বসমতী ঘামতে ঘামতে রসবালার বাড়ি ঢুকে দেখে কেউ বাড়িতে নেই। বেরোতে যাবে বুধেশ্বরের বউয়ের সঙ্গে দেখা। ওকে দেখেই জিজ্ঞেস করল,
"কোটে গেইসে তো বারে ইমরা মানষিগিলা। এখেনা দরকারোত আসিলুং তে দেখেছোং নাই, কোয়ারিকাট্টা মারা।"
বুধেশ্বরের বউয়ের শীর্ণ মলিন চেহারা। দেখলে কষ্ট হয়। কন্ঠার হাড় বের হওয়া শীর্ণ মুখটাই হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কিছুটা।
"উমরা সোগায় দোলাবাড়ি গেইসে। দ্যাখেন না এইবার বাইস্যাখান এলাও নাগিল না। শন মাসখানে গেইল। তে শুকান কাদো দিবার চান্দাইসে জল ছেকিয়া। কাদোখানো শুকি গেইসে।"
বসমতীও বিষন্ন হয়ে মাথা নাড়ে।
"আর বচ্ছরও এইলা দিনোত কী সাতাও! এখেনা হে বাড়ি হো বাড়ি যাওয়া নাই যায়। চ্যাং মাছলা এখেরে আগিনাত ঝাপ্পি আইসে। এই সন আরো নাই বা। হিদি তে হিদি ওউদের কষ্টখান বাদে দিলুং। জল না হলে আবাদ কিষ্ষি করির না পালে মানষি না খায়ায় মরিবে বারে।"
বুধেশ্বরের বৌয়ের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস নামে।
"মোইদ্য দোলার জাম্পোইটাথ তোসজল নাই নাইকে। ঘাসগিলাও মরি গেইসে। শুকিয়া এখেরে খড়িখাট্টা নাইগসে চাইরো পাখে।"
বসমতী পরনের আঁচলটা মাথায় তুলে রসবালার খোঁজে মাঠের দিকেই রওনা দেয়। রসবালারা পুরো পরিবারটাই বিষন্ন মুখে মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশের সব জমি শুকিয়ে ফেটে ফেটে আছে। রোয়া বোনা তো দূরের কথা মাঠের ঘাসগুলিও শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেছে। গরু বাছুর নাই বললেই চলে। বসমতী রসবালাকে দেখে ডাক দেয়,
"মাই, এত্তি শুনেক তো কনেক।"
রসবালা শুকনো খটখটে জমিটার দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বসমতীর কাছে আসে। বসমতী গলাটা নামিয়ে বলে,
"সুন্দরমণি আর ভেলুর মাও আইচ্চে। হামার বাড়িত বসে থুয়া আসিলুং।"
রসবালা প্রথমে বুঝতে পারে না। কিছুটা অবাক হয়ে বলে,
"কেনে তে?"
"চলখেনে, কোইম এলায়।"
রসবালা আরো কৌতুহলী হয়ে ওঠে,
"মোরঠে আইচ্চে নাকি তে! কেনে?"
তারপর আপন মনে বলে,
"মোরঠে আরো কী দরকার উমার।"
রসবালা শূন্যের দিকে তাকিয়ে, "মুই যাছোং" বলে বসমতীর পেছন পেছন আসতে থাকে। সরেন যা বোঝার বুঝে নেয়। অন্যরাও। বসমতী ওদের আসার ব্যাপারে কিছু না বলে অন্য কথা পাড়ে,
"আর বচ্ছর বানায় ভাসি গেল দুনিয়াটা। এ বচ্ছর এমন খরা দ্যাছে, মানষি এখেরে হাপসি গেল।"
রসবালা চিন্তিত গলায় বলে,
"জল না হলে হায় দুনিয়ার মানষিলা এইবার মরিবে দি। আবাদ সুবাদ নাহলে খাবে কী? হামারে বিছনগিলা মরি যাছে দি। শুকিয়া নাল নাইগসে বিছনলা।"
হন হন করে পা চালিয়ে দুজনে এসে দেখে ভেলুর মা আর সুন্দরমণি ছাড়াও কুমুদিনি আর শিবানী এসে বসে আছে। বসমতী কলপাড়ে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে বলে,
"হ, উমাক আরো কায় খবর দিল? আইচ্চেন তে বোইসো। কনেক চা করোং। তোমরা তাবত্তে আল্লাপ সাল্লাপ নিকলাও। মুই শুনোছোং।"
বসমতী উনুনে কাঠ গুঁজে দেয়। গোয়ালঘর থেকে পাটকাঠি ভেঙে আনে।তারপর দেশলাই জ্বেলে কূপী ধরিয়ে সেই আগুনে পাটকাঠি ধরিয়ে উনুনে দেয়। দেওয়ামাত্র দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। শুকনো কাঠগুলোকে মুহূর্তের মধ্যে আগুন যেন মহানন্দে গিলে ফেলল। বসমতী আপনমনে কাজ করে যাচ্ছে। একসঙ্গে জমায়েত হওয়ার আসল উদ্দেশ্য নিয়েও কেউ কিছু বলছে না। সবাই নিজেদের মতো ঘরকন্নার গল্প করছে। রসবালা নিবিষ্ট মনে বসমতীর কাজ লক্ষ্য করছিল। এবার বলল,
"তিন ঠ্যাঙাটা বসে দেক। মুই জ্বালাছোং চা খান। তোমরা করখেনে কী আল্লাপ করিবেন।"
বসমতী এবার হুজুগ তুলে দিয়ে বলে,
"ন্যাও। কাথালা কওখেনে।"
ভেলুর মা বলে,
"হামরা আসিলি তোর বাড়ি। তুইয়ে কবু। হামরা শুনিমো।"
বসমতী হাসতে হাসতে গলায় তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে,
"এঃ! মোক আরো কবার নাগে। তোমরায় বলে হইলেন সবজান্তা। হামরা ঘুরি তোমাল্লার পাছোত। মোকে আরো কয় কবার না!"
ভেলুর মা এবার পিঁড়িটায় নড়ে চড়ে বসে। তারপর গলাটাকে অনাবশ্যক উঁচুতে তুলে শুরু করে,
"অ্যায় যে দেখেছেন আষাঢ় মাসখান গেইল, এলা শন মাসখানো যাছে তাও জল নাই। ডিগিডাগা শুকিয়া খটখটিয়া নাইগসে। কতলা মানষি পাটা ধুবার পাইসে, কতলা মানষি পরে আরো পাটার জাগ ভাঙিয়া নদী নিগাইসে। তাও দ্যাওয়াটাত এখেনা জল তো দূরের কাথা ম্যাগও নাই। কেনে?"
বলে একটু থামে। তারপর বলে দ্যাবতা বিরস হোইসে হামার উপর। এলা উয়াক তুষ্ট করির নাগিবে। ওই ত্যানে হামরা বেচ্ছুয়াগিলা হুদুমা দ্যাও-এর পূজা করিমো ঠিক কচ্চি। তে তোমাকো সগাকে এই ত্যানে কছি। ব্যাটেছাওয়ালাক কয়দিন বাড়ি থাকি বিরির দ্যাওয়া যাবে না।"
রসবালা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে,
"মুই না পাইম বা কাপড়া খুলির না।"
ভেলুর মা একটা ধমক দ্যায়।
"তোক কী কাহো দ্যাখেছে? আন্দার আতি। ন্যাল্টেং, গোছা কোনোয় নবে না। হামরায় মাইয়া কয়টা খালি।"
রসবালা আবারও মাথা নাড়ে,
"তাও। হোইলেও। মুই না পাইম বা। মোক সরম নাগিবে।"
বসমতী সবাইকে চা দিতে দিতে বলে,
"মুই খালি শুনিসুং। কোনোবারো হুদুমা পূজা দ্যাখোং নাই। এইবার দেখিম। কইনা মাই। ঠাকুরের নায় কিসের হোটে সরম। কাহোকো না কাহোকো তো পূজাখান করিরে নাগিবে। নাহালে কী না খায়া মরিবেন?"
কথাটা ঠিক। রসবালা মনে মনে ভাবে। ব্যাঙের বিয়েও দেওয়া হয়ে গেল, তারপরেও বৃষ্টির দেখা নেই। এবার শেষ চেষ্টা হুদুমা পূজা।
..................................................
সাতাও - সাতদিন আটদিন টানা বৃষ্টিকে সাতাও বলে।
হায় দুনিয়া - সমগ্রতা অর্থে বোঝায়
গোছা - কূপী