চুনাভাটি চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
চুনাভাটি চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
ডুয়ার্সের পাঁচালী এবং গল্প শেষ হবার নয়। ডায়নার তীরে বানারহাট। নির্ভেজাল মফঃস্বল শহর। এই চত্বরেই গ্যাঁন্দ্রাপাড়া, তোতাপাড়া, লখীপাড়া, দেবপাড়ার মত ভালো ভালো বাগান আছে। বিন্নাগুড়ির দিকে আছে হলদিবাড়ি, তেলিপাড়া, বিন্নাগুড়ির মত ভালো বাগান। শীতের এক মেঘলা কুয়াশাভেজা সকালে চালসা থেকে নাগরাকাটা, গ্রাসমোর, ক্যারণ, লুকসান, রেডব্যাঙ্ক, ডায়না হয়ে বানারহাট চা বাগানের কাছে নেমে পড়লাম বাস থেকে। আজ যাব চামুর্চির কাছে চুনাভাটি চা বাগিচাতে। হাটবার। দেখলাম ভোরবেলাতেই দৈনিক কাগজ চলে এসেছে। ব্রডব্যান্ড, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, মোবাইল, বিউটি পার্লার হাতের মুঠোয়। পথের উপরে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে উকুন মারার ওষুধ আর সেইসঙ্গে মাইকে উচ্চনিনাদে ঘোষিত হচ্ছে আজকের খেলা রয়্যাল ভুটান। ডানদিকে ছোট দোকানে খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন। দেখলাম খবরের কাগজের মাথায় লিখে রাখা আছে বিভিন্ন চা বাগানের নাম। চা বাগানের লোকেরা বাগান থেকে এসে নিয়ে যায় কিংবা বাগানের গাড়িতে পাঠানো হয়। রহস্যময়ী, মোহময়ী, রোমাঞ্চে ভরা ডুয়ার্স। সেদিনের বানারহাট হারিয়ে গেছে। চেনা পথ যেন অচেনা। কু ঝিক ঝিক ট্রেনের শব্দ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী গগনে গগনে ছেয়ে যেত। এখনও পুরনো বানারহাটের গন্ধ অনুভব করা যায়। গেলাম স্টেশনে। শূন্য নিঝুম প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে দেখি ফাঁকা স্টেশন চত্বর। ছবি তুললাম দু একটা। মনে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চামুর্চি বাজারে কমলালেবুর আড়তে রাত্রিযাপন করে পরদিন শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে দেখতে গিয়েছিলাম পাকদণ্ডী, চড়াই, উৎরাই বেয়ে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চামূর্চী মহাকাল। এবারে আবার যাচ্ছি। আগামী পরশু এবারও যাব মহাকাল গুহাতে। এবারে এই যাত্রায় চুনাভাটি, নিউ ডুয়ার্স, কাঠালগুড়ি, রিয়াবাড়ি, পলাশবাড়ি হয়ে চামুর্চি সার্কিটের চা বাগানগুলিতে কাজ করব। তবে এই যাত্রায় পুণ্যার্জনের জন্য চামুর্চি মহাকালে সুহানা সফর। জয় বাবা মহাকাল।
আমার বুকিং চামুর্চি ইকো রিসর্টে । সরকারি ব্যবস্থা এখন বেসরকারি লীজে। খাওয়া-দাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। এরাই আমার সাইটসিয়িংয়ের ব্যবস্থা এবং মহাকাল গুহাতে নিয়ে যাবার ব্যাবস্থা করেছে। বর্ডার রোডের অদূরেই ডুয়ার্সের অন্যতম প্রাচীন চুনাভাটি এবং নিউ ডুয়ার্স চা বাগান। পলাশবাড়ি, নিউ ডুয়ার্স, চুনাভাটি, সামচি বাগানের পাশ দিয়ে প্রতিদিন বানারহাট থেকে চামুর্চি হয়ে ভুটানের সামসি পর্যন্ত বর্ডার রোড ধরে ভোর পাঁচটা থেকে অনেক রাত পর্যন্ত বালি পাথর বোঝাই ভারী লরি বা ট্রিপার চলাচল করে। গোটা এলাকা ধুলোর চাদরে ঢেকে থাকছে। ধুলোর জেরে দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। জানলাম পলাশবাড়ি, নিউ ডুয়ার্স, চুনাভাটি চা বাগানের দুই শতাধিক শ্রমিক চোখের রোগে আক্রান্ত। হাসপাতালে প্রতিনিয়ত ধুলো ঢুকছে। ঘরে ঘরে শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ দানা বেঁধেছে। শিশু-কিশোরদের অনেকের নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। ধুলোর জন্য তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না। এলাকার বাসিন্দারা নানারকম অসুখে আক্রান্ত। নাক-মুখ ঢেকে কোনোমতে শ্রমিকরা কাজে যাচ্ছে। লজের ম্যানেজারের কাছ থেকে জানলাম ওই রাস্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের আধিকারিকদের কাছে রাস্তাটি সংস্কারের দাবি জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ভুটানের দ্বারপ্রান্তে চামুর্চি গ্রাম। এসে পৌঁছলাম চামুর্চি ইকো পার্কে। চামুর্চি ইকো রিসর্ট দেবাশীষ চ্যাটার্জী ৯৪৩২৮৯১৪৪২ (এ ছাড়াও দূরভাষ ৯৫৯৩২০০৪৭৩ / ৯৫৯৩২০০৫৭০ / ৯৯০৩৪৯২০১৮) । কাছাকাছি রয়েছে চামুর্চি মহাকাল, মিউজিক্যাল স্টোন কেভ, গারুচিরা, কালাপানি, বিভিন্ন চা বাগান এবং ভুটানের সামচি। চামুর্চি ইকো পার্ক ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। এই পার্ক থেকেই ঘুরে আসা যায় ভুটানের সামসি বাজার সহ বিভিন্ন এলাকা। দেখলাম পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি হচ্ছে চামুর্চির ব্যবসাও। (ওয়েবসাইট chamurchiecoresort.com, ইমেল chamurchiecoresort@gmail.com.)
জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি ব্লক এর বানারহাট থানার অন্তর্গত চুনাভাটি চা বাগানটির পরিচালক গোষ্ঠী অ্যান্ড্রু ইউল অ্যান্ড কোম্পানি। বাগানে ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৩ জন। বাগানে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন ৬ টি। এগুলি হল সিবিএমইউ, পিটিডব্লিউইউ, ডিটিডিপিএলইউ, টিইএডব্লিউবি, টিডিপিডব্লিউইউ, এবং ডব্লিউবিসিএমএস। চুনাভাটি চা বাগানের আয়তন ৫৩৪.৩২ হেক্টর এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল সহ চাষযোগ্য আবাদি ক্ষেত্র ৪০১.০৮ হেক্টর। মোট উৎপাদনক্ষেত্র ৪০১.০৮ হেক্টর। সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়ার প্রতি হেক্টর জমি থেকে ১৫৭১ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। নাগরাকাটা ব্লকের চুনাভাটি চা বাগিচার বাৎসরিক গড় উৎপাদন ১৮-২০ লাখ কেজি কাঁচা চা পাতা। কাঁচা চা পাতা থেকে ফ্যাক্টরিতে প্রসেসিং এর পর গড়ে ৫-৭ লাখ কেজি তৈরি চা প্রস্তুত হয়ে বাজারে বিপণনের জন্য বস্তা বন্দী হয়। বাইরের বাগান থেকে কেনা কাঁচা চা পাতাতে বাগিচাতে আরো প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কেজি উন্নত মানের ইনঅর্গানিক সিটিসি তৈরি চা উৎপাদিত হয়। চুনাভাটি চা বাগানটির সাব স্টাফ সংখ্যা ৮৮ জন। করণিক ১৮ জন এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ০৮ জন। বাগানের শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ১১৩০। মোট জনসংখ্যা ৫৬৪৯। স্থায়ী শ্রমিক ১০৬৬ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১১৮৬ এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৪৪৬৩ জন। চুনাভাটি চা বাগিচা এমজিএনআরইজিএস এর সুবিধা ভোগ করে না। ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অর্থাৎ অধুনা পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক এর কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। বাগানটির লিজ হোল্ডার চুনাভাটি টি এস্টেট। প্রাথমিক সমীক্ষা করে ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। কারণ ম্যানেজার বা ডাক্তারবাবু ছুটির দিন বলে সবাই প্রায় বাইরে গিয়েছিলেন। তাই তথ্য দেবার মত কেঊ ছিল না। রিসর্টের ম্যানেজারের কাছ থেকে শুনলাম চামুর্চির দুই রূপ। দিনের ও রাতের। সকালে মিঠে রোদ গায়ে মেখে পায়ে পায়ে ভুটান সীমান্তের সামসিতে যাওয়া যায়। সামসি ভুটানের অন্তর্গত। অলস জীবন দেখে ভালো লাগবে। মাটির সোঁদা গন্ধ ভালোবাসলে কিংবা একই সঙ্গে ঢেউ খেলানো পাহাড় আর মখমলে চা বাগানের ছবি পেতে ইচ্ছে করলে ডুয়ার্সের চামুর্চি হতে পারে যে কোন পর্যটকের আদর্শ গন্তব্য।
দেখলাম সুকৃতি নদীর পারে ক্যাম্পিং সাইট করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ট্রেকিং, রক ক্লাইম্বিং, কোয়াড বাইকিং (পাথুরে রাস্তা বা মরুভূমিতে ব্যবহার করা ছোট বাইক) করার ব্যবস্থার কথাও ভাবা হয়েছে। আর ভুটানে না গিয়েও সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে উপভোগ করার বাড়তি আকর্ষণ থাকছে। আর তা ছাড়া থাকছে সামচি এবং ভুটান পাহাড়ের ডলোমাইট কারখানা। বিন্দু ঝালং-এর মত অনুমতি পেলে সেখানেও পর্যটকদের ঘোরানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একদম চামূর্চি চা বাগান লাগোয়া চামূর্চি বাজারটা একটু ঘুরতে গেলাম। ঢুকলাম চামূর্চি বাজারে। অদূরে সামচি ভুটানের চেকপোস্ট। ওপারে ভুটান। বাসরাস্তা থেকে একটু হেঁটে বাজারের মধ্যে রেস্ট হাউস। নামেই বিশ্রাম নিবাস। ছোট কাঠের ঘর। পাশের ঘরে কমলালেবুর আড়ত। রাতভর হিসাব নিকাশ, প্যাকিং এইসব চলে সেখানে। শীতকালে আড়তে আড়তে কমলালেবুর স্তুপ। খড়ের গাদি এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের ঝুড়ি আর বাক্সে প্যাকিং হয় কমলালেবু। বাইরে ট্রাক রেডি থাকে। বোঝাই হয় আর দূর দূরান্তে চলে যায়। জমজমাট চামূর্চি বাজারে কমলার সিজনে মহাজন এবং ব্যাপারীরা দলে দলে যায় আর আসে। বাজারের কোন ছিরিছাঁদ নেই। যেমন নোংরা, তেমনি অস্বাস্থ্যকর। শীতকালে এইসবের মধ্যেই কমলালেবুতে মুখরিত থাকে চারিদিক। দিনভর ভুটান থেকে কমলা এনে জড়ো করা হয় চামুর্চি বাজারে। এখানে ট্রাকে করে লোড করা হয়। হাটবার নয় বলে চামূর্চি বাজারটা যেন ঝিমোচ্ছে। হাটবারে দোকানে দোকানে মাছির মত ভিড় লেগে থাকে। অন্যান্য দিন শুনশান। একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চা আর নিমকি খাই। সন্ধ্যে হয়ে এল। চামুর্চি বাজারে আর একটু চা খেয়ে সোজা ইকো পার্ক। ভেজ পকোড়া এবং কফি খেয়ে পরের দিনের প্রোগ্রাম ঠিক করে নিলাম। রাতে হলো ক্যাম্প ফায়ার। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের আবহ। অবশেষে বিছানা দখল।
চুনাভাটি চা-বাগিচাতে হাসপাতাল একটি। আউটওয়ার্ড ডিসপেন্সারি আছে। বাগিচাতে মেল ওয়ার্ড ছটা, ফিমেল ওয়ার্ড দশটা, আইসোলেশন ওয়ার্ড চারটা, মেটারনিটি ওয়ার্ড চারটা থাকলেও অপারেশন থিয়েটার নেই। অ্যাম্বুলেন্স আছে। গড়ে আশি জন রোগীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় অথবা ক্ষেত্রবিশেষে মহকুমা জেলা হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়ার পরিষেবা আছে। বহু বছর আগে যখন চুনাভাটিতে গিয়েছিলাম তখন বাগিচাতে ডক্টর আর এন চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমি যে আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম সেই আত্মীয়ের বাড়ির পাশেই চা বাগানের সেই ডাক্তারবাবু থাকতেন। এবারে গিয়ে তাঁকে পেলাম না। বাগিচাতে ট্রেন্ড নার্স, মিড ওয়াইফ, কম্পাউন্ডার এবং স্বাস্থ্য সহকর্মী একজন করে আছেন। চুনাভাটি চা-বাগিচায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ করা হয়। বাগিচার হাসপাতালে ভর্তি হলে উন্নত মানের ডায়েট চার্ট অনুযায়ী খাবার পরিবেশন করার ব্যবস্থা আছে। বাগিচার হাসপাতালে গড়ে বছরে কুড়িজন করে নারী শ্রমিক মেটারনিটি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। বাগিচাতে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার আছে। এর আগে যখন এসেছিলাম তখন যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল এস কে দাস। এবারে পরিচয় হলেও খুব একটা কথা বলতে চাইলেন না। চুনাভাটি চা বাগানে স্থায়ী ক্রেশের সংখ্যা একটি। অ্যাটেনডেন্ট তিন জন। পানীয় জল এবং শিশুদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা ক্রেশে আছে। চুনাভাটি চা বাগিচার পড়ুয়াদের বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ট্রাকের ব্যবস্থা আছে। বাগানে ক্লাব এবং শ্রমিকদের বিনোদনের জন্য খেলার মাঠও আছে। বাগিচা অফিস থেকে তথ্য পেলাম বছরে গড়ে ৬০-৭০ লাখ টাকা শ্রমিকদের প্রভিডেন্ড ফান্ড বাবদ খরচ হয়। বাগিচার শ্রমিকদের নিয়মিত সরকারি নিয়ম-নীতি মেনে গ্র্যাচুইটি প্রদান করা হয়। বছরে গড়ে ৫০ জন শ্রমিক গ্র্যাচুইটি পেয়ে থাকেন। চুনাভাটি চা-বাগিচায় মজুরি, রেশন, জ্বালানি, ছাতা, চপ্পল, ব্ল্যাঙ্কেট কোন কিছুই বকেয়া থাকে না। কুড়ি শতাংশ হারে প্রায় ১২০০ জন শ্রমিককে গড়ে প্রতিবছর বোনাস দেওয়া হয়। ম্যানেজারের সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম চা বাগিচায়। তাঁর সঙ্গে ঢুকলাম চা বাগানের ফ্যাক্টরীতে। দেখলাম চায়ের প্রসেসিং।
আগামীকাল রওনা হব মহাকালের পথে। মহাকালের মন্দিরের পূজারী বাজে (বয়স্ক) খুব ভালো মানুষ। প্রতিদিন চড়াই উতরাই ভেঙে আসা যাওয়া করেন। তিনি আমি সহ রিসর্টের কয়েকজনকে নিয়ে যাবেন মহাকাল মন্দির। সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই প্রাতঃকৃত্য সেরে রেডি হই। টুপি, মাফলার ব্যাগের মধ্যে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম বাজের জন্য। ঠিক পৌনে আটটায় বাজে চলে এল। বাজের সঙ্গে আমাদের শুরু হলো চরৈবেতি। বাজার এলাকা এবং বাড়িঘর ছাড়িয়ে আমরা ঢুকে গেলাম ভুটান সীমান্তে। ছোট্ট চৌকি পেতে বসে আছে সীমান্তের ভুটানি পুলিশ। একটা শুকনো ঝোরা পেরিয়ে আলপথ এবং মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকি। দূরে দেখা যাচ্ছে মহাকালের পাহাড় চূড়া। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর শুরু হলো জঙ্গল। পাহাড়ি পথ। আমরা সমতলের মানুষ। পাহাড়ে উঠতে হাঁপ ধরে। বাজের ভেলকি দেখার মত। পায়ে যেন চাকা লাগানো। তরতর করে হাঁটছেন। আমরা ওঁকে ধরবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। অরণ্যবেষ্টিত পথ ভীষণ নির্জন হয়ে এলো। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াই বুনো ফুলের শোভা দেখার জন্য। ঝোপেঝাড়ে, লতায়-পাতায় বিচিত্র বর্ণের ফুল ফুটেছে। মাঝে মাঝে জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে নীল পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে। মানুষজনের সাড়াশব্দ নেই। আমরা তিনজনই মহাকালের যাত্রী। দম নেবার জন্য কখনো কখনো পাথরের ওপর একটু বসে আবার বিশ্রাম করছি। ভীষণ নির্জন। মাঝে মাঝে পাহাড়ি নদীর সঙ্গে দেখা হয়, আবার তারা অদৃশ্য হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের মাথায় চলে এসেছি। একটা ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আশেপাশের ল্যান্ডস্কেপ দেখি। পাহাড়ের গায়ে চাষ আবাদ চলছে। ধান, ভুট্টা, নানারকম শাক সবজির খেত। দূরে দূরে গ্রাম, বস্তি। ছোট ছোট ঘরবাড়ি। দূর থেকে দেখে মনে হয় পাহাড়। এই পাহাড়ি বাড়িগুলিতে নেপালি পরিবার বাস করছে। ওরা আছে ওদের মতন। খুবই শ্রদ্ধা ভক্তি করে বাজেকে।
বাজে আমাদের নিয়ে গেল একটা পরিবারে। অল্পবয়সী একটা মেয়ে এক বাটি নুন, মশলা মেশানো লাল চা নিয়ে এলো। লাজুক স্বভাবের মেয়েটা আমাদের দেখে কি ভাবছে কে জানে। জলপাইগুড়ি থেকে চলে এসেছি শুনে অবাক। শিলিগুড়ির নাম শুনেছে। সে জানে সেটা বিরাট শহর। কিন্তু সে বেড়াতে আসেনি। প্রায় আধঘণ্টা গ্রামে বিশ্রাম করে আবার হাঁটতে শুরু করি। আর কত দূর? আর কতখানি হাঁটতে হবে? কোমর ধরে আসছে। টন টন করছে। লজ্জার মাথা খেয়ে বাজের কাছে জানতে চাই। বাজে হাত দিয়ে পাহাড়ের মাথা দেখিয়ে দিল। একটা ডুমুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বাজে বলল ওই পাহাড়ের মাথায় উঠতে হবে। নেপালী গ্রাম থেকে আবার চড়াই উতরাই পথ বেয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে থাকি। চারিদিকে গাছপালায় এত ঢাকা যে সকালবেলাতেই কেমন স্যাঁতস্যাঁতে। রোদ্দুর ঢোকার পথ বন্ধ। হাঁপাতে হাঁপাতে এগোতে থাকি। বুকটা হাঁপড়ের মত ওঠানামা করছে। বাজে বলল ওই দেখা যাচ্ছে মন্দির। জনমানবহীন, নির্জন পরিবেশ। মন্দিরের চারপাশে ছোট বড় পতাকা উড়ছে। মন্দিরের গায়ে পাথরের উপরে বসে পড়ি। ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যায়। বাজে আগুন জ্বালিয়ে পূজা পাঠ শুরু করল। আমরা পূজা দিলাম, মন্ত্র পাঠ করালেন বাজে মহাশয়। এবারে মন্দির থেকে আমরা এগিয়ে যাই গুহার দিকে। বাজে আমাদের পথ প্রদর্শক। ছোট টর্চ নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। গুহা দিয়ে ঝুলছে স্ট্যালাগমাইটের অজস্র শিলাখন্ড। জয়ন্তী পাহাড় এর মত চামূর্চি মহাকালেও শিবের জটা ঝালরের মত ঝুলছে। এসবই নাকি শিবের জটা। দম বন্ধ হয়ে আসে। ভয় ভয় করছিল। মহাকাল বাবা কি জয় বলে বেড়িয়ে আসি। রুদ্রাক্ষের গাছের নিচে বসে একটু বিশ্রাম করে নিচে নামতে থাকি বাজের সঙ্গে। চামূর্চি বাজারে ফিরতে ফিরতে দুপুর। বাজেকে দক্ষিণা দিয়ে দোকানে বসে একটু চা খেয়ে নি। সর্বাঙ্গে ব্যথা। এবার বাড়ির পানে। ঘন্টাখানেক বাদে রওনা দিই বানারহাট হয়ে জলপাইগুড়ি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴