মানাবাড়ি টি গার্ডেন
গৌতম চক্রবর্তী
---------------------------
সুখ এবং দুঃখ পাশাপাশি অবস্থান করে। আলোর পাশেই থাকে যেমন অন্ধকার। মানাবাড়ি চা বাগানে গিয়ে চা বাগিচার অন্ধকার দিকটা সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা লাভ করলাম সেটা ডুয়ার্সের অনেক চা বাগিচার সাধারণ এবং স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। যদি কষ্টি পাথরের আলোকে ফেলা যায় তাহলে কুমারগ্রামের তুরতুরি, কালচিনির তোর্সা, রায়মাটাং, বীরপাড়ার লঙ্কাপাড়া, তুলসীপাড়া, মালবাজারের কুমলাই বা মানাবাড়ি, নাগরাকাটার কাছে রেডব্যাঙ্ক, ধরণীপুর, জলপাইগুড়ির রায়পুর একই সমপর্যায়ভুক্ত। হতাশা, শোষণ, বাগিচার মালিকানার ঘনঘন হাতবদল, অপুষ্টি, অনাহার মানাবাড়ি বাগিচার নিত্যসঙ্গী। গোদের উপর বিষফোঁড়া নারী পাচার, চোলাই এবং মাদকের রমরমা এবং বিভিন্ন ধরণের অসামাজিক কাজের রমরমা। বাগিচা শ্রমিকদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিচ্ছে একদল মানুষ যার মাশুল দিচ্ছে অভাবী চা শ্রমিকেরা। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাস থেকে মানাবাড়ি চা বাগান কতবার যে বন্ধ হয়েছে এবং কতবার যে খুলেছে তার পরিসংখ্যান নিতে গেলে চোখ কপালে উঠে যাবে। টোডি টি কোম্পানি লিমিটেডের নামে চা বাগানটি পরিচালিত হয়ে এসেছে দীর্ঘদিন। টোডিরা বাগানটাকে ছিবড়ে করে দিয়ে যাবতীয় লাভের নির্যাস নিয়ে চলে গেছে। পড়ে আছে বাগানের প্রায় হাজারখানেক মজদুর যাদের কথা বলার লোকের সংখ্যা কল্পনাতীতভাবে কমে গেছে ডুয়ার্সের ট্রেড ইউনিয়ন বলয়ে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের শাসকদল শুধুমাত্র রাজনীতি করে নিজেদের ভিত শক্ত করতে চাচ্ছে চা বাগিচা বলয়ে। কিন্তু শ্রমিকদের কথা কেউ ভাবছে না। তার ফলে ধীরে ধীরে ভিসুভিয়াসের লাভাক্ষরণের অপেক্ষাতে ডুয়ার্স রাণীর আতঙ্ক বাড়ছে দিনে দিনে।
আমরা চা বাগিচার সৌন্দর্যই শুধু দেখতে পাই। কিন্তু বাগিচার অন্তরালে রয়েছে কত মানুষের বুকফাটা কান্না এবং যন্ত্রণার ইতিহাস তার খোঁজখবর আমরা কতজন রাখি? ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর সকালে শেষবারের মতন বাগানের সাইরেন শুনে কাজে যোগ দিয়েছিলেন বাগানের শ্রমিক কর্মচারী সকলে। সেই বছর মহাষষ্ঠীর বিকেলে বোনাস সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে বাগান ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তৎকালীন মালিকপক্ষ “টোডি টি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের” প্রতিনিধিরা। শেষ চার বছরে তারা আর ফেরেননি। বাগানের প্রায় ৭০০ শ্রমিক পরিবারের অভাব অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় এই সময়কালে। মানাবাড়ি চা বাগানটি তরাই ব্রাঞ্চ অব ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর অধীন। ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় অজিত ওঁরাও, সুধীর ওঁরাও, প্রকাশ বিশ্বকর্মার মত চা শ্রমিকদের অভিযোগ অনুযায়ী প্রচুর টাকা বকেয়া ছিল। গ্র্যাচুইটি এবং পিএফের টাকা জমা পড়ে নি। রেশনও বকেয়া ছিল। স্বাস্থ্য পরিষেবাও ঠিকঠাক মেলে নি। বাধ্য হয়ে অনেক শ্রমিক কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে গেছেন। আবার অনেকে বাগান লাগোয়া ঘিস, লিস, চেল নদীতে ট্রাকে পাথর, বালি তোলার কাজে লেগে গেছে। মালবাজারের অ্যাসিস্ট্যান্ট লেবার কমিশনার আর্থার হিরো যখন ছিলেন তখন মানাবাড়ি বাগান নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করার সময় তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন মানাবাড়ি চা বাগানের অচলাবস্থা কাটানোর জন্য তাঁরা যে মিটিং আহ্বান করেছিলেন তাতে ম্যানেজমেন্টের কোন প্রতিনিধি যোগদান করেনি। সঙ্গত কারণেই শ্রমিকেরা নতুন মালিক তথা ম্যানেজমেন্ট না এলে বাগান খুলতে না দেবার দাবিতে অনড় ছিলো। মালবাজারের লেবার কমিশনারের অফিসের সামনে তারা হাঙ্গার স্ট্রাইকও করে বাগানের লিজ বাতিল করার দাবি জানায়। তারা সরকারের কাছে নতুন মালিকের কাছে বাগান বিক্রি করে দেবার দাবি জানায় যারা দায়িত্ব নিয়ে বাগান পরিচালনা করবে। কিন্তু সরকার কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে নি মালিকপক্ষের অসহযোগিতা এনং হাইকোর্টে মামলার কারণে। তাই দীর্ঘদিন ধরেই ফাউলাই এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে বাগিচা শ্রমিকেরা মাত্র ১৫০০ টাকা রোজগারের ভরসাতেই কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে মানাবাড়ি চা বাগানে।
মালবাজার মহকুমার মানাবাড়ি চা বাগানটি বন্ধ হবার সময় আইটিপিএ এবং টিপার সদস্য ছিল। বর্তমানে কোন ম্যানেজমেন্টের ছত্রছায়াতে তা জানা যায় নি। অবশেষে খুলেছে বাগান। বর্তমান কোম্পানি ২০২০ সালে বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। তবে বাগান এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তরাই ডুয়ার্স প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার ইউনিয়নের জয়েন্ট জেনারেল সেক্রেটারি পুলিন গোলদারের কাছ থেকে জেনেছিলাম দীর্ঘদিন ধরেই মানাবাড়ি চা বাগান বন্ধ করে রেখেছিলেন পুরোনো মালিক নিরঞ্জন টোডি। যার ফলে চরম সমস্যার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছিল বাগানের প্রায় ৭০০ শ্রমিক ও তার পরিবার। রাজ্য সরকারের চেষ্টায় দ্রুততার সাথে এই বাগান খুলেছে। “টি অ্যান্ড বেভারেজেস প্রাইভেট লিমিটেড” নামক কোম্পানি বাগানটির দায়িত্ব নিয়েছে। এ বিষয়ে প্রাক্তন মালিক নিরঞ্জন টোডির সাথে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা হলেও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাই তার কোনোরূপ প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায়নি। শ্রমিকদের মধ্যে খুশির হাওয়া। শ্রমিক রমেশ কুর্মি, ডিম্পল মঙ্গর, সুনিতা ওরাওঁ, বিমল ওরাওঁ, জয়রাম ওরাওঁ, আশিক প্রজা, লক্ষণ মুন্ডা প্রমুখ এর জন্য নতুন মালিকপক্ষ এবং রাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। ক্ষেত্রসমীক্ষার সময়ে বাগানটি পুরোপুরি বন্ধ ছিল এবং চারিদিকে ছিল জঙ্গল এবং ফ্যাক্টরি ছিল পোড়োবাড়ির মত। বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ তিনজন। বাগানে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন পাঁচটি। এগুলি হল এনইউপিডব্লিউ, সিবিএমইউ, পিটিডব্লিউইউ, টিডিপিডব্লিউইউ, এবং ডিটিডিপিএলইউ। কিন্তু প্রায় সব ট্রেড ইউনিয়নেই কোথাও কেন্দ্রীয় আবার কোথাও বা রাজ্যের শাসকদলের দাপাদাপি। মানাবারি চা বাগানের আয়তন ৪৫০ হেক্টর এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র সমপরিমাণ। এক্সটেন্ডেড জমির পরিমাণ ২৭১.১৬ হেক্টর এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ১০০.৬ হেক্টর। সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ২৭১.১৬ হেক্টর এবং উৎপাদনক্ষম আবাদীক্ষেত্রও তাই। মানাবাড়ি চা বাগিচার সাব স্টাফ এর সংখ্যা কুড়ি জন। করণিক নেই। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ মাত্র একজন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৩০০ জন। মোট জনসংখ্যা ৩২৫০ জন। স্থায়ী শ্রমিক ৩৪২ জন। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী বিঘা শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১১৬ জন। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক সংখ্যা ১৪০ জন। কম্পিউটার অপারেটর নেই। মোট কর্মরত শ্রমিক ৩৬৫ জন।
মানাবারি চা বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত কাঁচা চা পাতা ১০ লাখ কেজি গড়ে। ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চা গড়ে প্রায় ২.৫ লাখ কেজি উৎপাদন হত। বর্তমানে ফ্যাক্টরি চালু থাকলেও ঘুরে দাঁড়াতে সময় তো লাগবেই নতুন ম্যানেজমেন্টের। বাইরের বাগান থেকে কাঁচা পাতা কিনে তার থেকে চা প্রস্তুত করার পরিকাঠামো ফ্যাক্টরিতে আছে। উৎপাদিত চা প্রকৃতিগতভাবে সিটিসি এবং ইনঅরগানিক। মানাবাড়ি বাগানটিকে চরিত্রগত দিক দিয়ে দুর্বল পরিকাঠামোর এবং নিম্নমানের বাগানে পরিণত করেছে বর্তমান পরিচালকবৃন্দ একথা বললে সত্যের অপলাপ হয় না। মানাবাড়িতে সরকারি সংস্থা অন্বেষা ক্লিনিকের উদ্যোগে মানব পাচার ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ে রোখা নিয়ে ক্লিনিকের উদ্যোগে চা বাগানগুলিতে প্রায়ই সচেতনতা শিবির করা হয়। মানাবাড়িতে দেখলাম এরকম একটা সচেতন শিবির সংঘটিত হচ্ছে। একদল মেয়ে গাইছে ‘হাম দেশ কি হ্যায় আম, হাম দেশ কি হ্যায় শান, না সমঝো তুম হামে, বিকনে কি সামান’। কৌতূহল হল। দেখলাম জবালা অ্যাকশন রিসার্চ অর্গানাইজেশন এবং নোভাল ফাউন্ডেশন নামে দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে পথনাটিকা, গান এবং বিভিন্ন স্লোগানের মাধ্যমে সচেতনতা শিবির চলছে। খোঁজখবর নিয়ে পেলাম ডুয়ার্সের বাগিচাগুলির এক ভয়াবহ চিত্র। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সদর ব্লক থেকে ৭৫ টি নারী পাচারের অভিযোগ প্রশাসনের কাছে জমা পড়েছে। এর মধ্যে ১৮ জন নাবালক সহ ৫০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার মধ্যে মানাবাড়ির ৭ জন, রায়পুরের ১৮ জন, ডেঙ্গুয়াঝাড়ের ১৪ জন ও ভান্ডিগুড়ির ৩ জন রয়েছে। চা বাগানের ওয়েলফেয়ার অফিসার, স্বাস্থ্য দপ্তরও ডুয়ার্সের বিভিন্ন বাগান থেকে যেভাবে নারী এবং নাবালক পাচার হচ্ছে তাতে উদবেগ প্রকাশ করেছে। প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় সোর্স তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের কাছে কোন অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমা পড়ে না।এখনও পর্যন্ত এই ধরনের যত অভিযোগ দায়ের হয়েছে তার মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ নাবালিকাকে উদ্ধার করে আনা সম্ভব হয়েছে। বাকিদের ঠাঁই হয়েছে অন্ধকার জগতে। শুধু পুলিশের পক্ষে এই সামাজিক ব্যাধি রোখা কঠিন কাজ হলেও সচেতনতা প্রচারের মাধ্যমে, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের সহযোগিতায় কয়েকটি সাধারণ বিষয় মেনে চললেই নারী পাচার এবং নাবালিকা ও শিশুদের উপর অত্যাচার কমিয়ে আনা সম্ভব।
ডুয়ার্সের বন্ধ চা বাগিচার মেয়েদের দিকে নজর অনেকেরই। অনেকেই চায় ওরা ‘কম পয়সার কামওয়ালি’ হিসেবে কাজ করুক বাড়িতে। অনেকে আবার ওদের ভিনরাজ্যে কাজ পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখাতে ঘুরঘুর করে বাগানে। নারী পাচার তরাই ডুয়ার্সের চা বলয়ে নতুন কিছু নয়। চা বাগান বন্ধ থাকলে তো কথাই নেই। খোলা চা বাগানেও অনেক সময় ঘুরঘুর করে মেয়ে ধরার আড়কাঠিরা। ওদের প্রলোভনে পা দিলেই সর্বনাশ। মানাবাড়ি সহ ডুয়ার্সের বিভিন্ন ব্লকের বিভিন্ন চা বাগান থেকে হতদরিদ্র যুবক-যুবতীরা কাজ করতে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে। আর্থিক অনটনের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই বাগান এলাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার আদিবাসী যুবক যুবতী বা কিশোর কিশোরীরা। কর্মসংস্থানের অভাব, স্বল্প মজুরির কারণে বাগান সংলগ্ন এলাকার যুবক-যুবতীরা দালালের মাধ্যমে দিনরাত্রি পাচার হয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ। মাঝেমাঝেই চা বাগানের বিভিন্ন যুবক যুবতীকে বাড়িতে না জানিয়ে দিল্লিতে কাজ করানোর জন্য নিয়ে যায় দালালচক্র। দিল্লি হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশের রাজ্যগুলিতে এক ধরনের এজেন্সির হাতে তুলে দেয় এরা। বদলে মাথাপিছু দশহাজার থেকে পনেরো হাজার টাকা কমিশন পায়। মোটা মাইনের কাজের লোভে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়ে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, লাঞ্ছিতা, ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনা এর আগে বহুবার সামনে এসেছে। অনেকে যেমন লাঞ্ছনা, গঞ্জনার শিকার হয়, অনেকেই আবার হারিয়ে যায় অন্ধকার জগতে। মেট্রোপলিটন শহরের ঘুপচি গলির অন্ধকার, স্যাঁতস্যাতে ঘরেই কেটে যায় অনেকের যৌবনের দিনগুলি। ডুয়ার্সের কুমারগ্রাম থেকে শুরু করে এলেনবাড়ি পর্যন্ত একশ্রেণির দালাল ছড়িয়ে রয়েছে। তারা আর্থিক অনটনের সুযোগ নিয়ে ভালো মানুষের ছদ্মবেশে অভাবী পরিবারের সঙ্গে মিশে গিয়ে সময় বুঝে ফাঁদ পেতে নাবালিকাদের অন্যত্র পাচার করছে। শুধুমাত্র আর্থিক কারণেই প্রাথমিকভাবে বিষয়টিতে পরিবারের অভিভাবকদের সায় থাকে। কিন্তু যতক্ষণে তারা প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন ততক্ষণে পাচার হওয়া নাবালিকার যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ফলে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতেও দেরি করে ফেলেন অভিভাবকরা।
মোবাইল ফোনের দৌলতে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় হরেকরকম প্রলোভনের হাতছানি। কথা বলেছিলাম জলপাইগুড়ি জেলা শিশুকল্যাণ কমিটির চেয়ারপার্সন বেবি উপাধ্যায়ের সঙ্গে। জেনেছিলাম নাবালিকার পাশাপাশি জলপাইগুড়ির বিভিন্ন চা বাগান থেকে নাবালকদেরও পাচার করা হচ্ছে। তাদের ভিনরাজ্যে নিয়ে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামানোর চক্র সক্রিয়। দেখা যাচ্ছে মানাবাড়ি, কুমলাই, সাইলি বা রাণীচেরা নয়, জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের ডেঙ্গুয়াঝাড়, রায়পুর, ভান্ডিগুড়ি, ভাণ্ডারপুর, করলাভ্যালির মত বাগান থেকে মোটা প্রলোভন দেখিয়ে নাবালকদেরও পাচার করা হচ্ছে। ওই নাবালকদের ভিনরাজ্যে নিয়ে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির কাজে লাগানোর ঘটনাও সামনে এসেছে। উদ্ধার হওয়া নাবালকদের নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। পরে তাদের ভিক্ষা করার জন্য বলা হয়। তারা রাজি না হলে মারধর করা হয়। অন্যদিকে, নাবালিকাদের দিয়ে বাড়ির কাজ করানোর পাশাপাশি ম্যাসাজ পার্লার, ড্যান্স বারে কাজে লাগানো হয়। চা বাগান এবং তার বাইরেও গ্রাম ও শহরে নাবালক বালিকাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে অনেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষায় অসফল হলে বা প্রেমে বাড়ির বাধা পেয়ে বিশেষত নাবালিকারা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে। চা বাগানের পাশাপাশি এখন গ্রামাঞ্চলেও অল্পবয়সি মেয়েরা বিভিন্ন কারণে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ পাচার হচ্ছে। জলপাইগুড়ি জেলার চাইল্ড লাইনের সঙ্গে যুক্ত অপর্ণা ভট্টাচার্যের মতে, আগামী প্রজন্মকে এই ধরনের সামাজিক ব্যাধি থেকে দূরে রাখতে পরিবারের ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অচেনা কেউ ভালোবাসার সম্পর্ক গড়তে চাইলেই তাতে সম্মতি দেওয়া উচিত নয়। অভাবের সুযোগ নিয়ে কেউ কারও সঙ্গে মেশার আগে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য ও পুলিশকে জানিয়ে ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া উচিত। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও উচিত তাদের ছেলেমেয়েরা কাদের সঙ্গে এবং কিভাবে মিশছে সেদিকে সজাগ থাকা। তবেই নারীদের ওপর নির্যাতনের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।
তবে আশার কথা এবার বেঁকে বসেছে ওরাই। ওরা পড়তে চায়। ওরা চায় প্রতিবেশীদের কেউ যেন আর হারিয়ে না যায়। তাই ওদের মুখে এখন শোনা যাচ্ছে প্রতিবাদের গান। বাগানে বাগানে ওরা গাইছে। ওরা সংগঠন গড়ছে। এবার সমস্ত কিছুর প্রতিবাদে পথে নেমেছে বাগিচার মেয়েরাই। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে এখন ওরা এলাকাবাসীকে সচেতন করার কাজে নেমেছে। ভিনদেশে বা ভিনরাজ্যে কাজের খোঁজে যে সমস্ত মানুষ বিশেষ করে যে মেয়েরা যাচ্ছে তাদের সচেতন করে তুলতে জবালা অ্যাকশন রিসার্চ অর্গানাইজেশন এবং নোভাল ফাউন্ডেশন নামে দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে ডুয়ার্সের চা বাগানের কিশোরীদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছোটো ছোটো দল। দলগুলি চা বাগানের বিভিন্ন শ্রমিক মহল্লায় ঘুরে ঘুরে পথনাটিকা, গান এবং বিভিন্ন স্লোগানের মাধ্যমে গড়ে তুলছে সচেতনতা। জবালা অ্যাকশন রিসার্চ অর্গানাইজেশনের মাদারিহাট-বীরপাড়া ব্লকের কো অর্ডিনেটর আবদুল লতিফের সাহায্যে মেয়েরা নিজেদের উদ্যোগে মাঝে মাঝে সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করছে। মানুষ সচেতন হলেই চা বলয়ে পাচারের ঘটনা বন্ধ হবে। মানাবাড়িতেই দেখলাম ন্যাকড়া ভিজিয়ে বাবুদের ঘর আর মুছতে চায় না ওরা। চায় না বাবুদের কাপড় কাচতে। ওরা চায় পড়তে। সন্ধ্যার গোধূলি লগ্নে গৃহাভিমুখী আমি এক ভ্রামণিক সবুজ গালিচায় দেখতে পেলাম দিন বদলের স্বপ্নে উজ্জীবিত একদল কিশোর কিশোরীর চোখেমুখে দারিদ্র্যের মাঝেও মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন। —