আমি এক যাযাবর-৭/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
৭ম পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
বাসুদেব দাস বাউল। এ প্রজন্ম তাঁকে হয়তো তেমন চেনে না। ১৯৭৫-এ ওয়ার্ল্ড জ্যাজ ফেস্টিভ্যালে ভারতের একমাত্র আমন্ত্রিত শিল্পী ছিলেন বাংলার এই বাউল। যুগোস্লাভিয়ার মাটি কেঁপে উঠেছিলো তাঁর কন্ঠে, বাদ্যে। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। কেবল বাসুদাই নন, বৌদির কাছেও আমার আদর-অধিকার বহু জন্মের। সেইমতো অভ্যর্থনা, এবং তারপর গানের আসর। বাসুদা তো বটেই, বৌদি, ভোলা(বাসুদার ছেলে), বর্ষা (একে আমি সদ্যোজাতাই দেখেছিলাম, পড়শি গৌরদা'র মেয়ে, এখন ক্লাস এইট)। গানের বর্ণনায় যাবো না, এ লেখা শেষ করা যাবে না তাহলে। অর্পিতা মুগ্ধ, এভাবে বাউল সংসারে আসরে বসা ওর প্রথম। রাতে খিচুড়ি আর মাংস। তারপর বৌদির চিরাচরিত আদর, আমার হাত ধুইয়ে দেওয়া! আমি নাকি তাঁর 'কালা', তাঁরই ভাষায়, "আমার ঘরে যে কালার অন্ন বাঁধা রইচে গ'!"
বাসুদাকে নিয়ে, কেবলই বাসুদাকে নিয়ে লিখতে গেলে, একটা গোটা কিস্তিতেও শেষ করতে পারব না। তাই বাউলপর্ব এখানেই থামিয়ে রাখলাম। কেবল, ভোলার কথা একটু না বললেই নয়। ছোট্ট ভোলা, কিশোর ভোলা, আজকের বিবাহিত এবং একজন বাবা হয়ে যাওয়া ভোলা যে কোনো ইন্সট্রুমেন্টকে কথা বলাতে পারতো, পারে। শিশুকালে প্রেমজুরি বাজাতে শুনেছি। ২০১৯এ পুরুলিয়াতে রাজু দাসের সঙ্গী যুবক ভোলার ইলেক্ট্রিক গিটার শুনেছি। আর এবার শুনলাম প্রেমজুরি, দোতারা, ডুবকি, খোল, একতারা: একের পর এক বাজনায় ওর সহজ যাতায়াত। অর্পিতার কথা ধার করে বলি, জলের বহমানতার মতো সাবলীল ভোলার বাজনা।
যাক, এবারের শান্তিনিকেতনে শেষ দিনটার কথায় আসি। এ প্রসঙ্গে বন্ধু অলয়ের কথা বলে নিই একটু। অলয় বিশী, বন্ধু, অসম বয়সের। ভুবনডাঙায় বাড়ি। ভারচুয়াল বন্ধুত্ব। আমি বোলপুর যাচ্ছি শুনে নিজের থেকে দায়িত্ব নিয়ে আমাদের এ দিনের ঘোরাফেরার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সুরুলের জমিদার বাড়ি দেখার ইচ্ছে জেনে পরামর্শ দিয়েছে সিপুর-রায়পুর রাজবাড়ী যেন অবশ্যই দেখে আসি।
সকাল এগারোটায় গাড়ি এলো। আজ চারচাকাই। সরস্বতী পুজোর দিন। রাস্তায় রাস্তায় শাড়ি, পাঞ্জাবির অনভ্যস্ত স্রোত। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার নিজের কৈশোর মনে ফিরে এলো। বোলপুর থেকে রায়পুর যাওয়ার রাস্তা বেশ মসৃণ, ঝকঝকে। রাস্তার দু'পাশে বিরাট ক্যাম্পাস জুড়ে কোথাও ইউনিভার্সিটি, কোথাও বাসস্ট্যান্ড, কোথাও বা অন্য কোনো সরকারি ইমারত। তাদের গায়ের থেকে রঙের নুতন গন্ধ এখনো বোধহয় মোছেনি। তবে কোথাওই মানুষজন দেখতে পেলাম না।
এর ঠিক উল্টো চেহারা রায়পুর রাজবাড়িতে। যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে এমন প্রাসাদ, কালের কালিমা মুছে দিয়েছে আদি রঙের পরিচয়। গেট নয়, দেওয়ালের গায়ে ভাঙা খোদল গলে ভেতরে ঢুকলাম। এক মানুষ সমান পরিসর। মাথা নামিয়ে সাবধানে পেরোতে হয়। আর ভেতরে ঢুকতেই বাইরের পৃথিবী, বাইরের বর্তমান অদৃশ্য হয়ে যায়। হাজার বছরের পুরনো ভাঙাচোরা ইতিহাসে পা রাখি। তবে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের প্রচুর ভীড়। সম্ভবত স্থানীয়, স্কুল থেকে, ক্লাব/পাড়া থেকে দল বেঁধে, বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে জোড়ায় জোড়ায়। আমাদের মতো বহিরাগতরাও কেউ কেউ। সব মিলিয়ে ভীড়ে ভীড়। বৃদ্ধ, ন্যুব্জ, মহাকায় একাকীত্বের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান! চারিদিকে ঘর দালান, মাঝের চত্বরে একটি পরিত্যক্ত, বাঁধানো কুয়ো। যাঁরা মৃণাল সেনের খন্ডহর দেখেছেন, কুয়োটিকে চিনে উঠতে পারবেন। চত্বরটি ছাড়াও এই প্রাসাদের আরও কিছু অংশে খন্ডহরের চিত্রগ্রহণ হয়েছিল। শুনলাম, আরও কোনো কোনো চলচ্চিত্রেরও, সম্ভবত "যেখানে ভুতের ভয়" নামেরও একটি। দিনের বেলা, অসংখ্য মানুষের মাঝে থেকেও আনুমানিক ৬০ বিঘা জমি এবং ১২০টি কক্ষ বিশিষ্ট প্রাসাদটির কোণায় কোণায় অতীতের রহস্য উদগ্রীব মনকে হাতছানি দেয়। লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিনহা এই সব অলিন্দে হেঁটে বেড়িয়েছেন, কোনো কক্ষের ধুলোজীর্ণ ধ্বংসাবশেষ বয়ে নিয়ে চলেছে তাঁর পড়াশোনার সাক্ষ্য। এই সেই পরিবার, যাঁদের কাছ থেকে কেনা জমিতেই গড়ে উঠেছে অধুনা শান্তিনিকেতন, জনশ্রুতি।
প্রাসাদটি ছেড়ে ফিরে আসতে মন চাইছিলো না। কিন্তু, বাস্তব বাধ্যতা টেনে আনলো বাইরে। আপাতত রায়পুরের একটি ক্লাব সাতের দশক থেকে পরিত্যক্ত রাজবাড়িটির দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী। কয়েকজন সদস্য, বয়স্ক, চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন রাজবাড়ি ঘেঁষা ক্লাবঘরের সামনে। এগিয়ে গিয়ে পরিচয় করলাম। অনুরোধ করলাম এই রাজবাড়ির ইতিহাস নিয়ে যদি দর্শনার্থীদের জন্য একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা যায়। তাঁরা জানালেন ভাবনাটি মনে রাখবেন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴