পলাশবাড়ি টি এস্টেট/গৌতম চক্রবর্তী
পলাশবাড়ি টি এস্টেট
গৌতম চক্রবর্তী
বর্ষা রাতের শেষে চা-বাগিচার সবুজ গালিচায় আছড়ে পড়া সোনা রোদের আভা, অদূরেই মাথা তোলা হিমালয়, যৌবনমদে মত্ত পাগলাঝোরা, অলস পায়ে হেঁটে চলা বুনো হাতির দল। এ সবই ডুয়ার্সের পরিচিত ল্যান্ডস্কেপ। এ সবের বাইরেও বানারহাটে রয়েছে আরও বহু আকর্ষণ যা শুধু ভ্রমণবিলাসীদের নয়, ছাপোষারও মন কেড়ে নেবে। শিলিগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার জংশন গামী ট্রেনে চা- বাগিচার কোলে ছোট সুন্দর বানারহাট রেল স্টেশন। ট্রেনের যাত্রাপথও খুব মনোরম। অজস্র নদী, চা বাগান, জঙ্গলের বুক চিরে চলতে থাকে রেলগাড়ি। পথে রয়েছে দু-দুটি টানেল। গা-ছমছমে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ঝমঝম শব্দ এক অসাধারণ সুরমাধুরী সৃষ্টি করে। এছাড়া শিলিগুড়ির পি.সি.মিত্তাল বাস টার্মিনাস থেকেও সকাল-বিকাল বানারহাটে আসার অনেক বাস রয়েছে। শিলিগুড়ি থেকে যাওয়া গেলে সেভক-এ তিস্তা নদীর ওপরে থাকা করোনেশন ব্রিজ পার হয়ে পাহাড়ি পথ ধরে বেশ কিছুক্ষণ ছুটে চলবে গাড়ি। একপাশে খাড়া পাহাড়, অন্যপাশে নদীখাদ। অদ্ভূত রোমাঞ্চ ছড়িয়ে যাবে। এভাবে চলতে চলতে বানারহাট পার হয়ে ভুটানের পাদদেশে চামুর্চি। একদিকে আকাশ ছুঁয়ে রয়েছে একের পর এক ছোট-বড় ভুটান পাহাড়। আরেক পাশে এ রাজ্যের সীমানায় থাকা ছোট ছোট পাহাড়, জঙ্গল আর বিস্তৃত চা বাগিচা। মাঝ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে ডুয়ার্সের অতি পরিচিত সুকৃতি নদী। পাশেই বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে নদীর চর, আর গাছ গাছড়া। পরিষ্কার আকাশে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘারও। ভারত-ভুটান সীমান্তের একেবারে ২০০ মিটারের মধ্যে। ডুয়ার্সের এই চামূর্চিতেই গড়ে উঠেছে ডুয়ার্সের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম স্পট। পাহাড়, নদী বা পাথুরে রাস্তাকে ঘিরে রোমাঞ্চই শুধু নয়, আছে পুরোদস্তুর রাতে থাকার ব্যবস্থা। আছে ক্যাম্পিং সাইট ও ওয়াচ টাওয়ারও। ‘ডুয়ার্স কলিং’ নাম দিয়ে নতুন নতুন এলাকায় পরিকাঠামোর কাজ চলছে। এর মধ্যে চামুর্চি অন্যতম।
চা বাগান আর চা বাগান। রেড ব্যাংক, আমবাড়ি, বানারহাট, কাঁঠালগুড়ি, পলাশবাড়ি। দুপাশে চা বাগানের মাঝখান চিরে এগিয়ে চলা পথ। দেখলাম চা বাগানের উপর দিয়ে রেলপথ গেছে। তারপরেই বানারহাট। রবিবার হাটের দিন বলে বানারহাট হাটতলা ভিড়ভাট্টায় জমজমাট। পৌঁছে গেলাম বানারহাট হাইস্কুলের দোরগোড়ায়। অদূরে রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং। সোজা পথটা মিশেছে চামুর্চি মোড়ে। ডানদিকে বানারহাট কালীবাড়ি। দুপাশে দোকান পসার। ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্য দিয়ে বানারহাট রেলস্টেশনে যাবার পথ। অন্যপথ চামুর্চি মোড়ের দিকে চলে গেছে। গেটের কাছেই চায়ের দোকান। গাছ-গাছালির ছায়ায় কিছুটা হেঁটে গেলে স্কুলবাড়ি। বাঁদিকে সবুজ মাঠ, পাশে মিটারগেজ রেলপথ। এখন ব্রডগেজে রূপান্তরিত। অনেকবার এসেছি বানারহাট। কোনসময়ে লখীপাড়া, কোনসময়ে কারবালা অথবা মোগলকাটা। স্বচ্ছ নির্মল দিনে ডায়না সেতু থেকে দেখেছি সামচি ভুটান। সন্ধ্যায় দেখেছি ঝিকিমিকি আলোর রোশনাই। চা বাগান, জঙ্গল, নদী, ঝোরা, খোলা অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর বানারহাট। জাতীয় সড়ক ছেড়ে রেললাইন পেরিয়ে চলতে লাগলাম চামূর্চির রাস্তায়। নিউ ডুয়ার্স, রিয়াবাড়ি, পলাশবাড়ী, চুনাভাটি, নিউ ডুয়ার্স, চামুর্চি। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম ডুয়ার্সে সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। দেখলাম সরকারিভাবে চামূর্চিকে ঘিরে সেই পরিকল্পনাই নেওয়া হয়েছে। এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে পর্যটকেরা দারুণ উপভোগ করতে পারবেন। শুনলাম অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের সমস্ত রকমের ব্যবস্থা হবে। বানারহাট থেকে খুবই কাছে সামচি লাগোয়া চামূর্চিতে এর আগে বার দুই এসেছিলাম। কিন্তু সামচি ভুটানে যাওয়া হয়ে ওঠে নি। সামচি চমৎকার জায়গা। পাহাড়, নদী, বন, ঝোরা, ঝর্ণা। গেলে আর আসতেই ইচ্ছা করবে না। সবুজ বন, নীল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে জিপগুলো যেন ডানা মেলে উড়ে যায়। এবার তাই সামচি ভুটানে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।
বানারহাট ছাড়িয়ে চামুর্চিতে ভুটান পাহাড়ের নীচেই দুয়াপানি নদীর তীরে অসাধারণ সুন্দর চামুর্চি ইকো পার্ক। এখানকার রিসর্টে এবার নিয়ে দুইবার ঊঠলাম। চামূর্চি ইকো পার্কের মধ্যে যখন গাড়ি প্রবেশ করল দূরের ভুটান পাহাড় দেখে মন ভরে গেল। রিসর্ট অনবদ্য। আহারাদির জন্য ভোজনালয়। রিসেপশন, একটা তিনতলা নজর মিনার। সেরা আকর্ষণ ওটাই। ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক দিয়ে আপ্যায়িত হবার পর নথিবদ্ধকরণ। তারপর ঘরের দখল। সুকৃতি নদীর তীরে বসে স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলাম। বছর সাতেক আগে যখন কাজ চলছিল তখন প্রথম এসেছিলাম শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে মহাকাল গুহাতে ট্রেকিং করতে। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। তখন দেখেছিলাম জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনের পর্যটন বিভাগ, সীমান্ত উন্নয়ন তহবিল, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকায় পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ হচ্ছে। ধূপগুড়ি ব্লকের চামুর্চি এলাকাটির ৩ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে ভুটানের সামচি। আর তার আরেক পাশেই ভুটানের বিখ্যাত ডলেমাইট উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। এই সামচিতেই রয়েছে ভারত-ভুটান গেট। ভুটানের থিম্পু, পারো বা পুনাখার মত এলাকায় যেতে না পারলে এই এলাকায় ঘুরে অনেকেই ভুটানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করে থাকেন। সেই দিকটি মাথায় রেখেই পর্যটন দফতর প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল। প্রায় ১ কোটি দিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিল পর্যটন দফতর। সেই সঙ্গে রিসর্ট, রেঁস্তোরার ব্যবস্থাও হচ্ছিল। নদীর পাশে বিরাট এলাকা জুড়ে ল্যান্ডস্কেপিং-এর কাজ চলছিল। জেনেছিলাম নদী, পাহাড়কে সামনে রেখে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করা হবে। প্রথম পর্যায়ে রাস্তা, খোলা এবং ছাউনি দেওয়া বসার ব্যবস্থা, এক ছাদের তলায় সাতটি ডবল বেড রুম, একটি বড় ডরমেটরি, রেঁস্তোরা এবং ওয়াচ টাওয়ারের কাজ ছিল শেষ পর্যায়ে। এবারে দেখলাম এখানে ১৮ জন পর্যটকের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। দুপুরের সুস্বাদু আহারের পর বের হলাম নিউ ডুয়ার্স চা বাগিচায়। চামুর্চি ভিউ পয়েন্ট পার হয়ে চামুর্চি রোড ধরে নিউ ডুয়ার্স চা বাগিচা প্রায় ৫ কিমি। সময় লাগল প্রায় ২০ মিনিট।
বানারহাট থেকে বানারহাট টি গার্ডেন ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে উত্তরদিকে চামুর্চি রোড ধরে ৩.০৭ কিমি গেলেই পলাশবাড়ি টি গার্ডেন। গাড়িতে সময় লাগে ১০ মিনিট। পলাশবাড়ি চা বাগিচা ঘিরে সবুজ পাহাড়ের বিস্তার। দূরে ঝকঝকে তুষারশুভ্র হিমালয়। আর আছে চা বাগানের শ্যামলিমা। ছোটো ছোটো চা গাছ ছাঁটা সুন্দর করে। দেখে নেওয়া যায় চা পাতা তোলার কাজ। রাতের চামুর্চি সহ নিউ ডুয়ার্স, পলাশবাড়ি চা বাগানগুলি অপরূপা। জ্যোৎস্নায় যখন ধুয়ে যায় চরাচর, তখন কানে আসে বহমান জলধারার কুলকুল শব্দ। অমাবস্যার রাতে যখন চাঁদ থাকবে না, ঝিকমিকে তারার দল আকাশের গায়ে শোভা পাবে হীরকসম। জঙ্গল থেকে শনশন বাতাস শরীর ছুঁয়ে যাবে। নিউ ডুয়ার্স, পলাশবাড়ি, চুনাভাটি ইত্যাদি বাগিচা এলাকার তিন কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে ডুয়াসের্র বিখ্যাত মিউজিক্যাল স্টোন কেভ। কথিত আছে, পাথুরে গুহার গায়ে পাথর দিয়ে আঘাত করলে বেজে ওঠে সপ্তসুর। সে এক বিরল ব্যাপার। চামুর্চি ইকো পার্কের পাশেই গারুচিরা, কালাপানি এবং রেতির জঙ্গল রয়েছে। হাতির পাল, চিতাবাঘ, বাইসন প্রায়ই সেখানে দেখা যায়। সেই দিক থেকে এই চা বাগান ঘেরা অঞ্চলটি ইকো পর্যটন প্রকল্পের আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে যা হবতে পারে ডুয়ার্সের পর্যটন মানচিত্রে নতুন মুকুট। ধূপগুড়ি ব্লক এর পলাশবাড়ি টি গার্ডেন এর পরিচালক গোষ্ঠী পলাশবাড়ি টি কোম্পানি লিমিটেড ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ডিবিআইটিএ-এর সদস্যভুক্ত বর্তমান কোম্পানিতে ১৯৯৬ সাল থেকে গৌতম ব্যানার্জী ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসাবে বাগানটি দেখাশোনা করতেন। ২০০০ সাল থেকে ম্যানেজমেন্ট দেখাশোনা করতেন প্রকাশ শাহরিয়া, চন্দ্রপ্রকাশ শাহরিয়া, এবং মৃণাল কান্তি পাল যৌথ পার্টনারশিপের ভিত্তিতে। ২০০৫ সালে মনোজ ধাওয়ান, ২০০৭ সালে রঘুনাথপ্রসাদ কিন্ডোই, ২০২০ সালে শান্তনু শাহরিয়া এবং ২০২১ সালে নির্মলা শাহরিয়া বাগিচার ডিরেকটর হিসাবে তাঁদের কাজের দায়িত্ব বুঝে নেন।
বাগানে বর্তমানে ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৭ জন। কোম্পানির মালিক গৌতম ব্যানার্জি কলকাতার গল্ফ ক্লাব রোডে থাকেন এবং কলকাতাতেই কোম্পানির হেড অফিস অবস্থিত। বাগানে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন ৬ টি যেগুলি হল পিটিডব্লিউইউ, এনইউপিডব্লিউ, সিবিএমইউ, ডিসিবিডব্লিউইউ ইত্যাদি। জলপাইগুড়ির সদর মহকুমার অন্যতম সুন্দর এই চা বাগানটির আইন-শৃঙ্খলা বানারহাট থানার পক্ষ থেকে দেখাশোনা করা হয়। পলাশবাড়ি চা বাগানের আয়তন ৪২৬.০৬ হেক্টর, চাষযোগ্য আবাদি ক্ষেত্র বা গ্র্যান্ট এরিয়া ৩৫৭.৬৮ হেক্টর, আপরুটেড এবং রিপ্ল্যান্টেড এরিয়া ৫১.২১ হেক্টর। সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ৩৫৭.৬৮ হেক্টর এবং মোট চাষযোগ্য উৎপাদন ক্ষেত্র ৩৪৫.৮২ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ১৭০০ কেজি করে চা পাতা উৎপাদিত হয়। পলাশবাড়ী চা বাগিচায় গড়ে ২০ থেকে ২৫ লাখ কেজি কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয় যার থেকে গড়ে ৪-৫ লাখ কেজি তৈরি চা বাগিচার কারখানা থেকে উৎপাদিত হয়। অন্যান্য বাগান থেকে সংগ্রহ করা কাঁচা চা পাতা থেকে বাগানের কারখানাতে ১-২ লাখ কেজি পর্যন্ত তৈরি চা উৎপাদিত হয়। বাগিচায় নিজস্ব উদ্যোগে কোন প্যাকেট টি তৈরি করা হয় না। ব্লেন্ডিং চা-ও এই কোম্পানির পক্ষ থেকে বিপণন করা হয় না। পলাশবাড়ী চা বাগানে মোট গড়ে ৫-৬ লাখ কেজি ইনঅর্গানিক সিটিসি তৈরি চা উৎপাদিত হয় যার স্বাদে এবং গন্ধে বাজারে সুনাম আছে। পলাশবাড়ি চা বাগিচা এমজিএনআরই জিএস এর সুবিধা ভোগ করে না। ব্যাংক এর কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ নয়। বাগানটির লিজ হোল্ডার পলাশবাড়ী টি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। শুনলাম মাস খানেক আগেই বৃষ্টির অভাবে চা গাছের পাতা নেতিয়ে পড়েছিল। অতিবৃষ্টির জেরে বাড়ছে না চা পাতা, চিন্তায় বাগান। এখন অতিবৃষ্টির ভার সামলানোই দায় হয়ে পড়ছে। প্রবল বৃষ্টিতে রোদের দেখা না পেয়ে, চা পাতার বৃদ্ধি থমকে গিয়েছে। সে সঙ্গে দিন কয়েক আগে, বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় বাগানের মাটিও নরম হয়ে ধসে যাচ্ছে।
কথা বললাম চা বাগান পরিচালকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান টি অ্যাশোসিয়েশনের ডুয়ার্স শাখার চেয়ারম্যান জীবনচন্দ্র পাণ্ডের সঙ্গে। জানলাম এ বছর আবহাওয়ার খামখেয়ালে চা পাতায় চরম ক্ষতি হয়েছে। প্রথম ফ্লাশের সময় থেকে আবহাওয়ার সঙ্গে লড়তে হয়ছে। দ্বিতীয় ফ্লাশের শুরুতে তাপমাত্রা অত্যন্ত চড়া ছিল। তখন আবার বৃষ্টি প্রবল। সবেতেই ক্ষতি হয়েছিল চা উৎপাদনের। জুন-জুলাই মাসে দ্বিতীয় ‘ফ্লাশ’-এর চা পাতা মেলে। এই সময়ে প্রতি বছরই উত্তরবঙ্গে বৃষ্টি থাকে। এই সময়ে রোদ-বৃষ্টি উভয়ই প্রয়োজন চায়ের বৃদ্ধিতে। তবে দুটোর কোনওটা এক টানা হলে, চা গাছের বৃদ্ধি থেমে যায়। জুনের শুরুতে এ বার বৃষ্টি দেখেনি উত্তরবঙ্গ। চরম তাপপ্রবাহে চা পাতা গাছেই ঝলসে গিয়েছিল। তাতেই কমেছিল উৎপাদন। জুনের মাঝামাঝি আবহাওয়ায় ভারসাম্য ফিরলেও, তার পরে এবং জুলাইয়ের শুরু থেকে টানা বৃষ্টিতে ফের বির্পর্যস্ত চা উৎপাদন। অন্তত ৩০ শতাংশ উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল জুলাইয়ে এবং সেটাই বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়। অতিবৃষ্টির ফলে চা পাতার গুণমান ভাল হয় নি। তা মেনেও নিয়েছিলেন চা উৎপাদকেরা। সে কারণে কাঁচা পাতার দামও পড়েছে। এক কেজি কাঁচা পাতার দাম এসে ঠেকেছে ১২ থেকে ১৩ টাকা দরে। তার পরেও কাঁচা পাতা থেকে জল বাদ দেওয়া হয়। তার পরে দাম এসে কেজি প্রতি আট থেকে ন’টাকায় নেমেছিল। অতিবৃষ্টির কারণে উৎপাদনও কমেছে। টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’র সচিব সুমিত ঘোষের কথাতেও একই অভিব্যাক্তি। জানালেন, “একে অতিবৃষ্টিতে ভাঙন, তার উপরে পাতার উৎপাদন কম— দু’ভাবেই চা বাগানে বিপদ বাড়ছে।” জলপাইগুড়িতে দেখা হল ছোট চা বাগানের সর্বভারতীয় সংগঠনের সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তীর সঙ্গে। তাঁর অভিযোগ, “সবচেয়ে বিপদে ছোট চা বাগান। চা পাতার দাম পাওয়া যাচ্ছে না”।
তরাই এবং ডুয়ার্সের বেশ কিছু চা বাগানে প্রবল ভাঙন দেখা দিয়েছে। মরসুম শুরুর পরে, এখনও পর্যন্ত চা বাগানের পিছু ছাড়েনি সঙ্কট। চা মহল্লার অভিজ্ঞদের দাবি, এ বছরে একের পরে এক দুর্যোগ এসেছে চা শিল্পে। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৬৪৮ জন এবং মোট জনসংখ্যা ৩৫০০ জন। স্থায়ী শ্রমিক ৭১২। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী শ্রমিক সংখ্যা ছিল ১৬০ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৭৭ জন, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক সংখ্যা ৩৩ জন, কম্পিউটার অপারেটর একজন। সর্বমোট সাব স্টাফের সংখ্যা ৭৩ জন। টেকনিক্যাল স্টাফ ২১ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ৯১৭ জন এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ২৫৮৩ জন। পলাশবাড়ী চা বাগানে একটা হাসপাতাল এবং একটা ডিসপেনসরি রয়েছে। মেল ওয়ার্ড পাঁচটি, ফিমেল ওয়ার্ড ছটা, আইসোলেশন ওয়ার্ড তিনটে এবং মেটারনিটি ওয়ার্ড আছে দুটো। বাগানে অপারেশন থিয়েটার নেই। অ্যাম্বুলেন্স আছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। ডাক্তার নেই। একজন করে মিড ওয়াইফ, কম্পাউন্ডার এবং স্বাস্থ্য সহযোগী আছে। বাগানে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ করা হয়। অসুস্থ হলে বাগিচার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সরাসরি ভর্তির ব্যবস্থা আছে। রোগীরা সুষম এবং উন্নত কোয়ালিটির খাবার পায়। ২০১২ সাল থেকে বাগিচাতে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। অস্থায়ী ক্রেশ একটা। অ্যাটেনডেন্ট ২ জন। গড়ে বছরে ৪৫ লক্ষ টাকা পি এফ বাবদ দেওয়া হয়। মজুরী, রেশন। জ্বালানি, ছাতা, চপ্পল, কম্বল নিয়মিত পায়। গড়ে বছরে ২০ জন শ্রমিক প্রায় পাঁচ লাখ টাকা গ্র্যাচুইটি বাবদ টাকা পায়। বোনাসের হার ২০ শতাংশ।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের সঙ্গে এলাম সামচি। সামচি বাজারে আমাকে নামিয়ে দিয়ে নিজস্ব কাজে চলে গেলেন। ভুটানে দেখলাম রাজনীতির দলাদলি নাই। পথঘাট খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভুটানিদের প্রিয় ড্রাগনের ছাপ সর্বত্র। ভুটানের সর্বত্র গুম্ফার ছড়াছড়ি। এখনো ভালো হোটেল বা লজ গড়ে ওঠেনি। সামচি রাজকীয় হাসপাতাল ছিমছাম গোছানো। চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনেই রয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ প্যাগাডা। স্বর্ণালি বর্ণের সুবিশাল বৌদ্ধমূর্তির পাদদেশে জ্বলছে শত শত আলোক দীপমালা। হাতের ছোঁয়ায় ঘুরতে থাকে কালচক্র। অচেনা পথ ধরে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি নদীর ধারে। কয়েকজন ভুটানি রমণী পিঠে মাল বোঝাই করে পাহাড় থেকে নেমে আসছে। নদীর পাড়ে পাথরের উপর চুপচাপ বসে থাকি। বেশিক্ষণ বসা যাবে না। হঠাৎ করে ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে সমস্যায় পড়ব। বলতে না বলতেই দু একফোঁটা জল গায়ে এসে পড়ল। প্রমাদ গুনে এসে দাঁড়াই একটা বাড়ির শেডের নিচে। চারিদিক ঝাপসা আঁধার। বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশে মেঘ ডাকছে গুড়গুড়। বাড়িটা জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার এক রিটায়ার্ড ভদ্রলোকের। ড্রইংরুমে বসতে বললেন। জার্নালিস্ট এবং লেখালেখির অভ্যাস আছে শুনে গল্পের ফোয়ারা ছোটালেন। আমাকে ভুটানি মদ অফার করলেন। আমি খাই না শুনে নিজে এক পেগ নিয়ে গল্প জুড়লেন। ভুটানি মদের প্রশংসা করলেন। আমাকে কিছু ভুটানি ডাকটিকিট এবং কিছু মুদ্রাও দিলেন। শুনলাম সামচি ডাকঘর থেকে সংগ্রহ করা যায় রং বেরঙের সব ডাকটিকিট। ডাকটিকিটের বৈচিত্র্যে ভুটানের নাম জগতজোড়া। ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইকো পার্কের আস্তানায়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴