গ্রাসমোড় চা বাগিচা ( দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
গ্রাসমোড় চা বাগিচা ( দ্বিতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
---------------------------------------
নাগরাকাটা সার্কিট সফর শেষ হল। পরের সপ্তাহ থেকে শুরু হবে বানারহাট সার্কিট এবং ধুপগুড়ি গয়েরকাটা সার্কিটের বাগিচা সফর। বাকি আর ৩৫ টির মতো বাগান। এবারের বাগিচা সফরে নির্দিষ্ট কোন বাগিচা সফর নয়। মেটেলি ব্লকে মহাষ্টমীতে চা বাগিচার পুজো দেখতে বেরিয়েছিলাম। গাড়িতে যেতে যেতে ননে হল বন্ধ চা বাগিচার পুজো দিয়েই যাত্রাপথ সূচিত হোক। এলাম জলপাইগুড়ি সরর ব্লকের রায়পুর চা বাগিচাতে। জলপাইগুড়ি জেলার অন্যতম চা বাগান হিসেবে পরিচিতি ছিল রায়পুর বাগানের। দুর্গাপুজোতেও ধুমধাম হত প্রচুর। মালিকপক্ষের অনুদানেই পুজোর আয়োজন করা হত। শ্রমিকদের সঙ্গে একসঙ্গে পাতপেড়ে ভোগ খেতেন মালিকরাও। কিন্তু ১৪ বছর আগে হঠাৎ করেই বাগানে অন্ধকার নামে। যা আজও কাটেনি। কোনওরকমে বাগানের চা পাতা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন শ্রমিকরা। সময়ের সঙ্গে পুরোনো হয়েছে চা গাছগুলি। নতুন করে গাছ লাগানো দরকার। কিন্তু করবে কে? নিজেদের স্বার্থেই বিনা পারিশ্রমিকে কয়েকবার বাগানে প্রুনিং করেছেন শ্রমিকরা। বাগান ১৪ বছর ধরে বন্ধ। চেন্নাইয়ের এক ব্যবসায়ী বাগান অধিগ্রহণ করলেও গত পাঁচ বছরে তিনি একবারের জন্যও আসেননি। পুরোনো কথা মনে পড়ে যায় বাগানের শ্রমিক এবং প্রাক্তন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান প্রধান হেমব্রমের। তাঁর কাছ থেকে জানলাম আগে পুজোর সময় বাগানের মাঠে মেলা বসত। এখন আর বসে না। শ্রমিকদের হাতে তো পয়সাই নেই। কেনাকাটা হয়নি তাই। আক্ষেপ ঝরে পড়ে প্রধানের গলা থেকে। বাগানের বেশিরভাগ শ্রমিক ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন জামা কিনতে পারেননি। শীত শুরু হলে চা পাতা তোলা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন কীভাবে রোজগার হবে তা নিয়েই চিন্তায় সকলে। সরকার থেকে তারা চাল পাচ্ছে ঠিকই।
নিজেরা চা পাতা তুলে বিক্রি করে যেটুকু লাভ করছেন, তা দিয়েই এবার দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছেন জলপাইগুড়ির রায়পুর চা বাগানের শ্রমিকরা। পুজোর জন্য সারাবছর ধরে টাকা জমিয়েছেন তাঁরা। ৬০০ জন শ্রমিক এবার ১৫০ টাকা করে চাঁদা দিয়েছেন। সেই টাকাতেই দুর্গার আবাহন করেছেন তারা। তবে ওইটুকুই। পুজো নিয়ে বেশি মাতামাতি করার সাধ্য নেই শ্রমিকদের। বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম ৭২ বছর ধরে বাগানে পুজো হচ্ছে। সেই পুজো কি করে বন্ধ করা যায়। তাই তারা পুজোর জন্য প্রতি মাসে কিছু টাকা আলাদা করে রেখে চাঁদা দেয়। তাই সনিয়ারা নমো নমো করেই দেবীর পুজো করেছে। অষ্টমীর দিন ভোগের ব্যবস্থা করেছে। সেদিন সবাই মিলে একসঙ্গে পুজোর প্রসাদ খেয়েছে তারা। তবে তাঁদের দুঃখকষ্ট লাঘব করুন দেবী দুর্গা, অঞ্জলি দিয়ে সেই প্রার্থনাই জানিয়েছেন মঙরা, সাবিত্রী, কমলিরা। বাগানের শ্রমিক প্রধান হেমব্রমের কাছ থেকে জানলাম বাগানের পরিচালনভার চেন্নাইয়ের ব্যবসায়ীর হাতে যাওয়ার পর বাগান খোলার আশা জেগেছিল। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে তিনি বাগানে আসেননি। শ্রমিকদের বকেয়া পিএফ শোধ করা হচ্ছে না। শ্রম দপ্তরের তরফে ওই ব্যবসায়ীকে বারবার নোটিশ পাঠিয়েও ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে বসাতে পারেনি। ১৪ বছর ধরে একটা বাগান বন্ধ রয়েছে। অথচ বাগান খোলার জন্য কেউ কোনও পদক্ষেপ করল না। তাই দেবীর কাছে একটাই প্রার্থনা রায়পুরের চা শ্রমিকদের। আবার খুলে যাক বাগান। সেই আশাতেই চারদিন উপবাস করে অঞ্জলি দিলেন শ্রমিকরা।
এলাম কিলকট এবং নাগেশ্বরী চা বাগিচাতে। ভয়ঙ্কর দুটো রুগ্ন বাগান গতবছর দীপাবলীর আগে গোয়েঙ্কাদের হাত থেকে বের হয়ে নতুন মালিকের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে শুরু করেছিল তাদের পথচলা। এর আগে দুই চা বাগানই ডানকানস গোষ্ঠীর আওতায় ছিল। সেই সময় মজুরি সহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে মাঝেমধ্যেই বাগানে আন্দোলন চলত। দীর্ঘদিন ধরেই দুই চা বাগানের শ্রমিকরা বাগানে নতুন মালিকপক্ষের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সেই বছরও দুর্গাপুজোর সময় বোনাস নিয়ে বাগান সরগরম হয়ে ওঠে। দীর্ঘ আন্দোলনের পর দুই চা বাগানে শ্রমিকদের ১৩.২৫ শতাংশ হারে বোনাস দেওয়া হয়। সেটাও দুই কিস্তিতে। শিলিগুড়িতে দাগাপুরের শ্রম ভবনে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে টি অ্যান্ড বেভারেজেস প্রাইভেট লিমিটেড কিলকট ও নাগেশ্বরী চা বাগানের দায়িত্বভার তুলে নেয়। বাগান শ্রমিকদের উপস্থিতিতে নতুন মালিকপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে দুই চা বাগানের দায়িত্বভার তুলে নেন। আদিবাসী নিয়মরীতি মেনে ধামসা-মাদলের তালে তালে নতুন মালিকপক্ষকে স্বাগত জানিয়েছিল বাগানের বাসিন্দারা। আয়োজন করা হয়েছিল পূজার্চনারও। দুই চা বাগানেই অনুষ্ঠান হয়। দীপাবলির আগেই নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছিল মেটেলি ব্লকের কিলকট ও নাগেশ্বরী তাই এই বছর দীপাবলীর ঠিক আগে আগে এই দুটি বাগান সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম মোটামুটি ঠিকঠাকই চলছে বাগানদুটি। তাই নতুন আশায় বুক বেঁধেছেন নাগেশ্বরী চা বাগানের শ্রমিক সাবিত্রী মির্ধা, রাধা লোহার, কিলকোট বাগানের আশা মাহালিরা। তাদের কথায়, ‘আগের মালিক ঠিকঠাকভাবে বাগান চালাতে পারতেন না। সময়মতো পাওনাগণ্ডা দিতেন না আমাদের। তাই বহুদিন আগেই বাগানে নতুন মালিকের দাবি উঠেছিল। অবশেষে নতুন মালিকের হাত ধরে বাগানে সাইরেন বেজেছে।
গত বছর দীপাবলিতে খুশির রোশনাই ছিল দুই বাগান মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক পরিবারে। যাঁরা মেটেলির নাগেশ্বরী ও কিলকট চালাচ্ছেন সেই নতুন পরিচালক টি অ্যান্ড বেভারেজেস প্রাইভেট লিমিটেডের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ও অচল থাকা মাল মহকুমার মানাবাড়ি ও বাগ্রাকোট বাগান দুটিও বর্তমানে চলছে। পাশাপাশি ওই গোষ্ঠীরই ‘মেরিকো টি কোম্পানি'-র মাধ্যমে চলছে মাদারিহাট-বীরপাড়া ব্লকের হান্টাপাড়া, গ্যারগান্ডা, তুলসিপাড়া, ধূমচিপাড়া ও বীরপাড়ার মতো আরও পাঁচটি বাগান। নাগেশ্বরী- কিলকটকে ধরলে ডুয়ার্সের মোট নয়টি বাগান চালু হয়েছে। টি অ্যান্ড বেভারেজের সুরজিৎ বকসির সাবেক বাড়ি জলপাইগুড়ির আসাম মোড়ে। তাঁর কাছ থেকে জানলাম, অন্য বন্ধ ও অচল বাগানগুলি নিজেদের হাতে নেওয়ার পর যেভাবে চালানো হচ্ছে নাগেশ্বরী-কিলকোটের ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করা হবে। শ্রমিক সংগঠনগুলির পাশাপাশি রাজ্য সরকারের তরফে তাদের কাছে ওই দুই বাগানের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ ছিল। বরাবরের মতো শুধু ব্যবসা নয়, শ্রমিক কল্যাণ ও চা শিল্পের সর্বাঙ্গীণ বিকাশই যেহেতু তাদের লক্ষ্য তাই নাগেশ্বরী- কিলকটের পাশাপাশি ডুয়ার্সের নয়টি বাগানের ক্ষেত্রেও শ্রমিক কল্যাণের ক্ষেত্র কোন অন্যথা হবে না বলে জানালেন সুরজিতবাবু। অচল নাগেশ্বরী, কিলকটকে স্বাভাবিক করতে শ্রমমন্ত্রী বেচারাম মান্না নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর তৎপরতাতেই ওই দুই বাগান নয়া পরিচালক খুঁজে পেল। এর আগে নাগেশ্বরী ও কিলকট চা বাগান দুটি ডানকানস চালাত। তবে দুই বাগানে তাঁদের জমির লিজের মেয়াদ যথাক্রমে ২০০২ ও ১৯৯৫ সালে ফুরিয়ে যায়।
কেমন আছে চা বাগিচার শৈশব জানার প্রচেষ্টাতে প্রত্যেকটি বাগিচা সফরে গেলেই ক্রেশে যাই বা যদি লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার থাকেন তাহলে তাদের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক জায়গাতে চোখে পড়ে খাঁচাবন্দি চা বাগানের শৈশব। ডিবিআইটিএ অফিসে কিছু কাজ সেরে এলাম তেলিপাড়া আর বিন্নাগুড়ি চা বাগানে। বাবা মায়ের রুজি-রোজগারের তাগিদে ডুয়ার্সের চা বাগানগুলিতে অনেক শিশুরই খাঁচাবন্দি অবস্থায় দিন কাটছে। একদিকে বাগানের পরিবারগুলির বেঁচে থাকার তাগিদ, অন্যদিকে চা বাগানে বাচ্চা চুরির আতঙ্ক ও জীবজন্তুর ভয়। এই আশঙ্কায় অভিভাবকরা তাঁদের শিশুদের বাগানের জাল ঘেরা ক্রেশে রেখে পাতা তোলার কাজে যান। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭ টাতে সাইরেন বা ঘণ্টার আওয়াজে চা বাগানের শ্রমিকদের কাজে যাওয়ার ব্যস্ততা ডুয়ার্সের প্রতিটি বাগানেরই দৃশ্য। বাড়িতে শিশুদের দেখার মতো কেউ থাকেন না। বাধ্য হয়ে শিশুদের ক্রেশ ভ্যানে রেখে চা পাতা তোলার কাজ করেন সারিতা মুন্ডা, ঊর্মিলা মাহালি, লক্ষ্মী ওরাওঁরা। পাতা তুলতে তুলতে মাথা নীচু করে ঊর্মিলার বক্তব্য বাড়ির পুরুষরা সকালে উঠেই কাজে যায়। কাজ না করলে ভাত জোটে না। কথা বলছিলাম তেলিপাড়া চা বাগানের সিনিয়ার ওয়েলফেয়ার ম্যানেজার রিংকু গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। জানলাম প্রত্যেকটা বাগানেই নিরাপত্তার সঙ্গে শিশুদের রাখা হয়। শিশুদের জন্য জল, ও শৌচালয়ের ব্যবস্থা থাকে। জানলাম কাজের ফাঁকে মায়েরা সন্তানদের সঙ্গে কিছুটা সময়ও কাটান।
ট্র্যাক্টরের একটি অস্থায়ী ট্রলারের চারদিকে লোহার জাল লাগিয়ে 'ক্রেশ' তৈরি করা হয়। মাথার ওপর টিনের শেড। সেই ছোট্ট বিশ-পঁচিশ ফুটের খাঁচাবন্দি ঘরে দিনের অধিকাংশ সময় কাটে শিশুদের। তাদের দেখভালের জন্য অবশ্য একজন 'ধাইমা' নিযুক্ত থাকেন। এক-একটি ট্রলারের ভিতরে ১২-১৫ জন শিশুকে রাখা হয়। স্থানীয়রা ক্রেশভ্যানকে ‘টং’ও বলেন। যদিও এই ক্রেশভ্যান পুরোপুরি নিরাপদ নয় বলে অভিযোগ৷ ক্রেশের চারদিকে লোহার জাল মাথায় টিনের শেড থাকলেও ওপরের দিকে বেশ খানিক অংশ ফাঁকা থাকে। এতে যে কোনও সময় বন্যজন্তুর আক্রমণের আশঙ্কা থাকে। তবুও এই ক্রেশেই প্রাণের অধিক প্রিয় সন্তানদের রেখে কাজ করতে বাধ্য হন মায়েরা। যদিও বাগান কর্তৃপক্ষের দাবি, শিশুদের দেখাশোনায় কোনও খামতি রাখা হয় না। বাগানে শিশুদের এই ক্রেশে রাখার পদ্ধতি বেশ পুরোনো। জঙ্গলে ঘেরা ডুয়ার্সের চা বাগান এলাকায় শ্রমিকদের শিশুদের বন্যজন্তুদের থেকে রক্ষা করতে ইংরেজরা এই ব্যবস্থা চালু করেন। মান্ধাতা আমলের সেই ব্যবস্থা আজও সমানে চলছে। এর বিকল্প হিসেবে কোনও কিছু ভাবা হয়নি বলে অভিযোগ। যদিও প্রতিটি বাগানে শিশুদের দেখভালের জন্য ওয়েলফেয়ার অফিসার নিযুক্ত করা হয়। তাঁরা বিভিন্নভাবে শিশুদের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিলেও বাগানে শৈশবের বন্দিদশা কাটাতে প্রশাসন কোনও বিকল্প ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ আছে।
নবমীর ভোরে বের হলাম আলিপুরদুয়ারের চা বাগিচা পরিক্রমায়। এলাম মাঝেরডাবরি চা বাগিচাতে। খবর পেয়েছিলাম ছয়রকম স্বাদের চায়ের সম্ভার নিয়ে হাজির মাঝেরডাবরি চা বাগান কর্তৃপক্ষ। বিশেষভাবে তৈরি এই চায়ের বাক্স মিলছে আলিপুরদুয়ার শহর সহ জেলার কয়েকটি টুরিস্ট স্পটে। কিনতে পারবেন সকলেই, যদিও বাগান কর্তৃপক্ষের টার্গেট পুজোর মরশুমে আসা পর্যটকেরাই। দেখলাম ছয়টি আলাদা আলাদা স্বাদের চা থাকছে এই বাক্সে। তার মধ্যে রয়েছে সিটিসি, অর্থডক্স, দার্জিলিং চা বা গ্রিন টি'র মতো পরিচিত স্বাদ। আবার রয়েছে গোলাপ ফ্লেভার, জবা ফ্লেভার বা কোয়ালিটি মশলাদার চাও। বাঙালি মাত্রেই চা-রসিক। পেয়ালায় চুমুক দিয়ে চায়ের আমেজে মুখ থেকে আরামের 'আহ' বের হয় না এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর। এমনিতেই ডুয়ার্সের চায়ের কদর বিশ্বজুড়েই। তবে দেখলাম আলিপুরদুয়ারে বেড়াতে আসা পর্যটকরা মাত হবেন অন্যরকম চায়ের গন্ধে। চায়ের সুগন্ধ অনেকেরই প্রিয়। ভালোমানের চায়ের এমনিতেই যথেষ্ট গুণ রয়েছে। এবার তার সঙ্গে যদি মিশে যায় গোলাপের সুগন্ধ অথবা জবাফুলের গুণাগুণ তবে কেমন হবে এ প্রশ্নের জবাব মিলবে ওই বাক্সে। বাক্সগুলিও নজরকাড়া। প্রত্যেকটি বাক্সে ছোট ছোট ছয়টি কনটেনারে আছে ওই ছয় রকমের চা। তার সঙ্গে স্থানীয় বনাঞ্চল থেকে সংগৃহীত খাঁটি মধুও মিলছে উপহার হিসেবে। প্রত্যেকটি কনটেনারে ৪০ গ্রাম করে চা দেওয়া হয়েছে। বাক্সের দাম ২,০০০ টাকা। আলিপুরদুয়ার শহরে ওই চা বাগান কর্তৃপক্ষের একটি নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে ওই চা বিক্রি করা হচ্ছে। আপাতত আলিপুরদুয়ার ও জয়ন্তীতে মিলছে ওই বিশেষ চায়ের বাক্স। তবে লাটাগুড়ি, জলদাপাড়া সহ ডুয়ার্সের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রেও মিলবে তা।
পেয়ে গেলাম মাঝেরডাবরি চা বাগানের ম্যানেজার চিন্ময় ধরকে। পুরনো আলাপ চিন্ময়বাবুর সঙ্গে। আলাপচারিতাতে জানতে পারলাম ভালো চায়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে তাঁরা নিয়মিত ভাবনাচিন্তা করেন। সেই ভাবনা থেকেই এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দার্জিলিংয়ের বাগান থেকে তাঁরা দার্জিলিং অর্থডক্স চা সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া বাকি পাঁচটি হাই কোয়ালিটির চা নিজেদেরই বাগান ও ফ্যাক্টরিতে তৈরি করা হয়েছে। জানলাম মাঝেরডাবরি বাগানেই গোলাপ বাগান তৈরি করা হয়েছে। জবা ফুলের চাষও করা হয়েছে। পাশাপাশি বাগানেই গোলমরিচ সহ বিভিন্ন মশলারও চাষ করা হয়েছে। ডুয়ার্সের সঙ্গে চায়ের নাম যেহেতু অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে তাই পর্যটকরা এখানে এসে প্রায়শই ভালো চা কিনতে চান। এখন আবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত চায়ের ভাবনাও। সবকিছু নাগালের মধ্যে এনে দিতেই তাই এই বাক্সের ভাবনা। করোনা আবহে চা শিল্প যেহেতু একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাই এই পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতেই এই অন্যরকম ভাবনা বলে জানতে পারলাম চিন্ময়বাবুর কাছ থেকে। বাগানের সেরা পাতা দিয়ে তৈরি চায়ের সঙ্গে গোলাপের পাপড়ি বিশেষ পদ্ধতিতে মেশানো হয়েছে। সেই চা পান করা জিভের পাশাপাশি ত্বকের পক্ষেও ভালো। ওই চায়ের দৃষ্টিনন্দন বাক্স উপহার দেওয়ার পক্ষেও আকর্ষণীয়। বলে মনে করে বাগান কর্তৃপক্ষ। তাই এই পরীক্ষামূলক উদ্যোগ।
বাগানে পুজোর চারদিন ধরে যাত্রাগান হয়। তাই বাগানের বাইরে পুজো দেখতে শ্রমিকরা কেউ সচরাচর যান না।না। প্রতি বছর সপ্তমী থেকে দশমী এই চারদিন রায়ডাক চা বাগানে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা শো চলে। রাত জেগে শ্রমিকরা সিনেমা দেখেন। রায়ডাক চা বাগিচার কর্মী সব্যসাচী বসু আমার বিশিষ্ট বন্ধু। সব্যসাচীর কাছ থেকে শুনলাম এবার পুজোয় সিনেমা শো হচ্ছে না। তাই কিছুটা হলেও মন খারাপ সবার। তবে প্রতিদিন আরতি সহ নান প্রতিযোগিতা রাখা হয়ছে। ধওলাঝোরা চা বাগানে থাকে আমার বিশিষ্ট বন্ধু গোপাল বকসি। গোপালের কাছ থেকে জানলাম পুজোর সময় যাত্রাগান, সিনেমা শো অথবা গানের জলসার মধ্যে যে কোনও একটা কিছুর আয়োজন করা হয়। কিন্তু এ বছর কালীপুজোর সময় সিনেমা শো বা যাত্রাগানের আয়োজনের চিন্তাভাবনা করছেন পুজোর আয়োজকরা। আসলে চা বাগানের পুজো মানেই মঞ্চ বেঁধে যাত্রাগান, পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা শো আর গানের জলসা। তবে চা বাগানের সেই চেনা ছবি হারিয়ে যাচ্ছে। শুনলাম শামুকতলা এলাকার দশটি চা বাগানের পুজো কার্যত সাদামাঠাভাবেই পালিত হয়েছে। যাত্রা, সিনেমা বা গানের জলসা থেকে এবার বঞ্চিতই থেকেছেন ফাসখাওয়া, চুনিয়া, কোহিনূর, জয়ন্তী, রায়ডাক, ধওলাঝোরা চা বাগানের শ্রমিকরা। তাই কিছুটা মন খারাপ নিয়েই দেবীর আরাধনায় শামিল হয়েছেন বাগানের শ্রমিকরা। সারাটা বছর কাজ করেই কাটিয়ে দেন শ্রমিকেরা। সারাবছর অপেক্ষা করেন পুজোর কয়েকটা দিন আনন্দ নেওয়ার জন্য। পুজোর বোনাসের টাকাও পেয়েছে শ্রমিকেরা। সবাই নতুন পোশাকও কিনেছে। তবুও ভালোমন্দে কাটল ২০২৩ সালের শারদ উৎসবের আনন্দঘন মুহুর্তগুলি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴