দাঁড়াবার জায়গা/পর্ব-ছয়
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
বাড়ির
পাশেই ছোট্ট এক টুকরো মাঠ, পরিণত বয়সে যাকে উঠোনের বেশি মনে হয়নি।
বর্ষাকালে সেখানে দেড়-দুফুট জল জমা হয়। বর্ষার প্রথম দিকে সেই মাঠ মাটি
ধোয়া ঘোলা জলে ভরে উঠলে এক আশ্চর্য রহস্য দানা বাঁধে। এতদিন যেখানে ছোট ছোট
গাছপালা, ঘাস-জঙ্গল ছিল, এখন সেখানে ঘোলা জলে ভেসে আছে এক টুকরো আকাশ।
জলের দর্পণে সে আকাশ বাতাসে দোল খাচ্ছে, মৃদু ঢেউ উঠছে। পারের দিকে দুয়েকটা
জঙ্গুলে গাছের এক চিলতে মাথা তখনও বেরিয়ে আছে। জলের ওপরে অজস্র পোকামাকড়
খেলে বেড়াচ্ছে। এদিক সেদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ঘুঘরি পোকা। তার মাথার দিকটা
কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো অনেকটা। কচুগাছের পাতার ওপরে চুপচাপ বসে আছে মাকড়সা।
রাতের প্রবল বর্ষণের পর ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি বেশ কিছু কোলা ব্যাং ডেকেই
চলেছে গলা ফুলিয়ে। হলুদ-সবুজে উজ্জ্বল রং তাদের গা থেকে যেন পিছলে পড়ছে।
মাঝে মাঝেই তারা এদিক সেদিকে লাফালাফি করছে। ঘ্যাঙর ঘ্যাং ডাকের মাঝেমধ্যে
তারা স্বর পাল্টে কুরুকুর করে ডাকছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের আনন্দ আর ধরে
না। অপরূপ সে দৃশ্য একমনে তাকিয়ে দেখি। তাদের চোখগুলো বেশ বড় বড়। কিন্তু
তারা যেন আমাদের দেখেও দেখে না। উজ্জ্বল গায়ের ব্যাঙগুলো নিজেদের আনন্দে
নিজেরা এমন মশগুল যে কারও দিকে নজর নেই। এক মুঠো মুড়ি নিয়ে তাদের দিকে
ছড়িয়ে দিই। জানি ওরা খাবে না, তবু দিই। পোকা ধরে দিলে নিশ্চয়ই খাবে,
কিন্তু হাতে করে পোকা ধরার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া, কাছাকাছি গেলেই তারা জলে
ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছোট মাঠটা দেখে বোঝা যায় প্রাণের মেলা লেগেছে। জেগে উঠেছে কত
প্রাণ। হঠাৎ কখনও দুয়েকটা দাঁড়কিনা, পুঁটি মাছ ভেসে উঠছে। পারের কাছে
দৃষ্টিসীমায়, জলের নীচে চুপটি করে আছে চ্যাং মাছ। কখনও কখনও ল্যাটা মাছও
নজরে পড়ে যায়। এরা এলো কোথা থেকে। আগের দিনই জায়গাটা শুকনো ছিলো। রাতের
বৃষ্টির পর সামান্য জল জমা হতেই তাদের দেখা যাচ্ছে। শুখা মাসগুলোতে এই
প্রাণীরা কী করে যে মাটির নীচে বেঁচে থাকে, আর বৃষ্টি হলেই বেরিয়ে আসে!
আমাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।
হঠাৎ
জমে ওঠা জলের ভেতর থেকে সামান্য মাথা উঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় সফল
গাছের অদ্ভুতভাবে নড়ে ওঠা। আমরা জানি, ওখানে নীচ থেকে উঠে আসছে কাঁকড়া।
প্রথম বর্ষার জলে ধোয়া সেই কাঁকড়ার রং হলদেটে। বাড়িতে বা আশপাশ থেকে সেসব
কাঁকড়া ধরে আমরা ঘরে নিয়ে এলে সুস্বাদু রান্না হয়েছে। চমৎকার তার স্বাদ।
ঘাস-জঙ্গল নাড়িয়ে নীচ থেকে উঠে আসছে যে কাঁকড়া তাকে ধরা খুব সহজ। শুধু
তার অবস্থানের সঠিক আন্দাজ করতে হবে। নইলে সাঁড়াশির মতো শক্ত দাঁড়া হাতে
চেপে বসতে পারে। সে এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা। দু-একবার সেরকম অভিজ্ঞতাও যে হয়নি
তা নয়। তবু শৈশবের স্পর্ধায় ওভাবে ঝুঁকি নিয়ে কাঁকড়া ধরায় আনন্দ ছিলো,
তাতে খেলার মজা ছিলো। জলের পাশে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেই কয়েকটা
কাঁকড়া ধরে ফেলা যেতো সহজেই। আবার, শরৎকালে সেই জমির জল শুকিয়ে খটখটে হয়ে
উঠত। তখন সেই শুকনো জমিতে আমাদের নানা খেলা, হুটোপাটি।
এরকম
এক শীতের বিকেল, পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়ে গেছে, নতুন ক্লাসে উঠেছি আমরা
সকলেই। সেই মাঠে জমে উঠেছে আমাদের হুটোপাটি, খেলা। এক প্রস্ত হাডুডু, তারপর
কানামাছি। তারপর খেলা ভাঙার সময় ঘনিয়ে এলো। আমাদের মধ্যে একজন হঠাৎ আকাশের
দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ওই দ্যাখ, চাঁদে বুড়ি সূতা কাটে’। আমি তাকে বলি,
‘চাঁদে কেউ আছে নাকি, যে সূতা কাটবে!’ চাঁদে মানুষের পদার্পণের খবর আমার
জানা ছিলো। নীল আর্মস্ট্রং যে চাঁদের মাটিতে পা রেখেছেন সেটা জানা ছিলো।
সেই সঙ্গে চাঁদের জনমানবহীনতা সম্পর্কেও জানতাম। ফলে, বুড়ির সুতো কাটার
গল্পে বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু, আমার শৈশবের সঙ্গীরা তাদের পারিবারিক
পরিবেশে এবং স্কুলেও এমন কিছু শোনেনি, যাতে প্রচলিত বিশ্বাস টাল খেতে পারে,
নতুন কথা তাদের মনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে। আমাদের তখনকার পাঠ্যবইয়েও
সেরকম কিছু ছিলো না। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা অধিকাংশই ঘুষ দিয়ে, নেতাদের
অনুরোধ-উপরোধ করে শিক্ষকতার একটি চাকরি জুটিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে
হেডমাস্টারের পরিবারের চার-পাঁচজন সেই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আর, তখন
পরীক্ষায় অবাধে টোকাটুকি চলত। ফলে এসব শিক্ষকের অনেকেই সেভাবে পাশ করে আসা।
এরা অনেকেই বাংলা রিডিং পড়তেও হোঁচট খেতেন। মনে আছে, আমাদের ক্লাস ফোরের
ইংরেজি বইয়ে পাশাপাশি দু-পাতায় দুটো সাদা-কালো ছবি ছিল। একটি ফ্রক পরা মেয়ে
এবং অন্যটি হাফপ্যান্ট শার্ট পরা ছেলে। মেয়েটির পাশে পাশে লেখা ছিলো, ‘দিস
ইজ মিনু’। তারপর আরও নানা বিবরণ। আর, ছেলেটির ছবির পাশে লেখা ছিল, ‘দিস ইজ
সুভাষ’। এবং তারপর আরও কিছু। তো সুভাষের প্যান্টের রং সম্পর্কে বলা
হয়েছিলো, খাকি। সেটা আমার স্কুলের শিক্ষিকা পড়েছিলেন, ‘কেকি’! পাঁচ দশক
পরে সবগুলো আর মনে নেই। ওটা যে ‘খাকি’ তা আমি শিখেছিলাম বাবার কাছে। তো,
আমার সেই সঙ্গীদের কাছে শিক্ষাগুরু বলতে ছিল নিজেদের পরিবারের নানা
সম্পর্কিত অভিভাবকরা। এখন শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু, আমাদের
পাড়ায় সেই সময়ে, মানে সত্তরের দশকের প্রথম দিকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাও
বিরলপ্রায় ছিলো। আশপাশে নানা বয়সী যাদের দেখতাম তারা অধিকাংশই বড়জোর
সাক্ষর। কেউ কেউ অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা স্কুলের উঁচু ক্লাসের পড়ুয়া মাত্র।
এরাই ছিলো আমাদের অনেক শৈশব-সঙ্গীর অভিভাবক এবং শিক্ষাগুরু। চাঁদে বুড়ির
সুতো কাটা প্রসঙ্গে আমার আপত্তির প্রেক্ষিতে আমাদের সেই সঙ্গীটি বললো,
‘আমার ঠাকুমা বলসে’। আমি আপত্তি করি, ‘ঠাকুমা বললেও হবে না। চাঁদে মাটি আর
পাথর আছে। আর কিছু নাই, কেউ নাই’। ছেলেটি ক্ষিপ্ত হয়ে আমার দিকে তেড়ে এসে
বলল, ‘ঠাকুমা জানে না?’ আমি বলি, ‘না’। সে বলে, ‘ঠাকুমা কি মিথ্যা বলসে!’
আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই সে আমার মুখে ধাঁ করে একটা ঘুসি চালিয়ে দিল।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি স্তম্ভিত। তার ঘুসিতে আমার ডানচোখে জোর আঘাত লাগল।
আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলে বাকি সবাই আমাকে ঘিরে ধরে বলতে থাকল, ‘কোথায়
লাগসে, কোথায় লাগসে, দেখি’। কাছেই আমাদের বাড়ির উঠোন। সেখান থেকে মা
বোধহয় আমাদের দিকে নজর রাখছিলো। অস্বাভাবিক উঁচু স্বরে আমাকে ডাকলো মা। আমি
ছুটে বাড়িতে ঢুকে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমার মুখটা টেনে নিয়ে চোখের আঘাত
কতটা পরখ করে দেখে, আঁচলের একটা প্রান্ত নিজের মুখে চেপে ধরে ‘হাহ্ হাহ্’
করে নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় গরম করে আমার চোখে চেপে ধরতে লাগলো। মা বলল, ‘ইস,
লাল হয়ে গেছে’। একটু পরে বললো, ‘আর খেলতে যাবি না’। সেদিনের মতো খেলা পণ্ড,
সবাই নিজেদের বাড়িতে চলে গেল।
সেই
শুরু। জীবনে বহুবার এধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। শৈশবে দেখেছি গায়ের জোর
প্রাধান্য পেয়েছে। মনে আছে, মাটি দিয়ে মূর্তি বানানোর নেশা ছিলো। একেবারে
সূচনায় কলা, আমের মতো কিছু বানিয়েছি। সেসব রং করার পরে যথেষ্ট আকর্ষণীয়
হতো। বাড়িতে বাইরের কেউ এলে খুব প্রশংসা করতেন। পাড়ার অনেকেই স্কুলের
জন্য প্রয়োজনীয় হাতের কাজ হিসেবে আমার এসব নিয়ে যেতো। মনে আছে, এক জোড়া
পাকাকলা বানিয়েছিলাম। পাড়ার এক দিদিস্থানীয়, ডাক নাম খেলন, সেটা নিয়ে
স্কুলে জমা দিয়েছে। তার স্কুলের দিদিমণি নাকি তাকে অনেক নম্বরও দিয়েছে
সেজন্য। ছবিও এঁকেছি প্রচুর। কিন্তু, এসব করতাম বলে অনেকের বিরাগভাজনও হতে
হয়েছে। শৈশবে ছড়া লেখা, ছবি আঁকা, মূর্তি গড়ার জেরে সঙ্গীরা প্রবল ঘৃণায়
যেন সরে গেছে। একসময় এমনকি আমাকে নানাভাবে বিরক্ত করা, পেছনে লাগা, শারীরিক
নির্যাতনের শিকারও হতে হয়েছে। মনে আছে, যে ছেলেটি চাঁদে বুড়ির সুতো কাটা
নিয়ে আমাকে ঘুসি মেরেছিল, সে কয়েক মাস পরে সব ফের স্বাভাবিক হয়ে এলে একদিন
বলেছিল, ‘আমাকে একটা ছবি দে তো’। তাকে বললাম, ‘কই ছবি? আঁকলে দেবো’। সে
পরদিনই এসে বললো, ‘ছবি দে’। আমি বলি, ‘আঁকি নাই তো’। সে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে
তাকিয়ে বলে, ‘আমাকে দিবি না’? আমি বলি, ‘দেবো। এখন রং নাই’। সে বলে, ‘তুই
তো সরকার থেকে রং পাস। দিতে হবে ছবি’। আমি অবাক হয়ে বলি, ‘সরকার? কোন
সরকার? কে আমাকে রং দেয়? রং দেয় তো দাদা’। একথা বলার পর সে হনহন করে চলে
গেলো। পরবর্তীতে তার অদ্ভুত সব আচরণ দেখেছি। তবে, অনেক বছর অবধি তার সঙ্গে
বন্ধুত্বও ছিল। মাধ্যমিকের পর শহর ছেড়ে বহুদূরে চলে গেলে তার সঙ্গে
পাকাপাকি দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়।
জীবনের
অনেকগুলো বছর ভালোয়-মন্দয় পেরিয়ে গেছে। নানা অভিজ্ঞতা জীবনকে পুষ্ট করেছে।
সেই সঙ্গে অনেক অভিজ্ঞতা নতুন করে জীবনকে চিনতে শিখিয়েছে। পরিণত বয়সে
দেখেছি, গায়ের জোরই শুধু নয়, আরও নানা শক্তি মানুষকে জিতিয়ে দেবার প্ররোচনা
দেয়। কেউ পরাজিত হতে, ন্যূন হতে চায় না, স্বীকার করে না। সকলেই বাকিদের
চেয়ে নিজের মাথাটা উঁচু করে তুলে ধরতে চায়। অথচ, মাথার উচ্চতা যে অনেকগুলো
ঘটনার ফল, অনেক শর্তের অধীন সেটাই তাদের জানা হয়ে ওঠে না। সেকারণেই প্রকৃত
প্রতিযোগিতার পরিবর্তে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মনোভাব এবং তারই জেরে প্রয়োজনীয়
শর্তগুলো অস্বীকার করার প্রবণতা। এরা সবটাই বিনা আয়াসে পেতে চায়।
কার্যকারণের সূত্রটি এদের জানা হয়ে ওঠে না। এই প্রবণতা থেকে নীতিহীনতা
মাথাচাড়া দিতেই পারে, দেয়ও। সেটা দৈনন্দিন জীবনের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে
ওঠে। বহুবার দেখেছি, দশজনের মধ্যে একজন কোনোভাবে এগিয়ে গেলে তাকে বাকিদের
রোষে পড়তে হয়, হবে। সেটা বোধহয় জীবনের সবক্ষেত্রেই সত্যি। সব মাধ্যম ছেড়ে
পাকাপাকিভাবে সাহিত্যের দ্বারস্থ হবার পরেও দেখেছি সেই একই ভাবে ময়দান
দখলের চেষ্টা! তখন খ্যাতির জন্য, প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য অনেক অনৈতিক কাজও
দিব্যই চলে!