রিয়াবাড়ি চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
রিয়াবাড়ি চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
পলাশবাড়ি থেকে বের হয়ে চামুর্চি রোড ধরে এগিয়ে চললাম। বানারহাট থেকে পলাশবাড়ি এবং নিউ ডুয়ার্স চা বাগিচার পাশ দিয়ে শিবমন্দির হয়ে চামুর্চি রোড ধরে রিয়াবাড়ি চা বাগান ৮ কিমি। সময় লাগে ২০ মিনিট। বানারহাট থানার অন্তর্গত রিয়াবাড়ি টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী রিয়াবাড়ি টি কোম্পানি লিমিটেড। ডিবিআইটিএ-এর সদস্যভুক্ত বর্তমান কোম্পানি ১৯৮৩ সালে বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে। বাগানে ম্যানেজারিয়াল স্টাফ দশজন। কোম্পানির মালিকের নাম অশোক বনশল এবং অন্যান্য ডিরেক্টরেরা হলেন রাজ বনশল, দীপক বনশল, সিদ্ধার্থ বনশল এবং রাহুল বনশল। কোম্পানির হেড অফিস কলকাতায়। বাগানে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন পাঁচটি। এগুলি হল ডব্লিউবিসিএমএস, সিবিএমইউ, ডব্লিউবিসিএসইউ, পিটিডব্লিউইউ, এনইউপিডব্লিউ। রিয়াবাড়ি চা বাগিচার আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ৫১০.১৪ হেক্টর। আপরুটেড অঞ্চল ১৪.২৮ হেক্টর, রিপ্লান্টেড এরিয়া ৭.১১ হেক্টর, সেচসেবিত অঞ্চল ১৬০ হেক্টর, ড্রেনযুক্ত সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল এবং চাষযোগ্য উৎপাদন ক্ষেত্র ৩৬০.৩৪ হেক্টর। প্রতি হেক্টর সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন আবাদযোগ্য এরিয়া থেকে ২০২৫ কেজি করে কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয়।
রিয়াবাড়ি বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ৫১ জন। করণিক ০৫ জন। ক্ল্যারিক্যাল, টেকনিক্যাল স্টাফ ০৬ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৬০৭ জন এবং মোট জনসংখ্যা ৫০০০ জন। স্থায়ী শ্রমিক ৮৩৭ জন। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী শ্রমিক সংখ্যা ছিল ১৬০ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৭৭ জন, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক সংখ্যা ৩৩ জন, কম্পিউটার অপারেটর একজন। সর্বমোট সাব স্টাফের সংখ্যা ৭৩ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ৯১৭ জন যারা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ কাজের জন্য নির্দিষ্ট মজুরি পায়। শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ২৫৮৩ জন। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৫৫০ জনের মত। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ছিল ১২৩ জন, কম্পিউটার অপারেটর ছিল মাত্র একজন। সর্বমোট সাব স্টাফের সংখ্যা ৫১ জন। ক্ল্যারিক্যাল, টেকনিক্যাল স্টাফ এবং অস্থায়ী শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১৬ জন। কর্মরত শ্রমিক ১০২৮ জন এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্য ৩৯৭২ জন।
রিয়াবাড়ি চা বাগিচা এমজিএনআরইজিএস এর সুবিধা ভোগ করে না। বাগানটি আর্থিকভাবে ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক এর কাছে দায়বদ্ধ। বাগানটির লিজ হোল্ডার ম্যানেজার, রিয়াবাড়ি টি এস্টেট। লিজ ভ্যালিড ২০২৫ সাল পর্যন্ত। রিয়াবাড়ি চা বাগিচায় স্থায়ী ক্রেশ একটা। অস্থায়ী ক্রেশ নেই। অ্যাটেনডেন্ট দুজন। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা, শৌচালয় মাঝারি মানের। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের দেওয়া কার্যত দেওয়া হয় না বললেই চলে। পর্যাপ্ত পানীয় জল ক্ৰেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয়। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় নেই। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে একটা ট্রাক আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব, খেলার মাঠ আছে। রিয়াবাড়ি টি গার্ডেনে নিয়মিত পি এফ বা গ্র্যাচুইটির টাকা জমা পড়ে। বোনাস চুক্তি অনুযায়ী মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে বাগানটি রুগ্ন বাগান। কোন কোন সময় পি এফ বা গ্র্যাচুইটি বকেয়া থাকে। শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয় । ২০০০ সাল থেকে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার আছে। ( সামগ্রীক তথ্যসূত্র লেবার অফিস থেকে সংগ্রহ করা যা ভেরিফাই করে দেখেছি বহু পুরণো। তাই বাগিচা সফরে দেওয়া বেশ কিছু তথ্য পরিবর্তিত হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে)
এবারের বাগিচা সফরে ছিলাম রিয়াবাড়ি টি গার্ডেনের স্টাফ কোয়ার্টারে। আমার প্রাক্তন ছাত্র তথা এক সময়কালের দাপুটে ছাত্রনেতা অধুনা বাগিচার শাসকদলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সমীর ওঁরাও এর বাড়িতে। সমীর এক সময়ে আদিবাসী বিকাশ পর্ষদের সঙ্গেও যুক্ত ছিল এবং সেই সূত্রে তেজকুমার টোপ্পোর সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা আছে। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হচ্ছিল সমীরের সঙ্গে ডুয়ার্সের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আমার দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর ডুয়ার্সের চা বাগানে ঘুরে ঘুরে কাজ করার কথা শেয়ার প্রসঙ্গে জানালাম কাজ করতে গিয়ে আমার ভাষা সমস্যার কথা। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাগিচায় কাজ করতে গেলে হিন্দী, সাদরি, নেপালি ভাষা জানা অত্যন্ত জরুরী। তাহলে সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া যায়। আর ওদের সংস্কৃতি, খাওয়া দাওয়া, ভাষা আত্মস্থ করতে পারলে বাগিচার মানুষের মন পাওয়া সামান্য ব্যাপার। কিন্তু হায়। এতদিনেও সাদরি ভাষা আর নেপালিটা শিখতে পারলাম না। বুঝি, কিন্তু বলতে পারি না। রাজবংশী ভাষা যেমন কাজ চালানোর ক্ষেত্রে বলতে পারি। কিন্তু সাদরি নিয়ে আমার অপারগতার কথা জানালাম সমীরকে। আর জানালাম, “এখনো আমি তরল জলের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারলাম না। অথচ হাঁড়িয়ার আসরে না বসলে, অতিথি আপ্যায়নে হাঁড়িয়াতে চুমুক না দিলে আদিবাসীরা আমাকে আপনজন ভাববে কেন”? সমীর হেসে জানালো, “সেটা ডুয়ার্সের আদিবাসী সমাজ কিছু মনে করে না। হ্যা, খেলে খুব খুশী হয়, দু চারকথা তোমাকে বাড়তি বলে দেবে, ঘর সংসারের সুখ দুঃখের কথা অকপটে তোমাকে শেয়ার করবে, কিন্তু তুমি না খেলে তোমাকে ওরা দূরের বলে মনে করবে এমনটা নয়”। সাদরি ভাষা নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল বরাবরের। পরদিন রবিবার। ছুটির দিন। সমীরের সঙ্গে এলাম চামুর্চি ভিউ পয়েন্টে। রিল্যাক্স মুডে শুনলাম ডুয়ার্সের সাদরি ভাষা চর্চার ইতিহাস। সমীরের জবানবন্দী এবং নিজস্ব পড়াশুনার ভিত্তিতে আজকের পর্বে তাই ডুয়ার্সের সাদরি ভাষাচর্চার ইতিহাস নিয়ে কলম ধরলাম।
ইংরেজ সাহেবরা ১৮৩৬ সালে অসমের ছাবুয়ায়, ড. ক্যাম্পবেল সাহেব ১৮৪১ সালে দার্জিলিঙে পরীক্ষামূলকভাবে উত্তরাঞ্চলের কুমাউ পাহাড় থেকে চায়না জাতীয় চা-বীজ এনে এবং ১৮৬৪ সালে হাউটন সাহেব জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স অঞ্চলের গজলডোবায় প্রথম বাগিচা স্থাপনের কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। জঙ্গল পরিষ্কার থেকে শুরু করে চা-বীজ ও চারা লাগানো, গাছের পরিচর্যা, চা-পাতা তোলা, চা কারখানা তৈরি ও পরে চা উৎপাদন করার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ল হাজার হাজার শ্রমিকের। চা বাগিচায় মূলতঃ কুখ্যাত আড়কাঠি নামে এজেন্টদের চা করেরা অর্থাৎ টি প্ল্যান্টারেরা চা বাগিচায় শ্রমিকদের আনার জন্য নিযুক্ত করেন। তারা নেপাল থেকে নেপালি শ্রমিকদের আনল দার্জিলিং পাহাড়ে এবং সমতল উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স তরাই অঞ্চলে এল ছোটনাগপুর, রাঁচি, দুমকা, সাঁওতাল-পরগণা, সুদুর উড়িষ্যা, অন্ধ্রের গঞ্জাম, কোরাপুট এমনটি ছত্তিশগড় থেকে ওরাওঁ, মুণ্ডা, সাঁওতাল, খড়িয়া, মালপাহাড়িয়া, মাহালী, নাগেশিয়া, খেড়ওয়ার, চিক-বরাইক, লোহার প্রভৃতি আদিবাসী কৃষক ও কৃষি শ্রমিক। আসলে ১৮৫৭ থেকে ১৯১৮ র মধ্যে পরপর পাঁচটি দুর্ভিক্ষ ও তিনটি বন্যায় বিহারের আদিবাসীরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। ফলে ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগণা, রাঁচি, লোহারডাগা, ময়ূরভঞ্জ, কোরাপুট ইত্যাদি অঞ্চলের অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর আদিবাসীরা চা-বাগানে শ্রমিক হিসাবে আসে। আদিবাসী ওঁরাও, মুণ্ডা, সাওতালরা ‘মধ্যদেশ’ অঞ্চলের বলে এদেরকে ‘মদেশিয়া’ বলে সম্বোধন করা হত। নেপালি ভাষায়ও মদেশ বলতে সমতলের লোকদেরই বলা হত। আদিবাসী-মদেশিয়ারা চরম দারিদ্রে ছিল। তাই নব জীবনের স্বপ্নে তারা অজানা অচেনা দেশে এসে উপস্থিত হয়। ভারতবর্ষের সুসভ্য, অর্ধসভ্য ও অসভ্য সব রকমের অনার্য আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে আর্যদের প্রথম সংস্পর্শ বিরোধের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু অনার্য ভারতে আর্যদের উপনিবেশ স্থাপিত হবার পর থেকেই অনার্য ও আর্য উভয় শ্রেণীর মানুষ পরিবেশের প্রভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। ডুয়ার্স-তরাই চা-শ্রমিকদের মধ্যে ওরাওঁরা ছিল সংখ্যায় বেশি।
অসমে ওঁরাও, মুণ্ডা, সাঁওতাল, তাতি ইত্যাদি চা-শ্রমিকদের ‘ট্রি ট্রাইব' হিসেবে সরকার চিহ্নিত করে। পশ্চিমবঙ্গে ওঁরাও, মুণ্ডা, সাঁওতাল, অসুর, চিক বরাইক, মহালী, নাগেশিয়া, মালপাহাড়ি, লোহার ইত্যাদি উপজাতি সমাজ এস.টি. হিসেবে স্বীকৃত। এখন থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে যে আদিবাসী ওরাওঁ, মুণ্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে চা বাগিচাতে এল তাদের নিজেদের মাতৃভাষা ওরাওঁ/কুরুক, সাঁওতাল, মুণ্ডারী ইত্যাদি থাকলেও এই সমস্ত ভাষাগুলি শুধুমাত্র নিজেদের স্বামী-স্ত্রী-পরিবার ও নিজেদের ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার ফলস্বরূপ একটি ঐক্যবিধায়ক ভাষা বা যোগাযোগের মাধ্যমের ভাষা রূপে লিঙ্ক ল্যাঙ্গুয়েজ অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আর্যদের ভাষা দ্রাবিড় ও অষ্ট্রিক ভাষাগুলিকে হীনপ্ৰভ করেছিল। কোল ও দ্রাবিড় অনার্যদের মধ্যে ঐক্য বিষয়ক ভাষার অভাব ছিল। বিজেতা মর্যাদা নিয়ে আর্যভাষা সে অভাব পূরণ করল। আদিবাসী চা-শ্রমিকদের মধ্যে অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ১৯ টি এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ১২টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে কম বেশি সবাই সময়ের ব্যবধানে চা-বাগানে মাতৃভাষা বর্জন করে নাগপুরিয়া বা সাদরি ভাষা গ্রহণ করে। এভাবে দেখলে বলতে হয় যারা মাতৃভাষা সম্পূর্ণ বর্জন করে আর্য ভাষা গ্রহণ করেছিল সাদরিই হয়ে উঠেছে তাদের মাতৃভাষা। এইভাবে লিঙ্ক ল্যাঙ্গুয়েজ হিসাবে সাদরি ভাষা প্রয়োজন মিটিয়েছিল। যাঁরা নিজেদের গোষ্ঠীর ভাষা সম্পূর্ণ বর্জন করেনি সাদরি তাদের কাছে দ্বিতীয় মাতৃভাষার স্থান গ্রহণ করেছে। এভাবেই আসলে ভাষার বিবর্তন হয়। সাদরির প্রচার প্রসার ও জনপ্রিয়তা আদিবাসী চা-শ্রমিকদের মধ্যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। অসম উত্তরবঙ্গে ইংরেজদের বাগিচার গোড়াপত্তনের সময়কাল থেকেই ডুয়ার্স তরাই চা-শ্রমিকদের মধ্যে যারা আদিবাসী নামে পরিচিত তাদের সঙ্গেই এই অঞ্চলে সাদরি ভাষার আগমন। উত্তরবঙ্গে সাদরি ভাষার কেন্দ্রভূমি দার্জিলিং জেলার তরাই ও জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্স অঞ্চলের চা-বাগানগুলি এবং তৎসংলগ্ন বনবস্তি কিংবা কৃষি বলয়। ১৯৬১ সালে জলপাইগুড়ি জেলায় প্রধান চারটি ভাষা ছিল বাংলা, কুরুক/ওরাওঁ, নেপালি এবং হিন্দি।
শতাংশের হিসাবে প্রথম স্থানে বাংলা, দ্বিতীয় স্থানে কুরুক/ওঁরাও, তৃতীয় স্থানে নেপালী এবং চতুর্থ স্থানে হিন্দি ছিল। এটি ১৯৭১-এ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় বাংলা, হিন্দি, কুরুক/ওঁরাও এবং নেপালি। ওরাওঁদের মাতৃভাষা ওঁরাও/কুরুক-এর বাচক সংখ্যা কমে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। দ্বিগুণ হয় হিন্দি ভাষার বাচকের সংখ্যা। আদিবাসী চা-শ্রমিকদের অনেকেই জনজীবনের বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় চা-বাগান এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ডুয়ার্স এলাকায় বাংলা এবং হিন্দি হাইস্কুলে পড়াশোনা শুরু করে। স্কুল/কলেজে পড়াশুনা শেষ করে এদের অনেকেই নানা সরকারি দপ্তরে কিংবা বিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করে। ধীরে ধীরে চা-শ্রমিকদের আর্থিক, সামাজিক ও অবস্থানগত পরিবর্তন হতে শুরু করে। একটি অংশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উত্তরণ ঘটে এবং অপর অংশ দরিদ্র শ্রমিক সম্প্রদায় রূপে চা বাগিচা অঞ্চলেই কর্মরত থাকে নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে। আদিবাসী সমাজও ধীরে ধীরে নিজস্ব আইডেন্টিটির প্রয়োজন বোধ করতে শুরু করে। ক্রমে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চা বাগিচার আদিবাসী শ্রমিক পরিবারের ছেলেরা পরিবারে স্বচ্ছলতা আনার প্রচেষ্টায় বেকার সমস্যার জন্য দিল্লি, মুম্বাই এমনকি কাশ্মীর পর্যন্ত যেতে শুরু করল। জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ জন্মস্থান/ মাতৃভূমি থেকে অন্য কোনও জায়গায় যেতে শুরু করল। চা-বাগিচার জীবিকার সংস্থান তাই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। এভাবে সাদরি ভাষার আমূল পরিবর্তন হয়। সাদরি ভাষার জন্মস্থান ছোটনাগপুর, রাঁচী অঞ্চলে হলেও চা-বাগিচাতে এসে উত্তরবঙ্গে বাংলা, হিন্দি ও ওড়িয়া ভাষার প্রচুর শব্দ/উপাদান এই ভাষার সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়েছে। অসমে অসমীয়া ভাষার বহু শব্দ/উপাদান সাদরি ভাষায় মিশ্রিত হয়েছে। সাঁওতাল, মুন্ডারা ওদের মাতৃভাষায় পরিবারের চৌহদ্দিতে কথা বললেও ওঁরাও, মহালী, অসুর, বরাইক প্রভৃতি আদিবাসী চা-শ্রমিক পরিবার গত দুই/তিন দশকে সাদরি ভাষাতেই কথা বলে। সাদরি আস্তে আস্তে তাদের মাতৃভাষা হয়ে যাচ্ছে।
আসলে লোকসাহিত্য চা-বাগানের মানুষদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে, আমরা জীবনের বাস্তবমুখী চিত্র পেয়েছি। চা-বাগান থেকে উঠে আসা লেখকদের রচনায় ঔপনিবেশিকতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। চা-বাগানের একটা সামাজিক স্তরবিন্যাস সাহিত্যের পাতায় পাতায় বারবার চলে এসেছে। গল্প-উপন্যাস-কবিতায় চা-বাগানের সাহিত্যিকরা ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক আমলের রাজনীতি, দলাদলি ও ক্ষমতা দখলের কথা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বলেছেন। আসলে চা-বাগানের মানুষের লোকগান ও সাহিত্য-সংস্কৃতি উঠে এসেছে তাদের জীবন থেকে। এতে আছে তাদের জীবনযাত্রার সত্য প্রতিফলন। এই সহজ, স্বাভাবিক বর্ণনাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় চা-বাগানের মানুষদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিশেষ চর্চা প্রয়োজন। আজ ডুয়ার্স তরাই চা-বাগিচা ও তৎসংলগ্ন বন, কৃষিবস্তি এবং সামগ্রিকভাবে উত্তরবঙ্গই তাদের নিজের দেশ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴