বাংড়ি তিতি হাউড়ি শেষে
পর্ব : ছয়
মিশা ঘোষাল
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
টোটোপাড়ার বৃষ্টি
নামছে আষাঢ় আকাশ ভেঙে
ঝর ঝর জল পদ্য
আকাশ কালো মেঘের আঁধার
বৃষ্টি লেখার জন্য ...
এমনই
এক বৃষ্টির দিনে আমি তখন টোটোপাড়াতেই থাকি, টোটোপাড়ায় থেকেই স্কুলে
যাতায়াত করি। বাড়িটি আমাদের "ধনপতি টোটো মেমোরিয়াল হাই স্কুলে"র খুব
কাছেই, টোটোপাড়ার সরকারি হসপিটালে যাবার জন্য যে রাস্তা তেমাথা থেকে শুরু
হয়েছে, যেখানে টোটোপাড়ার বি এফ পি প্রাইমারি স্কুলটি রয়েছে তার উল্টোদিকেই
এই বাড়িটি অবস্থিত। এখানে আমি টোটোপাড়ার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বিনোদ
টোটোর বাড়ির একটি কাঠের পাটাতন যুক্ত উঁচু টিনের দো-চালা ঘরের একটি কামরা
ভাড়া নিয়ে থাকতাম। বিনোদ টোটোর পরিবার, তাঁর স্ত্রী কেউটি টোটো ও তাঁদের
দুই পুত্র ছাড়াও এই বাড়িটিতে ভাড়া থাকেন আরও তিনটি পরিবার । বর্ষাকালে তখন
সারাদিন টোটোপাড়ায় আমি বৃষ্টির এমন অঝোরে ঝরার রূপ দেখে ভয় পেতাম খুব। জল
নামছে ঝর ঝর করে, টোটোপাড়ার ঝোরাগুলি ভরে উঠেছে, বয়ে যাচ্ছে তীব্র গতিতে,
পাকা ড্রেন করা আছে ঝোরার জল নামার জন্য, সেই জলের কী শব্দ, কী অসম্ভব
জলের গতি! কেউ যদি পা পিছলে এই প্রচন্ড গতির ঝোরার জলে পড়ে, আর রক্ষা নেই !
জলস্রোত সবেগে নিয়ে গিয়ে তোর্ষার জলে ফেলে দেবে !
এরকম
একটি ঘটনা ঘটেছিল ২0১৭ সালে। টোটোপাড়ার বি এফ পি প্রাইমারি স্কুলে পড়ত
বাচ্চাটি। স্কুল ছুটির পর বাড়িতে ফেরার সময় এই ঝোরার জলে পড়ে ভেসে গিয়ে পড়ে
হাউড়ির জলে। পাথরে ক্ষতবিক্ষত কঙ্কালসার সেই দেহ উদ্ধার হয়েছিল তোর্ষার
কাছাকাছি। শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল ছেলেটির মা বাবা। গোটা টোটোপাড়ায় নেমে
এসেছিল শোকের ছায়া ! টোটোপাড়ায় এমন ঘটনা মাঝে মধ্যে দুএকটি ঘটে।
আর
টোটোপাড়ায় যখন তখন প্রচন্ড বাজ পড়ার শব্দ ! টোটোপাড়ার পাশেই তো আমাদের
প্রতিবেশি দেশ ভূটান। হিমালয় পর্বতমালার অন্তর্গত এই ভূটান পাহাড়ের পাদদেশে
এই ভূটান দেশটিই তো বজ্রপাতের দেশ ! তাই বৃষ্টি টোটোপাড়ায় এমন তীব্র
বজ্রপাতও অহরহ। টোটোপাড়ার ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়
ঘেরা ছোট্ট একটি বৃষ্টিচ্ছ্বায় অঞ্চল এটি। জলভরা মেঘ ছুটে এসে ভূটান
পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খায় ফলে বৃষ্টির ঢল নামে এই টোটোপাড়ায়।
বিনোদ
টোটো আমাদের বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন।
বেশ পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর বৌদির। পাশেই জল মজুদ করে রাখার জন্য বড় একটি
ড্রাম। বৌদির হাতের রান্নাই খাই, পেয়িং গেষ্ট আমি তখন কেউটি বৌদির । স্কুল
ছুটির পর স্নান সেরে কাঠের বারান্দায় এসে বসলে বৌদি এককাপ চা এগিয়ে দেয়,
সাথে বিস্কুট বা মুড়ি-চানাচুর। স্থানীয় গরুর দুধের চা।
চায়ে
চুমুক দিয়ে বৃষ্টি-জলের কবিতা লিখতে শুরু করি আমি, গল্প শুনি পুরানো দিনের
টোটোপাড়ার। টোটোপাড়া থেকে মাদারীহাট বাজার করতে যাওয়ার কষ্ট ও
নিত্যনৈমিত্যিক জিনিসগুলো কাছের মাদারিহাট থেকে সংগ্রহ করে আনার জন্য
পায়ে হেঁটে যাওয়ার কষ্টের কাহিনি সেসব । বৌদির কাছ থেকে টোটোদের
রীতি-রেওয়াজ ও অনেক পুরোনো দিনের কথা শুনে সময় গড়িয়ে যেত আমার।
বৌদির
হাতে অনেক কাজ। রান্নাবান্না সহ নিজের বাড়ির সামনে একটি মুদিখানার ঝক্বি
সামলাতে হয় বৌদিকেই। এই দোকানের মালিক এই বৌদি। বিনোদদাও মাঝে মাঝে বসেন
দোকানে। তাছাড়া কৃষিকাজ করেন দাদা, এলাচ সুপারির বাগান আছে টোটোপাড়ায় তাঁর।
আর কিছু সরকারি প্রকল্প (মূলত আদিবাসী কল্যাণ দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার)
রূপায়নের কাজেও তিনি দায়িত্বপাপ্ত কর্মী। টোটোপাড়ায় নিজের একটি ঘরকে তিনি
এখন "ব্লু হোম স্টে" বানিয়েছেন। টোটোপাড়ায় পর্যটনশিল্পের প্রসারে তাঁর
ভূমিকাও কিছু কম নয়! আমি যখন এখানকার উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে প্রধান
শিক্ষিকার পদে কাজে যোগদান করি ( 25.09.2008), সেই সময়ে অর্থাৎ ২০০৮ সাল
থেকে পর পর তিন বছর তিনি আমাদের টোটোপাড়ার এই উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং
কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন। তখন বিদ্যালয়গুলোতে ইলেকশনের মাধ্যমে অভিভাবক
প্রতিনিধি নির্বাচন করা হত। টোটোদের মধ্যে তিনি তখন মাধ্যমিক পাশ করা
একজন অভিভাবক প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি ছিলেন সমাজসেবী একজন ভালো মানুষ।
বিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে তার যোগদান ও কাজ সেই সময় একটি নিদর্শন হিসেবে রয়ে
গেছে টোটোপাড়ায়।
আমি বারান্দায় বসে টিনের চালে
বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতাম, চাল দিয়ে অবিরাম গড়িয়ে পড়া বৃষ্টি ফোটা ছুঁয়ে
দেখতাম, আমার মোবাইল ফোনে ক্যামেরাবন্দি করে রাখতাম সেই সব দুর্লভ ছবি।
টোটোপাড়ার
প্রকৃতির এই নির্ভেজাল রূপ শত প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে আমার মনের মণিকোঠায় একটি
জায়গা করে নিয়েছিল। আমি মনে মনে রচনা করতাম আমার অলিখিত এক উপন্যাসের
পটভূমি।
বর্ষাকালে এই দুর্গম পথ রোজানা পাড়ি দেওয়া
প্রায় অসম্ভব ছিল তখন। হাউড়ি, তিতি আর বাংড়ির ঝাকুনি বর্ষাকালে রোজ হজম
করাও একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই এই কাঠের বাড়ির দোচালা ঘরের পুরোনো
টিনের একটি এক-কামরার ঘরে থাকতাম আমি তখন টোটোপাড়ায়। খাওয়া দাওয়া করতিম
বৌদির হেঁসেলে। রাত আটটায় ডিনার কমপ্লিট। এবার আমার গদ্য লেখার পালা...