পইলা সাঞ্ঝির কথা/৬
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৬
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
আগুরি দ্যাওয়া
~~~~~~~~~~~
বসমতীর এখন এমনিতে নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। তার উপর ছেলে –মেয়ে দুটো হয়েছে পাজির পাজি। একটা কথাও যদি শুনে! নির্ঘাত কোথাও গিয়ে খেলছে। কি ঝড় কি বৃষ্টি, এদের বাড়িতে রাখা মুসকিল। একটু সুযোগ পেলেই হাওয়া। কাজ করতে করতেই একবার চেঁচাল। নাহ! কারো পাত্তা নেই, ত্রিসীমানায় আছে বলে মনে হল না। এদিকে কান্তেশ্বর তো জমিতে লোক লাগিয়ে দিয়েই মুহুরীর কাজে শহরে। সমস্ত দেখাশোনা ওকেই করতে হয় প্রতিবার। না দেখলে চলে! ঠিকমতো দেখাশুনা না করলে মাঝখানটায় ফাঁকা ফাঁকা করে গছি গুঁজে কাজ তুলে দেবে। বসমতী ছটফট করে। বাচ্চাগুলোকে একটু খাইয়ে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। বাইরে বেরিয়ে দেখতে গিয়ে দেখে খিরদৈ পিসি দাঁড়িয়ে। এই গরমে একটা মোটা ছেঁড়া কাঁথা গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোঁকাচ্ছে। বসমতীর রাগ উধাও হয়ে মজা লাগে।
"তোমরা আরো আজি কেতা উড়া দেও হইসেন কেনে মা?"
খিরদৈ বেচারা হাসতে পারে না। মিন মিন করে বলে,
"আর কনকে না বৌমা, এলা এমন ধুমাকাচা কাজের তাল, আর কালি থাকি মোর কেমতন জ্বরখান আসিল। দেখো তো বারে। এইলা কি এলা দেহাটা সয়! ফাকাতুর বেটাক ওইসোদ আনির দিসুং বামন দাক্তারেট্টে। তে আস্তার ভিত্তি দ্যাখেছোং। হাটিরে না পাং বারে, মাতাটা টালায়, ঠ্যাং গিলা খাবুলায়।"
পাশ দিয়ে হন হন করে গজেন মাঠের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর মুখে বলে,
"তুই এলাও মরিস নাই! মুই কছোং মোরিলু বোদায়, যাং বাঁশ টাশ কাটং।"
খিরদৈ পিসি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল ঠিকই কিন্তু কার উপর? বক্তা ততক্ষণে বড় বড় পা ফেলে চলে গেছে অনেকটা দূর! বসমতী হেসে ফেলে। হেসে হেসে বলল, "কেনে, বড়মা যে কছে তোমরা বলে এইবার এখেরে সেই কাজ করির ধইচ্চেন!"
খিরদৈ পিসি এবার মুখটা মুচড়িয়ে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে,
"হুর, হোটা ফরফরানী ঝালাখৈ টার কতা বাদ দেক তো তুই। অই মতন করি কয় দেখি তো উয়ারে দারায় মাথাটাত ত্যাল বসে নিলুং কালি।"
"ভালে কইচ্চেন" বলে হাসতে হাসতে এগিয়ে যায় বসমতী। আর কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ি বাড়ি এই জ্বরটা শুরু হবে। বড্ড ভোগায়।
মেয়েকে সহজেই পাওয়া গেল। পাশের একটা বাড়িতে পুতুল খেলছে। চুপ করে লুকিয়ে একটু খেলা দেখল বসমতী। দেশলাইয়ে বাক্সে পুতুলের কাপড় ভাঁজ করে রাখা। মোটা পাট কাঠির গায়ে ঝাঁটার কাঠি ফুটিয়ে হাত বানানো, সে সোজা হাতের উপর দিয়ে মেয়েদের শাড়ি, ছেলেদের পাঞ্জাবী পরানো। মেয়ের পুতুলটা পাশের বাড়ি সাগাই খেতে গেছে, কিন্তু বসমতী তাকে দুদিন আয়েস করে সাগাই খাওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়েই চোখ পাকিয়ে এক ধমকে সব পোঁটলা গুটিয়ে সাথে নিয়ে চলল। ওকে খেতে বসিয়ে দিয়ে ছেলের সন্ধানে বের হল, হাতে একটা বাঁশের কঞ্চি। আসার সময় মেয়ে বলে দিয়েছে, ‘দাদা নদীর বগলত মাটোত জমুরা দিয়া বল খেলাছে মা’! কঞ্চিটা অবশ্য কাজে লাগল না। দূর থেকে মাকে দেখেই অবস্থা বেগতিক দেখে দৌড়ে চলে এসেছে, তবু বসমতী রাগের চোটে খালি হাতেই দুটো থাপ্পড় কষিয়ে দিল।
ছেলেকেও খেতে বসিয়ে দিয়েই বসমতী হন হন করে মাঠের দিকে দৌঁড়ল। মাঠ এখন হাজার লোকের কোলাহল। দ্রুত হাত চলছে সবার। তার মধ্যেই এর ওর পেছনে লাগা, কেউ বা আপন মনে দু কলি গান গুন গুন করছে। কেউ আবার মাঝে একটু দাঁড়িয়ে কোমরটা সোজা করে নিচ্ছে। আলের মাথায় দাঁড়িয়ে বসমতীও ওদের সাথে গল্পে জুড়ে গেল। এক দিকে জলের জগ আর গেলাস রাখা। মাঝে মাঝে এর তার বাচ্চা আসছে মায়েদের কাজ দেখতে, তাদের দিয়ে জল আনানো হচ্ছে। এর মধ্যেই চা এসে গেল। নাকে সোনালী রঙ করা বড় একটা নথ, হাতে এক গোছা চুড়ি, চোখে বড় করে টানা কাজল, একটা গামছা গলায় জড়িয়ে টলমল টলমল পায়ে ঝলমলির বেটি ঝলমল করতে করতে চা নিয়ে এল। স্কুল থেকে পাওয়া সুতির জামাটা ঘাড় থেকে প্রায় খুলেই পড়তে চাইলে হবে কি, গলায় বেশ গিন্নী গিন্নী ভাব। পায়ের নুপূরগুল চক চক করছে দেখে কে একজন জিজ্ঞেস করল, "তোরাগিলা বানাইসেন বৌমা?" ঝলমলি উত্তর দিল, ‘না হয় বারে, বোম্বাই উপা। সেদিন বাড়িতে নিসুং।’ একজন মাঝখান থেকে বলে উঠল, "তোমার বেটি তো বড়ই হইল বারে, তে কুনদিন থুইয়া আসিবেন?" ঝলমলি হেসে বলে, "নিগাও তো বারে নিগাও, তোমার বুড়িটার পাল্লাত পড়িলে ভাত আন্দা শিকিবে। মোর কাথা তো শুনেই না। ওই খেলা আর খেলা। দিনমনটায় খেলাখান। সাক্কালে উঠি কি গোলেক ঘান্টা ঘুগুরা নিকলাবে আর খেলাবে, একখান আত্তি কুড়ায় না বারে!"
আমাতির দিন কয়টা পেরিয়েই শুরু হয়েছে, আরো কিছুদিন চলবে মাঠের ব্যস্ততা। রোয়া বুনতে বুনতেই ওরা আলোচনা করে "এইবার কোনেক আগুরি দেওয়াটা নামিল। আর একজন গলা হেঁকড়ে বলে, ‘আগুরি দেওয়ার সপে নাই বারে, জমিত জলে ফান্দে না’। সঙ্গে সঙ্গেই আর একজন প্রতিবাদ করে, ‘হিলা কি তে। তোমরা কি শুকান কাদো গারেছেন তে?" মাঠ থেকে বাড়ির পথে আসতে না আসতেই তুমুল বৃষ্টিটা নামল। বসমতী দৌঁড়তে দৌঁড়তেই ভিজে গেল। ভিজতে ভিজতেই গরুটাকে টেনে বাইরের চালাটার নিচে জল আর ভাতের মাড় দেয় নুন মিশিয়ে। ছাগলটাকেও একটু দেয়। যথারীতি বাড়িতে দুটোর একটাও নেই, আবার খেলতে গেছে নিশ্চয়ই। বসমতী জানে এদের পেছনে ছুটে লাভ নেই। এই বৃষ্টির মধ্যেই বাতাবী লেবুর বল নিয়ে পাঁই পাঁই করে ছুটবে। ঝগড়া-মারামারি করে নাক ফাটিয়েও বাড়ি আসতে পারে অথবা নদীতে ঝাঁপাতে পারে। মেয়েটাও কম যায় না। পাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে কবে পা ভেঙে বাড়ি আসবে বসমতী সেই অপেক্ষায় আছে। তারপর যা মারটা মারবে না, বুঝতে পারবে। আমাতির দিনই তো সন্ধ্যাবেলা পিঠের ছাল তুলে নিচ্ছিল প্রায়। কান্তেশ্বর এসে থামিয়েছে।
সকাল থেকে বৃষ্টির পর আকাশটা একটু থামতেই ওরা বাড়িতে আর কেউ নেই। কলার গাছ কেটে রাস্তায় আমাতির ঘর বানিয়ে ফেলেছে, বাড়ি থেকে একটা ঠাকুরের ছবির ক্যালেন্ডার কখন লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে সুন্দর সাজিয়েছে। শেষদিন দুপুরে পূজা-পানি করে বসমতী ওদের ঘরে নিয়ে একটু শুয়েছে। কখন একটু চোখটা লেগেছে, উঠে দেখে নেই। সন্ধ্যা দিয়ে শুনে অল্পের জন্য মেয়েটার মাথাটা ফাটতো সাইকেলের ধাক্কায়। রাস্তার ধারে ধারে বাচ্চাদের ছোট ছোট আমাতি ঠাকুরের ঘর। রাস্তার দুদিকে দাঁড়িয়ে দড়ি উঁচু করে টেনে ধরে হাটফেরতা মানুষদের থামায়। সবাই যে যার সামর্থ্যমতো খেজুর, কালো জাম, নটকা একটা দুটো দিতে দিতে যায়। এর মধ্যে হঠাত কেউ কেউ আছে যারা সাইকেল থামায় না। বাচ্চারা দড়ি ছেড়ে দিতেই পুরো জোরে সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে যায়। সেরকমই একটা সাইকেলের ধাক্কায় মৌমিতা পড়ে গেছিল। শুনে আর যায় কোথায়, টেনে এনে আচ্ছা পিটুনি। কান্তেশ্বর না থামালে আরো যে কত মারটা খেত! সেজন্য ওদের চিন্তা ছেড়ে জলে ভিজে ভিজেই বসমতী ঘর সংসারের কাজগুলো করে ফেলতে থাকে। করে একেবারে স্নান করে উঠবে। তবু মনটা পরে থাকে ওদের উপরেই, জ্বর না বাঁধায় আবার!
-------------------------------------------------------------
কেতা উড়া দ্যাও - গ্রাম্য লোক কথা অনুযায়ী রাস্তায় বসে বসে কোঁকাতে থাকা ভূত বা পেত্নি, গায়ে মোটা কাঁথা জড়ানো থাকে।
ফরফরানী ঝালা খৈ - যে মহিলা হিংসায় জ্বলে আর ফরফর করে হাঁটে
জমুরা - বাতাবি লেবু
ঘান্টা ঘুগুরা - ছোট ছোট হাবিজাবি জিনিস।
আত্তি কুড়ানো - কিছু চাইলে দেওয়া বা কোনো কাজ করতে বললে করে দেওয়া।
-------------------------------------------------------------
পুতুল ও ছবি : শুক্লা রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴