অন্তহীন আকাশের নীচে/পর্ব ৭
অন্তহীন আকাশের নীচে/পর্ব ৭
দেবপ্রিয়া সরকার
================
ঊষারানীর ঘরের নোনাধরা দেওয়ালে নতুন রঙের প্রলেপ পড়েছে। ঘষেমেজে পালিশ করা হয়েছে জীর্ণ আসবাবগুলো। পুরনো ঘরখানা যেন খোলস বদলে বের করে এনেছে নতুন রূপ। আসমানী রঙের নতুন চাদর পাতা টানটান বিছানায় গুটিসুটি হয়ে বসে আছেন ঊষারানী। তার ঝাপসা চোখে সবটা ধরা পড়েও পড়ছে না।
পাখিকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকল জয়শীলা। বকুল তখন পুরনো বাসনের ট্রাঙ্ক খুলে বের করেছে বড় কাঁসার থালা, গ্লাস, রেকাবি ইত্যাদি। পাখি ঊষারানীর কাছে এসে হাসি মুখে বলল, কেমন লাগছে দিদা? এসব আয়োজন তোমার জন্যে। আর ক’দিন বাদেই তো তোমায় নিয়ে উৎসব হবে।
ঊষারানী তাঁর বুজে আসা চোখ তুলে তাকালেন পাখির দিকে, কিসের উৎসব রে দিদিভাই? এই বুড়িকে নিয়ে আবার কী হবে?
-সে যখন হবে তখন দেখতে পাবেন। এখন দেখুন তো এই কাপড়খানা পছন্দ হয় কিনা?
শহরের এক বনেদি বিপণির নাম লেখা ব্যাগ থেকে একটা সবুজ পাড়ের সাদা গরদের শাড়ি বের করে তাঁর সামনে রাখতে রাখতে বলল জয়শীলা। ঊষারানী চোখ কুঁচকে একবার দেখলেন শাড়িটাকে। তারপর শাড়ির নরম জমিনে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, বাহ্! বেশ মোলায়ম। এটা কার জন্যে? তোমার নাকি?
-না মা, এটা আপনার।
-আমার! শাড়ি দিয়ে আমি কী করব জয়া? আজকাল এসব একেবারে গায়ে দিতে পারি না। কেমন কুট কুট করে। আমার এই আটপৌরে শাড়ি, শেমিজই ঠিক আছে।
-উঁহু, তা বললে তো হবে না। একটা দিন অন্তত পরতেই হবে। আমি পরিয়ে দেব আপনাকে। এ্যাদ্দিন বাদে সঞ্জীবনী, ঠাকুরজামাই, নাতি, নাতনি, নাতবৌরা আসছে একটু সাজগোজ করবেন না?
-কে আসছে বললে? সঞ্জু? আমি ঠিক শুনলাম তো জয়া?
-হ্যাঁ গো দিদা একদম ঠিক শুনেছ। সঞ্জুপিসি, পিসেমশাই, দিদিভাইরা, ডাব্বুদাদা, বৌদি সক্কলে আসছে শুধু তোমার জন্য। শুধু তোমাকে দেখতে, তোমায় নিয়ে আনন্দ করতে। আর মাত্র কয়েকটা দিন। আমি তো দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছি স্বয়ংদ্যুতিদিদির জন্যে।
এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল পাখি।
-তুই স্বয়ংদ্যুতি মানে আমাদের টুপুরকে চিনিস নাকি? - শাড়ি ভাঁজ করতে করতে জিজ্ঞেস করল জয়শীলা।
-চিনি তো, খুব ভালভাবে চিনি।
-সেকি? টাপুর টুপুর দুই বোন তো সেই ছোট থাকতেই কয়েকবার কোচবিহার এসেছিল। কিন্তু তখন তো তোর মা এখানে কাজ করত না, আর তোরও বোধবুদ্ধি জন্মায়নি। তাহলে তুই কীভাবে চিনলি ওকে?
পাখি একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে বলল, সামনাসামনি কখনও দেখিনি ঠিকই কিন্তু স্বয়ংদ্যুতিদিদিকে আমি অন্যভাবে চিনি। ওর ইউটিউব চ্যানেলের আমি একজন সাবস্ক্রাইবার আর নিয়মিত ভিউয়ার। স্বয়ংদ্যুতিদিদি কখন কোথায় যায়, কী খায় আমি জেনে ফেলি ওর বানানো ভ্লগ দেখে। আমি তো জানতামই না স্বয়ংদ্যুতি
সঞ্জুপিসির মেয়ের নাম। গতকাল আমাদের কোচিং ক্লাসে ইন্দ্রদার মুখে শুনলাম। স্বয়ংদ্যুতিদিদি কোচ রাজবংশের ইতিহাস নিয়ে কীসব আলোচনা করতে চায় ইন্দ্রদার সঙ্গে। তাই ফোনে যোগাযোগ করেছে। মূলত ইতিহাসের ওপরই ভ্লগ বানায় দিদি। আর আমি তো হিস্ট্রির পোকা সুতরাং দুয়ে দুয়ে চার করে নাও।
ঘরের বাকি তিনজন সদস্য এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল পাখির কথা। প্রথমে জয়শীলা বলল, কী বানায় বললি?
ভ্লগ! সেটা খায় না মাথায় দেয়? আর ওই যে ওটা ইউটিভি না কীসব চ্যানেল ওগুলোতে তো শুনেছি খারাপ খারাপ জিনিস দেখায়। ওসব তুই দেখিস পাখি? বকুল ভাল চাস তো মেয়েকে সামলে রাখ। দিনকাল বড্ড খারাপ।
জয়শীলার কথা শুনে সুর করে নাকি কান্না জুড়ে দিল বকুল, আর বলো না বৌদি। ওই মুখপোড়া মোবাইল ফোনটা যত নষ্টের গোড়া! সারাদিন ওটা চোখের সামনে নিয়ে কী যে ছাইপাঁশ দেখে কী বলব! আমি কিছু বলতে গেলেই বলে, তুমি কিছু বোঝো না চুপ করো। মদনমোহনের কাছে কত মানত-উপোশ করে এই মেয়েকে পেটে ধরেছিলাম, সে কীনা এখন আমাদের মুখে চুনকালি মাখাতে চায়! তুমিই বলো বৌদি এই মেয়েকে নিয়ে এখন আমি কী করি?
-কী আর করবি বকুল সবই যুগের হাওয়া। খুব চোখে চোখে রাখবি। ভালয় ভালয় পরীক্ষা টরিক্ষা মিটে যাক তারপর একটা ভাল রোজগেরে পাত্র খুঁজে চারহাত যত তাড়াতাড়ি পারিস এক করে দে।
এরকম একটা বেমক্কা পরিস্থিতির জন্য একেবারে তৈরি ছিল না পাখি। জয়শীলা আর বকুলের আজকের সোশ্যাল মিডিয়া আর ভার্চুয়াল পৃথিবী সম্বন্ধে অজ্ঞতা দেখে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পাচ্ছিল না। একবার বলতে গিয়েছিল, আরে বড়মা তুমি যা ভাবছ তেমনটা নয়, এটা তো...
-তুই থামতো। আমাদের বোঝাতে আসিস না। বড়রা যখন কোনও কথা আলোচনা করে তার মাঝখানে তোকে মুখ নাড়তে কে বলেছে, শুনি?
বকুলের ধমক শুনে চুপসে গেল পাখি। এতক্ষণ গোটা ব্যাপারটা নিঃশব্দে লক্ষ করছিলেন ঊষারানী। এবার মুখ ফুটে আলতো স্বরে বললেন, কার বিয়ে দিচ্ছিস রে তোরা, বকুল?
-এখনও দিইনি তবে খুব তাড়াতাড়ি দিয়ে দেব, তোমার এই আহ্লাদী নাতনির।
-পাখি দিদিভাইয়ের বিয়ে হবে? বাহ্ রে! খুব খুশির খবর। আমি খুব আনন্দ করব তোর বিয়েতে দেখিস, ঠিক
যেমনটা করেছিলাম রাজকুমারীর বিয়ের সময়। সে কী আর যে সে বিয়ে ছিল?
-ওই, আবার শুরু হল রাজবাড়ির গপ্প!
বকুল বিরক্ত হয়ে বাসনের বোঝা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। জয়শীলাও কাপড়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে পড়ল চটপট।
বকুল ঘর ছেড়ে বেরুবার আগে বলল, পাখি বসে বসে বকবক না করে দিদার চুলটা আঁচড়ে বেঁধে দে তো, আমি বাসন কটা ধুয়ে আনি।
-আমিও যাই ওদিকে দেখি গে তোর জেঠু নেমন্তন্নের লিস্টিটা বানাল কীনা। তারা তো সব দূর থেকে বলেই খালাস। যত ঝক্কি সব আমাকেই পোহাতে হয়।
বকুল ও জয়শীলা বিদায় নিলে চিরুনি হাতে ঊষারানীর চুল আঁচড়াতে বসল পাখি। বিয়ের কথায় তার মনটা তেতো হয়ে গিয়েছিল। আজকাল বেশ বুঝতে পারে, কেউ তার বিয়ে দেবার কথা বললেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়।
গলার কাছটায় একটা চাপা কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে। কী যেন একটা হারানোর ভয় তাড়া করে বেড়ায়। মনটা হালকা করতে ঊষারানীর সঙ্গে গল্প জুড়ল পাখি, আচ্ছা দিদা, শুনেছি রাজকুমারী গায়ত্রী দেবীর থেকে জয়পুরের মহারাজা বয়সে অনেকটা বড় ছিলেন। সেই কারণে নাকি রানিমার এই বিয়েতে মত ছিল না। কথাটা কি সত্যি?
-একেবারে সত্যি। কিন্তু জানিস তো দিদিভাই স্বামীস্ত্রীর জোড় ভগবান সৃষ্টি করে পাঠান। যার যেখানে নির্বন্ধ লেখা থাকে তার সেখানেই ঠাঁই হয়। রাজকুমারীর সঙ্গে যখন প্রথম জয়পুরের মহারাজার দেখা হয় তখন তাঁর বয়স ছিলেন মাত্র বারো বছর আর রাজাবাবুর একুশ। সেই কিশোরী বয়স থেকে মনে মনে তাঁর প্রতি ভাললাগা লালন করতেন গায়ত্রী দেবী আর কী অদ্ভুত নিয়তি সেই রাজার প্রিয়তমা পত্নী হয়েই জীবন কেটেছিল তাঁর।*
-তিনি রাজকুমারী ছিলেন বলেই বোধহয় এটা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের মতো সাধারণ ঘরের মেয়েদের সঙ্গে কী আর এমন কিছু ঘটে? মনের ভেতর যাই থাক না কেন মুখ বুজে মেনে নিতে হয় অন্যদের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে।
পাখির কথার মধ্যে মিশে থাকা বিষাদ কান এড়ায়নি ঊষারানীর। তিনি পাখির হাত ধরে বললেন, কেন রে দিদিভাই তোরও কি কোনও রাজপুত্তুরকে মনে ধরেছে?
পাখি লাজুক হাসি হেসে বলল, কী যে বলো না তুমি দিদা? আমি আবার রাজপুত্তুর কোথায় পাব? এখন চুপটি করে বসো তো তোমার চুলটা বেঁধে দিই, নাহলে মা এসে বকাবকি করবে আবার।
ঊষারানীর সামনে প্রকাশ না করলেও পাখির মনের ভেতর চলতে থাকা বিরামহীন ঝড়ঝাপটার দমক মাঝে মাঝেই এলোমেলো করে দেয় তার মনকে। অনেক চেষ্টা করেছে ইন্দ্রায়ুধের কথা না ভাবার তবুও পারে না কিছুতে।
ইন্দ্রায়ুধ সামনে এসে দাঁড়ালেই পাখির সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ইন্দ্রায়ুধের হাসি মুখ, তার গুরুগম্ভীর অথচ পেলবতা মাখানো গলার স্বর, শরীরের সেই মাদক গন্ধের সামনে বারবার নিজেকে নিঃস্ব মনে হয় পাখির আর এক অবুঝ মন খারাপ ঘিরে ধরে তাকে। যেমন করে স্রোতের ধাক্কায় নদীর পাড় ভাঙে, তেমন করে কী যেন ভাঙতে থাকে পাখির বুকের ভিতরেও। অথচ এ এমন এক গোপন অনুভূতি যা বলে বোঝানোর উপায় নেই কাউকে।
আদৌ কি কখনও সে ইন্দ্রায়ুধকে জানাতে পারবে তার এই ভাললাগার কথা? আর ইন্দ্রায়ুধ? তার মতই বা কি?
কোচিংক্লাসের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের থেকে একটু আলাদা রকম ব্যবহার সে পায় ইন্দ্রায়ুধের কাছ থেকে, তবে সেটা পুরোপুরি তার পড়াশোনার জন্য। পাখির সহপাঠিরা এ’নিয়ে টিটকিরি দিতেও ছাড়ে না। যদিও সে জানে তার এই ছেলেমানুষি ভালবাসাবাসির হয়তো আদৌ কোনও মুল্য ইন্দ্রায়ুধের কাছে নেই। পাখির অজান্তে দু’ ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার চোখ বেয়ে।
-কী হয়েছে দিদিভাই? কাঁদছিস কেন? কেউ কষ্ট দিয়েছে তোকে?
আলগোছে চোখের জল মুছে পাখি তাকাল ঊষারানীর দিকে। কীভাবে সে বলবে জেনেশুনে কী কঠিন যন্ত্রণাকে আশ্রয় দিয়েছে নিজের বুকের ভেতর? তবু জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে বলল, খামোখা কাঁদতে যাব কেন দিদা?
চোখটা বড্ড ঝামেলা করছে আজকাল। বলা নেই কওয়া নেই জল গড়াতেই থাকে মাঝে মাঝে। এবার ডাক্তার না দেখালেই নয়। আমি আজ আসি, কেমন?
পাখির অপস্রিয়মাণ শরীরের দিকে অপলক চেয়ে থাকলেন ঊষারাণী। ম্লান হাসি হেসে অস্ফুটে বললেন, ও মেয়ে মনটাকে সামলে রাখ এ’বেলা। এ বড় কঠিন ব্যথা রে মেয়ে, বড় কঠিন ব্যথা!
*তথ্যসূত্রঃ রঁদেভু উইথ সিমি গারওয়ালঃ রাজমাতা গায়ত্রী দেবী।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴