চ্যাংমারী চা বাগান (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
চ্যাংমারী চা বাগান (দ্বিতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
--------------------------------------
দুর্গাপুজা শেষ। আবার সেই গতানুগতিক জীবন। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে পাতা তোলা। চা-বাগিচার শ্রমিকদের আট ঘন্টা কাজ করতে হয়। পাতা তুলতে তুলতে হাত পা অবশ হয়ে আসে। কীটনাশকের ঠেলায় হাতে পায়ে ঘা হয়ে যায়। এছাড়া আছে জোঁক আর মশার কামড়। সর্দিকাশি, ম্যালেরিয়া, বাত এসব উপেক্ষা করেই পাতা তুলতে হয়। ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে খরচ বেড়েছে। ঘরে শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন বুড়োবুড়ি। তাদের খরচ, মরদের নেশার খরচ। শুখা সময়ের জন্য সঞ্চয়। আর ঘরে ‘মেইমান’ বা অতিথি এলে তো কথাই নেই। “আয় গোঁয় গুতিয়া ভিসায় দেলায় পাটিয়া/ দুখম সুখম বলে লাগাইল বাতিয়া” – বলে ছড়া আওড়ানো যত সহজ, খরচ জোটানো তত কষ্টের। নিজেরা শাকভাত খাও। কিন্তু মেহমান এলে তো সেটি হবার উপায় নেই। তাদের জন্য হাঁড়িয়া আন, মাংস আন, ডিম আন, বিড়ি, সিগারেট, মিষ্টি আন। হরেক রকম খরচ। অসুখ-বিসুখ তো লেগেই আছে। কোম্পানির ডাক্তারখানার যা ছিরি। বাইরে থেকে ওষুধ না কিনলে অসুখ সারে না। বাগানবাড়ি যেতে যেতে বুকের ভেতর থেকে দলা দলা দুঃখ বেরিয়ে আসে। এরা আপন মনে গাইতে থাকে ‘আগে বটে ছৌয়া (ছেলে)/ পিছে বটে টোকোরি (টুকরি)/ ঘুমারি ঘুমারি পাতি তোড়য়’। সকাল সাতটা থেকে এগারটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাতি তোলা। খারাপ পাতা তুললে নিস্তার নেই। সাহেব ম্যানেজার টুকরি কাত করে ফেলে দেবে। দিনের শেষে শ্রান্ত দেহে ঘরে ফেরা। খাওয়া দাওয়ার পর শুয়ে শুয়ে গান। সে তো গান নয়। দুঃখের পাঁচালী। ভূমি থেকে উৎখাত হয়ে পেটের দায়ে সেই কবে ছোটনাগপুর থেকে ভোটাং দেশের চা-বাগিচায় তারা ছিটকে পড়েছিল। সেই সব স্মৃতিকণা ঝরে পড়ে গানে, ‘রাঁচি জেলা রে, ছোটনাগপুর/ উঠ বিহানে হাল জোতয়’। কিন্তু চাষ করেও সারা বছর ভাত জুটতো না। আর তাইতে একদিন ঝিটিমিটি নিয়ে ডুয়ার্সে, দার্জিলিং-এ আসা। ঝিটিমিটি টাঙ্গু সৈয়া/ চলু তো ভোটাং রে/ টোকোরি ফাড়ুয়া নসিবে লিখিল’।
ডুয়ার্সে সংস্কৃতির বন্ধন লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন ধর্মীয় আচার পালনে, মন্দিরে দেবদেবীর বন্দনায় বা অশুভ শক্তির বিনাশ কামনায় অনুষ্ঠেয় বিভিন্ন লোকসংস্কৃতিতে। এবারে পুজা পরবর্তী সময়কালের কলামে চা বাগিচার সংস্কৃতি এবং বাবু কালচারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করব। তবে তার আগে চ্যাংমারী বাগানের পরিকাঠামো পরিচিতি না দিলেই নয়। এসেছি চ্যাংমারী টি এস্টেটে। এশিয়ার অন্যতম একটি বৃহৎ বাগান নাগরাকাটা ব্লকের চ্যাংমারী টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী চ্যাংমারী টি কোম্পানিটিতে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ আছেন ২৩ জন। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেকটর রাজ কেজরিওয়াল। অন্যান্য ডিরেকটরদের মধ্যে সঙ্গীতা কেজরিওয়াল, পুষ্পা কেজরিওয়াল, ইন্দ্র কেজরিওয়াল, লক্ষীকান্ত টিব্রাওয়ালদের ম্যানেজমেন্ট সহযোগিতা দেয় টাই। বাগানে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন ছিল ২ টি। এগুলি হল এনইউপিডব্লিউ এবং সিবিএমইউ। এখন বিজেপি এবং রাজ্যের শাসকদলের ট্রেড ইউনিয়নের বাড়বাড়ন্ত। চ্যাংমারী চা বাগিচার আয়তন ১৮৫১.৩৭ হেক্টর। চাষযোগ্য আবাদি ক্ষেত্র এবং ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত উৎপাদনযোগ্য আবাদী অঞ্চল ১৩৪০.৮১ হেক্টর। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ১৩০.২৩ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ২৩২৩ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। চ্যাংমারী চা বাগানে পেলাম এলাম ফ্যাক্টরিতে। জুনিয়ার ম্যানেজারকে জানালাম আমার উদ্দেশ্য। দেখলাম একেবারে কর্পোরেট কালচার। তিনি ম্যানেজারকে ফোন করলেন। তিনি আবার সিনিয়ার ম্যানেজারকে। ফিল্ডে ছিলেন। প্রায় আধঘন্টা বাদে এলেন। আরো প্রায় আধঘন্টা আমার কাছ থেকে আমার কাজের বিভিন্ন বিষয়ে জেনে সন্তুষ্ট হলেন। অবশেষে কোম্পানী সম্পর্কে তথ্য দেবার জন্য বড়বাবুকে নির্দেশ দিলেন। তবে পাশাপাশি জানালেন কোম্পানীর কোন লুকোছাপা নেই। সব তথ্য আমি ইনটারনেট থেকেই পেয়ে যাবো।
চ্যাংমারী চা বাগানে নিজস্ব চা পাতা উৎপাদনের গড় ১ কোটি ২০ লক্ষ কেজি। ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উৎপাদিত ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা ২০ লক্ষ কেজির মতো। চ্যাংমারী চা বাগিচার সাব স্টাফ ৩২৭ জন। করণিক ২২ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ২০ জন। বাগানের শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৪৯৫০। মোট জনসংখ্যা ১৫০০০ জন। দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা তোলার জন্য নির্দিষ্ট মজুরী পাওয়া স্থায়ী শ্রমিক ২৭৬৫ জন। প্রায় প্রতি বছর অস্থায়ী শ্রমিক বা বিঘা শ্রমিক থাকে গড়ে ৯০০-১০০০ জন যাদেরকে আশেপাশের বন্ধ চা বাগিচা থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হয়। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৪৪৬ জন। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক প্রায় ৫০০-৬০০ জনের মত। সর্বমোট সাব স্টাফ ৩২৭ জন। ফ্যাক্টরিতে ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ এবং মোট শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ৪২ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ৩৭১৯ এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ১১২৮১ জন। চ্যাংমারি চা-বাগিচায় ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ১০২৯। সেমি পাকা বাড়ি ৫৬, বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাস নেই। অন্যান্য বাড়ির সংখ্যা ৭৭। সরকারি সহযোগিতাতে তৈরি বাড়ি নেই। মোট শ্রমিক আবাস ১১৬২। শ্রমিক সংখ্যা ৩৭১৯। বাগিচায় শতকরা ৩১ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। ইউবিআই ব্যাংকের কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। বাগানটির লিজ হোল্ডার চ্যাংমারি টি কোম্পানী লিমিটেড। এলাম শ্রমিক আবাসে। দেখলাম অন্যান্য বাগানের থেকে কিছুটা উন্নত শ্রমিক আবাস। এর আগেও এই শ্রমিক আবাসে এসেছিলাম অন্য একটি ঘটনার সাক্ষী হতে। সে ও বছর পাঁচেক আগেকার কথা। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে ঘটনাটা না বললেই নয়। জলপাইগুড়ি তথা ডুয়ার্সের একটি সামাজিক সংস্থা ‘টু লিভস অ্যান্ড এ বাডস’। ‘দুটি পাতা একটি কুড়ি/ মেয়েরা নয় হাতের চুড়ি’ এই আপ্তবাক্যকে সম্বল করে সমাজসেবী নারী অর্পিতা বাগচী দিদি হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন চ্যাংমারী চা বাগিচার সোনিয়ার পাশে তাকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করার সাধনা নিয়ে।
কর্ণধার অর্পিতাদি আমাকে একদিন সকালে ফোন করে জানালেন যে তিনি ডুয়ার্সের রুগ্ন, বন্ধ বাগিচাগুলির কয়েকজনের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিতে চান। পাশাপাশি যাদের আগ্রহ আছে সেই সমস্ত দরিদ্র চা বাগানের পরিবারের মেয়েদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে চান। তখনও বুঝতে পারিনি যে তিনি তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার ব্রতে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন এবং যতদূর পর্যন্ত তারা পড়াশুনা করতে চায় তিনি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করবেন। প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হল জয়ন্তী, সোনিয়া, অঞ্জলীকে যারা তিনজনেই ছিল সেই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনী। সোনিয়া ছিল চ্যাংমারী চা বাগিচার। তখন সম্ভবত পরীক্ষার মাস পাঁচেক বাকি ছিল। শুরু হল অর্পিতাদির একক লড়াই এবং জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য মেয়েগুলির সমষ্টিবদ্ধ লড়াই। প্রত্যেকমাসে অর্পিতাদি ১০০০ টাকা করে পাঠাতেন এদের তিনজনের পড়াশুনার জন্য। মনে রাখতে হবে সমীক্ষা করতে গিয়ে জেনেছিলাম সোনিয়ার মা বাগিচার হপ্তা পাওয়ার পর তার মদ্যপ বাবা সেই টাকাটা কেড়ে নিয়ে নিত সোনিয়ার মায়ের হাত থেকে এক একদিন তাদের ভাত খাওয়াও জুটতো না। তাই প্রতিমাসে ১০০০ টাকা ডুয়ার্সের একজন নারী চা শ্রমিকের কাছে যে কতটা আর্থিক সাহায্য সেটা হয়তো আলাদা করে বলে দিতে হবে না। প্রতিমাসে টাকা পাঠানো হতে থাকে। কিন্তু মাস দুয়েক পরে একদিন চা বাগান থেকে সোনিয়া নিরূদ্দেশ হয়। প্রশাসনকে জানানো হয়। চলে খোজাখুঁজি। কিছুদিন পরে সে ফিরে আসে। মনে রাখতে হবে সোনিয়ার নিরূদ্দেশ এবং ফিরে আসা দীর্ঘ আট মাসের লড়াইতে ছিল প্রশাসনের নেতিবাচক মনোভাব এবং চা বাগিচার হারিয়ে যাওয়া একটি মেয়েকে খুঁজে আনার এক অদম্য লড়াই যে লড়াই লড়েছিলেন অর্পিতা দি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমস্ত ঘটনা জানানোর ফলে তাঁর নির্দেশে তামিলনাড়ু থেকে প্রশাসনের সহযোগিতাতে ফিরে এসেছিল সোনিয়া।
সোনিয়ার কাছ থেকে জেনেছিলাম তার আর্থিক দুরবস্থার কথা সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করার ফলে বহু মানুষ জানতে পেরে তাকে প্রচুর টাকা পয়সা পাঠিয়েছিল। ফলে তার হাতে বেশ কিছু পয়সা জমে গিয়েছিল। তাই ভালো কাজ ও রোজগারের লোভে একজনের সঙ্গে সে চলে গিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে খারাপ জায়গাতে। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু চা বাগিচার উপজাতি সমাজের মেয়ে একবার যদি সমাজের বাইরে চলে যায় তার যা পরিণতি হবার সেটাই হয়েছিল। সোনিয়ার সঙ্গে আবার কথা বলা হয়। সে জানায় পড়াশুনা করবে, কিন্তু তার চ্যাংমারী স্কুলে সে আর যাবে না বলে জানায়। সে লজ্জা পাচ্ছিল আবার মুল স্রোতে ফিরে আসতে। এইভাবেই একদিন পরিচয় হয় বানারহাট গার্লস হাইস্কুলের জয়িতা ম্যাডামের সঙ্গে। তিনি অর্পিতাদির প্রজেক্টের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সামিল হলেন। তাঁদের হাত ধরে সোনিয়ার চলল এক অন্য ধরণের লড়াই। ‘টু লিভস অ্যান্ড এ বাড’ উপলব্ধি করেছিল একবার যদি টাকা বা বৃহত্তর স্বপ্নিল জীবনের স্বাদ চা বাগিচার কিশোরী বা নারীরা পায় তাহলে মূলস্রোতে তার ফিরে আসাটা খুবই প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ায়। অর্পিতাদি অসুস্থ হবার পরে সেভাবে আর যেতে পারতেন না ডুয়ার্সের বাগিচাগুলিতে। কিন্তু প্রতি বছরের ২৫ শে ডিসেম্বর তাঁর টিম পৌঁছে যেত ডুয়ার্সের কোন এক বন্ধ চা বাগিচাতে সেখানকার মানুষের জন্য জামাকাপড়, খাদ্যসামগ্রী বা অন্য কোন উপহার সামগ্রী নিয়ে। অর্পিতাদি মনে করেন সমাজে এখনো লিঙ্গ বৈষম্য প্রবল। এর ফলে মেয়েরা অর্থনৈতিক অবহেলা এবং শোষণের শিকার। মেয়েরাও পড়াশুনা করতে চাইলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার থেকে সমর্থন এবং সহযোগিতা পাওয়া যায় না। পারিবারিক সম্পদ এখনো উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের হাতে যায়। তাই অর্পিতাদি অঞ্জলি, জয়ন্তী এবং সোনিয়াদের শিখিয়েছিলেন ১০০ টাকা হলেও পরিবারের হাতে তুলে দিতে যাতে তারা মনে করেন আগামী দিনে তাদের মেয়ে রোজগার করলে এইভাবেই তাদের সাহায্য করতে পারবে। আসলে এই লড়াই একদিকে চা বাগিচার নারী শ্রমিকদের লড়াই নয়। এই লড়াই আমার, আপনার, সকলের। পরিবারে নারীশক্তির আত্মমর্যাদার যে লড়াই শেখাচ্ছেন অর্পিতাদিরা তার গুরুত্ব কম নাকি?
দেখলাম চা বাগিচায় সুন্দর গোছানো হাসপাতাল ১টি, ডিসপেনসরিও ২ টি। আবাসিক ডাক্তার আছে। প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা ২ জন। বাগিচায় নার্সের সহযোগী মিড ওয়াইভস ৪ জন। কম্পাউন্ডার ২ জন এবং স্বাস্থ্য সহযোগী ২ জন। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ১৮ টি, ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ২১ টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড ৪ টি, মেটারনিটি ওয়ার্ড ৬ টি। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার আছে। অ্যাম্বুলেন্স আছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার আছে। বাগিচায় ওষুধ সরবরাহ নিয়মিত। উন্নত মানের পথ্য সরবরাহ এবং নিয়মিত ডায়েট চার্ট অনুসরণ করা হয়। বাগিচাতে স্থায়ী ক্রেশের সংখ্যা ৯ টি, অস্থায়ী ক্রেশের সংখ্যা ৫ টি অর্থাৎ মোট ১৪ টি। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা, শৌচালয় আছে। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের দেওয়া হয়। মোট অ্যাটেনডেন্ট ২৩ জন। পর্যাপ্ত পানীয় জল ক্ৰেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয় । বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় আছে। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে ট্রাক আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব, খেলার মাঠ আছে। চ্যাংমারি টি গার্ডেনে নিয়মিত পি এফ বা গ্র্যাচুইটির টাকা জমা পড়ে। বোনাস চুক্তি অনুযায়ী মিটিয়ে দেওয়া হয়। পি এফ বা গ্র্যাচুইটি বকেয়া থাকে না। শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। ফিরে এলাম চ্যাংমারি বাগিচা থেকে। আসতে আসতে ভাবছিলাম ডুয়ার্সের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চা বাগিচার জনসমাজ বহুবিচিত্র ধারার যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল সেই সংস্কৃতি আবহমানকাল ধরে বয়ে চলেছে এখানকার জল, মাটি, অরণ্যের গানে গানে। চা-বাগিচাগুলিতে বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষজন আয়োজন করে দুর্গাপুজোর। দুর্গোৎসবের সময় পুজোর আনন্দে মেতে ওঠে চা বাগিচার ম্যানেজার থেকে শুরু করে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণির কর্মীবৃন্দ ও তাদের পরিবার। পুজোর কয়েকদিন সবার জন্যে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি সহযোগে পেটপুরে খাবার ব্যবস্থা থাকে প্রায় সব বাগানেই।
চা-বাগানে কর্মরত আদিবাসীদের মধ্যে যাঁরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তাঁরা প্রতি রবিবার নিয়মিত ভাবে চা-বাগানের কাছে চার্চে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়াও তাঁরা উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করেন খ্রিস্টমাস ডে বা বড়োদিন, গুড ফ্রাইডে, ইস্টার সানডে ও ইস্টার মানডে এবং এই উপলক্ষ্যে চার্চে তাঁরা বিশেষ প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেন। ভাদ্র মাসের শুরুপক্ষের একাদশীতে তরাই ও ডুয়ার্সের চা-বাগানগুলোতে মূলত সাঁওতাল জনজাতির মানুষেরা পালন করেন করম উৎসব যা মূলত কৃষি উৎসব। এই উৎসব উপলক্ষ্যে বন থেকে সংগৃহীত তিনটি করম বা কদম্ব গাছের শাখাকে দুধ ও হাঁড়িয়া দিয়ে পরিষ্কার করে নাচের আসর বা 'আখড়ার' মাঝে স্থাপন করা হয় এবং বন থেকে সংগৃহীত ফুল ও ফল দিয়ে উর্বরতা ও সমৃদ্ধির দেবতা করম দেবতার প্রতীকরূপে পূজা করা হয়। পূজার দিন সকালে সাঁওতাল রমণীদের ঢেঁকিতে গুঁড়ো করা চালের ময়দা দিয়ে তৈরি হয় মিষ্টি নোনতা স্বাদের পিঠে এবং যা বিতরিত হয় প্রতিবেশীদের মধ্যে। এই পূজা উপলক্ষ্যে সাঁওতাল রমণীরা কানের পেছনে হলুদ ফুল গুঁজে পরস্পরের কোমর জড়িয়ে সমবেত সংগীত ও ধামসা ও মাদলের তালে তালে সারা রাত ধরে প্রথাগত করম নৃত্যে মেতে ওঠেন এবং এর সঙ্গে চলে একত্রে খাদ্যগ্রহণ ও হাঁড়িয়া পান। পূজার পরের দিন পূজিত করম গাছের শাখাগুলোকে দই দিয়ে স্নান করাবার পর নদীতে বিসর্জনের সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি।
ডুয়ার্সের এইসব চা-বাগিচাগুলিতে নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষেরা পালন করেন পাঁচ দিন ব্যাপী আলোর উৎসব "তিহার'। চান্দ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশ তিথিতে 'কাগ তিহার’ দিয়ে শুরু হওয়া এই উৎসবের পঞ্চম বা শেষ দিনে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে পালিত হয় ভাইবোনের মধ্যে চিরাচরিত প্রীতি ও ভালোবাসার উৎসব ‘ভাইটিকা'। তিহার উৎসব চলাকালীন শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা প্রথাগত গীত ‘ভাইলো ও দেউসিরে' সংগীত গেয়ে ও নৃত্য করে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে অর্থ, খাবার ও মিষ্টি সংগ্রহ করে। পরিবর্তে এই নৃত্য ও গীতে অংশগ্রহণকারী ভাই বোনেরা গৃহস্থের সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনায় আশীর্বাদ প্রদান করে। সাধারণভাবে মেয়েরা গায় ভাইলো' এবং ছেলেরা গায় 'দেউসি' সংগীত। ‘ভাইটিকা' পার্বণে বোনেরা মেঝেতে উপবিষ্ট ভাইদের সামনে নানারকম মিষ্টির থালা সাজিয়ে নিজেদের গাঁথা ফুলের মালা পরিয়ে দেন ভাইদের গলায়। তামার পাত্র থেকে তেল নিয়ে মাখিয়ে দেয় মাথার চুলে এবং কপালে লেপন করে সাতরঙা টিকা' বা তিলক। এরপর ভাইরাও একইভাবে বোনেদের কপালে লেপন করে 'টিকা' এবং তাদের প্রদান করেন উপহার সামগ্রী। আসলে বহু বিচিত্র সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে এই ডুয়ার্স। দার্জিলিং জেলাতে বসবাসকারী শেরপা সম্প্রদায়ের মানুষের পর্বতারোহণে দক্ষতা বিশ্ববিদিত। এই জেলার সমতলের তরাই এলাকায় গোৰ্খা ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশি বাস করেন বড়ো সংখ্যায় বাংলাভাষী মানুষ। পাহাড় ও সমতল মিলিয়ে জেলার মানুষেরা নেপালি, ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি ছাড়াও কথা বলেন লেপচা, টিবেটান, লিম্বু, রাই, তামাং, ইয়াকখা, সুনুওয়ার, ডেনজোংকে, রাজবংশী, বিজোরি (মুন্ডা ভাষা) প্রভৃতি ভাষায়। এখানকার লেপচা, ভুটিয়া, গুরুং ও তামাং সম্প্রদায় নববর্ষ পালন করেন জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসে, যে-উৎসবের নাম ‘লোসার। এ ছাড়াও দার্জিলিং জেলার নিজস্ব সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য উৎসব বুদ্ধজয়ন্তী, চোতরুল ডুচেন, টেনডং লো রুমফাট ও মাঘ উৎসব ইত্যাদিও মর্যাদা সহকারে পালিত হয়। বৈচিত্রের মধ্যে বহু বিচিত্র সংস্কৃতি নিয়ে সমুজ্জ্বল আমাদের এই ডুয়ার্স।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴