নিউ ডুয়ার্স চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
নিউ ডুয়ার্স চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
লিখতে গেলে পড়তে হয় প্রচুর। বিশেষ করে আমার যেহেতু ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি নিয়ে কাজ কারবার তাই তথ্যবিকৃতি হলে তার দায়ভার আমি এড়াতে পারি না। তাই তথ্যের আকর সংগ্রহের জন্য আমাকে তথ্যভিত্তিক বই পড়তে হয় এবং নিজের ফিল্ড ওয়ার্কের সাথে সেই তথ্য মিলিয়ে আপডেট করে তারপর লিখতে হয়। শীতের এই মরসুমে পুজোর ছুটিতে তাই পড়ে ফেলেছি বেশ কয়েকটা বই। হাতে এসেছিল অপূর্ব দাশগুপ্তের “ডুয়ার্সের চা বাগানঃ ইতিহাস ও সংস্কৃতি”, সমীর চক্রবর্তীর “উত্তরবঙ্গের আদিবাসী চা-শ্রমিকের সমাজ ও সংস্কৃতি”, সরিত ভৌমিকের “ক্লাশ ফর্মেশন ইন প্ল্যান্টেশন সিস্টেম”, আর বানারহাট সার্কিট নিয়ে লিখতে গিয়ে রেফারেন্স হিসাবে সংগ্রহ করলাম দুজন প্রথিতযশা ট্রেড ইউনিয়নিস্ট তথা রাজনীতিবিদের চা বাগিচা বিষয়ক লেখা পশ্চিমবঙ্গ: জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা/তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ/পশ্চিমবঙ্গ সরকার/১৪০৮ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে। একজন হলেন প্রয়াত মানিক সান্যাল, অপরজন মনোহর তিরকি। মানিক সান্যালের লেখা “চা-শিল্প ও শ্রমিক আন্দোলন” এবং মনোহর তিরকির লেখা “জলপাইগুড়ির আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি”। আমার তথ্যভান্ডার মজুত করে রওনা দিলাম বানারহাট ব্লকের চামুর্চি সার্কিটের “নিউ ডুয়ার্স” চা বাগিচায়। এবার আমার বাড়তি প্রাপ্তি আদিবাসী সংস্কৃতি উৎসবে বেশ অনেকটা সময় কাটানো। আড়কাঠিরা শ্রমিকদের চা-বাগিচায় যাওয়ার জন্য লোভ দেখিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এনে ফেলত ডুয়ার্সে বা অসমে। অনেকদিন আগে সুখবিলাস বর্মা শুনিয়েছিলেন একটি গান— ‘আম ধরে ঝোপা ঝোপা / তেইতুল ধরে বেঁকা গ / পূরব দেশে গিয়াছিলাম / রাঢ়ি হাতে শাঁখা গ।’ একটা আদিবাসী দল এই গানটা গাইল। মনে হল যাঁরা নিজস্ব জমিজমা, এলাকা ছেড়ে এসে এই নতুন উপনিবেশে বসবাস করছে তাঁরা তাঁদের পুরনো শিল্পকলা, সঙ্গীত, জীবনচর্যা একবারে ভুলতে পারেনি। তাই এখনও শোনা যায় সেই সব পুরনো গান। তা এখন বৃহত্তর চা-শ্রমিকদের গান হয়ে গেছে।
উত্তরবাংলার ডুয়ার্স অঞ্চলে গারো, রাভা, মেচ, রাজবংশী ইত্যাদি স্থানীয় কৃষিজীবী মানুষ চা-বাগিচায় শ্রমিক হিসেবে আসেনি। ফলে পাহাড়ি এলাকা থেকে নেপালি শ্রমিকরা এসেছিল। আবার আড়কাঠির সাহায্যে ছোটনাগপুর-সাঁওতাল পরগণা ও মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে শ্রমিক হিসেবে আনা হয়েছিল আদিবাসী জনজাতির মানুষকে। ইমিগ্রেশন লেবার অ্যাক্টের ফাঁসে তাদের পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ওরাঁও, মুণ্ডা, নাগেশিয়া ইত্যাদি সম্প্রদায়ের শ্রমিকেরা এসেছিল। ব্যবসার সন্ধানে ব্যাপক সংখ্যায় অবাঙালি ব্যবসায়ী, ঠিকাদার আর মহাজনরাও আসে। আড়কাঠিরা শ্রমিকদের চা-বাগিচায় যাওয়ার জন্য লোভ দেখিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এনে ফেলত ডুয়ার্সে বা অসমে। তাই আজও প্রাসঙ্গিক ‘কাঁহাকের কুলি পানি কাঁহাকের বাবুভৈয়া / লোহারদাগা ডিপুর কুলি চালান করে / জঙ্গল কাঁইটকে মাটি কাঁইটকে বৈঠলেক ঘানি / লোহারদাগা ডিপুরে কুলি চালান করে। (সূত্র : মহঃ সৈফুদ্দিন, বাগিচা-শ্রমিকদের নয়া ইতিহাস রচনার প্রবহমানতা)। গত শতকের পাঁচের দশকের আগেই (১৯৪৬) গণনাট্য সংগঠনের অন্যতম নেতা বিজয় রায় গান করেছেন-“ হামারা দেশমে আকে / হামারা পাসা থাকে / আঁখ না দিখানা / হো না দিখানা”। (সূত্র- পরিতোষ দত্ত)। এই গানগুলির ভাষা সাধারণত ‘সাদরি’। ‘সাদরি’ উপভাষাটি বাংলা-হিন্দির অপভ্রংশ এবং আদিবাসী ভাষার সমন্বয়ে উদ্ভুত এক উপভাষা। বিভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির সমন্বয় সাধন ঘটেছে চা-বাগানে ব্যবহৃত কথ্য ভাষায় এবং এখানকার সংস্কৃতিতে। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক-শিল্পী সংঘ জলপাইগুড়ি জেলা কমিটির সম্পাদনায় প্রকাশিত জলপাইগুড়ি জেলার “ভাষা-বিভাষার কবিতা' বইটিকে বলা যায় বহুভাষাভাষী ছোটখাটো মহাদেশতুল্য ডুয়ার্সের লোকায়ত ও শিষ্ট কাব্যচর্চার এক দর্পণ। টোটো, মেচ, রাভা, সাদরি, লিম্বু, মুণ্ডা, সাঁওতাল, নেপালি, রাজবংশী ইত্যাদির সঙ্গে এই সংকলনে এ কালের আধুনিক বাংলা কবিদের লেখাও আছে। কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য সংকলিত ‘ডুয়ার্সের লোকায়ত শব্দকোষ' বইটিও এই অঞ্চলের জাতি-উপজাতি বিষয়ে এক প্রামাণ্য গ্রন্থ। বানারহাট সার্কিটে কাজ শুরু করার আগে ডুয়ার্সের আর্থ-সামাজিক চিত্রটা বুঝে নিতে চাইলাম।
উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের দার্জিলিং, আসাম এবং ডুয়ার্সের প্রধান চা উৎপাদনকারী অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান অ্যান্ড্রু ইউল এন্ড কোম্পানি লিমিটেড হল একটি ১৫৫ বছরের পুরনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি যারা দার্জিলিং, আসাম এবং ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা ১৫ টি প্রিমিয়াম চা বাগান থেকে ১২ মিলিয়ন কিলো সিটিসি, অর্থডক্স এবং গ্রিন টি উৎপাদন করে। আসাম এবং ডুয়ার্সের কিছু বাগানে অর্থডক্স এবং গ্রিন টি এবং দার্জিলিং এর কিছু কিছু চা বাগিচায় জৈব চা এবং কোয়ালিটি অর্থডক্স চা তৈরীর ক্ষেত্রে কোম্পানীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অ্যান্ড্রু ইউল কোম্পানির আসাম এবং ডুয়ার্স উভয় সার্কিটেরই সিটিসি চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সুনাম আছে। জর্জিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ডে অ্যান্ড্রু ইউল অ্যান্ড কোম্পানির চা নিয়মিত বিক্রি হয়। অ্যান্ড্রু ইউল কোম্পানির ইতিহাস কেবল তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের ইতিহাস নয়, বরং দেশের আর্থ-সামাজিক এবং শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে এই কোম্পানির একটি বিশাল অবদান রয়েছে। ১৯৬৩ সাল। স্কটল্যান্ডের একজন তরুণ উদ্যোক্তা অ্যান্ড্রু ইউল ভারতের তৎকালীন সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় এসে এমন একটি সময়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যখন দেশে রেল, টেলিগ্রাফ এবং পাট ও পাটজাত দ্রব্যের পরিষেবা শুরু হয়েছিল। ৬৩ সালে শুরু করে ১৮৭৫ সাল নাগাদ কোম্পানি পাট, চা, তুলা, কয়লা এবং বিমাক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করে। অ্যান্ড্রু ইউলের বড় ভাই জর্জ ইউল ১৮৭৫ সালে কোম্পানির শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন উদারপন্থী চিন্তাধারার একজন সাধারণ উদ্যোক্তা। তিনি ১৮৮৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। শুধুমাত্র দুই ইউরোপীয়দের মধ্যে তিনিই একজন যিনি এই সম্মান পেয়েছেন। জর্জ ইউলের মৃত্যুর পর ব্যবসার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ১৯০২ সাল নাগাদ কোম্পানি ৩০ টিরও বেশি ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকে যার মধ্যে ছিল জুট মিল, কটন মিল, চা কোম্পানি, কয়লা কোম্পানি, প্রিন্টিং প্রেস ইত্যাদি। অ্যান্ড্রু ইউল কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলাতে জমিদারি কোম্পানি গড়ে তোলে যেখানে কোম্পানি কৃষি, বনজ, মৎস্য, রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল এবং ডিসপেনসারি তৈরি করে। অ্যান্ড্রু ইউল কোম্পানির ডুয়ার্সের চা বাগিচাগুলি হল কারবালা, বানারহাট, চুনাভাটি এবং নিউ ডুয়ার্স।
অ্যান্ড্রু ইউল কোম্পানির নিউ ডুয়ার্স টি গার্ডেনটি বানারহাট টি গার্ডেন ফ্যাক্টরি এবং পলাশবাড়ি চা বাগানের পাশ দিয়ে চামূর্চি রোড ধরে ৭ কিমি। ম্যানেজমেন্ট সহযোগিতা দেয় ডিবিআইটিএ। ম্যানেজারিয়াল স্টাফ আট জন। বাগানে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন আছে সাতটি। এগুলি হল সিবিএমইউ, এনইউপিডব্লিউ, পিটিডব্লিউইউ, ডব্লিউবিসিএমএস, ডিটিডিপিএল ইউ ইত্যাদি। বানারহাট ব্লকের অন্তর্গত নিউ ডুয়ার্স চা বাগিচার আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ৯৬৭.৬৫ হেক্টর। সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ৭৯২.৩৫ হেক্টর এবং মোট চাষযোগ্য উৎপাদন ক্ষেত্রও সমপরিমাণ। উৎপাদনযোগ্য এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ১২০০ কেজি করে চা পাতা উৎপাদিত হয়। নিউ ডুয়ার্স চা বাগিচাতে বছরে গড়ে ৪৫ লাখ কেজি কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয় যা নিজস্ব কারখানায় প্রসেসিং এর পর গড়ে ৮ থেকে ৯ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত এবং বিপণন হয়ে থাকে। অন্যান্য বাগিচা থেকে সংগৃহীত কাঁচা চা পাতা ফ্যাক্টরিতে প্রসেসিং হবার পর গড়ে আরো প্রায় ২ লক্ষ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত এবং বিপণন হয়। গড়ে বাগানে ১০ থেকে ১২ লাখ কেজি সুস্বাদু উন্নত কোয়ালিটির ইনঅর্গানিক সিটিসি চা উৎপাদিত হয়। নিউ ডুয়ার্স চা বাগিচা এমজিএনআরইজিএসএর সুবিধা ভোগ করে না। পূর্বতন ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এবং বর্তমান পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক এর কাছে বাগানটি আর্থিক ঋণে দায়বদ্ধ। বাগানটির লিজ হোল্ডার অ্যান্ড্রু ইউল অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। লিজের ভ্যালিডিটি ২০২৫ সাল পর্যন্ত। নিউ ডুয়ার্স টি গার্ডেনটির সাব স্টাফের সংখ্যা ১৫২ জন, করণিক ১৭ জন, ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ২০ জন। বাগিচায় শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ১৩০০, মোট জনসংখ্যা ৬৯০০, স্থায়ী শ্রমিক ১৫৪৭ জন। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী বিঘা শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৬৫০ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা মাত্র ৪ জন। কম্পিউটার অপারেটর ৩ জন। সর্বমোট সাব স্টাফের সংখ্যা ১৫২ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল এবং অস্থায়ী শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ৪৫ জন। কর্মরত শ্রমিক ৯২০ জন এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৩২৮৪ জন।
ভারত-ভুটান সীমান্তের চুনাভাটি এবং নিউ ডুয়ার্স। ওই চা বাগানগুলির পাশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে বানারহাট চামুর্চি সার্ক রোড। কিন্তু কাজের দীর্ঘসূত্রিতার জন্য প্রতিনিয়ত বাগানগুলোতে ধুলো ঢুকছে। ধুলো ঢুকছে হাসপাতালগুলোতেও। চিকিৎসাধীন রুগীরা ঘুমোতে পারছে না। ধুলোতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে শ্রমিক পল্লীর বাসিন্দারা। ফলে দুই চা বাগানে উদ্বেগ ক্রমশই বাড়ছে। ধুলোয় ঢেকে যাচ্ছে শ্রমিক আবাসগুলি। ওই দুই চা বাগানের পাশাপাশি পলাশবাড়ি চা বাগানেও ধুলোর কারণে শ্রমিকেরা ক্ষুব্ধ। কথা বলছিলাম বাগিচার ট্রেড ইউনিয়নিস্ট জিতবাহাদুর থাপার সঙ্গে। জানলাম শীতের সুখা সময়ে চা পাতা তোলা বন্ধ থাকে। অনেক রুগ্ন বা ধুঁকতে থাকা চা বাগান এই সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ বছরের শুরুটা হয়েছিল চা পাতা বিক্রিতে মন্দার ছায়া ফেলে। গোটা দেশের নিলামের নিরিখে উত্তর ভারতের চায়ের দর হু-হু করে পড়ে যায়। গত জানুয়ারি মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত চা পাতার দাম কম হতে থাকে। এমনকি, বাজারে প্রথম ফ্লাশের চা পাতা চলে এলেও দাম ওঠার মোটেই কোনও লক্ষণ ছিল না। চা বাগান পরিচালকদের একাংশ মনে করছিলেন, বেশি দাম পড়লে উৎপাদন খরচের পুরোটা তুলতে সমস্যায় পড়তে হবে। বহু বাগানে উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনাও হয়েছিল যার প্রভাব সরাসরি শ্রমিকদের মজুরিতে পড়ার আশঙ্কা ছিল। সে তুলনায় বছরের শেষ দিকে চা পাতার দাম উঠে যায়। কিন্তু শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরী আর মিলল না। শুনলাম ম্যানেজমেন্ট নাছোর আট ঘন্টা কাজের দাবিতে। পাশেই রিয়াবাড়ি চা বাগিচাতে বোনাস, মজুরী, সুযোগসুবিধা সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও আন্দোলন চলছে আট ঘন্টা কাজ করা না করা নিয়ে। তবে এই লেখা প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত সমস্যা সমাধান না হলেও খুব তাড়াতাড়ি সমস্যা সমাধান হবে বলে আশাবাদী শ্রমিক এবং ম্যানেজমেন্ট তথা মালিকপক্ষ। কিন্তু সমস্যা হল শীতের এই সময়টাতে অনেক বাগান বন্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এই লেখা যখন প্রকাশের জন্য যাচ্ছে তখন ডুয়ার্সে প্রায় ২০ টি বাগান বন্ধ এবং ২০০৩ সালের ছায়া ডুয়ার্সে। এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ১১। ( তথ্যসূত্র- উত্তরবঙ্গ সংবাদ)
পঞ্চায়েত ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রান্তির সভায় ঘোষণা করেন দ্রুত চা বাগানের জমিতে শ্রমিকদের পাট্টা দেওয়া হবে। যদিও মালিক পক্ষের যুক্তি বাগানের যে জমি উদ্বৃত্ত রয়েছে তা বিভিন্ন প্রয়োজনে লাগে এবং ওই জমিতে পাট্টা দিলে বাগান পরিচালনায় সমস্যা হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ‘ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন’-এর এক কর্তার যুক্তি, ‘‘রাজ্য সরকার চুক্তি করে জমির ‘লিজ়’ দিয়েছে। সে জমির কোনও অংশ ফিরিয়ে নিলে চুক্তিভঙ্গ হবে। সে ক্ষেত্রে আইনি পরিসরে বিষয়টি মেটাতে হবে।’’ সব মিলিয়ে ১,২২৮ জন চা শ্রমিককে পাট্টা দেওয়া হবে। সমস্যা তৈরি হয়েছে খোলা চা বাগানগুলির ক্ষেত্রে। এই বাগানগুলির জমির মালিকানা সংশ্লিষ্ট সংস্থার হাতে। রাজ্য সরকারই চা বাগান পরিচালনার জন্য জমির দীর্ঘমেয়াদি ‘লিজ়’ দেয়। এই চা বাগানে রাজ্য সরকার শ্রমিকদের পাট্টা দিলে প্রথমে সেই জমি মালিকের হাত থেকে নিতে হবে। তাতে আইনি জটের আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে একাধিক মালিক সংগঠনের তরফে এ নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে। মালিক পক্ষ আইনি জটের প্রশ্ন তুললেও কোন বাগানে কত জমি উদ্বৃত্ত, তার হিসাব রাখতে শুরু করেছিল জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন। জেলার বন্ধ চা বাগানে ইতিমধ্যেই শ্রমিকদের পাট্টা দেওয়া শুরু হয়েছে। মানাবাড়ি, ধরণিপুর, রেডব্যাঙ্ক এবং গ্রাসমোড় চা বাগানে পাট্টা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা নেই। কারণ এই চা বাগানগুলির জমির ‘লিজ়’ বাতিল করেছে রাজ্য সরকার। সে কারণে পাট্টা দেওয়ায় আইনত কোনও সমস্যাও নেই। শ্রমিকদের পাট্টা দিয়ে ‘চা সুন্দরী’ প্রকল্পে ঘরও তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে বাগানগুলিতে। পঞ্চায়েত ভোট মিটে যাওয়ার পরে চা শ্রমিকদের পাট্টা দেওয়ার কাজে গতি এসেছে। নিউ ডুয়ার্স বাগিচাতে কাজ করতে করতেই জানলাম জলপাইগুড়ির বানারহাটে এবং আলিপুরদুয়ারের প্রশাসনিক সভাতে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মূল লক্ষ্য উদ্বৃত্ত জমিতে বাগানে বসবাসকারী চা শ্রমিকদের পাট্টা দেওয়া। লোকসভা ভোটের আগে ন্যূনতম ১০ শতাংশ শ্রমিকের হাতে যেন পাট্টা তুলে দেওয়া যায় সে চেষ্টা চলছে বলে জানলাম আইএনটিটিইউসি নেতা রাজেশ লাকড়ার কাছ থেকে।
নিউ ডুয়ার্স চা বাগিচার সহকারি ম্যানেজারের কাছ থেকে জানলাম শীতকালীন বাগানের চালচিত্র। যুগ যুগ ধরে শীতকালের গর্ভে নতুন বছর জন্ম নেয়। শীতের আসার খবর জানিয়ে দিয়ে প্রথমে হিম পড়ে। সে হিম জমে জমে পাতা ভারী হয়। শীতকাল চা-গাছের যত্নের কাল। চা-গাছের মাথা কেটে ফেলা হয় শীতে। ধীরে ধীরে গাছ বাড়তে থাকে। সবুজ চা-পাতাগুলো সাদা রঙের হয়ে যায় শীতকালে। ধীরে ধীরে হেমন্ত আসে। বাতাস শুকিয়ে যায়। ধুলো ওড়ে। সে ধূলিকণা আশ্রয় নেয় চা-পাতায়। তবে সব চা-বাগানের পাতায় ধুলো জমে না, হিম জমতে জমতে যে বাগান বন্ধ, যে বাগানের চা-পাতার যত্ন হয় না, সেখানেই যত ধুলো জমে। সুখা সময়ে বাতাসে রস থাকে না। বসন্তকালে নতুন পাতা আসে। কিন্তু যে বাগান বন্ধ, সেখানে গাছ কাটা হয় না। পুরনো চা-পাতায় হিম পড়তে থাকে। তার পরে জমে ধুলোর পরত। তার পরে কুয়াশা। চা-পাতা সাদা রঙের হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ফুল ফোটে। চা-গাছের হলুদ রঙের ফুল। নাকছাবি হারিয়ে যায় হলুদ বনে বনে। সে ভাবেই সুখ হারিয়ে যায় হলুদ ফুলের চা-বাগানে। কথায় বলে, যে চা-গাছে ফুল ফোটে, সে গাছ জনমদুখী, আদর-যত্ন না পেয়ে মনমরা। চা-গাছের পরিচর্যা হলে ফুল ফোটার সুযোগই আসে না। যত্ন পেলে আগেই গাছের ডাল ছেটে দেওয়া হত। সে বাগান শ্রমিকদের মুখে হাসি ফোটাত। আর বন্ধ বাগানে শ্রমিকদের খিদে মেটায় হলুদ চা-ফুল। সে ফুল ভেজে শ্রমিকেরা সেদ্ধ ভাতে মেখে খান। গরম ভাতের সঙ্গে চা-ফুল ভাজার গন্ধ চর্তুদিকে জিজ্ঞাসা ছড়িয়ে দেয়— আরও একটা নতুন বছর! সুখ আসবে কবে? ক্যালেন্ডার পাল্টায়, বছর ঘোরে। কিন্তু চা-পাতার ধুলো উড়ে যায় না কিছু বাগানের। কিছু শ্রমিকের বাড়ির জরাজীর্ণ চালের ফুটো দিয়ে হিম পড়তেই থাকে বছরের পরে বছর। এ ছবি এখন একঘেয়ে। দুঃখী মুখমণ্ডলের সন্ধানে বন্ধ, ধুঁকতে থাকা চা-বাগানের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায় কত-শত আধুনিক ক্যামেরা। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির প্রতি বছরের ত্রাণ বিলির নির্বিবাদী সহজ ঠিকানা হয়ে যায় বন্ধ চা-বাগান। বছর বদলাতে থাকে, ত্রাণের ঠিকানা বদলায় না।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴