শূন্য আমি পূর্ণ আমি/৬
শূন্য আমি পূর্ণ আমি/পর্ব : ৬
অমর চক্রবর্তী
~~~~~~~~~~~~~~~~
কেন লেখার কথা মাথায় এল! সেকি ঐ সিনেমাহল থেকে বেরিয়ে! মনে হত কি সুন্দর কাহিনি। তখন সিনেমাকে বলা হত বই আর কাহিনিকে ফ্যাক্ট। সবসময় সিনেমাহলে যেতে হত না। ভারত সরকারের তথ্য সংযোগ বিভাগ পাড়ায় পাড়ায় তথ্যচিত্র দেখাত। আমরা বলতাম পাবলিসিটি। একবার একটা ছবি দেখাল, নাম "সুজাতা"। এক দলিত অচ্ছুত মেয়ের কাহিনি। সামাজিক অবিচারের কথা। সিনেমা দেখা হয়ে গেলে রাতে ছটফট করছি আর মনে হচ্ছে আমরাও তো অবিচার করছি। আমাদের বাড়িতে যিনি কাঁধে করে মলভান্ড নিয়ে যান। পুজোর দিনগুলোতে আসেন নারু মোয়া নিতে। তিনি এসে বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে মাকে ডাক দিতেন আমরা নাড়ু মোয়া দিতাম। সেও তো অচ্ছুত। কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়লাম। প্রথম বাক্য লিখলাম। আমাদের পাড়ায় সব বাড়িতেই খাটা পায়খানা। নিজেরই বমি পেত আর মানুষটি কিভাবে আমাদের সুস্থ রাখতেন! সেদিন পারিনি। পরে এই দলিত কাহিনি লিখে নিজের মনোবেদনা লাঘব করেছি। আমি কি সত্যিই লিখতে পারব না! টেকনিক্যাল স্ট্রিম পেয়েও আর্থিক কারণে পড়তে না পেরে কলা বিভাগ। একদিকে ভালোই হল। ইকোনমিক্স পল সায়েন্স সংস্কৃত ইতিহাস। তখন ইকোনমিক্স ও রাস্ট্রবিজ্ঞান একসঙ্গে। স্কুল ম্যাগাজিন বেরোবে। সবার লেখা নিচ্ছে। প্রথম দিকে ভালো রেজাল্ট করতাম। কিন্তু লাজুক বলে সামনের বেঞ্চে বসার সাহস হত না। সামনের বেঞ্চে বসত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ব্যবসায়ীদের ছেলে মেয়ে। তখন জেনকিন্সে পড়ার সুযোগ সহজে হত না! আমাকে সামনে আনলেন মাস্টারমশাই জ্যোতির্ময় দাশ শঙ্কর চক্রবর্তী সুধীর চৌধুরী। ভালোবাসতেন হেডমাস্টারমশাই মৃণাল কান্তি বর্মণ। পেছনে বসলেও ভালোবাসতেন মাস্টারমশাই আনন্দ ওঝা নিশীথ কর্মকার গোপেশ দত্ত প্রমুখ। কিন্তু যে ছড়াটা দিলাম ছাপা হল না!ম্যাগাজিন পেয়ে বাড়িতে এসে খুব কাঁদলাম। রাসমেলা থেকে একটা মাটির রবীন্দ্রনাথ কিনেছিলাম। সেই মূর্তির সামনে অনড় বসে থাকলাম। কতক্ষণ জানি না। হঠাৎ মনে হল রবিঠাকুর মূর্তি থেকে বেরিয়ে এলেন, আমার মাথায় হাত রাখলেন। কি আশ্চর্য আমি লিখে ফেললাম 'রেটিনায় আলোর ছটা'। রেটিনা কি ভালো করে জানি না! এই আমার প্রথম কবিতা। পরে ঘষে মেজে পত্রিকায় দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো গল্প লিখতে চাই। নিপীড়িত নিগৃহীতদের কথা। লিখতে চাই ম্যাজিক কথা। আমি দুবার কারফিউ দেখেছি। প্রথমবার একটা সার্কাসে গোলমালের পর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড লুটপাট।সাত আট বছরের ছেলে কারফিউ কি বুঝিনি কিন্তু দ্বিতীয়বার আমার প্রিয় মাস্টারমশাই শংকর বাবুকে সিআরপিএফ গুলি করে, শহরে আবার ভয়়ংকর অবস্থা সরকারি অফিসে আগুন। এইগুলো লিখতে হবে। শংকরবাবু যিনি খোঁজ নিতেন টিফিন পেয়েছি কিনা! বড়লোকের বলশালী ছেলেরা ক্লাস মনিটর হত আর টিফিন আনার সময় প্রায়ই খেয়ে নিত। সরকারি দুটো স্কুলেই টিফিন সিস্টেম ছিল। দুটাকায় সারা মাস নানা রকমের খাবার পেতাম টিফিন পিরিয়ডে। কিন্তু আমি লাস্ট বেঞ্চে বলে প্রায়ই পেতাম না! শংকরবাবু আসতেন আবার আনিয়ে দিতেন।এই ভাবেই অর্থাৎ টিফিন পিরিয়ডে শংকরবাবু বাইরে এসেছেন আর ছেলেরা হৈ হৈ করে ক্লাসরুমের বাইরে এসেছে। এদিকে মদনমোহন বাড়ির চৌপথীতে সিআরপিএফ-এর গাড়ির সঙ্গে আর একটি সংঘর্ষ হয়ে গেছে। একাত্তরে নকশাল দমনে সিআরপিএফ-এর আগমন। হিন্দিভাষী।একটা মজার গল্প চালু হয়েছিল সিআরপিএফ জিজ্ঞেস করছে "আপ কৌন হ্যায়?" তিনি বললেন, "আমি হেডমাস্টার।" সিআরপিএফ বলছে, "ক্যায়া হেডমাস্তান।মারো শালোকো।" এই সিআরপিএফ ছাত্রদের ভয়ে কিনা জানি না গুলি চালায়।কেড়ে নেয় আমার প্রিয় মাস্টারমশাইকে।লিখতে হবে এই সত্য কাহিনি। আমাকে গল্পকার হতে হবে।
লিখতে হবে। কিন্তু কে ছাপবে! স্কুল ম্যাগাজিন আমার লেখা ছাপেনি! তবে কি হবে লিখে! না হোক ছাপা তবু লিখব। দশম শ্রেণি। পড়ার বই তাকে উঠল। অনর্থ বই হাতে উঠে এল। আর এর পশ্চাতে বড় কারণ আমার হঠাৎ অসুখ। সপ্তম শ্রেণি পড়াকালীন নেফ্রাইটিস। হাসপাতালে ভর্তি করা হল। হাত পা পেট ফোলা তবুও বেডে শুয়ে থাকতাম না। সব রোগীর মাথার কাছে যেতাম। আমার দুধ পাউরুটি দিতাম। একদিন আমার ডাক্তার সিস্টার রত্নাদিকে বললেন ও এভাবে ঘুরে বেড়ায় ওকে লাইব্রেরিতে নিয়ে গিয়ে বই দাও। হাসপাতালে লাইব্রেরি! প্রথম ছবি দেখে যে বইটি তুলে নিয়েছিলাম 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট', এরিখ মারিয়া রেমার্ক, বাংলায় মনে সুধীন্দ্র নাথ রাহা! পড়ার রুচি বদল হয়ে গেল! আবার দশম শ্রেণিতে লেখালেখি। কবিতা। বেশ কটা কবিতা। জোগাড় হয়ে গেল নজরুল সুকান্ত। দারিদ্র্যপীড়িত জীবন। আধাদিস্তা কাগজ শেলাই করে খাতা। নজরুলের অনুসরণে লিখলাম, দারিদ্র্যই আমায় করুক মহান/কবিতা হোক আমার অহংকারের শিরস্ত্রাণ।বেশ কিছু কবিতা লেখা হয়ে গেল। কিন্তু কে দেখবে! কাকে দেখাব! পাড়ায় দুজন কবি আছেন, তাদের কাছে যাব কি! শহরে তখন এক সম্পাদক কাম সাংবাদিক ঘুরে বেড়ান। ওনার কাছে গেলে কেমন হয়! যে কথা সেই কাজ। অকৃতদার এই সম্পাদক কখন কোথায় থাকেন জানা মুশকিল! তবু একরাতে তার ভাড়া বাড়িতে গেলাম। মোম জ্বালিয়ে সংবাদ লিখছেন। সংবাদ কম। বিজ্ঞাপন সার। এটাই ওনার উপার্জন। আমি উপস্থিত। তিনি বললেন একটা কবিতা ছাপব। দশ টাকা দিতে হবে। মন খারাপ হয়ে গেল। আরো সম্পাদকের কাছে যেতে হবে।তখন শহরে সব সংবাদ সাম্প্রতিক 'নদার্ণ রিভিউ' (সম্পাদক: মাস্টারমশাই বারীণ রাহা), নাগরিক, দেশবার্তা,পঞ্চনন, কোচবিহার সমাচার। যেতে হবে এই সব জায়গায়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴