অনেক প্রবীণ বাসিন্দা পাওয়া যাবে যাঁরা বলেন তাঁদের পিতৃ-পিতামহকে রুকরুকা নদীর ঘাটের শ্মশানে দাহ করা হয়েছে। পরবর্তীতে এখানে মাড়োয়ারি শ্মশান নির্মিত হয়, যা বর্তমানে আমরা দেখতে পাই। সুতরাং শ্মশান সংলগ্ন এলাকায় যে শ্মশান কালী মন্দির থাকবে তা সহজেই অনুমেয়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দমনের পর এখানে কালীর থান ও বিষহরি থান ছিল যা স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা পূজিত হত। সেই সূত্রেই এখানকার দেবী শ্মশান কালী। ১৯০৪ সালে তৈরি ব্রিটিশ সরকারের ভূমি দপ্তরের নথিতে এখানকার জমিকে কালী মন্দিরের সম্পত্তি অর্থাৎ জনস্বার্থে ব্যবহৃত বা দেবত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। সে সময় এই স্থান অযত্নে ছিল, শুধু বাৎসরিক পুজোর সময় পরিষ্কার করা হত। বহিরাগত সাধুসন্ন্যাসীরা এখানে আশ্রয় নিত। হঠাৎ বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে ছোট ছোট কয়েকটি গুহাপথ ছিল। এগুলির ভিতর দিয়ে দ্রুত নদীর পাড়ে পৌছানো যেত। মন্দিরের সামনে হরিতকী গাছের তলায় তুলসী বেদির পাশে এখনও এরূপ একটি গুহাপথের মুখ দেখতে পাওয়া যাবে যদি উপরের পাকা স্ল্যাব সরানো হয়। এই সুড়ঙ্গের নিচে সিঁড়ির ধাপ কাটা আছে যা পাতকাটা অঞ্চলের অনেক প্রবীণ বাসিন্দা প্রত্যক্ষ করেছেন।
জলপাইগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে করলাভ্যালি চা বাগান। জায়গাটা দ্বীপের মতো। চা বাগান থেকে নেমে করলা নদী পেরিয়ে কাকচক্ষু জলের নিচে বালির আলপনা আর রঙবেরঙের পাথর দেখতে দেখতে জল থেকে ওপারে উঠলাম। একটা টিলামতো জায়গায় লোটাদেবীর মন্দির। পাশেই চা বাগান। ঢেউ খেলানো বাগিচার নয়নাভিরাম দৃশ্য। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম। তখনই ভালো লাগার তালটা কেটে গেল। দেখলাম প্রকাশ্য দিবালোকে বড় নদীর বুকে একাধিক ট্রাক বালি পাথর তুলছে। বালিবোঝাই ট্রাক উঠে যাচ্ছে মোহিতনগরের দিকে। বড় রাস্তায় নদীর পাড় কেটে বাঁধের বারোটা বাজিয়ে নদীর বুক থেকে রাস্তা পর্যন্ত ট্রাক উঠে যাওয়ার মসৃণ এবং স্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছে। নদীর এপারে অনেক মানুষ বসবাস করে। স্নান করতে বা নদীতে কাপড় কাচতে আসেন। সবাই দেখলাম নীরব দর্শক। ম্যানেজার সাহেব এর সৌজন্যে বাগানটি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের শহর লাগোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বাগান এটি। আয়তন ৩৩১.৮৪ হেক্টর। চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্রও সমপরিমাণ। আপরুডেট এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ১০১.০৪ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ২২৪.০৩ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য উৎপাদন ক্ষেত্র ২২৪ হেক্টর। বাগানের শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৫২০ এবং মোট জনসংখ্যা ২৫৩১ জন। স্থায়ী শ্রমিক ৫৫২ জন। এরা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা তোলার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মজুরি পান। মোট কর্মরত শ্রমিক ৬৬৫ জন। করলাভ্যালি চা বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত চা ২০ থেকে ২৫ লক্ষ কেজি এবং ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চা ৪.৫ থেকে ৫.৫ লাখ কেজি। বহিরাগত বাগান থেকে সংগৃহীত এবং খোলা কাঁচা চা পাতায় প্রস্তুত চা ধরে ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চায়ের পরিমাণ ৬.৫ থেকে ৭.৫ লাখ কেজি। উৎপাদিত চা এর প্রকৃতি অনুযায়ী এই বাগানে উন্নত কোয়ালিটির চা উৎপাদিত হয়। করলাভ্যালি বাগানটি চরিত্রগত দিক থেকে ইনঅরগানিক চা প্রস্তুত করে। এই চা বাগিচা মেচপাড়া এবং জুরান্তি চা বাগান এর মতই দার্জিলিং ডুয়ার্স প্ল্যান্টেশন লিমিটেড এর অন্তর্গত যারা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। করলাভ্যালি টি এস্টেট সঠিকভাবেই প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা জমা করে। অর্থাৎ প্রোডাকশনের দিক থেকে বাগানের অবস্থা মন্দ নয়। বাগিচায় হাসপাতালের সংখ্যা একটাই। ডাক্তার আছে, অ্যাম্বুলেন্স আছে। কিছু না পারুন, বাইরে চিকিৎসা জরুরি মনে করলে অন্তত সঠিকভাবে রেফার করে দিতে পারেন। বছরে গড়ে তিনহাজার অসুস্থ শ্রমিককে রেফার করা হয় বলে তথ্য মিলল। বাগিচা সংলগ্ন ইংরেজি মিডিয়াম উচ্চ বিদ্যালয় হোলি চাইল্ড এবং বাংলা মাধ্যমের স্কুল মোহিতনগর। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব আছে, খেলার মাঠও আছে।
করলাভ্যালি চা বাগান আমার জলপাইগুড়ির শান্তিপাড়ার বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মত। তাই বাগানে আমার বেশ কিছু পরিচিতজন বন্ধুস্থানীয় থাকাতে নিত্য যাওয়া আসা। তাছাড়া করোনাকালের আগে ওখানকার স্থানীয় ক্লাবের কিছু যুবক প্রতি শনি রবিবার যে ফ্রি কোচিং সেন্টার চালাত সেখানে মাঝে মাঝে পড়াতে যেতাম প্রতি শনি রবিবার করে। তাই ওখানকার আদিবাসী, অ-আদিবাসী ছাত্রছাত্রী, ক্লাব, বাগান প্রশাসন, শ্রমিকদের সঙ্গে একটা সহজ সম্পর্কের ফলে তাদের ভাষা সংস্কৃতি শেখার এবং বোঝার একটা চেষ্টা তো ছিলই আমার। দেখেছিলাম সারাদিন প্রাণবন্ত, কর্মচঞ্চল বাগান রাত হলেই ডুবে যায় নেশার চোরাস্রোতে। চা বাগানের শ্রমিক মহল্লা থেকে মাঝেমধ্যেই অভিযোগ উঠত একাংশ শ্রমিক নিজেদের বাড়িতে অবৈধভাবে হাঁড়িয়া এবং চোলাই এর ব্যবসা করছে। বাগানে কাজ করার পাশাপাশি এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে অনেক শ্রমিক ভালো টাকা রোজগার করত। এরা নিজেদের মুনাফার জন্য চা বাগানের পরিবেশ নষ্ট করছে বলে অভিযোগ ওঠাতে আবগারি দপ্তর চা বাগান এলাকায় মাঝেমধ্যে অভিযান চালাত। পুলিশ প্রশাসনের তরফেও অবৈধ মদের ব্যবসার বিরুদ্ধে সচেতনতামুলক প্রচার চালানো হত। তাতে সাময়িকভাবে মদ বিক্রি বন্ধ হলেও কিছুদিন পরে আবার একই পরিস্থিতি দেখা যেত। কোচিং সেন্টারের বাচ্চাগুলোর সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম ওদের বাবারা অধিকাংশই রাত হতে না হতেই দেশী চোলাই অথবা হাঁড়িয়ার নেশাতে ডুবে যায়। ক্লাবের বেশ কিছু ছেলে দেখলাম ওরাও কিছু করতে চায়। ওদেরকেই নিয়ে একদিন এলাম সদর বিডিও অফিসে। বিডিও তখন ছিলেন তাপসী সাহা। আমরা আনুপূর্বিক ঘটনাবলী ওনাকে জানালাম। উনি মন দিয়ে শুনলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে আমাদেরকে বলেছিলেন তিনি দেখবেন কিছু করতে পারেন কিনা। বিষয়টা আমলাতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি ধরে নিয়েই চলে এসেছিলাম। চলছিল এভাবেই।
একদিন করলা ভ্যালি থেকে খবর পেলাম ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে বাগিচাতে সচেতনতামূলক ক্যাম্প হবে। সদর বিডিও তাপসী সাহা নিজে থাকবেন। এছাড়াও আবগারি দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, জেলার স্বনিযুক্তি প্রকল্পের আধিকারিকেরাও উপস্থিত থাকবেন। সঙ্গে চা বাগিচার সমস্ত স্তরের ম্যানেজার, বাবু, শ্রমিক লিডার সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। স্বাভাবিক নিয়মেই আমন্ত্রিত হলাম এবং বাগিচায় নেশার কুফল হিসাবে বাচ্চাদের ওপর তার প্রভাব কিভাবে পড়ছে সেই বিষয়ে আমার চিন্তাভাবনা তুলে ধরলাম। খুব অবাক এবং খুশী হলাম যে ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে সেবার আর সচেতনতামূলক ক্যাম্প শুধু নয়, চা বাগান এলাকায় অবৈধ মদের ব্যবসা রুখতে পুলিশ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে অভিনব উদ্যোগ নিল সদর ব্লক প্রশাসন। শ্রমিকদের একাংশ যারা অবৈধ হাঁড়িয়া এবং চোলাই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের সেই ব্যবসা থেকে সরিয়ে সরকারি সাহায্যের মাধ্যমে মাশরুম চাষ সহ বিভিন্ন কাজে যুক্ত করতে উদ্যোগী হল ব্লক প্রশাসন। জানলাম চা বাগানে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে ওই সমস্ত পরিবারের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। বিডিও তাপসী সাহা, স্বনযুক্তি প্রকল্পের আধিকারিকেরা সেদিন শ্রমিকদের কাছে কর্মসংস্থান মুখী একাধিক সরকারি প্রকল্প তুলে ধরেন। ব্লক প্রশাসন কিভাবে তাদের সাহায্য করবে তাও বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেন তিনি। পরবর্তীকালে একান্ত কথোপকথনে সদর বিডিও তাপসী সাহা জানিয়েছিলেন তারা দেখেছেন বিভিন্ন চা বাগান এলাকায় এক শ্রেণীর মানুষ অবৈধভাবে মদের ব্যবসা চালাচ্ছে। এতে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সেই সমস্ত মানুষকে স্বনিযুক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি প্রকল্পের মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থানমুখী করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রথমে শ্রমিকদের নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে, তারপর তাদের মাশরুম বা অন্যান্য বিকল্প চাষের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই প্রকল্প করতে সব ধরনের সাহায্য করা হবে। তবে অসাধু চক্র এতটাই সক্রিয় যে করলা ভ্যালির পরিবেশ নষ্ট হতে সময় লাগে নি। তবে এটুকু ভেবে তৃপ্তি হয় ওদের জন্য কিছুটা হলেও চেষ্টা এবং চিন্তা করেছিলাম আমরা এবং ব্লক প্রশাসন উদ্যোগী হয়েছিল। কারোর যদি 'সুখে থাকতে ভুতে কিলায়' আর কি ই বা করার থাকতে পারে আমাদের?
এই করলা ভালি চা বাগানেই প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম করম পূজোর উৎসবের আয়োজন। এই বাগানের কুলি লাইনে থাকত সোনম লাকড়া। সরল সাদাসিধে এই চা শ্রমিক পরিবার বাগানের পাশেই হোলি চাইল্ডের চার্চে খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। সোনমের পরিবারের সঙ্গে আমার খুব খাতির ছিল। সোনমের ছেলে পিঙ্কু এসি কলেজে পড়ত। হাসিখুশী, প্রাণবন্ত যুবক। সেবার পিঙ্কু করম পুজো দেখার আমন্ত্রণ জানাল তার বাড়িতে। সকাল সকাল চলে গেলাম। এর আগে আদিবাসীদের অন্যতম এই উৎসব কোনদিন দেখিনি বলে একটা আলাদা উচ্ছ্বাস তো ছিলই। সকাল থেকে উপোস করে পিঙ্কু সূর্য ডোবার পর রায়পুর চা বাগান থেকে কেটে আনল করমের ডাল। অনুপা তিরকি, মিনা কেরকেট্টা এবং কুন্চিয়া কেরকাট্টা পিঙ্কুদের বাড়ির পাশেই থাকে। জানতাম অনুপার সঙ্গে পিঙ্কুর মন দেওয়া নেওয়ার পালা চলছিল অনেকদিন থেকেই। অনুপা মোহিতনগর স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ে। ডাল কাটার ক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করল অনুপা, মিনা আর কুন্চিয়ারা। অতি সন্তর্পণে রায়পুর চা বাগান থেকে অত্যন্ত যত্নে করম গাছের ডালটিকে কেটে আনল তারা। কারণ তাদের পুজোর অন্যতম উপকরণ এই করম গাছের ডালটি মাটিতে পতিত হলেই সকল অনুষ্ঠান ব্যর্থ হয়ে যাবে। ধামসা মাদলের ছন্দে নিজেদের নৃত্যের তালে তাল মেলাতে ভোলেননি এরা কেউই। অদ্ভূতভাবে লক্ষ্য করলাম পুজোকে কেন্দ্র করে আদিবাসী সমাজের আট থেকে আশি বছর বয়সের সকলেই আনন্দের জোয়ারে মেতে উঠেছিল। করমডাল কেটে এনে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে সেই করমডালকে প্রতিষ্ঠা করা হল কুলি লাইনের মাঝখানে বড় মাঠে। করম পুজো অনুষ্ঠিত হয় এইরকমই কোন বড় মাঠে অথবা সভা করার মত কোন জায়গায়। এরপর শুরু হল পুজো। ওইদিন সন্ধ্যাতেই হল করমডালের বিসর্জন। এই করম পূজার সমাপন হল পূজিতা করম দেবতার বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। অনুপার কাছ থেকে শুনলাম এই বিসর্জনকে কেন্দ্র করে অনেক জায়গাতে বিসর্জনের ঘাটগুলিতে মেলা বসে। সারারাত ধরে পূজোর অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে গানবাজনা এবং নৃত্যগীত চলে। এখানেও হল আদিবাসী নৃত্য। নাগরা, মাদল, ঢোলের দ্রিমিদ্রিমি শব্দে তাল অনুরণিত হল এলাকায় এলাকায়। করম মেলাকে কেন্দ্র করে হল আদিবাসী নৃত্য এবং লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴