পাহাড়চূড়ায় রবি ঠাকুর
অমিত কুমার দে
-------------------------------
১
শুভ বলল – “চল, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে!”
কিছুক্ষণ আগে অহলদারা-য় পৌঁছেছি। কার্শিয়াং-এর সিটং-৩ গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট্ট গ্রাম অহলদারা। পুরো পথটাই তো আমার কাছে একটা আস্ত বিস্ময় ছিল! আবার নতুন কী সারপ্রাইজ!! অন্তরাকে ইশারায় শুভ জানিয়ে দিল আমাকে আগে কিছু বলা চলবে না!
“চল, ওই চা বাগানের পথ ধরেই একটু হাঁটতে হবে! পাহাড়ি রাস্তা।” কয়েক মাস আগে দুর্ঘটনায় হাত-পা ভেঙেছে, তাই সকলের দুশ্চিন্তা।
তথাস্তু! চললাম বিস্মিত হতে!
পাহাড়ের একটা সীমানায় পৌঁছতেই আঙুল তুলে আরেকটা পাহাড়চূড়ার দিকে তাকাতে বলল শুভ। অন্তরা বলল – “কিছু দেখতে পাচ্ছ? ভালো করে দ্যাখো! তোমার খুব কাছের কিছু!”
পড়ন্ত রোদ পড়েছে পাহাড়চূড়ায়। একদিক অন্ধকার, অন্যদিক আলো। আমার মুখ থেকে তখন কথা হারিয়ে গেল। তিনি এখানে শুয়ে আছেন!! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! অবিকল তাঁর মুখের আদল। শুভ বলল – “এই পাহাড়ের নাম টেগোর মাউন্টেন!”
২
হঠাত করেই অহলদারা-য় টইটই! পরিকল্পনা শুভ-অন্তরা-র। আমি-পপি জুড়ে গেলাম! শুভ স্টিয়ারিং-এ হাত রাখলে বিজ্ঞাপনী ভাষাতেই মন বলতে চায় – “চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়!” ও আবার আমার ড্রাইভিং শেখার মাস্টারমশাই! স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে বলল – “খুব খাড়া রাস্তা। ব্রেক ঠিক নেই! সারিয়ে নিতে হবে।” লুকসানে একটা গাড়ি-মেরামতির দোকানে ব্রেক সারাইয়ের জন্য বিরতি, ফিটার আসছেন নাগরাকাটা থেকে। সেই ফুরসতে এক নেপালি বৌদির বানানো গরম গরম রুটি আর ঘুগনিতে ব্রেকফাস্ট সারা হল।
তারপর যথারীতি আমার গরীবী গাড়ি ওর হাতে যেন রাজপুত্র হয়ে উঠল! মোলায়েম রাস্তায় নরম সকাল বসে আছে। নদীর পর নদী পেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। ডায়না, জলঢাকা, লিস, ঘিস ছাড়িয়ে একসময় তিস্তা। তার আগে অবশ্য সেভক আর কালীঝোরার বাঁদরদের জন্য ডজন ডজন কলা কেনা হল। এটা অন্তরার বিশেষ দাবি। কলা খাওয়ানোর মগ্নতায় বাঁদরদের সপরিবারে সবান্ধবে দু’পায়ে দাঁড়ানোর অসামান্য ভঙ্গিটা ক্যামেরাবন্দি করতে আমরা ভুলেই গেলাম। কিন্তু মনে তো পাক্কা ফ্রেমবন্দি হয়েই রইল!
৩
কালীঝোরায় গেলে এখন আমার মনখারাপ হয়। একসময় বারবার এখানে এসে তিস্তাকে ছুঁয়েছি। এখানে কাশবনে হারিয়ে যাওয়ার অসংখ্য স্মৃতি বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে। এখন কংক্রিটে বাঁধা পড়েছে নদী। কষ্ট হয়!
হাইওয়ে ছেড়ে বিরিকে ওপরে ওঠার খাঁড়া পথে উঠতেই বুক দুরুদুরু। শুভ বলল – “ভয় নেই, ব্রেক ঠিক করে নিয়েছি তো! বাইরেটা দ্যাখো, কী সুন্দর!” রোদমাখা পাহাড়ে তখন ওয়েলকাম-নোট!
৪
সূর্যাস্তের সময় কী যে মায়াবী হয়ে উঠল অহলদারা। কাঞ্চনজঙ্ঘার শরীর আবিরে মাখামাখি! তার ওপর কুয়াশার প্রলেপ। সত্যিই তিনশো ষাট ডিগ্রি প্যারানমিক ভিউ। চারিদিকের পাহাড় ক্রমাগত রহস্যময় হয়ে উঠছে।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছি আমরা। কোনো কোনো মুহূর্তে কথাও হারিয়ে যায়। কোথায় যাচ্ছি তারও কোনো হদিশ নেই! অনেক নেমে আবারো উঠে একটা সমতল। আমরা বসে পড়লাম।
পাশেই গাজর আর কোয়াশের ক্ষেত। কত কষ্ট করে এই আবাদ। পপি গিয়ে ক্ষেতে বসল। কিছুতেই টাটকা বিষহীন সবজির মোহ কাটাতে পারল না। পট করে তিনখানা গাজর তুলে ফেলল। চোরনির সাগরেদ আমরাও হয়ে পড়লাম! অর্গানিক গাজর মুখে দিয়ে মনে হল কাশ্মীরের আপেল হার মানবে। শরীর ছুঁয়ে আছে পড়ন্ত রোদ, আর আমরা চার গাজরচোর জমিতে পা ছড়িয়ে বসে গাজর চিবোতে লাগলাম!
শুভ দাঁড়িয়ে ডিএসএলআর তাক করে বলল – “এমন পড়ন্ত আলো ছবির জন্য পারফেক্ট।”
৫
রাত্রিটা কী অন্যরকম। আমাদের কটেজের সামনেই কাছে দূরে বেশ কয়েকটি টেন্ট খাটানো হয়েছে। কটেজ টেন্ট সব পর্যটকে ভরা। তার মধ্যেই আমি নির্জনতা খুঁজে বেড়াচ্ছি। শুভ অন্তরা ‘বার্বিকিউ’-এর আয়োজনে ব্যস্ত। বনফায়ারের আয়োজন করে দিচ্ছে নিশেল তামাং। কালচিনিতে ওর আসল বাসা, এখন অহলদারা-র এই হোম-স্টে-র ম্যানেজার-কাম-কুক-কাম-অল-ইন-অল। মালিক পদম গুরুং তার মামা। কালো স্যুট আর একটা হাফহাতা হলুদ টি-শার্ট পরে, চুলে পনিটেল নিয়ে, সে ছুটে বেড়াচ্ছে। একটা মানুষ হাসিমুখে কী অসামান্য পরিশ্রম যে করতে পারে, নিশেলের মতো মানুষদের কাছ থেকে না দেখলে বোঝা কঠিন। নিশেল বলছিল – লকডাউনের সময় যখন হোম-স্টে বন্ধ, সে ষোল কিলোমিটার দুর্গম রাস্তা পায়ে হেঁটে রোজ যেত সিঙ্কোনা বাগানে কাজ করতে।
বনফায়ারের আগুনে ঝলমল করছিল নিশেলের সপ্রতিভ মুখ। সে বারবার ফিরে যাচ্ছিল মামার কথায়। পদম গুরুং। শুধু অহলদারা নয়, তাঁর হোম-স্টে রয়েছে লাটপাঞ্চারে – হর্নবিল নেস্ট হোম-স্টে। তার কথায় – “এমন মানুষ লাখেও একজন মেলে না। গোটা শেলপু পাহাড়ের মানুষজন তাঁকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। এখানে পর্যটন বিকাশের মূল কান্ডারি তিনি। শুধু নিজের কথা নয়, সাধারণতম মানুষও যাতে নিয়মিত কাজ পায়, তার জন্য তাঁর কত ভাবনা।” নিশেলই জানাল – পদম গুরুং-এর ১৩ বছরের কিশোরী মেয়েটি হঠাত মরে যাবার পর তিনি আরো অন্যরকম হয়ে উঠেছেন। কেউ কোনো বিপদে পড়লে তিনি দু’হাত বাড়িয়ে দেন, সাহায্যের ও সহমর্মিতার। কারোর বিয়ের দায়িত্ব নিচ্ছেন, কারোর চিকিৎসার, কারোর পড়াশুনার।
৬
একদল যুবক যুবতী রঙিন আলো জ্বালিয়ে, লাউডস্পীকার চালিয়ে হিন্দী গানে নাচ জুড়েছেন। সঙ্গে মদের প্লাবন। নির্জনতা ভেঙে চুরমার। আর এক প্রান্তে এক সরকারি আধিকারিক তাঁর বান্ধবীদের নিয়ে বনফায়ারে সামিল। কাবাব আর মদ চলছে। নেশা চড়তে চড়তে পেট থেকে ভুরভুর করে বেরিয়ে আসছে অনেক কথা। সেসব গোপন কথা বাতাসে ভাসছে। আমি আকাশ দেখছি। তারা নক্ষত্ররা আজ পৃথিবীর কত কাছাকাছি।
চারদিকে ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে পাহাড়ে জ্বলে ওঠা বাতি দেখছি, যেন দীপান্বিতার আলো। তাগদা, তিনচুলে, চটকপুর, বাগোরা, মংপু, কালীঝোরা, কালিম্পং, কার্শিয়াং ইত্যাদি কত জায়গার আলো। শিলিগুড়ি আর এনজেপি-র আলো এখান থেকে উৎসবের মতো।
৭
সকালবেলায় চার চোর গেল ক্ষেতমালিকের কাছে। গাজর চুরির স্বীকারোক্তি দিয়ে তাঁর কাছ থেকে সবজি কিনে নিতে! মলিম খাওয়াস, মুখ জুড়ে হাসি। কী যত্ন করে এক ফালি জমিতে বীনস, গাজর, কোয়াশ, আদা ফলিয়েছেন। ফুলঝাড়ু তৈরির গাছ জমির সীমানা ঘিরে। এখানকার মানুষজন এসব ফলিয়েই সামান্য উপার্জনে সংসার চালান। মলিম সবজি ছিঁড়তে ছিঁড়তে জানালেন – নিজের পোষা গরুর গোবর দিয়েই এসব চাষ, কোনো রাসায়নিক নেই।
৮
লাটপাঞ্চারে সিঙ্কোনা প্ল্যান্টেশন আর তার অফিস দেখতে চললাম আমরা। এই গ্রামে দেশ-বিদেশের বার্ড-ওয়াচার-রা ভিড় করেন, রকমারি পাখি দেখতে। দেখা মেলে বিচিত্র প্রজাপতির। গাঢ় সবুজ পাতায় ছাওয়া গাছে টাটকা হলুদ ফুল ঝোলানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল – এখানেই থেকে যাই!
তারপর গেলাম নামথিং পোখরিতে। এই লেক বিখ্যাত বিলুপ্তপ্রায় স্যালামান্ডারের জন্য। স্যালামান্ডারের দেখা মিলল না। মিলবেই বা কি করে? আমরা মানুষেরা তাদের এই নিভৃত আস্তানাতেও এসে আধিপত্য বিস্তার করে তাদের তাড়িয়েছি! এখন জল-শুকনো লেক পড়ে আছে। পাইনের ছায়াময় জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ।
তারপর লাপ-চে-গুম্ফা, ২০০ বছরের পুরনো। খুঁজে খুঁজে পৌঁছে দেখি বৌদ্ধমন্দিরের দুয়ার বন্ধ। প্রাচীন গুম্ফার ভগ্নাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিক। দিনের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন দুধসাদা, স্পষ্ট সবাক!
--------------------------------------------------------------------
অহলদারা ৩৬০ডিগ্রি ভিউপয়েন্ট হোম স্টে-তে যেতে হলে যোগাযোগ : পদম গুরুং – ৯৪৭৫৯৫৯৯৭৪/৯০৬৪১৩৪১৯৮/৯৪৩৪৫৬৩৪৩৪/৯৪৭৫৫৫৭২২৫