সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
28-March,2025 - Friday ✍️ By- সৌগত ভট্টাচার্য 69

মায়াপথের মীড়-৬/সৌগত ভট্টাচার্য

মায়াপথের মীড়/৬
সৌগত ভট্টাচার্য

আমাদের পাড়ায় বর্ষা এলেই আলো জেঠিমাদের বাড়ির কাঠ টগর গাছটা ফুলের ভারে ঝুঁকে পড়ে। প্রতিদিন সকালে কাঠ টগর ফুল রাস্তায় পড়ে থাকে। মেঘ মাথায় এক কিশোরী রাস্তা থেকে একটা কাঠ টগর ফুল কানের পাশে চুলের মধ্যে ফুল গুঁজে পড়ার অন্য প্রান্তে টিউশন পড়তে যায়… 
        এদিকে সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। জলের মধ্যে নিচু হয়ে পা টিপে টিপে দুটো হাত এক করে, খপাত! বাঁটুল চিৎকার করে,"ধরছি ধরছি..." চিম্পু কাঁচের হরলিক্সের বয়ামে ড্রেনের জল ভরে খুব আস্তে আস্তে বাঁটুলের সমানে নিয়ে আসে। হাতে খলবল করা খোলসা মাছটা আস্তে করে বয়ামের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় বাঁটুল। এই নিয়ে তিনটা হল! কাঁচের বয়ামের বাইরে থেকে খোলসা মাছগুলোকে ইয়া বড় দেখায়! বাঁটুল চিম্পু ভোলারা আজ স্কুল যাবে না। ওরা লাইব্রেরীর মাঠে ছেঁড়া মশারি আর গামছা দিয়ে মাছ ধরেছে। বড় রাস্তার হাইড্রেনে তিন মানুষ জল। জলে ভেসে আসা ময়লা কচুরি পানার ফুল হাইড্রেনের মাথা উঁচু করা একটা পুরোনো কাঠের খুঁটিতে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে! বাচ্চারা হাইড্রেনের ‘কারেন্টে' পড়লেই নাকি সোজা বাংলাদেশে চলে যায়… পাড়ার পূজার মাঠ আর হাইড্রেন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে, সেখানে খালি গায়ে বৃষ্টি-ফুটবল খেলছে আমাদের গলির বাবু পাপ্পুরা, নাকের বৃষ্টির জল, আজ সকলেই মারাদোনা প্লাতিনি। মেঘের ডাকের মতোই তাদের উল্লাস চিৎকার ভেসে আসছে জলবাতাসে। গাড়ির চাকা রাস্তার জমা জলে পড়লেই এক বিস্ময়-ফোয়ারা তৈরি করে পাড়ার মোড়ে। রাস্তার গর্তে জমা জলকে ফুটবলের মতো কিক করে ভেজা ইউনিফর্মে কিশোরবেলা হাঁটা দেয় একটা মেঘলা রঙের স্কুলের দিকে। স্কুলের স্যাঁতস্যাঁতে লম্বা করিডোরটা আজ কেউ যেন যত্নে ধোয়া মোছা করেছে। রেনি ডে’র অন্যমনস্ক ঘন্টার শব্দ ছাপিয়ে বৃষ্টির অঝোর শব্দ শোনা যায়! কিশোরের কাঠ টগরের কথা মনে পড়ে।
        পাড়ার মোড়েই নন্দ কাকুর "সোনালী" স্টুডিও। স্টুডিওর ডার্করুমটা যেন কিশোরবেলার এক অবাক জাদু কুঠুরি। সকাল বেলার ঝাপসা নেগেটিভগুলো দুপুর বেলায় জলে ধুয়ে ঝকঝকে ছবি হয়ে যাবে। ক্লিপে লাগিয়ে পরপর অচেনা ছবি শুকোতে দেওয়া হয়। ছবিগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ডে সকাল বেলার একটা মেঘলা আকাশ। বৃষ্টি মাথায় স্কুল ফেরত কিশোর উঁকিঝুঁকি দিয়ে কতবার দেখতে চাইত ওই ছবি তৈরির কারখানা! জলে ধুয়ে নাকি ছবি তৈরি হয়! কী অবাক কান্ড!
        আষাঢ়ের শুরুতে কাদা-পিছল বাড়ির উঠোনে ইঁট পাতা হয়েছে। ইঁট রাস্তার শেষে দূরের দ্বীপের মতো মাথা তুলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘর কুয়োর পাড় বাথরুম পায়খানা। উঠোনের হাঁটু জল ভেঙে মা রান্নাঘরে যায়। কুয়োপাড়ের পাশে মানকচু গাছের তলায় ব্যাঙের বাসা। মা বলে, বৃষ্টি নামার কথা ওরা সবার আগে জানতে পারে। মা রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে, খাটের তলা থেকে জিনিস সরানোর জন্য। ইঁট দিয়ে পায়া উঁচু করা খাটের নীচে আরেকটা গেরস্থালি। গতবার  ফুটো সারানো টিনের একই জায়গা দিয়ে এবছরও জল পড়ছে টপ টপ টপ... বাবা একটা পাত্র রেখে দিয়েছে। সেই পাত্রে কত মিলিমিটার বৃষ্টি ধরে কে জানে! রেডিওতে জলদ গম্ভীর গলায় মেঘ চুঁইয়ে বৃষ্টি জলের খবর আসে! গতকালের বৃষ্টির জল এখনো উঠোন থেকে নামেনি। আরেকটু বৃষ্টি হলেই ঘরের মেঝেতে কাগজের নৌকোর মত ভাসবে বাসন জুতোর বাক্স হাওয়াই চটি আর ভাসবে অনেক দিন চোখের আড়ালে চলে যাওয়া কোনো তুচ্ছ স্মৃতি। সন্ধ্যায় শোয়ার ঘরেই মা একটা জলচৌকির ওপর স্টোভে রেখে চালে-ডালে বসায়। কারেন্ট নেই, লন্ঠনের আলোয় বাবার মুখের চিন্তার রেখাগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। আষাঢ়ের সন্ধ্যায় এক কিশোর দিদির সঙ্গে খাটের উপর বসে থাকে আর ব্যাঙের ডাক শুনতে শুনতে চোখ ঘুমে ঢুলে আসে। ঘরময় মেলা ভেজা কাপড় জামার ভ্যাপসা গন্ধ, কাঠ টগরের গন্ধ কিশোরবেলা টের পায় না!  
      মায়ের হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে, গতকাল নাকি পূর্ণিমা ছিল। সন্ধের পর বৃষ্টি কিছুটা ধরেছে। ঘরের একফালি দরজা দিয়ে উঠোনটাকে রাত-কালো জলের একটা চৌকো পুকুর মনে হয়। উঠোনের চারপাশের কালো গাছের ছায়া, মেঘলা চাঁদের ছায়া পড়ে উঠোন-পুকুরের জলে। সবুজ পাতার ডগা ছুঁয়ে থাকা অপেক্ষমান ফোঁটা বৃষ্টিজল অলৌকিক উঠোন-দীঘির জলে টুপ করে পড়লেই  গোলগোল ঢেউ...চাঁদ গাছ-গাছালির স্থির জলছবি টুকরো করে ভেঙে দেয়।
        মেঘে মেঘে বেলা বাড়ে। কৈশোর কাটানো ঘরটির ঠিক উল্টো দিকে, একই বাড়ির চৌহদ্দিতে উঠোনের এই পারে নতুন ঘরে শুরু হয় কিশোরের যৌবনযাপন। বেখেয়ালে মাঝের উঠোনটির মধ্যে যেন বেশ কয়েকটি সমুদ্র ঢুকে যায় কয়েক বছরে। বৃষ্টি নামলে সেই উঠোন-সমুদ্রের এপারের নতুন ঘর থেকে লেন্স তাক করে সেদিনের কিশোর — ছোটবেলার সিপিয়া রংয়ের টিনের চলাটার ওপর। কিছুতেই যেন লেন্স অ্যাডজাস্ট করতে পারে না সে বৃষ্টি ভেজা কিশোর বেলায়… হাত কেঁপে ঝাপসা হয়ে যায়। অনন্ত বর্ষাকাল চোখ ঝাপসা করে দেয়। সেই কিশোর যেন দেখতে পায় মা হাঁটু জল ভেঙে বাসনপত্র নিয়ে রান্না ঘরে যাচ্ছে, বাবা খাটের পায়ায় ইঁট দিচ্ছে, দিদি স্যাঁতস্যাঁতে জামা কাপড় ঘরে টাঙানো দাড়িতে মেলছে… কানে আসে রেনি ডে'র ঘন্টা, ব্যাঙের ডাক, টিনের ওপর বৃষ্টির শব্দ! দেখে কাচের বয়ামে খোলসা মাছটাকে, মেঘলা রঙের স্কুল বাড়িটাকে, চৌকো উঠোন-পুকুরে চাঁদের ছায়া আর কানের পাশে কাঠ টগর ফুল লাগিয়ে টিউশন পড়তে যাচ্ছে কিশোরী …
          অনেক বর্ষা-যুগ পেরিয়ে পড়ার মোড়ের আলো জেঠিমাদের বাড়ির কাঠ টগর গাছটা এখন অনেক অনেক বড় হয়ে গেছে, অনেক লম্বা। গাছের ছায়া গাছের থেকে লম্বা হয়ে পড়ে গলির মোড়ে। নন্দ কাকুর সোনালী স্টুডিওটি আর নেই। কিন্তু সেই কিশোরের বুকের ভেতরে একটা আস্ত ডার্করুম থেকে গেছে, যা তার একান্ত ব্যক্তিগত ডার্করুম। শুধু অবিশ্রান্ত বৃষ্টিফোঁটায় ছোটবেলার অসংখ্য ঝাপসা জলছবি ছায়া ছায়া...জলে ভেজা সেসব ছবির ঝকঝকে হয়ে ওঠার কোন দায় নেই!

বর্ষাকাল আর কাঠ টগরের গল্পগুলো শুধু ডার্করুমই জানে…! 
যে ডার্করুমে বাইরে লেখা থাকে "প্রবেশ নিষেধ"।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri