বানারহাট চা বাগিচা ( দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
বানারহাট চা বাগিচা ( দ্বিতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
-------------------------------------------
বড়ই অসামান্য আমাদের এই ডুয়ার্স। বড়ই রূপসী এই সবুজ গালিচার দেশ। অসাধারণ এই দেশের মানুষজনের আর্থ- সামাজিক জীবনযাত্রা। বানারহাট সার্কিটের বাগানগুলি নিয়ে কাজ শুরু করার আগে এই বিশাল সবুজ গালিচার কিছু আর্থ-সামাজিক ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন। প্রথমে শুরু করি মুখার্জীবাবুর কথা দিয়ে। ধরে নিতে হবে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের কোন এক সময়কালে এই বাগিচা সফর। ১৯৬৩ সালের ৭ ই মে ডুয়ার্সে অবতরণ করেছিলেন অলোক মুখার্জী। মনে রাখতে হবে কলকাতা থেকে ডুয়ার্স হয়ে উচ্চ আসাম পর্যন্ত রেলযাত্রায় তখন প্রায় তিন দিন সময় লাগত। পুরানো দিনের যাত্রীদের কাছে পাফিং ট্রেনে এই দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর ভ্রমণটি অবশ্যই ছিল শিহরণ জাগানোর মতো। 'জয়নিং অ্যালাউন্স'-এর পাশাপাশি নতুন নিয়োগকর্তারা অলকবাবুকে তাই দিয়েছিলেন দমদম এরোড্রোম থেকে উড্ডয়নের জন্য একটি এয়ার টিকিট। সপ্তাহে তিন দিন ভোর ৪ টা নাগাদ উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের উদ্দেশে উড়ে যেত বিমান। সেই সময় ভারতে প্রাইভেট এভিয়েশনের প্রথম দিকের বিমান পরিসেবা উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছিল। জেমস বি মাফ এবং এডি কুইন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চায়না ন্যাশনাল এয়ারলাইন কর্পোরেশন (সিএনএসি) এর সাথে ছিলেন এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই ভারতে আসেন। এখানে তারা নওয়ানগরের জামসাহেবের সাথে দেখা করে অংশীদারিত্বে কয়েকটি ডগলাস সি-৪৭ এয়ারক্রাফ্ট ক্রয় করে 'জামাইর' গঠন করে। কিংবদন্তি সি ৪৭ এস 'ডাকোটা' নামে পরিচিত এবং সামরিক ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত সফল ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সি-৪৭ লোভনীয় এবং আকর্ষণীয় দামে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছিল। তাদের ক্রমবর্ধমান খ্যাতি এবং উড়ানের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর-পূর্বে। জামাইরের বিমান পরিষেবাগুলি কলকাতার চা সম্প্রদায়ের ম্যানেজার বা উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা ট্রেনের বিকল্প হিসাবে বিমানপথ ব্যাবহার করত। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়কালে অনেক সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় বিমান সংস্থাটির গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
সেই সময়ে দমদম এরোড্রোমে হ্যাঙ্গারে বিমানগুলি পার্ক করা থাকত। নিরাপত্তা চেকিং এর কোন অস্তিত্ব ছিল না। হাইজ্যাক এবং মানব-বোমার কথা তখনও শোনা যায়নি। জীবন সহজ সরল ছিল। অলকের লেখা ডাইরী থেকে জানলাম “ট্যাক্সির হেডলাইট দেখে একজন বিহারী চৌকিদার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে চিরাচরিত ‘সালাম’ দিয়ে নিচুতে ঝুলে থাকা গেটটা খুলে দিল”। পকেটে এয়ার টিকিট নিয়ে প্রবেশ করলেন অলক। দূর থেকে অলোক জামাইরের উজ্জ্বল আলোকিত হ্যাঙ্গারটি দেখতে পেয়ে এটির দিকে এগিয়ে গেলেন। ভিতরে একটি ভিনটেজ ডাকোটা অপেক্ষা করছিল। অলোক লিখেছেন “৩-৩০ এর ঠিক পরেই দ্য স্টেটসম্যানের 'ডাক-এডিশন'-এর বান্ডিল, মেইল ব্যাগ, যন্ত্রপাতির যন্ত্রাংশের ক্রেট, কোল্ড স্টোরের কার্টন এবং অন্যান্য বহুবিধ জিনিস কেবিনে লোড করা হল। সৌভাগ্যবশত সেখানে কোনো গবাদিপশু ছিল না। বিমানের বাতিল আসনগুলি হয় কেবিনের মেঝেতে ফোল্ড করা হয়েছিল বা সম্পূর্ণ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল এবং অপেক্ষারত যাত্রীদের জন্য একটি অস্থায়ী আসন হ্যাঙ্গারে রেখে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে কেবলমাত্র একজন অন্য ব্যক্তি অপেক্ষা করছিলেন তালিকাহীনভাবে বোর্ডের জন্য”। যুদ্ধের বিমানে চায়ের অজানা দেশে উড্ডয়নের প্রত্যাশায় অলকের মনের মধ্যে দুঃসাহসিক অনুভূতি জাগছিল। পাইলট ভোর চারটার ঠিক আগে এসে পড়লেন। পাইলট এবং যাত্রীরা একসাথে বিমানের কেবিনে প্রবেশ করলেন। সমস্ত বৈচিত্র্যময় পণ্যদ্রব্যের তীব্রতার একটি মৃদু গন্ধ অলককে স্বাগত জানাল। অলক দেখলেন খালি ধাতব মেঝে প্রায় পুরোটাই আটকানো জিনিসপত্র দ্বারা দখলীকৃত। কেবিন ক্রু ছিল না। পাইলট ককপিটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কয়েকটা বাজে কম্বল হাতে তুলে রাখার পরামর্শ দিয়ে পাইলট বললেন এদের প্রয়োজন হতে পারে। একটি তীব্র বিদেশী গন্ধ অলকের ঘ্রানেন্দ্রিয় প্রবলভাবে আক্রমণ করছিল।
সবেমাত্র অলক সহ সহযাত্রীরা তাদের জন্য নির্দিষ্ট সিটে বসেছেন, ঠিক তখন দুটি প্রপেলার ইঞ্জিন প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। পুরানো ডাকোটা সামনের দিকে গড়ালো এবং টেক অফের জন্য দ্রুত পজিশন নিল। পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে গন্তব্যের জন্য উত্তরে কম্পাস সেট করে তারা ভরা আকাশের নীল শূন্যে উড়লেন। দুটি ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে শুনতে পাড়ি দিলেন ডুয়ার্সের উদ্দেশ্যে। একটু পরে ফ্লাইটে অলক ঠান্ডা অনুভব করতে লাগলেন এবং চারপাশে তাকিয়ে এর কারণ খুঁজতে লাগলেন। ঠাণ্ডা বাতাস জয়েন্টগুলির সরু ফাঁক দিয়ে কেবিনে অবাধে প্রবাহিত হচ্ছিল। অলক তার চারপাশে কম্বল জড়িয়ে নিলেন। কিছুটা সুরক্ষা দেওয়ার জন্য নীরবে পাইলটকে ধন্যবাদ জানালেন। তিন ঘন্টার মধ্যে তারা উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলের উপর দিয়ে উড়তে শুরু করলেন এবং অলকের গন্তব্য এয়ারফিল্ড গ্রাসমোরে অবতরণের প্রস্তুতি নিলেন। তখন ভোরের সূর্য আকাশ আলোকিত করে দিয়েছে। ভোরের আলোর কুয়াশা ভেদ করে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন সমতলের চা ঝোপের ঝরঝরে সারি লম্বা গাছের ছায়া কাছে আসছে। একটি অল্পবয়স্ক ছেলে বিমানের অবতরণের পথে তার গবাদি পশুর পালকে উন্মত্তভাবে ছোটাচ্ছিল। অলক কিছুটা উদ্বেগের সাথে বুঝতে পারছিলেন যে সেখানে কোন টারমাক নেই এবং ভয়াবহ ঝাকুনির জন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। যদিও উদ্বেগের কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ পাইলটের মত অভিজ্ঞ সৈনিকের সাথে সাথে পুরানো ডাকোটাও আত্মবিশ্বাসের সাথে তার সুনাম এবং ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছিল। সমানভাবে কাটা ঘাসের মাঠে মসৃণ স্পর্শ ঘটিয়ে বিমান অবতরণ করল। নীরবে পাইলটকে কয়েক ঘন্টা একসাথে থাকার জন্য দ্বিতীয়বার ধন্যবাদ জানালেন অলক। বিমানের ইঞ্জিনটি শেষ পর্যন্ত থেমে যাওয়ার সাথে সাথে একটা অদ্ভূত নীরবতা সকলকে গ্রাস করল। কেবিনের দরজাটা জোরে খুলে গেল এবং উজ্জ্বল এবং পরিষ্কার রোদে স্নান করা সকালে অলক পা রাখলেন তার প্রথম কর্মসাধনার মাতৃভূমি ডুয়ার্সের মাটিতে।
সামনে ভোরের শীতল বাতাসে একটি কালো এবং সাদা উইন্ডসক মৃদুভাবে উড়ছিল। এয়ারফিল্ডের এক কোণে একটি বড় টিনের চালা ছিল যা ছিল জামাইরের গোডাউন। কয়েকটি চা বাগানের লরি পাশাপাশি পার্ক করা ছিল। সম্ভবত বিমানে আনা মাল সংগ্রহ করার জন্য। একটি স্পোর্টস 'স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড' গাড়ি কাছাকাছি পার্ক করা ছিল। সাদা শর্টস এবং একটি খোলা গলার শার্ট পড়ে অন্য একজন গাড়িটির দিকে ঝুঁকে কি যেন করছিল। সামনে দাঁড়িয়ে ছিল হাফপ্যান্ট পরা একটি প্ল্যান্টার। পরে শুনেছিলেন তিনি বানারহাট টি এস্টেটের অন্য সহকারী ম্যানেজার। তিনি অপেক্ষা করছিলেন অলকের জন্যেই। পরিচয়ের পর অলকের স্বল্প মালপত্র ড্রাইভার তার নতুন সাদা স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড মোটর গাড়িতে নিয়ে নিল এবং দুপাশে চায়ের ঝোপের মাঝখান দিয়ে একটি সরু ময়লা ট্র্যাক ধরে তারা রওনা দিলেন বানারহাটের দিকে। অলক জানতে পারলেন তারা গ্রাসমোর টি এস্টেটের মধ্য দিয়ে গাড়িতে যাচ্ছেন। অলকের নিয়োগকর্তাদের মালিকানাধীন পাঁচটি বাগানের মধ্যে একটি দ্য ডুয়ার্স টি কোম্পানি। এই এয়ারফিল্ডের জমিটি ছিল গ্রাসমোরের। অলকের পিছনে পুরানো ডাকোটা গর্জন করে উঠে তেলিপাড়া এবং তারপরে ডুয়ার্স অঞ্চলের সুদূর নিউল্যান্ডসের দিকে তার যাত্রা শুরু করার ইঙ্গিত দিল। আসলে প্রকৃতি আর মানুষ এই দুয়ে মিলে ডুয়ার্সের প্রাণবন্ত চিত্রময় রূপ। ডুয়ার্সের অনুপম সৌন্দর্যের যেমন আকর্ষণ, তেমনি এই জনপদের মানুষজন প্রাণখোলা, দিলদরাজ আর অতিথিবৎসল।'ডুয়ার্স' নামটি 'দুয়ার' বা দরজা শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এই দুর্দান্ত প্রাকৃতিক শোভায় পরিপূর্ণ অঞ্চল 'হিমালয়ের প্রবেশদ্বার' হিসাবে বর্ণিত ছিল। আজ সেই ডুয়ার্সের অন্যতম সমৃদ্ধ একটি জনপদ বানারহাট এসে পৌছলাম।
বানারহাটের প্রখ্যাত চিকিৎসক ডঃ পার্থপ্রতিমের অসাধারণ আত্মজীবনী “একলা মানুষ, অনেক আকাশ” থেকে পুরণো দিনের বানারহাট সম্পর্কে পেলাম বহুবিধ তথ্য। চারদিকে সবুজ চা বাগিচা আর অরণ্য-বনানী। তারই মাঝে ছোট্ট জনপদ বানারহাট। চা-বাগিচা আর রেলস্টেশন ঘিরে গড়ে ওঠা জনবসতি। রেলের কোয়ার্টারগুলি ইংরেজ আমলের। ঘরগুলি লাল ইটের, মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে। ঘন্টা পড়ত ঢং-ঢং-ঢং। আসত বাষ্পচালিত রেলের ইঞ্জিন সহ প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কামরাগুলি। কয়লার ধোঁয়া ছাড়ত। তারপর কু-উ-উ-ঝিক্-ঝিক্। কয়লার গনগনে উনুনের ওপর থাকত ঢাউস বেলনাকার বয়লার। সেই চলমান উনুন বয়লার টেনে নিয়ে যেত বগিগুলিকে। ডিজেল ইঞ্জিন তখন নেই বললেই চলে। ট্রেনের যাত্রায় গেলে সঙ্গে রুমাল আবশ্যক ছিল। জানলার কাছে বসে থাকা যাত্রীদের চোখে ঢুকে যেত কয়লার কণা। সেগুলি আলতোভাবে বের করতে হত চোখ থেকে। পোকামাকড়, সাপ-খোপের হাত থেকে বাঁচার জন্য ডুয়ার্সের এই রেল স্টেশন তখন ছিল অন্যরকম। শিলিগুড়ি জংশন থেকে আসা মিটারগেজ ট্রেনে চা-বাগিচার কোলে ছোট সুন্দর বানারহাট রেল স্টেশন তখন প্রাণচঞ্চল ছিল। বিহারের কাটিহার থেকে মাছ, লিচু আসত ট্রেনে চেপে। কমলালেবু, চা, ডলোমাইট পাড়ি জমাত দূর দেশে। বানারহাটের জীবন ছিল আর দশটা মফস্বল শহরের মতোই সহজ সরল। মূলত ওপার বাংলা থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষের নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে বানারহাট জনপদের সৃষ্টি। তার সঙ্গে ছোটনাগপুর এবং নেপাল থেকে আগত মদেশিয়া এবং নেপালী শ্রমিক এই নিয়ে বানারহাটের চা বাগিচাকেন্দ্রিক জনজীবন। পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে জনপদ, পল্লী, সংঘ, গ্রন্থাগার, স্কুল।
সে সময় চা বাগানে শ্রমিকদের মনোরঞ্জনের জন্য মাঝেমধ্যে বিনাপয়সায় সিনেমা দেখানো হতো। মাঠের মাঝে দুটি বাঁশ পুঁতে টাঙানো হত সাদা পর্দা, তাতে প্রোজেকটার দিয়ে দেখানো হত ছবি। একটা সিনেমায় চার পাঁচবার ইন্টারভেল। আশেপাশের বাগানে সিনেমা হবে খবর পেলেই মাঠে চা শ্রমিক পরিবারের সঙ্গে চটি পেতে বসে যেত শিশু কিশোরেরা সিনেমা দেখতে। সিনেমা দেখা তখন মধ্যবিত্তের উচ্চমার্গের বিনোদন। উত্তমকুমার, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যালের বই এলে বাগান থেকে গাড়ি আসত। ইন্টারভ্যালে দেখা হত বিভিন্ন বাগানবাবু-মাইজির সঙ্গে। ব্যাপারটা রি-ইউনিয়নের মতো। শ্রমিকদের মনোরঞ্জনের জন্য হিন্দি সিনেমা দেখানো হত বাগানে। পয়সা দিত মালিকপক্ষ। বাগানের খেলার মাঠে দুটি বাঁশ পুঁতে বিকালে টাঙানো হত পর্দা। মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে যেত। সন্ধ্যা নামার পর শুরু হত সিনেমা। প্রজেক্টার এনে, রিল এনে ব্যবসা করত কেউ কেউ। এক রিল দেখানো হলে তারপর প্রোজেকশন থামিয়ে পরবর্তী রিল লাগিয়ে আবার শো চালু হত। একটি সিনেমায় ৮-১০ বার ইন্টারভ্যাল হত। ডায়নার তীরে বানারহাট। বর্ষা রাতের শেষে চা-বাগিচার সবুজ গালিচায় আছড়ে পড়া সোনা রোদের আভা, অদূরেই মাথা তোলা হিমালয়, যৌবনমদে মত্ত পাগলা ঝোরা, অলস পায়ে হেঁটে চলা বুনো হাতির দল। ডুয়ার্সের নাগরাকাটা - বানারহাট। সে সময় ব্রডগেজ লাইনের রমরমা ছিল না। বেশিরভাগ জায়গাতে যেতে হত মিটারগেজে চড়ে। কমলালেবু, চা, ডলোমাইট পাড়ি জমাত দূর দেশে। বাস-ট্যাক্সি তখন হাতগুনতি। সাধারণ জনবসতি গড়ে উঠেছিল রেলস্টেশন ঘিরেই। আর চারপাশে সবুজ সবুজ গালিচার চা-বাগান। এ সবই পরিচিত ল্যান্ডস্কেপ। তবে এ সবের বাইরেও বানারহাটে রয়েছে আরও বহু আকর্ষণ। যা শুধু ভ্রমণবিলাসীদের নয়, ছা-পোষারও মন কেড়ে নেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই ক্রম পরিবর্তনশীল।
বহুবার এসেছি বানারহাটে বা বানারহাটকে কেন্দ্র করে আশেপাশের চা বাগান বা গঞ্জ শহরে। সাংসারিক চাপ এবং অন্য ব্যাস্ততার কারণে ইদানীং আসা হয় খুবই কম। সেবারেও এক রবিবারের সকালে জলপাইগুড়ির বাস থেকে নেমে এলাম বানারহাট এর চা আড্ডায়। তখন সবেমাত্র বানারহাট ব্লক ঘোষণা হয়েছে। আড্ডা দেখলাম বানারহাটের উন্নয়ন অনুন্নয়ন নিয়ে সরগরম। সুকল্যাণের কাছ থেকে শুনলাম ২৭ টি চা বাগিচার কেন্দ্রবিন্দু জলপাইগুড়ি জেলার বানারহাটের লোকসংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার যার মধ্যে ৫২ শতাংশ তফসিলী উপজাতি ও ২৩ শতাংশ তফসিলী জাতির মানুষ। চা বাগিচাগুলিতেও রয়েছে পঞ্চায়েতি ব্যাবস্থা। কিন্তু চিকিৎসা, শিক্ষা, কেনাবেচা প্রায় সব বিষয়েই চা-কর্মীরা বানারহাটের উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে তুঙ্গে হলো জলের সংকট। বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য ব্যবহারযোগ্য জলের স্তর ভূ-পৃষ্ঠের ২৭৫ থেকে ৩০০ ফুট নিচুতে। এই পাহাড়ি পাথুরে অঞ্চলে সরকারি গভীর নলকূপ ছাড়া আর কোন জলের উৎস নেই। দৈনিক সরবরাহ মাত্রা মাথাপিছু ১১.৬ লিটার। ২০ হাজার লোকের পানীয় জলের সংকট আরও মারাত্মক আকার নেয় যখন বিদ্যুৎ গোলযোগের জন্য পাম্প অচল হয়ে পড়ে। আগে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হলে জিজেল পাম্প চালান হতো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ডিজেল পাম্পের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বৈদ্যুতিক পাম্পই এখন একমাত্র ভরসা। অবিলম্বে জলের আরও একটি বিকল্প-উৎস তৈরি করা দরকার। স্মৃতিমেদুরতা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বানারহাটে একসময় ভীষণ জলের কষ্ট ছিল। এক টাকার বিনিময়ে এক টিন জল সংগ্রহ করতে হত। এখন কিন্তু বিস্তর জল অপচয়ও হয়। অনেকের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিল সুকল্যাণ। বানারহাট হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক। একজন প্রকৃত শিক্ষক বলতে যা বোঝানো যায় সুকল্যাণ হচ্ছে সেই ঘরানার।
অনেকে প্রশ্ন করেন কিসের টানে বানারহাটে বারংবার ছুটে ছুটে আসি? আসলে দেখার জন্য চাই অনুভবের জগত। প্রকৃতিকে ভালোবাসা। তুচ্ছতার মধ্যে এবং শিশির বিন্দুর মাঝে লুকিয়ে থাকে অসামান্য সৌন্দর্য। ধামসা মাদলের শব্দ, চা শ্রমিকদের গান, চা বাগিচার সমাজ জীবন, বানারহাটের কাব্য কবিতার সমাহার, শীতের নিঝুম সন্ধ্যাতে জোনাকি পোকার ফুলঝুরি, মরাঘাটের জঙ্গল, মোগলহাটার হাট, চা বাগানের ভিতরে পুরোনো ঢিবি, কালীমন্দির, ঝরা বকুল গাছ, মানুষজন, পাখির কুজন, নীল আকাশ সবই আগের মতো আছে। আমি অবাক হয়ে ভাবি যোগাযোগ ব্যবস্থা বা দূরভাষের রমরমা ছিল না। তাহলে সাহিত্য-সংস্কৃতি কিভাবে এই মফস্বল শহরে ছোঁয়াচে ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে? একবার দূর্গাপুজোয় এসেছিলাম বানারহাট। মেলায় চড়কিপাক খেয়েছিলাম। দেখেছিলাম নেপালি, ভুটিয়া, আদিবাসী বাঙ্গালীদের বেচাকেনার ভিড়। সন্ধ্যায় দল বেঁধে নদীতে প্রতিমা নিরঞ্জন দেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চামুর্চি বাজারে কমলালেবুর আড়তে রাত্রিযাপন করে পরদিন প্রভাতে পাকদন্ডী দিয়ে চড়াই উতরাই ভেঙে ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দেখতে যাই চামুর্চি মহাকাল। রহস্যময়ী, মোহময়ী, রোমাঞ্চে ভরা ডুয়ার্স। সেদিনের বানারহাট হারিয়ে গেছে। চেনা পথ যেন অচেনা। কু ঝিক ঝিক ট্রেনের শব্দ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে ছেয়ে যেত। চা-বাগিচার বন্দরগুলিতে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে স্কুল, সিনেমা হল, দোকানপাট। সপ্তাহে এক দিন হাট বসত। চলত সপ্তাহিক কেনাকাটা। নেপালিদের দাপট কম, আদিবাসী মানুষের সংখ্যাই ছিল বেশি। ডাকা হত মদেশিয়া নামে। এখনও ডাকা হয়। এখনও পুরণো বানারহাটের গন্ধ অনুভব করা যায়। মধ্য দুপুরে একাকী শূন্য নিঝুম প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে দেখি ফাঁকা স্টেশন চত্বর। রওনা দিলাম ক্ষেত্রসমীক্ষায় বানারহাট চা বাগিচাতে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴