ভাস্কর্যের আঁতুরঘর/৬
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-৬)
মৈনাক ভট্টাচার্য
–---------------------------------
নাগেশ যবলকরের ‘শ্যামবাজার পাঁচ মাথা মোড়ের অশ্বারূঢ় নেতাজি’
রবীন্দ্রনাথের মতো নেতাজিও যে বাঙালির হাতে পড়ে প্রতিনিয়ত নানা ভাবে ব্যবহৃত হয় এ সত্য অস্বীকারের নয়। সুভাষের সুবাস পাওয়ার অনেক গল্পই সর্বজনীন বাঙালি জীবনের ইতিহাস হয়ে আছে। তাই বলে নেতাজিকে নিয়ে দিক নির্দেশে কম্পাসেরও কাজ করানোর মত জাতি হয়ত সত্যিই বিরল। যখন গুগল আসেনি, জি পি এস এর নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেমও ছিল না, তখন শ্যাম বাজার পাঁচমাথা মোড়ের ১৬ ফিট উঁচু বেদির উপর, চার টন ওজনের এবং ১৫ ফিট ১ ইঞ্চি উচ্চতার ব্রোঞ্জের এই নেতাজিই ছিল আমবাঙালীর টালা থেকে টালিগঞ্জ দিক নির্দেশের কম্পাস।
নেতাজির এই মূর্তির আঁতুড়ঘরেও রয়েছে নানান রঙিন গল্প। তখন সবেমাত্র দেশ স্বাধীনের এক দশক পেরিয়েছে। সরকারী ভাবে ঘোষিত, বিমান দূর্ঘটনায় নেতাজি মৃত। অথচ বাঙালি মন থেকে মেনে নেয়নি এই ঘটনা। নানা জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত খবর আসছে আজ ওনাকে ছদ্মবেশে এখানে দেখা গেছে তো কাল ওখানে। নেতাজির যা চরিত্র তাতে সবার দৃঢ় বিশ্বাস হঠাৎ করেই উনি উদয় হবেন মুশকিল আসানের মতই। ১৯৫৮ সালে কলকাতার মেয়র তখন ত্রিগুণা সেন। মেয়র কাউন্সিলের এক সভায় এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কলকাতায় নেতাজির একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি বসানো খুব প্রয়োজন। মূর্তি তৈরির সব কিছু খুঁটিনাটি সুষ্ঠভাবে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়ে তৈরি হল ষোল সদস্যের কাউন্সিলার নিয়ে এক প্যানেল। কমিটির মাথায় তখন ১৯২৮-এর সেই ঘটনা, সামরিক সাজে সজ্জিত হয়ে দুই হাজার বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সেনা, সামনে সেনাপতির তেজে দেশ স্বাধীনের বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ঘোড়ায় চেপে নেতাজির হাওড়া থেকে পার্ক সার্কাস অভিযান। অবাক বিস্ময়ে যা প্রথম ভারতীয়দের মনে করিয়ে দিয়েছিল ‘আমরাও পারি’। সেই শুরু, ভারতীয়দের নেতাজি ভাবতে শিখেছিলেন সামরিক দক্ষতা শুধু ব্রিটিশদের একাধিপত্ব নয়। গান্ধীজির হৃদয় হয়ত ভয়ে কেঁপে উঠেছিল সুভাষের এই কাজে। হয়ত ভেবেছিলেন, এই বুঝি সুভাষ তাঁকে সরিয়ে দিয়ে ভারতীয়দের চোখে সর্বাদিনায়কত্ত্বেরর দাবীদার হয়ে উঠবে। নয়ত কেনই বা তিনি এই ঘটনায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেবেন-“পার্ক সার্কাসে সার্কাস চলছে।” এই ব্যক্তিত্বের তেজকে অমর করে রাখবার বাসনায় ঘোড়ার পিঠে নেতাজির ম্যাকেট(কাজটির ছোট রূপ) চেয়ে পাঠানো হল দেশের নানান ভাস্করের কাছে। শান্তিনিকেতন থেকে পাঠালেন রামকিঙ্করও। তাঁর বরাবরের সাধ কলকাতায় একটা কাজ করেন। রামকিঙ্করের ভাষায়- “ বিষয়টা আমার খুব মনে ধরে ছিল। নেতাজিও যেমন তেজের প্রতীক, ঘোড়াও তো তেজেরই প্রতীক।” নেতাজি আর ঘোড়াকে একাকার করে বানিয়ে ফেললেন ম্যাকেট। কমিটির কাছে পাঠিয়েও দিলেন। কমিটির পছন্দ হলনা। সেই ম্যাকেট আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে এলো। সে যাক, সে তো অন্য গল্প। এই মূর্তি গড়ার জন্য কাউন্সিলরের প্যানেল দায়িত্ব দিলেন বিশিষ্ট মারাঠি ভাস্কর নাগেশ যবলকর(যোগলেকার)কে। তাঁদের পছন্দ, নেতাজির সেই ঘোড়ায় চড়ে পার্ক সার্কাস যাত্রার ব্যক্তিত্ব। এই মূর্তি হবে একেবারে আইরিশ ভাস্কর জন হেনরি ফলির ব্রিটিশ সুলভ আভিজাত্যে গড়া কলকাতার আর এক বিখ্যাত ভাস্কর্য আউট্রামের ঘোড়ার পিঠে চেপে বসার মত। যে মূর্তিটি এখনও রক্ষিত আছে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পূর্ব দিকের বাগানে। তাঁরা নাকি নানান কোণ থেকে ঘোড়া সমেত আউট্রামের মূর্তির ছবি তুলে মুম্বইতে গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন ভাস্কর নাগেশকে। সেই ছবি দেখেই ফরমায়েশি মূর্তি গড়লেন ভাস্কর। ১৯৬৯-এ মোম্বইতে তৈরি হল মূর্তি। সমস্যা দেখা দিল এত বড় মূর্তিকে কলকাতায় নিয়ে আসা হবে কি ভাবে। সামনের ২৩শে জানুয়ারি উদ্বোধন করতেই হবে কেননা এর মধ্যে কেটে গেছে এগারোটা বছর। চার বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে রাজ ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে কলকাতায় প্রথম নেতাজির পূর্নাবয়ব মূর্তিটিও বসানো হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তিন ভাগে সেই ব্রোঞ্জের টুকরো এলো কলকাতায়। নাগেশও এলেন, তত্ত্বাবধান করলেন নিজে দাঁড়িয়ে। প্রথম পূর্ণাবয়ব মূর্তি না হলেও এমন ঘরের দেশনায়কের অশ্বারূঢ় এই মূর্তি, শ্যামবাজারের মতো জায়গায়, একেবারে পাঁচরাস্তার মোড়ে। এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে দুই-তিন দিনের জন্যে বন্ধ রাখতে হয়েছিল শ্যামবাজার মোড় দিয়ে সমস্ত ট্রাম চলাচল। ট্রাম লাইন আর ট্রামের তারকে বাঁচিয়ে বা প্রয়োজন মত পুনর্বিন্যাস করে অনেকখানি জায়গা জুড়ে মূর্তির স্থাপনাটি ছিল এক বিশাল ও জটিল কর্মকাণ্ড। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের মতো জায়গায়, সেই সময়ের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ট্রাম চলাচল বন্ধ রেখে, দরকার মতো বাসের রাস্তা সাময়িকভাবে ঘুরিয়ে বা সরু করে দিয়ে সে কাজ কিন্তু খুব সুষ্ঠুভাবেই সমাধা হয়েছিল। নেতাজির জন্যে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছিলেন সাময়িক অসুবিধে। এই উদ্বোধন দেখবার জন্য স্বাধীনতার একুশ বছর পরেও মানুষের ভেতর উন্মাদনা কিছু কম ছিলনা। অবশেষে নেতাজির ৭৩তম জন্মদিনে বিজ্ঞানী ও জাতীয় অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার তৎকালীন অধ্যক্ষ বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলকাতা পুরসভার মেয়র ততদিনে অবশ্য ত্রিগুণা সেনের জায়গায় গোবিন্দচন্দ্র দে র উপস্থিতিতে মূর্তির আবরণ উন্মোচন হল। বিতর্কও সৃষ্টি হয়ে গেল মূর্তি দর্শনের প্রথম দিন থেকেই। আউট্রাম তো ডান দিকে ঘুরে বসেছেন ঘোড়ার পিঠে চেপে। ডান হাত ঘোড়ার পিঠে রেখে সামঞ্জস্য তৈরি করেছেন ভাস্কর জন হেনরি ফলি। আবেগের গতিতে লেজ যদিও ফলি বাঁকিয়ে ফেলেছেন অনেকটাই। তবুও লেজের বিস্তার এবং বাকি সব কাজ মিলিয়ে বেমানানটা অনেক কম। কিন্তু এই কাজকে অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে এটা কী করলেন নাগেশ যবলকরের মত ভাস্কর! ঘোড়ার লেজ পিঠের সাথে সমান্তরাল ভাবে সোজা, সেটার কিই যে বাস্তবতা আজও বোঝা গেলনা। ডান হাতে কিংবা পায়ে নেতাজির দৃঢ়তাহীনতা। চেহারায় নেতাজির তেজ অস্পষ্ট। একটু ভাল ভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় ঘোড়া আর নেতাজির অনুপাতেও রয়ে গেছে বিস্তর গোলমাল। আরও অনেক অনেক ত্রুটি- যা নাগেশ যবলকরের মতো শিল্পীর কাছ থেকে একদমই আশা করা যায় না। এর বাস্তব কারণ খুঁজলে বোঝা যায় শিল্পীকে রাজনৈতিক নেতাদের কাজের ফরমায়েশ চাপিয়ে দেওয়া কখনও কখনও যে বড়ই বালাই। আমাদের চোখের সামনে জলন্ত প্রমাণ হয়ে থাকল শ্যামবাজার পাঁচ মাথা মোড়ের এই নেতাজি মূর্তি। পঞ্চাশ বছর পার করে আজও সেই কলঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছে শ্যামবাজারের নেতাজি, তার সাথে সাথে সেটাই বয়ে বেড়াচ্ছে বাঙালির বিবেক......।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴