মোগলকাটা চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
মোগলকাটা চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
মোগলকাটা নামটাই যেন ইতিহাস। কিংবদন্তী এবং প্রত্নতত্ত্বের মোড়কে অতীতের ইতিহাস যেন হাতছানি দেয়। মোগলবাহিনী নাকি কামরূপ অভিযানের সময় এই পথ দিয়েই অগ্রসর হয়েছিল। ভুটান রাজের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কচুকাটা করা হয় মোগলদের অনেককে। এর সত্যি বা মিথ্যা নিরূপণ করা খুবই কঠিন কাজ। ১৮৭৯ সালে বাঙালির সম্মিলিত কর্মউদ্যোগে সর্বপ্রথম ভারতীয় চা বাগানের পত্তন হল জলপাইগুড়ি টি কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে মোগলকাটা চা বাগিচা। আদি প্রতিষ্ঠাতা গোপাল চন্দ্র ঘোষের নামে গোপালপুর চা বাগান। প্রথমে এটি ছিল জলপাইগুড়ি টি কোং এর অধীন যার প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৭৯ সালে গোপাল চন্দ্র ঘোষ, জয়গোবিন্দ গুহ, জয়চন্দ্র সান্যাল, তারিণী প্রসাদ রায় প্রমুখ চা-করের দ্বারা। প্রথম সভাপতি শ্রী জয়চন্দ্র সান্যাল এবং সম্পাদক কেশবচন্দ্র ঘটক। এছাড়াও ছিলেন শ্রীনাথ চক্রবর্তী, মনসুরউদ্দিন, যাদব চক্রবর্তী এবং আরো অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তি। ভুবনবিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর পিতা ভগবান চন্দ্র বসু তখন জলপাইগুড়ির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর জামাই বাগিচায় উৎসাহী ছিলেন। মোগলকাটা চা বাগান পরিচালনা করতে গিয়ে গোপালবাবুকে নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। অত বছর আগে ডুয়ার্সের আরণ্যক চিত্র, পথঘাট ছিল ভয়ঙ্কর। গরুর গাড়ি অথবা মোষের গাড়ি অথবা পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হতো। ১৮৮৪ সালে মোগলকাটা চা বাগিচার সম্পাদক উমানাথ চক্রবর্তী গোপালবাবুকে খবর পাঠান ৫০০০ টাকা লাগবে। গোপালবাবু তখন খুবই অসুস্থ। কিন্তু নিজে বাঁচার কথা চিন্তা না করে বাগানকে বাঁচানোর জন্য অর্থ জোগাড় করেন। কারণ চা বাগান ছিল তাঁর কাছে আপন সন্তানতূল্য। আজকের যুগে খুব কম মালিক আছেন যাঁরা সন্তানের মত স্নেহ করেন চা বাগানকে অথবা শ্রমিক বা বাবুদের প্রতি দয়াবান হন। গোপাল চন্দ্র ঘোষ ভয়ঙ্কর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ব্রিটিশদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চা শিল্পে নিজের সাম্রাজ্যের ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করেন।
যোগেশ্চন্দ্র ঘোষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনার শুরু উনবিংশ শতকের শুরুতেই বঙ্গভঙ্গ ও বয়কট আন্দোলন চলাকালীন সময়ে। পিতা গোপাল চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে চা ব্যাবসার হাল ধরেছেন গোপাল চন্দ্র ঘোষ। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত চা ব্যাবসায়ী হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটছে। ঠিক সেই সময়ে সেই প্রাক-বঙ্গভঙ্গের সময়কাল থেকেই যোগেশ চন্দ্র ঘোষ এবং ঘোষদের তৃতীয় পুরুষ বা সামগ্রীকভাবে পুরো পরিবার জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশ বিরোধী কর্মযজ্ঞে বা সামাজিক সাংস্কৃতিক, শিক্ষা সংক্রান্ত এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে। ১৯০২ সালে বাংলাদেশে বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতির কাজ শুরু হলে যোগেশচন্দ্র ঘোষ এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। বিল্পবের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে গুপ্তসমিতির সভ্যদের মধ্যে স্তরভেদ ছিল। যাঁরা শুধু অর্থ সাহায্য করতেন তাঁরা তৃতীয় এবং যাঁরা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তাঁরা চতুর্থ স্তরের সভ্য বলে গণ্য হতেন। যতদূর মনে হয়, যোগেশচন্দ্রের মধ্যে এই দুটি গুণের গন্ধ পেয়েই তাঁকে দলে টেনে নেওয়া হয়েছিল। পিতা গোপাল চন্দ্র ঘোষের মৃদু আপত্তি ছিল সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে। তবে পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে বাধা দেন নি। মহান বিপ্লবী নেতা পুলিনবিহারী দাসকে নিয়ে যোগেশচন্দ্র তাঁর দেশের বাড়ির গ্রামের ‘দোলখোলায়’ তিনদিন ধরে বৈঠক করেন। শক্তি চর্চার জন্য গ্রামে গ্রামে যুবসংগঠন ও শাখা সমিতি গঠিত হয় যার পুরোধায় ছিলেন স্বয়ং যোগেশচন্দ্র। এই ঘটনার পর থেকে তিনি দেশমাতৃকার সুসন্তান বলে চিহ্নিত হন। জলপাইগুড়ি শাখার চারজন কর্মীকে নিয়ে তিনি গঠন করেন গুপ্ত সমিতি। মাসকালাইবাড়ি শ্মশানে, নির্জন আমবাগানে, নিশীথ রাত্রির গম্ভীর পরিবেশে অন্নদা প্রসাদ বিশ্বাস, দুর্গাদাস চক্রবর্তী, পূর্ণদাস এবং পঞ্চানন নিয়োগী বুকের রক্ত দিয়ে শপথনামাতে স্বাক্ষর করেন এবং অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হন। ১৯০৫ সনে বিলাতি কাপড় বর্জন আন্দোলন শুরু হয়।
জলপাইগুড়ি শহরের দিনবাজারে বিলিতি কাপড় পোড়ানোর অপরাধে দুর্গাদাস চক্রবর্তী, আদ্যনাথ মিশ্র ও অন্নদা বিশ্বাসের দু সপ্তাহ জেল হয়। মুক্তির দিন চা-শিল্পপতি যোগেশচন্দ্র ঘোষ যুবকদের নিয়ে জেল গেটে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন পুলিশি ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। এ জাতীয় কাজ সে সময় দুঃসাহসিক ঘটনা। বিশেষ করে একজন চা শিল্পপতি হিসাবে এই কাজ কল্পনাই করা যায় না। যোগেশচন্দ্রের নেতৃত্বেই রাজবাড়ির দীঘির পাড়ে শিবমন্দিরে যুবকরা জমায়েত হয়ে দেশাত্মবোধের পাঠ নিয়ে একে অপরের হাতে রাখি বেঁধে দিতেন এবং গাইতেন ‘বন্দেমাতরম’। লাঠিখেলা শেখাবার জন্য সৈয়দপুর থেকে একজন মুসলমান ওস্তাদ এনে যোগেশচন্দ্র নিজ বাসভবনে রেখেছিলেন। তিনি নিজ পরিবারের ছেলেমেয়েদের লাঠি ও ছোড়াখেলাতে নিপুণ করে তুলেছিলেন। একাজে তাঁর শিক্ষক ছিলেন আশুতোষ দাশগুপ্ত। ইনি পরে ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলাতে গ্রেপ্তার হন। রাজনৈতিক পলাতক মনি লাহিড়ী নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে তাঁর শরনাপন্ন হন। তিনি মনি লাহিড়ীকে গুরজংঝোরা চা-বাগানের ম্যানেজার অনাথ সেনের অতন্দ্র প্রহরায় লুকিয়ে রাখেন এবং তাঁর প্রয়োজনীয় খরচপত্র নিজে বহন করেন। এই শ্রেনীর শরনাগতকে শরণ দিয়ে তিনি সেই সময়কালে দুর্দান্ত সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে স্বাদেশিকতার পাঠ এবং জাতীয় শিক্ষা প্রসারের দ্বারা স্বদেশী জাগরন দুটি উল্লেখযোগ্য সমসাময়িক ধারা ছিল। জলপাইগুড়ি জেলায় স্বদেশী জাগরনের উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে আর্যনাট্য সমাজে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। শশীকুমার নিয়োগী, তারিনী প্রসাদ রায়, সুরেশ্বর সান্যাল, অন্নদাচরন সেন, ত্রৈলোক্যনাথ মৌলিক প্রমুখ চা-করের পাশাপাশি যোগেশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন এর উদ্যোক্তা। এখন যেখানে গুরজংঝোরা চা কোম্পানীর বিরাট ভবন সেখানে ছিল একটি দোতলা টিনের ঘর। তারই নীচু তলায় একট প্রকোষ্ঠে ইউনিয়ন ক্লাব নামে একটি পাঠাগার খোলা হয়। এর পেছনের জমিতে ছিল সুতোর আখরা ও ব্যায়ামাগার। জয়চন্দ্র সান্যাল, অন্নদাচরণ সেন, কেশব দত্ত প্রমুখের পাশাপাশি চা-শিল্পপতি যোগেশচন্দ্র ঘোষ এই ক্লাবের সভ্য ছিলেন।
উত্তরবঙ্গে চা শিল্পের ইতিহাসে বাঙালি হিন্দু চা-করদের মধ্যে জলপাইগুড়ির ঘোষ ও রায় পরিবার ছিল এককথায় মাইলস্টোন। কেননা, সমগ্র উত্তরবঙ্গ ও আসাম জুড়ে যে কজন বাঙালি চা-কর চা বাগান গড়ে তুলতে অগ্রণী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ঘোষ এবং রায়রা ছিল সত্যি ব্যতিক্রমী। নিজ মালিকানাধীন চা বাগানের সংখ্যা এবং পারিবারিক ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তির বিচারে তাঁদের সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। এঁদের সাথে তুলনায় কেবলমাত্র জলপাইগুড়ির নবাব সাহেবই আসতে পারেন। আসলে ঐ সময় শহরের চা শিল্পপতিদের মধ্যে ঘোষ এবং রায় পরিবারের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় পুরুষ নিজেদের আভিজাত্য ও চিন্তাধারায় নিজেদের পরিবার এবং বাগানের চিন্তাভাবনা নিয়ে একটা স্বতন্ত্র গন্ডীর মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে পারিবারিক শিক্ষাদীক্ষা, বংশকৌলীন্য, সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনাতে ঘোষ এবং রায় পরিবার জলপাইগুড়িতে রেনেশাঁ এনে দিয়েছিলেন। একদিকে বনেদীয়ানা এবং আভিজাত্য, অন্যদিকে সমাজ সচেতনতার মেলবন্ধন ঘটেছিল তাঁদের মধ্যে। সুপম বিশ্বাসের চা সংক্রান্ত লেখা থেকে জানতে পারি বাবু কালচার এর যুগে হাতি, ঘোড়া, পালকি, নৌকা গাড়িই ছিল বাঙালি চা-কর, বাগান ম্যানেজারদের প্রধান যানবাহন। নৌকার তাকিয়াতে ঠেস দিয়ে, গড়গড়ায় তামাক টানতে টানতে চলায় একটা আমিরি ভাব ছিল। জলপাইগুড়ি শহরের বিশিষ্ট চা-কর যোগেশ চন্দ্র ঘোষের বাড়ির পিছনে করলা নদীতে ওঁর একখানা সুন্দর নৌকা বাঁধা থাকত। নদীর অপরপারে একটি জলসাঘর ছিল। যোগেশ ঘোষ তাঁর একান্ত সঙ্গী ক্ষুদু নিয়োগীকে নিয়ে মাঝে মাঝে নদীতে বেড়াতে যেতেন অথবা জলসা ঘরে বসে গানবাজনা শুনতেন। ক্ষুদু নিয়োগী খুব ভাল নাচতে পারতেন এবং বাইজীদের সঙ্গে সমান তালে নাচতেন। ক্ষুদু নিয়োগী মোগলকাটা চা কোম্পানির সেক্রেটারী ছিলেন। ১৯৬২-৬৩ সাল পর্যন্ত সমগ্র তরাই-ডুয়ার্সের অধিকাংশ চা-বাগানের মালিকানা ছিল বাঙালিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেই সময় বাঙালি চা-করদের সংখ্যা মোটেই কম ছিল না।
১৯২৫ সালে যোগেশ চন্দ্র ঘোষ তরাই অঞ্চলে ঘোষ পরিবারের হাতে তৈরি একমাত্র চা বাগান বিজয়নগর টি এস্টেট এর গোড়াপত্তন করেন। ১৯২৫ থেকে ১৯২৮ সালের মধ্যে তিনি ডুয়ার্সে মালহাটি, কাদম্বিনী, সৌদামিনী, লক্ষ্মীকান্ত নামে আরও চারটি চা বাগান পত্তন করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাগানগুলি ছিল বিজয়নগর টি কোম্পানির অধীন। পরে এটি মোগলকাটা টি এস্টেট এর নিয়ন্ত্ৰণাধীনে আসে ১৯৭৪ সালে। জলপাইগুড়ির ঘোষ ও রায় পরিবার সমগ্র ডুয়ার্স জুড়ে প্রায় ৪০ টির কাছাকাছি বাগান পত্তন করেছিলেন এবং আসামে বিভিন্ন চা বাগানের মালিকানায় অংশীদার ছিলেন। বাগিচার পর বাগিচা যেন সবুজের শোভাযাত্রা। বিজয়নগর টি এস্টেট ১৯৭৬ সালে কলকাতা টি বোর্ড থেকে সব থেকে বেশী চা উৎপাদনের জন্য পুরস্কৃত হয়। যোগেশ চন্দ্রের বাসায় চায়ের খরচ উঠত মাসে তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা। তাঁর পাকশালা ছিল সদাব্রত যার খরচ ছিল মাসে বারশ থেকে পনেরশ টাকা। এঁদের তালুকদারী ভূ-সম্পত্তিতে জায়গির পেয়ে নানা বৃত্তির লোক যেমন— ধোপা, নাপিত, মালাকার, গোয়ালা, ভুইমালী প্রভৃতি ঘর বাঁধত। এরা পুরোহিতদের বংশানুক্রমিক রাখতেন এবং সকলেরই থাকা-খাওয়া ছিল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। সামাজিক ক্রিয়াকলাপে এদের জাতিগত বৃত্তি অপরিহার্য ছিল বলে এরাও সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। (তথ্যসূত্রঃ এমারজেন্স অফ বেংলী এনটারপ্রেনিওরশিপঃ এ কেস স্টাডি অফ দি টি প্ল্যান্টেশন ইন্ডাসট্রি-সুপম বিশ্বাস) গোপাল চন্দ্র ঘোষের পৌত্র যোগেশ চন্দ্র ঘোষের দ্বিতীয় পুত্র বীরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ। বীরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ এবং তেজেশ চন্দ্র ঘোষের ভাগের বাগানগুলির হেড অফিস ছিল জলপাইগুড়িতে স্টেশন রোডে গোপালপুর হাউসে। বীরেনবাবু ছিলেন ভারতীয় চা সমিতির কর্ণধারদের মধ্যে অন্যতম।
ডিবিআইটিএ-র প্রত্যক্ষ পরিচালনাতে ধূপগুড়ি ব্লকের অন্তর্গত বানারহাট থানার মোগলকাটা টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী বিজয়নগর টি কোম্পানি লিমিটেড। ১৯২৮ সালে জলপাইগুড়ি টি কোং এর পরিচালনাতে প্রয়াত গোপালচন্দ্র ঘোষ বাগিচার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বর্তমানে বোর্ড অফ ডিরেকটরের যে তথ্য পেলাম তাতে চোখ কপালে উঠে গেল। সৌরজিত পাল চৌধুরী ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারী থেকে বাগানের ডাইরেক্টর, পাশাপাশি সন্তোষ কুমার আগরওয়াল একই সময়ে, মহেন্দ্রপ্রসাদ বনশল, ২০১৯ এর ২১ শে অক্টোবর থেকে এবং সোভিত ছাপেরিয়া ২০২০ সালের ৩ রা জানুয়ারি থেকে বোর্ড অফ ডিরেকটর। মোদ্দা কথা হল মোগলকাটা চা বাগিচা ঘোষ পরিবার বিক্রি করে দিয়েছেন এবং এটি এখন মোগলকাটা টি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। মোগলকাটা টি গার্ডেনের শিলিগুড়ি অফিস বনসল টি ওঅ্যার হাউস, সেকেন্ড মেইল, শিলিগুড়ি। বাগানে ম্যানেজারিয়াল স্টাফ সাতজন। প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন পাঁচটি। বানারহাট থানার তত্ত্বাবধানে বাগানটির আইন-শৃঙ্খলা বিষয়টি দেখাশোনা করা হয়। মোগলকাটা চা বাগানের আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ক্ষেত্র ৬৬৬.৮৫ হেক্টর। সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ১৫০.১৬ হেক্টর। এই প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে প্রতি হেক্টর জমি পিছু ১৫৯৯ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। মোগলকাটা চা বাগিচার সাব স্টাফ এর সংখ্যা ৩৯ জন, করণিক ১১ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ছয় জন। বাগানের শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৮২৫, মোট জনসংখ্যা ৫০৪৭ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত সাবেক শ্রমিক সংখ্যা ১৯ জন। কম্পিউটার অপারেটর একজন। কর্মরত স্থায়ী শ্রমিক ১১১৬ জন। শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৩৯৩১ জন। মোগলকাটা চা বাগিচা এমজিএনআরইজিএস এর সুবিধা পায় না। বাগানটি অর্থনৈতিক ব্যাপারে কোন ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরশীল নয়। চা বিক্রি বাবদ নিজস্ব অর্থনৈতিক খরচ খরচা বাগান মিটিয়ে নেয়। বাগিচার লিজ হোল্ডার বিজয়নগর টি কোম্পানি লিমিটেড।
মোগলকাটা চা বাগানে হাসপাতাল আছে। মেল ওয়ার্ড দশটা, ফিমেল ওয়ার্ড চোদ্দটা। আইসোলেশন ওয়ার্ড চারটে, কিন্তু কোন মেটারনিটি ওয়ার্ড নেই। অপারেশন থিয়েটার আছে। অ্যাম্বুলেন্স আছে। বাগানের আশেপাশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। বাগিচায় অল্টারনেটিভ মেডিসিনে এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার রয়েছেন। তাঁর নাম ডঃ কে রায়। এছাড়াও বাগিচায় একজন করে ট্রেন্ড নার্স এবং মিড ওয়াইফ, কম্পাউন্ডার এবং স্বাস্থ্য সহযোগী আছেন। পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধের সরবরাহ আছে এবং বাগিচার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সুষম খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে রোগীদের জন্য। বাগিচাতে স্থায়ী ক্রেশ নেই। অস্থায়ী ক্রেশ তিনটে। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা, শৌচালয় আছে। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত পানীয় জল ক্ৰেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয়। ক্রেশে অ্যাটেনডেন্ট মোট তিনজন। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে দুটো ট্রাক আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব এবং খেলার মাঠ আছে। মোগলকাটা টি গার্ডেনে নিয়মিত পিএফ বা গ্র্যাচুইটির টাকা জমা পড়ে। বোনাস চুক্তি অনুযায়ী মিটিয়ে দেওয়া হয়। শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। ২০০৯ সাল থেকে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসারের পোস্ট আছে। মাঝে মোগলকাটা কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে কর্মীদের দুশ্চিন্তা এবং দুর্ভাবনা বাড়ে। বাগান চালু থাকলেও রুগ্নতা পুরোপুরিভাবে এখনও দূর হয়নি। সবচেয়ে দুঃখের এবং বেদনার বাঙালি মালিকানার চা বাগান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে অথবা বছরের পর বছর বন্ধ থাকছে। কঙ্কালসার এবং জরাজীর্ণ হয়ে যাচ্ছে চা বাগানগুলি। বাগানগুলির মালিকানা তাদের হাত থেকে অবাঙালিদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। এই অবস্থা প্রায় সকল বাঙালি চা কর পরিবারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যাতিক্রম অবশ্যই রয়েছে।
তরাই অঞ্চলে ঘোষ এবং রায়দের হাতে স্থাপিত চা বাগানের সংখ্যা ডুয়ার্সের তুলনায় তরাইতে কেন কম ছিল তা অবশ্যই প্রশ্নচিহ্ণ রাখে। খুব সম্ভবত, ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে তরাই অঞ্চলে বাগান স্থাপনের জন্য জমি পাবার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের বিধি নিষেধ আরোপ এই ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছিল। আবার এটাও ঠিক যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জমি পাবার ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ উঠে গেলেও জলপাইগুড়ির এই প্রবাদপ্রতিম পরিবারের পক্ষে হয়তো নতুন করে তখন আরও অনেক বাগান তৈরি করা সম্ভব ছিল না। কারণ সেই সময়ে দেখা যাচ্ছিল প্রায় সব পরিবারই কোলকাতায় তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য আস্তানা গড়ে তুলছেন যেখানে পরিবারের একটা অংশ প্রায় সব সময়ই থাকছেন এবং কোলকাতার সোসাইটির সদস্য হবার উপযুক্ত করে নিজেদের তৈরী করে নিচ্ছেন। এঁরা জলপাইগুড়ি শহর বা শহরের উন্নয়ন বা শহরের অধিবাসীদের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করবার মানসিকতা হারিয়ে ফেললেন। যোগেশ চন্দ্র ঘোষের প্রথম পুত্র দেবেশ চন্দ্র ঘোষ ইন্ডিয়ান টি এ্যাসোসিয়েশনের সভ্য ছিলেন। কয়েকবার বিলেতও ঘুরে এসেছিলেন। দেবেশবাবু ওঁর পৈতৃক সম্পত্তি অর্থাৎ বাগানগুলির ব্যবস্থাপনা এবং মালিকানা ভাগাভাগি করে নিয়ে ওঁর ভাগের বাগানগুলির হেড অফিস জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা নিয়ে যান এবং সপরিবারে কলকাতার বাসিন্দা হয়ে পড়েন। সেই কারণেই জলপাইগুড়ির সুভাসিনী, যোগেশচন্দ্র, বিজয়নগর ইত্যাদি চা বাগান এবং কোম্পানীর হেড অফিস জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা চলে যেতে শুরু করে। এই বংশের চা বাগানটির শেষ কর্ণধার ছিলেন প্রখ্যাত চা-কর বীরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষের ভাই দেবেশ চন্দ্র ঘোষের প্রপৌত্র শুভজিৎ ঘোষ ও সুপ্রতীক ঘোষ। কিন্তু পরিচালন ব্যাবস্থার ত্রুটি এবং চা শিল্পে মন্দাজনিত কারণে এক এক করে ঘোষদের চারটি বাগান বিক্রি হয়ে যায়। ইতিপূর্বে গড়ে তোলা বাগানগুলি নিত্য পর্যবেক্ষণের অভাব, ফান্ডের অপ্রতুলতা, শ্রমিক-স্টাফদেরকে রক্ষা করা, আবার নুতনভাবে বাগান গড়ে তোলা ও তার পিছনে সময় দেওয়া, হয়তো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর করেননি বলেই হয়তো প্রথম ও দ্বিতীয় পুরুষ পর্যন্ত বাগানগুলির মালিকানা তাদের হাতেই ছিল। যা ধরে রাখতে পারে নি তাদের পরিবারের তৃতীয়-চতুর্থ পুরুষ।
তথ্যসূত্রঃ ১. কামাক্ষ্যাপ্রসাদ চক্রবর্তী, ‘সেকালের জলপাইগুড়ি শহর এবং সামাজিক জীবনের কিছু কথা’ সিগমা প্রকাশনী, জলপাইগুড়ি, ২০০৪, পৃষ্ঠা ২
২. বি সি ঘোষ, দি ডেভেলপমেন্ট অফ টি ইন্ডাস্ট্রি ইন দি ডিস্ট্রিক্ট অফ জলপাইগুড়ি (১৮৬৯-১৯৬৮, জলপাইগুড়ি, ১৯৭০)
৩. সুপম বিশ্বাস, এমারজেন্স অফ বেঙ্গলী এন্টারপ্রেনিওরশিপঃ এ কেস স্টাডি অফ দি টি প্ল্যান্টেশন ইন্ডাস্ট্রি, মার্চ ২০১২,
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴