আমি এক যাযাবর-৬/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
৬ষ্ঠ পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
গত পর্বের লেখাটিতে মোরগ্রামে থেমে গেছিলাম। এর মাঝে আরেক বিপত্তি ঘটেছিলো, মিটেও গেছিলো। পদাতিক যে হেতু রাত আড়াইটে নাগাদ বোলপুর পৌঁছয়, আমি রিটায়ারিং রুম বুক করে রেখেছিলাম। অর্পিতাকে বুকিং রিসিপ্ট, টিকিট ইত্যাদি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে রেখেছিলাম। পৌনে তিনটে নাগাদ ওর ফোন এল, "রুম খোলার মতো কোনো লোক নেই, স্টেশন মাস্টার গা করছেন না"! প্রায় ২০ ঘন্টা জেগে থাকা এবং অকুস্থল থেকে দূরে আমি এরপরও ধৈর্য ধরে বলতে পেরেছিলাম, "স্টেশন মাস্টারকে ফোনটা দে। কথা বলবো।" দরকার পড়েনি অবশ্য। অর্পিতাই তেড়ে ঝেড়ে ব্যবস্থা করে নিয়েছিলো। নিশ্চিন্ত হয়ে অতএব জাতীয় সড়ক ছেড়ে ডানদিকে বাঁক নিলাম। দু আড়াই কিলোমিটার মতো গড়িয়ে দেখি রাস্তা Y হয়ে আছে! পথচলতি মানুষকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, দুটি রাস্তাই বোলপুর যাবে, তবে শর্টকাট করতে গেলে বামপন্থী হওয়াই ভালো! সেইমতো আরও কিছুটা উজিয়ে ডান হাতে তোরণলিখন, তিরচিহ্নিত, বোলপুর ৬১ কিলোমিটার। তখন সাতটা। আবার সঙ্গী দুজনকে ফোন, এবার বেশ উজ্জীবিত হয়ে, যে আমি সকাল সকাল পৌঁছে যাবো হোটেলে, হয়তো বা ওরা পৌঁছনোর আগেই। হোটেলে আর্লি চেক-ইন বলে রেখেছি, সকাল ৯টা।
রামপুরহাটে দোকানপাট ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে। মন থেকে উদ্বেগ সরে গেছে। অতএব চা। তখনও ক্ষিদে চাগাড় দেয় নি। ফুরফুরে হয়ে এগোতে শুরু করলাম। এবং নাগরদোলায় চড়ে বসলাম! এ তো পথ পথ নয়, চাষখেত নিশ্চয়! মাটি এবং পাথর, চাকার তলায়। সরু রাস্তাটিই দুমুখো যানবাহনের একমাত্র আশ্রয়। সম্ভবত নুতন করে তৈরি হচ্ছে। ডাঁই করে রাখা দুপাশের টিলার মতো মাটি স্থানচ্যুতির ফলে সরু রাস্তাটি কেও গলা টিপে ধরেছে! মাঝেমধ্যে দু'একটা গঞ্জ গোছের, তা বাদে ধুলো মাটি এড়িয়ে চোখে কেবল ধু ধু মাঠ, চাষের জমি। এভাবেই আরও ঘন্টাখানেক। সোয়া আটটা নাগাদ ঐ মেঠো পথের ধারেও একটা চায়ের দোকান দেখে দীনেশকে গাড়ি থামাতে বললাম। এতক্ষণ ঢেঁকিবাহন হয়ে থাকার পর শরীরটা একটু খোলা বাতাস চাইছিল, এবং চা। দোকানে বসে দীনেশ আর আমি আলোচনা করছি, ফোনে জেনে নিলাম সঙ্গিনীরা রওয়ানা হচ্ছে হোটেলমুখে। দোকানির কানে আমাদের কথাগুলো ঢুকছিলো, নিজেই জানতে চাইলেন গন্তব্যের কথা। 'বোলপুর' শুনেই বলে দিলেন, ভুল না হলেও আমরা কুপথে যাচ্ছি! এ রাস্তা সামনে নাকি আরও খারাপ! 'ভালো' রাস্তা তিনিই বাতলালেন। চা সেরে অতএব গাড়ির মুখ অন্য দিকে ঘুরলো। সত্যিই রাস্তা ভালো। PMGSY scheme, রাস্তার পাশে বোর্ড দেখলাম।
এরপর গোটা ১৪ বার গাড়ি থামিয়ে বাচ্চাদের সরস্বতী পুজোর চাঁদাবায়না ছাড়া আর কিছু নেই বলার মতো! কীর্ণাহার বাজারের প্রাণান্তকর ভীড় ছাড়িয়ে নানুর হয়ে বোলপুর পৌঁছলাম সাড়ে দশটা নাগাদ। বাড়ি ছাড়ার, গাড়ি চাপার, প্রায় ১৫ ঘন্টা পর! হোটেলে এসে দেখি দীপক, বোলপুরে আমাদের এ দিনের সারথি অপেক্ষা করছে। বললাম তিনটে নাগাদ বের হব। এবং দোতলায় উঠে অর্পিতার ঘরে ঢুকে প্রথম সেটাই ঘোষণা করলাম। দুজনেই হাঁ করে আমার মুখের দিকে অল্পক্ষণ তাকিয়ে! তারপরই হাসিতে গড়িয়ে গেল! ওদের ব্রেকফাস্ট আড্ডায় আলোচ্য ছিলাম আমিই, এবং সেখানে মধুপর্ণা জানিয়েছিল অর্পিতাকে, শৌভিকদার শরীরে আলাদা কোনো যন্ত্র বসানো আছে! অর্পিতা সে কথার হাতেগরম প্রমাণ পেয়ে, আর চুমকি তার বলা কথাটির সার্থকতা প্রমাণিত হতে দেখে ঐ গড়ানো হাসির অংশীদার!
ব্রেকফাস্ট আর করিনি আমি। ক্ষিদে কিছুটা মরেই এসেছিল বোধহয়, তাছাড়া দুপুরের খাবার আসতেও খুব তো দেরি নেই। স্নান সেরেই তাই একবারে ভাত খেয়ে নেবো ঠিক করা। আর খাবার কথা ভাবতেই মনে এল, যা ফস্কেছি, গতরাতের ট্রেনে বয়ে নিয়ে যাওয়া সেই মেনু! গোপন ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে অর্পিতার বানিয়ে নিয়ে আসা ছোটআলুর সান্নিধ্যে ডিমকষা! জিজ্ঞেস করতেই জানলাম আমার ভাগেরটা অটুট রয়ে গ্যাছে। শুনেই ক্ষিদে চাগাড় দিয়ে উঠলো। স্নান সেরে তিনতলার খাবার ঘরে অতএব।
বেশ একটা কাচঘর। পালিশ করা কাঠের সংযোগ। টেবল গুলোও গ্লাসটপ। ছিমছাম। প্রতিটি টেবলে ছোট্ট কাচের বাটিতে জলে ভাসানো রঙিন পাপড়ি, বোগেনভিলিয়ার। তেমনই বাটিতে খাদ্যসম্ভার: ডাল, বেগুনভাজা, ফুলকপি, আলুপোস্ত। আর অর্পিতার হাতের সেই আলু ছেটানো ডিমকষা! এমন খাওয়ার পর যা হয়, এ্যালার্ম দিয়ে রেখেও ঘুমে অচেতন! চারটেয় উঠে দেখি দীপকের ডাক পড়ে আছে মোবাইলে, সেটাও শুনতে পাই নি! ফোন করতেই বলল, "স্যর, আমি কিন্তু তিনটেতেই এসে বসে আছি!"
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে রওয়ানা হওয়া গেল। রতনপল্লী প্রায় একই আছে। কিন্তু সে এলাকা ছাড়াতে ছাড়াতে দেখি শেষবার দেখা বোলপুর অনেক পালটে গেছে। আরও পাল্টানোর ইঙ্গিত ছড়িয়ে থাকছে পথের দু'ধারে। এই ভাবে কোপাই। শান্তিনিকেতন ভ্রমণার্থীদের আবহমান সেল্ফি জোন! নূতন (আমার কাছে) ব্রিজটি পছন্দ হ'ল না। তবু, বরাবরের মতোই নামলাম। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ছবিও তুললাম। আমার চোখ খুঁজছিল একটা জারুল গাছকে। ওপার থেকে "আমাদের ছোট নদী"র বুকে ঝুঁকে থাকতো। আর এপারে, তারই সমান্তরালে, বাবলাগাছ, তার নীচে চন্ডীদা। চণ্ডীদাস বাউল। যেন পৌঁছলেই চৌকো থার্মোকোলের আসনটি এগিয়ে দেবেন, বরাবরের মতোই চোখ নাচিয়ে জানতে চাইবেন, "কখন এলেন?" বাবরি চুল দুলিয়ে গেয়ে উঠবেন,
"গুরুর বীজমন্ত্র জপিলে পরে
জ্ঞান উৎপন্ন হয়......"
কিন্তু এবার তাঁর দেখা পাই নি। আছেন কি না, থাকলে কোথায়, কিচ্ছুটি জানি না! এদিকে অর্পিতা আর আমি তখন চপ-মুড়ি খাবই ঠিক করেছি। দীপক বেচারা বাঁধা গতের বাইরে তল্লাটটি তেমন চেনেন না, এমনটাই মনে হ'ল। বললাম সোজা চলো, একটা না একটা দোকান পাওয়া যাবেই। একটু এগোতেই রাস্তার ধার থেকে সুবেশা, সুশ্রী একজন (আর আমাদের টোটো থেকে মধুপর্ণাও, একসাথে) হেঁকে বললেন, "এই দাঁড়াও, দাঁড়াও, দাঁড়াও....."! টোটো থামতেই দুই ফে.বু বান্ধবীর প্রথম চাক্ষুস মিলন। উনি কৃষ্ণকলি, শান্তিনিকেতনেই থাকেন। সম্ভবত টেকনো ইন্ডিয়া স্কুলে পড়ান। কৃষ্ণকলিই আমাদের (বলা ভালো, মধুপর্ণাকেই) একবার মাড-হাউজ ঘুরে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। খুবই সুন্দর নাকি একটি খাওয়ার জায়গা। আপাতত অবশ্য দীপকের তাড়ায় সোনাঝুরির হাটের পথে ছুটতে হ'ল, বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। এবং আশঙ্কা সত্যি করে, যখন পৌঁছলাম, দেখি পসরা গোটাতে শুরু করেছেন অনেকেই। দুই সঙ্গিনী টুকটাক কেনাকাটা শুরু করতে না করতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু! পসরা গোটানোর ব্যস্ততাও পাল্লা দিয়ে বাড়লো। আমরাও টোটোর দিকে রওনা। উঠেই দীপককে বললাম, "ভাই, চপ মুড়ির কথা ভোলো নি তো?" বুঝলাম, ভুলে গেছিল, তবু বল্লভপুরে ডীয়ার পার্কে ঢোকার উল্টো মুখে দাঁড় করালো বাহনটি। এবং হ্যাঁ, ভাজা চলছে! কিন্তু ভাগ্য সাথে নেই, চপ শেষ হয়ে গ্যাছে। বেগুনি আছে জেনে তাই-ই মেনে নিলাম। চা-বেগুনির সাথে কিছুটা আড্ডা। ফেরার সময় দোকানী মানুষটির কাছে জানতে চাইলাম, এত সুক্ষ্ম ভাবে বেগুন কাটার শিল্পটি তিনি শিখেছেন কোথা থেকে! তাঁর হেঁ-হেঁ হাসিমুখকে টা টা করে এবার বাসুদেবদার বাড়ির পথ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴