বানারহাট চা বাগিচা ( প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
বানারহাট চা বাগিচা ( প্রথম পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
------------------------------------
বড়ই অদ্ভূত লাগে বাগিচা সফরে এসে। এই যে একরের পর একর সবুজ গালিচা, অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, বহু অজানা ইতিহাস রন্ধ্রে রন্ধ্রে ডুয়ার্সের সবুজ গালিচাকে ঘিরে, অথচ অনেকের কোন আগ্রহ নেই এই ইতিহাসকে জানার, চেনার বোঝার। চায়ের কাপে কত যে চোখের জল লুকিয়ে আছে তা কি জলপাইগুড়িতে, শিলিগুড়িতে, কোচবিহারে যে সব নব্য চা-সেবনকারীরা এলাইচি টি, মশল্লা টি, মালাই টি, কেশর টি সেবন করছেন গুচ্ছের রেস্ত খরচ করে সেটা বোঝার চেষ্টা করেন? জানি না, হয়তো এই লেখা পড়ে তারা রে রে করে উঠবেন। আমরা আমাদের পয়সাতে বিনোদন করছি, তুমি বাপু জ্ঞান দেবার কে হে? তখন শতেক চেষ্টা করলেও বোঝানো যাবে না সত্যি সত্যি তারা ঐ সমস্ত চা খেতে গিয়ে চায়ের আসল টেস্ট ভুলে যাচ্ছেন। তাঁরা অর্থাৎ আমরা আমজনতা যে নিম্নমানের চা খাই, এবং চায়ের নামে কি খাই তা তারা যদি বুঝতেন বা আমরা যদি বুঝতাম, অর্থাৎ এককথাতে আমরা যদি একটু কোয়ালিটি সচেতন হতাম তাহলে এইভাবে নির্বিচারে আমরা ঠকতাম না। যাইহোক, আপ রুচি খানা, পর রুচিসে পড়না। আমার বলার কিছু নেই। তবে এই অধমের একটা বিনীত অনুরোধ আছে দয়া করে ফেসবুকে পোস্ট পাঠানোর এক মিনিটের মধ্যে লাইক পাঠানোর কোন প্রয়োজন নেই। পড়তে ভালো না লাগলে পড়বেন না। ভালো লাগলে পড়ে লাইক বা ডিসলাইক পাঠান। মন্তব্য বা নির্মম সমালোচনাও করুন। অত্যন্ত খুশী হব। এজন্যেই বললাম আমার এই লেখা সচেতন, দরদী, মরমী পাঠকদের জন্য যারা অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং রাজনীতি নিয়ে ভাবেন, চর্চা করেন। আমার এই লেখা আর দশটা লেখার মতো নয়। অন্তত শতাধিক বই, জার্নাল, পেপার কাটিং, দুই তিনটি লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত দুষ্প্রাপ্য বই, চা ম্যানেজমেন্ট, শ্রমিক নেতা, সমাজকর্মী, প্রেস মিডিয়ার কাছ থেকে নেওয়া একজন ভ্রামণিক প্রাবন্ধিকের চরৈবেতির দুনিয়া। তাই চরৈবেতির ছন্দে ছন্দে এবারের পুজোর ছুটিকে কাজে লাগিয়ে এসে পড়লাম নাগরাকাটা সার্কিট শেষ করে বানারহাটে। কাজ শুরু করলাম বানারহাট চা বাগিচা থেকে যে বাগান কোয়ালিটির প্রশ্নে কোন আপোষ করে না।
তবে পাঠকবর্গ, বুঝতেই পারছেন নীরস, শুষ্কং কাষ্ঠং বাগিচা বৃত্তান্ত পড়ে পাঠকবর্গ ক্লান্ত। পুজোর আমেজ এখনো কাটেনি। উত্তরের এই প্রকৃতির টানে বাংলা তথা ভূ-ভারতের বহু পর্যটক উত্তরমুখী। গিজগিজ করছে হোটেল, মোটেল, রিসর্ট, লজ, বাংলোগুলো। তাই আজকের বাগিচা বৃত্তান্ত চা পর্যটন বৃত্তান্ত হলে পাঠকবর্গের নিশ্চয় আপত্তি থাকবে না। তাই ভণিতা ছেড়ে শুরু করি। জলপাইগুড়ি থেকে নাগরাকাটা যাবার সময়ে কি মনে হল ট্র্যাক চেঞ্জ করে একটু পর্যটনের স্বাদ নেবার জন্য নাগরাকাটা ক্রস করে প্রবেশ করলাম বাংলা-ভুটান সীমান্তের লাল ঝামেলায়। জায়গার নাম শুনলে অনেক পর্যটক হয়ত বা চমকে উঠবেন কিংবা পিছপা হবেন। কিন্তু একবার যদি সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে চলে আসেন কেউ তাহলে আর ফিরে যেতে চাইবেন না। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিছুতেই ছাড়বে না। টুরিস্ট স্পটটির নাম “লাল ঝামেলা বস্তি”। না, এই বস্তির সঙ্গে কোন মিল নেই মহানগরীর কোন ঘিঞ্জি বস্তির। নেই কোন “ঝুট ঝামেলা”-ও। এসেছি ডুয়ার্সের হলিডে ডেস্টিনেশন লাল ঝামেলাতে। সকাল সকাল রওনা দিয়েছিলাম জলপাইগুড়ি থেকে। লাটাগুড়িতে একটা দোকানে পুরি-সবজি খেয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম৷ লাটাগুড়ির সবুজ বনানী ছাড়িয়ে ডান দিকের পথ ধরে মুর্তি নদীর ওপর দিয়ে খুনিয়ার ভয়াল জঙ্গল অতিক্রম করে আবার বড় রাস্তায় উঠে নাগরাকাটাকে বাইপাস করে পৌঁছলাম লুকসানে৷ লুকসান পার হয়ে বাঁ দিক দিয়ে ধরনীপুর চা-বাগানের ফ্যাক্টরিকে বাঁ পাশে রেখে আদিবাসী প্রধান বসতির মধ্য দিয়ে এক ফালি পিচের সড়ক চলে গেছে ধরণীপুর চেংমারী চা বাগান অভিমুখে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় চেংমারী থেকে লালঝামেলা বস্তি ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত এই পাকা সড়ক ১৯১২ সালে নির্মিত হয়েছে। সাপের মতো চা-বাগানের সবুজ ক্যানভাসের বুক চিরে আরও কিছুক্ষণ গাড়িতে করে যাবার পর ৯ কিমি পথ পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম লালঝামেলা বস্তিতে।
নাগরাকাটার ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের লুকসান মোড় থেকে ধরণীপুর চা বাগান হয়ে চেংমারী চা বাগিচার শেষপ্রান্তে নেপালি এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসতি লালঝামেলা। ইন্দো ভুটান সীমান্তে অবস্থিত শান্ত, নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থান করছে জনজাতিদের অখ্যাত এই গ্রাম। সামনেই ভুটান সীমান্ত। এখানেই লাল ঝামেলা বস্তি। একেবারে চা-বাগানের পাশেই গড়ে ওঠা অখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র লালঝামেলা বস্তি শুধু একটু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং যত্ন পেলেই পর্যটকদের পছন্দের স্থান হয়ে উঠতে পারবে এবং একইসঙ্গে বদলে যাবে গোটা এলাকার আর্থ সামাজিক অবস্থা। লালঝামেলা বস্তিকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইকো ট্যুরিজম হয়ে উঠতে পারে অন্যতম প্রধান অবলম্বন। লাল ঝামেলাতে পৌঁছনোর পর কি কারণে এই অদ্ভূত নাম সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। জানার ব্যাপক ইচ্ছাতে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। অনেকেই বলতে পারল না। অবশেষে স্থানীয় এক বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা জানা গেল। এই বসতির জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জমি আন্দোলনের ইতিহাস। ষাটের দশকের শেষ দিকে এবং সত্তরের দশকের প্রথম দিকে জমি অধিকারের জন্য প্রাণপণ লড়াই করেছিলেন দু'জন ডাকাবুকো আদিবাসী মানুষ। তাঁদের নিরন্তর সংগ্রাম ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঝামেলা সোমরা ওঁরাও এবং লাল সোমরা ওঁরাওয়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজ্যে। এঁদের যখন রক্ত তাজা ছিল তখন বুকে সিআরপিএফ-এর ভারী বুট বা বন্দুকের গুলি অগ্রাহ্য করেই তারা জারি রেখেছিলেন তাঁদের লড়াই। তাঁদের নামেই এই গ্রামের নাম। বামপন্থী শ্রমিক নেতা লাল সোমরা ওরাও এবং ঝামেলা সোমরা ওরাওদের আন্দোলনের ফলে তৎকালীন চা বাগান কর্তৃপক্ষ জমি দিতে বাধ্য হয়। রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের শেষে জমি মেলে। নব্বইয়ের দশকে ৩০০ টি পরিবারকে তিন বিঘা করে জমির পাট্টা দেওয়া হয়। তখন থেকেই এই বসতি লালঝামেলা নামে পরিচিতি লাভ করে।
অশীতিপর এই দুই দামাল তরুণের আবাসস্থলটিই আজ ট্যুরিস্টদের কাছে বেড়াবার নতুন ডেস্টিনেশন। একদিকে সবুজ চা বাগান, অপরদিকে যতদূর চোখ যায় ভুটান পাহাড়। এখানকার ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। সরকারি প্রয়াসে পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করা গেলে পর্যটকরা এখানে বিনোদনের পাশাপাশি লোকসংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হতে পারবেন। নদী, জঙ্গল, চা বাগান ঘেরা ছবির মত জনবসতি। ঘন চা বাগিচা আর দুরন্ত ডায়না নদী লালঝামেলাকে অপরূপ করে তুলেছে। ডায়না নদী এখানে ভারত ভুটান নদী সীমান্ত। এখানে পা রাখলেই ভুটান পাহাড়ের সারি সারি চূড়া আর পর্বতের সানুদেশের ক্যানভাসে নৈসর্গিক ছবি চুম্বকের মত আকর্ষণ করে। ডায়না নদীর বাঁকের ঠিক মাথায় সবুজে মোড়া ছোট্ট বসতি। বাসিন্দাদের অতিথিপরায়ণতা মুগ্ধ করতে বাধ্য করে সকলকে। নদীর ঢেউয়ের শব্দ আরও ভালোভাবে শুনতে নেমে যাওয়া যেতে পারে নদী অববাহিকায়। ভরা বর্ষায় দুরন্ত ডায়না আপন খেয়ালে নদী খাতের পাথর ভাঙতে ভাঙতে প্রবাহিত হয়। শীতের নদী এখানে দুধের স্রোতের মত। পাথরে বসে পাখির কলকাকলি শুনতে শুনতে ভুটানের অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। দূর থেকে চোখে পড়ল ভুটানের একটি ব্রিজ। সেই ছবির মতো ব্রিজের ওপর দিয়ে ছোট ছোট গাড়ি চলছে। লাল ঝামেলায় মাথা গোঁজার কিছু ছিল না। এর আগে বছর পাঁচেক আগে যখন এসেছিলাম তখন জায়গাটার এত পরিচিতি হয় নি। তখন লালঝামেলাতে হোম স্টে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। ওই কাজে এগিয়ে এসেছিলেন লুকসান এলাকার উত্তম বড়ুয়া নামক এক ব্যক্তি। তবে তাঁর তৈরি হোম স্টে টি দেড় বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। অন্য আরেকটা হোম স্টে চালু থাকলেও সেখানে ঘর মাত্র চারটি। তাই এই পর্যটন কেন্দ্রটিকে নতুন করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। লালঝামেলার অপরূপ সৌন্দর্য ক্রস বর্ডার ট্যুরিজম ব্যবস্থা গড়ে তোলার একটি আদর্শ স্থান হতে পারে।
এই পাথরভাঙ্গা নদীপথে ভুটান পৌঁছে যাওয়া যায় সহজেই। এই অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী মানুষ চা বাগিচার জীবনের মধ্যে অরণ্য প্রকৃতির ছোঁয়া পেয়ে থাকেন। জীবন যন্ত্রণার মধ্যেও তারা খুঁজে পান বেঁচে থাকার আনন্দ। লোকায়ত সংস্কৃতির চিরাচরিত ধারাটিও রয়েছে যা তাদের একান্ত নিজস্ব। পিকনিক মরসুমে পিকনিক স্পট হিসাবে তুমুল জনপ্রিয় ডুয়ার্সের এই জায়গাটি। হাত বাড়ালেই ভুটান পাহাড় আর নদীর অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপে অবস্থিত এই গ্রামে বহু মানুষ পিকনিক করতে আসেন। সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল পিকনিক করার জন্য ডায়না নদীর বুকে অন্তত তিনশো ফুট নিচে নামতে হয়। সিঁড়ি না থাকার ফলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঝুঁকি নিয়ে নদীর বুকে নামেন পর্যটকেরা। শৌচাগার, পানীয়জল এবং নদীতে নামার সিঁড়ি যদি তৈরি করে দেওয়া যায় তাহলে এই পিকনিক স্পট কালেকালে অসাধারণ হয়ে উঠবে। অস্থায়ী শৌচাগার তৈরি করে দেওয়া হলেও পরের বছর সেগুলো আর ব্যবহার করা যায় না। সারা গ্রাম জুড়েই পানীয় জলের সংকট। পিকনিক স্পটেও জলের ব্যবস্থা নেই। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব কম স্থানেই আছে। শুধু একটু পরিকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। তবে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র লালঝামেলা বস্তির সঙ্গে ভুটানের সরাসরি যোগসূত্র স্থাপনের জন্য রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ। যেহেতু এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে তাই পরিকল্পনাটি জেলা প্রশাসনের নজরে আনা হয়েছে। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মন্ডিত লালঝামেলা বস্তি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করে দিলেই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে যাবে। রাস্তা তৈরি হলে এখানকার শ্রমিকদেরই শুধু সুবিধা হবে তা নয়, এর ফলে ভুটানও উপকৃত হবে। ওপরে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ থাকা গেল না। ডায়না নদী নিচ থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। কিন্তু ডাকলে কী হবে, সেই ডাকে সাড়া দিতে গেলে সাহস লাগে। কেননা বেশ খাড়াই পথ। কষ্ট করে নিচে নামতেই কিন্তু মনে হল পথশ্রম সার্থক। প্রকৃতির এমন মোহন রূপ দেখার জন্য এটুকু কষ্ট করাই যায়।
বড় একটা পাথরে বসলাম। আলগোছে ডায়না নদীর জলে পা ডোবাতেই সারা গায়ের রোম সহসা দাঁড়িয়ে গেল। হিম ঠান্ডা সেই জল। পায়ের পাতা স্পর্শ করতেই যেন ইলেকট্রিক শক খেলাম। সামনেই ভুটান পাহাড়। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সাদা সাদা বক। ট্যা ট্যা করে ডাকছে নাম না জানা পাখি। নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে দু তিনটে ময়ূর চোখে পড়ল। নদী ও পাহাড়ের এমন যুগল সম্ম্মোহনে চোখ জুড়িয়ে গেল। ওঠার সময় আবার কষ্ট। একশো মিটার মতো খাড়াই পথ বেয়ে উঠে খিদে যেন বেড়ে গেল। ওপরে উঠে চাউমিন খেলাম স্থানীয় একটা দোকান থেকে। এক রাউন্ড চা খেয়ে উঠে বসলাম নিজেদের গাড়িতে। এবার ফিরে আসার পালা। তবে আমার কাজ তো শেষ হয় নি। এও পাণীয় জলের সমস্যা, এত সুন্দর পর্যটন কেন্দ্রে পরিকাঠামো সমস্যার বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে আর দশটা পর্যটকের মতো নিছক বিনোদনের মুডে চলে যাব? কভি নেহি। চলে এলাম চায়ের দোকানে । দেখলাম এক রাউণ্ড খেলা হবে না। তিন রাউন্ড চা খেলাম আর গল্প জমিয়ে দিলাম চায়ের দোকানের মানুষগুলোর সঙ্গে। জানলাম লালঝামেলা বস্তির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকে বছরভর। তবুও পানীয় জলের মারাত্মক সংকটে জেরবার নাগরাকাটার লালঝামেলা বস্তি। পর্যটকেরা জল চাইলে সত্যিই লজ্জায় পড়ে যান এখানকার হাজার পাঁচেক বাসিন্দা। রিগবোর টিউবওয়েলের আয়রন মিশ্রিত অথবা নদী অথবা ঝোরার অপরিশোধিত জল এখানকার বাসিন্দাদের ভরসা। লালঝামেলা বস্তিতে সব মিলিয়ে আঠারোটা রিগবোর টিউবওয়েল থাকলেও সেগুলোর বেশিরভাগই অধিকাংশ সময় বিকল হয়ে থাকে এবং সচল থাকলেও সেগুলো থেকে আয়রন মিশ্রিত লাল জল পড়ে। গ্রামের স্কুল এবং অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র পর্যন্ত সর্বত্রই স্কুল পড়ুয়াদের সেই জল খেতে হয়। তার ওপর শীতের শুরু হলেই প্রত্যেক বছরের মতো জলের জন্য হাহাকার শুরু হলে বাধ্য হয়ে বাসিন্দাদের অনেকেই ডায়না নদী থেকে জল নিয়ে আসে।
জল সমস্যার সমাধানে প্রায় বছর পনেরো আগে এখানে সজল ধারা প্রকল্প চালু করা হলেও বিদ্যুতের বিল দিতে না পারার জন্য সেই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। বানারহাটে কাজ করার সময় পরবর্তীকালে নাগরাকাটার বিডিওর সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে লালঝামেলা বস্তিতে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর অনেক নিচে বলে টিউবওয়েল তৈরি করলেও তা কার্যকর হয় না। দেখেছিলাম এলাকার কয়েকটা বাড়ি নিজেদের উদ্যোগে একটা ঝর্ণা থেকে পাইপ দিয়ে জল আনার ব্যবস্থা করলেও তাতে উপকৃত হচ্ছে বড়জোর পাঁচ ছয়টা পরিবার। বাকিদের পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয়। লালঝামেলা বস্তির পাশেই ডায়না নদী রয়েছে। অপরিশোধিত সেই জল বছরের অনেকটা সময় হাজার পাঁচেক বাসিন্দার ভরসা। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের প্রকল্প না হলে লাল ঝামেলার পানীয় জলের সংকট কোনদিনও মিটবে না। কারণ জলের স্তর এতটাই নিচে যে টিউবওয়েল পাম্প করতে গিয়ে হাত ব্যাথা হয়ে যায়। যতটুকু জল মেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আয়রন বলে বাধ্য হয়ে নদী এবং ঝোড়ার জল পান করে অনেকেই। রাত কাটাবার ইচ্ছে থাকলেও শুধুমাত্র পরিকাঠামোর অভাবে সেই ইচ্ছে পূরণ হয় না পর্যটকদের। দিনে দিনে ফেরত যেতে হয় বহু ভ্রমণপিপাসুকে। এই পর্যটন কেন্দ্রটিকে নিয়ে সরকারি স্তর থেকে নানাসময় বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত রেলিং তৈরি হওয়া ছাড়া তেমন কিছু করা হয়নি। লালঝামেলাতে শীতের মরশুমে দিনে প্রায় পন্চাশটি পর্যটক বোঝাই গাড়ি যায়। অনেক পর্যটক লাটাগুড়ি, বক্সা বা জয়ন্তী ঘুরে লালঝামেলাতে রাত কাটানোর ইচ্ছে নিয়ে সেখানে পাড়ি দিলেও তাদেরকে নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে। এমনকি লালঝামেলাতে বসারও কোন ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি।
সবচেয়ে মারাত্মক যে তথ্য পেলাম সেটা হল নাগরাকাটার ভুটান সীমান্ত লাগোয়া লালঝামেলা বস্তিতে রয়েছে স্যান্ড ফ্লাই। ক্ষুদ্র আকারের ওই মাছি সাধারণত মাটির ফাটলে ডেরা বেঁধে থাকে। মাটির বাড়ি যেখানে বেশি সেই সমস্ত স্থানে স্যান্ড ফ্লাই দেখতে পাওয়া যায়। লালঝামেলা বস্তিতে অবশ্য মাটির বাড়ি নেই। তবে সেখানে কিছু বাড়ির দেওয়ালে মাটির প্রলেপ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেওয়ালে মাটির প্রলেপই সেখানে স্যান্ড ফ্লাই থাকার অন্যতম কারণ। তবে আশ্চর্যজনকভাবে দু'-একটি কংক্রিটের দেওয়ালওয়ালা বাড়ি থেকেও স্যান্ড ফ্লাই পাওয়া গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পাকা দেওয়ালের ফাটলের মধ্যে ওই মাছি ছিল। এলাকার হেলথ সেন্টার থেকে জানলাম এক মহিলা অসুস্থ হয়েছিলেন। তাঁর ত্বকের বায়োপসির পর কালাজ্বরের জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য দপ্তর তাঁকে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। লালঝামেলা বস্তিতে যে স্যান্ড ফ্লাই রয়েছে তা টের পেয়েছিলেন জলপাইগুড়ি জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের পতঙ্গবিদরা। জেলা পতঙ্গবিদ রাহুল সরকারের নেতৃত্বে সেখানে ম্যালেরিয়ার জীবাণুর বাহক অ্যানোফিলিস মশার ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। স্যান্ড ফ্লাইয়ের ওপর সমীক্ষা সন্ধ্যা ও ভোরের দিকেই করতে হয় বলে জানা গিয়েছে। একবার রোদ উঠে গেলে স্যান্ড ফ্লাই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তখনই স্বাস্থ্যকর্মীরা স্যান্ড ফ্লাইয়ের অস্তিত্ব টের পান। সঙ্গে সঙ্গে এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীদের এ ব্যাপারে সচেতন করা হয়। স্বাস্থ্যকর্মীরাও বিষয়টিকে নজরদারির মধ্যে রেখেছিলেন। লালঝামেলায় যে দলটি স্যান্ড ফ্লাই নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে তাতে জেলা পতঙ্গবিদ ছাড়াও ছিলেন নাগরাকাটার ম্যালেরিয়া ইনস্পেকটর অসিত দাস ও ম্যালেরিয়া ট্রিটমেন্ট সুপারভাইজার দীপ রায়। পর্যটন সমীক্ষার পাশাপাশি অনেকগুলি কাজ সারার তৃপ্তির আনন্দ নিয়ে চললাম লালঝামেলা থেকে বানারহাটের উদ্দেশ্যে। বানারহাটের প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক এবং একজন আদ্যন্ত সৎ, সমাজসেবী মানুষের গৃহে আমার আজকে রাত্রিযাপন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴