বাগানিয়া জার্নাল
পর্ব।।ছয়।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^
প্রায়
পাঁচ হাজার বছর আগে সবুজ-চায়ের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল -ওলং চায়ের হাত ধরে
খৃষ্টীয় সতেরো শতকে সে এসে পৌঁছল আজকের কালো-চায়ে। সে ও এক আকস্মিক
আবিষ্কার।
আগের পর্বে বলা
হয়েছে যে চায়ের পাতাকে একটু দলাইমলাই করে, থেঁতলিয়ে রস বার করে খোলা
হাওয়ায় ফেলে রাখলে তার ভিতরে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়।পাতার রঙ সবুজ থেকে
লালচে-কালো বা বাদামী হয়ে ওঠে।
কিন্তু
দেখা গেল রস মাখানো থ্যাঁতলানো পাতাকে গেঁজানোর জন্য বেশীক্ষণ ফেলে রাখলে
সে চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।যেভাবে মাটিতে পড়ে থাকা পাতা স্বাভাবিক নিয়মে পচে
যায়।
তবে, অভিজ্ঞতা থেকে এও দেখা গেল যদি কিছু সময়
পরেই তাকে দ্রুত শুকিয়ে নেওয়া হয় –তাতে পাতার সেই নষ্ট হয়ে যাওয়াটা আটকানো
যায়। ফলে, সেই থ্যাঁতলানো চা পাতাকে কিছু সময়ের জন্য গেঁজাতে দিয়ে আবার
কড়া রোদ্দুরে বিছিয়ে তাকে শুকিয়ে নেওয়া হতে লাগল। শুকিয়ে গেলে কাপড়ে ভরে,
চাপ দিয়ে চা-কেক, চা-বল বা চা-ইঁট বানিয়ে নেওয়া হতে লাগল।
সেই পাতা থেকে তৈরি চা অন্য রকমের - অন্য রঙের(লালচে-কা্লো), অন্য সুবাসের।সবুজ-চা থেকে তা অনেকটাই আলাদা।তার নাম হল ওলং চা।
থ্যাঁতলানো
চায়ের এই গুনগত পরিবর্তনটা ঘটে বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে পাতার কোষের
উপাদানগুলোর জারণ প্রক্রিয়ায় – যাকে চলতি কথায় ভুলভাবে বলা হয় ‘গেঁজানো’ বা
ফার্মেন্টেশান।
ফার্মেন্টেশানের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে তখন চিনে ওলং-চা তৈরির হিড়িক পড়ে গেল।
সবুজ-চা আর ওলং-চা পাশাপাশি চলল দীর্ঘদিন। বছরের পর বছর।
তারপর...
গল্পকথা বলে সতের শতকের মাঝামাঝি সময় চিনের জ্যাংশি( Jianxi) থেকে একদল সৈন্য
হঠাৎ
করে ফুজিয়ান প্রদেশে এসে এক চা-কারখানার পাশের মাঠে ক্যাম্প করে বসে।হঠাৎ
করে এই সৈন্যদলের এসে পড়ায় গ্রামের সব কাজ প্রায় চৌপাট হয়ে গেল।সেখানকার সব
লোককে যখন তখন ওই সৈন্যদের নানা রকম ফাইফরমাশ খাটতে হত। তারপর নিজেদের
কাজ, চা তৈরির কাজ। ফলে থ্যাঁতলানো চা পাতা অনেক বেশী সময় ধরে পড়ে থাকতে
লাগল। বেশী বেশী ‘ফার্মেন্টেশান’ হয়ে যেতে লাগল।পাতা বেশী লাল হয়ে গিয়ে
স্বাভাবিক ভাবেই নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করল।
সেই
নষ্ট হয়ে যাওয়া ঠেকাতে তাকে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু বিকেল হয়ে
সূর্য যে ঢলতে শুরু করেছে। তাই আর কোন উপায় না দেখে এক চা-চাষী পাইনকাঠের
আগুন জ্বেলে তারওপর পাতা বিছিয়ে সেঁকে শুকিয়ে নিল সেসব।তবে তৈরী চায়ের
পাতার রঙ হয়ে গেল কালো।
সেই
পাতা থেকে যে পানীয়-চা তৈরি হল তা যেমন বেশী লাল, বেশী কড়া তেমন তাতে
বেশ একটা ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ (smoky)। অল্প পাতাতেই বেশ অনেকটা লিকার পাওয়া
যাচ্ছে।লিকার কড়া ।আর কী আশ্চর্য!!সাধারণ লোকেদের বেশ ভাল লেগে গেল সেই
চা।
ফলে, তখন থেকেই থ্যাঁতলানো চা পাতাকে আগের থেকে
একটু বেশী সময় ধরে গেঁজিয়ে বা ফার্মেন্টেড করে, পাতা যখন সবুজ থেকে প্রায়
পুরো বাদামী-লাল হয়ে উঠছে, তাকে আগুনে সেঁকে (bake) বা ভুনে (roast)
এরকমের কালো চা বানানো চালু হয়ে লাগল। শুরু হল কালো চায়ের (Black Tea)
জয়যাত্রা।
##
আগেই বলা হয়েছে যে
সবুজ-চা ছাড়া অন্য সব চা (যেমন সাদা-চা, হলুদ-চা,বেগুনী-চা) তৈরির পদ্ধতি
এই কালো-চা তৈরির মতই – সামান্য রকমফের থাকে মাত্র ।তাই আজকের দিনের
কালো-চা তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে একটু জেনে নেব। তাহলে অন্য সব চায়ের মূলগত
পার্থক্য এবং অর্থোডক্স ও সিটিসি চায়ের পার্থক্য সহজেই বোঝা যাবে।
প্রথমেই
দুটি-পাতা-একটি-কুঁড়ি হিসেবে, কখনওবা সঙ্গে আরও দুটো পাতা সমেত, গাছ থেকে
চা-পাতা ভেঙে তুলে নিয়ে আসা হয়। একে বলে পাতা-তোলা (Plucking)।
সেই
পাতাকে ছায়ার নীচে খোলা হাওয়ায় বিছিয়ে ‘কিছুটা’ শুকিয়ে নেওয়া হয়। বাগানিয়া
ভাষায় তা ‘শুকলাই’ (Withering)। এতে পাতা কিছুটা মিইয়ে যায়। তাতে দলাইমলাই
করতে সুবিধা হয়- পাতা ভেঙে চুরচুর হয়ে যায় না।
এবার
সেই পাতাকে দলাইমলাই বা পেষা হয় – যে ভাবে ঘানিতে সর্ষে বা আখ মাড়াই করা
হয়। তবে তা খুব অল্প চাপে- যাতে পাতাগুলো মন্ড হয়ে একে অন্যের সঙ্গে মিশে
না যায়-কিন্তু পাতাগুলো ফেটে অল্প অল্প রস (juice) বেরিয়ে পাতার সঙ্গে
মাখামাখি হয়ে যায়। চুষি পিঠে বানাবার সময় মায়েরা যেমন এক তালুতে একটু চালের
মন্ড রেখে অন্য তালু দিয়ে চাপ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোল গোল করে দেন –
অনেকটা সেরকম। এখানেও পাতাগুলো লম্বাটে-গোল-গোল হয়ে যায়। চেষ্টা করা হয়
যাতে পাতাগুলো ভেঙে না গিয়ে যতটা বেশী সম্ভব লম্বাটে- গোল রাখা। একে বলে
‘মোলাই’ বা Rolling। একদম শুরুতে এই কাজটা হাতে করা হত। সেই ‘হাত-মোলাই’
চা এখনও পাওয়া যায়...মূলত দার্জিলিং অঞ্চলে। ওলং চায়ের ক্ষেত্রে এখনও অনেক
জায়গায় এই হাত-মোলাই চালু আছে। চিনে দক্ষ শ্রমিকেরা এই কাজটা করে।তারা
পাতাকে হাতের তালুতে রেখে anti-clockwise ঘোরায় যাতে পাতাগুলো পাক খেয়ে
পেঁচিয়ে যায়। জাপানীরা আবার সামনে-পিছনে ‘রোল’ করায় যাতে সুন্দর গোল সূঁচের
মত হয়। ভারতের আসামে যখন প্রথম কালো-চা তৈরি চালু হল তখন শ্রমিকেরা কাঠের
বাক্সের মধ্যে পাতা রেখে পা দিয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে সেগুলো দলাইমলাই করত।
তারপর
আসে ধাতুর মেশিন। যে মেশিনে এই কাজটা করা হয় তাকে বলে Rolling
Table/Rolling Machine। কাজটা কিন্তু যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। একটা
ধাতুর প্লেটের ওপর পাতা রেখে তার ওপরে আর একটা ধাতুর প্লেট চাপ দিয়ে নিয়মিত
ছন্দে ঘুরতে থাকে। যেমন রুটি বেলা হয়।তারমধ্যেই পাতাগুলোকে গুছিয়ে বা
উল্টেপালটে দিতে হয় মাঝে মাঝেই। তা হাত দিয়েই করতে হয়। সামান্য
অন্যমনস্কতায় সেই হাত পিষে, দুমড়ে মুচড়ে যেতে পারে। যায়ও। সেরকম ঘটনা শোনা
যায় মাঝে মাঝেই।
এবার সেই গেঁজানো বা
‘ফার্মেন্টেশান’। রস মাখামাখি দলাইমলাই করা পাতাগুলোকে ঠান্ডা জায়গায়
বিছিয়ে রাখা হয় কিছুক্ষণ। দলাইমলাই প্রক্রিয়ায় অনেক তাপ জন্মায়। তাই ঠান্ডা
জায়গায় রাখা – যাতে পরের জারণপ্রক্রিয়া, যাকে বাগানিভাষায় ফার্মেন্টেশান
বলা হয়, নিজদের প্রয়োজন মত কন্ট্রোল করা যায় –নইলে দ্রুত ফার্মেন্টেড হয়ে
পাতা নষ্ট হয়ে যাবে। জারণ-এর জন্য পাতাগুলো ক্রমশ রঙ পাল্টাতে থাকে - সবুজ
থেকে হয়ে যেতে থাকে লালচে-বাদামী ।আর কাঁচাপাতার গন্ধ চলে গিয়ে ক্রমশ
অন্যরকম সুবাস (aroma) ছড়াতে শুরু করে বাতাসে।
এই
ফার্মেন্টেশান কাজটা ভীষণ-ভীষণ-ভীষণ মূল্যবান ও স্পর্শকাতর (Sensitive)। এর
ওপরেই নির্ভর করে তৈরি-চায়ের (Finished Product) গুণমান। পাতা যদি কম বা
বেশী ফার্মেন্টেড হয়ে যায় – তাহলে চায়ের সেই প্রার্থিত সুবাস এবং অন্য
গুণগুলো আর পাওয়া যাবে না।তাই ভাল চা-করিয়েরা এই পর্বে খুব সতর্ক ধ্যান
দেন। ফার্মেন্টেড চায়ের রঙ এবং গন্ধ এখানে অত্যন্ত জরুরী ভূমিকা নেয়। অনেকে
শুধু গন্ধ শুঁকেই বুঝে নেন আর কতক্ষণ পাতাকে ফার্মেন্টেড করতে হবে এবং ঠিক
কখন সেই ফার্মেন্টেশানকে বন্ধ করতে হবে।বহু বছরের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা থেকে
এই জ্ঞান জন্মায়। আমি মকাইবাড়ি চা বাগানের ফ্যাকটরীতে এক বয়স্ক নেপালি
দাজুকে পেয়েছিলাম যাঁর কাজই ছিল শুধু ঐ গন্ধ শোঁকা। এ যেন সুকুমার রায়ের
‘গন্ধবিচার’ -গন্ধ শুঁকে মরতে হবে এ আবার কী আহ্লাদ।
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া...